উপক্রমণিকা :
পার্থিব
জীবনে মানুষ নানা রকম অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হয়। শরী‘আতে এসব অসুখের
চিকিৎসার নির্দেশও রয়েছে। ঔষধ সেবনের পাশাপাশি ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমেও আরোগ্য
লাভ হয়। কিন্তু সেসব ঝাড়-ফুঁক শিরকমুক্ত ও কুরআন-হাদীছ সম্মত হওয়া আবশ্যক।
আর কুরআন মাজীদ ও নবী করীম (ছাঃ) থেকে প্রমাণিত ‘রুক্বইয়া’ তথা ঝাড়-ফুঁকের
মাধ্যমে চিকিৎসা একটি উপকারী ও আরোগ্য লাভকারী দাওয়াই।[1]
আল্লাহ বলেন, قُلْ هُوَ لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا هُدًى وَّشِفَاءٌ ‘বল, এ কুরআন মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও আরোগ্য’ (হা-মীম সাজদা ৪১/৪৪)। তিনি আরও বলেন,وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِيْنَ وَلاَ يَزِيْدُ الظَّالِمِيْنَ إِلاَّ خَسَارًا- ‘আমরা কুরআন হ’তে (ক্রমশঃ) অবতীর্ণ করি যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত, কিন্তু তা যালিমদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে’ (ইসরা ১৭/৮২)।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُوْرِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِيْنَ- ‘হে মানুষ! তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমাদের কাছে এসেছে নছীহত এবং তোমাদের অন্তরে যা আছে তার নিরাময়। আর মুমিনদের জন্য সঠিক পথের দিশা ও রহমত’ (ইউনুস ১০/৫৭)। অতএব কুরআন হ’ল সকল প্রকার মানসিক ও শারীরিক রোগ-ব্যাধি থেকে আরোগ্য দানকারী।
ইবনুল
ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘সুতরাং যাকে কুরআন রোগমুক্ত করেনি, তাকে আল্লাহ
রোগমুক্ত না করুন! আর কুরআন যার জন্য যথেষ্ট নয়, আল্লাহ তার জন্য কোন
কিছুকেই যথেষ্ট না করুন![2]
অনুরূপভাবে নবী
করীম (ছাঃ) থেকে প্রমাণিত ‘রুক্বইয়া’ বা ঝাড়-ফুঁক একটি উত্তম চিকিৎসা।
কেননা কোন দো‘আ যদি কবুল হওয়ার সকল বাধা থেকে মুক্ত হয়, তবে তা হয়
অপসন্দনীয় বস্ত্ত প্রতিরোধ এবং ঈপ্সিত বস্ত্ত লাভের সবচেয়ে উপকারী উপায়ের
অন্যতম। দো‘আ বিপদকে আটকে রাখে ও বাধা দেয়, কিংবা বিপদ আসলেও তাকে লঘু করে।[3] নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘যে বিপদ ঘটেছে এবং যে বিপদ ঘটেনি সবগুলোতেই দো‘আ উপকারী। কাজেই হে আল্লাহর বান্দারা! তোমাদের উচিত দো‘আ করা’।[4]
তিনি আরো বলেন, ‘তাক্বদীর রদ হয় কেবল দো‘আর মাধ্যমে আর আয়ু বৃদ্ধি হয় কেবল সৎকাজের মাধ্যমে’।[5] কিন্তু এক্ষেত্রে একটি বিষয় স্মর্তব্য যে, যেসব আয়াত, যিকির, দো‘আ ও আল্লাহর আশ্রয় নেওয়ার শাব্দাবলীর মাধ্যমে আরোগ্য কামনা করা হয় এবং রুক্বইয়া বা ঝাড়-ফুঁক করা হয়, সেগুলো অবশ্যই উপকারী ও আরোগ্যদানকারী; কিন্তু সেগুলো কার্যকর হ’তে হ’লে ঝাড়-ফুঁককারীর গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। সুতরাং যদি আরোগ্য না হয় তবে তা হবে ঝাড়-ফুঁককারীর দুর্বলতার কারণে অথবা ঝাড়-ফুঁককৃত ব্যক্তি তা গ্রহণ না করার কারণে কিংবা ঝাড়-ফুঁককৃত ব্যক্তির মধ্যে এমন কোন শক্তিশালী প্রতিবন্ধকতা থাকার কারণে, যা তার মধ্যে রুক্বইয়া কার্যকর হ’তে বাধা দেয়। কেননা ঝাড়-ফুঁক দু’টি বিষয়ের সমন্বয়ে কার্যকর হয়- রোগী ও চিকিৎসক। নিমেণ শারঈ ঝাড়-ফুঁক সম্পর্কে আলোচনা করা হ’ল।-
ঝাড়-ফুঁকের পরিচয় :
ঝাড়-ফুঁককে আরবীতে ‘রুকইয়া’ বলে। ‘রুক্বইয়া’ হ’ল যার দ্বারা আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রর্থনা করা হয় এবং আরোগ্যের জন্য রোগীকে ফুঁক দেওয়া হয়।
ইবরাহীম মাদকূর বলেন, العوذة التي يرقى بها المريض ونحوه ‘এমন আশ্রয় যা দ্বারা রোগী ও অনুরূপ কোন অসুস্থকে ঝাঁড়া হয়’।[6]
ইবনু মানযূর বলেন,الرُّقية يُرْقى بها الإِنسان من فزع أَو جنون ‘রুক্বইয়া
হ’ল এমন বিষয় যা দ্বারা মানুষকে ঝাড়া হয় ভয় বা উন্মাদনা থেকে’।[7]
ঝাড়ফুঁকের বিধান :
ঝাড়-ফুঁক
শরী‘আত সম্মত একটি প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থা। রাসূল (ছাঃ) নিজেও ঝাড়-ফুঁক
করতেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ
يَنْفُثُ عَلَى نَفْسِهِ فِى الْمَرَضِ الَّذِىْ مَاتَ فِيْهِ
بِالْمُعَوِّذَاتِ ‘নবী করীম (ছাঃ) যে রোগে মৃত্যুবরণ করেন সেই সময়ে তিনি
নিজ দেহে ‘মু‘আবিবযাত (সূরা নাস ও ফালাক্ব) পড়ে ফুঁক দিতেন’।[8]
মহিলাদেরকে ঝাড়-ফুঁক করার পদ্ধতি :
ঝাড়-ফুঁককারী
মাহরাম ব্যতীত কোন মহিলার মাথায় বা শরীরের কোন স্থানে স্পর্শ করতে পারবে
না। পরপুরুষ পর্দা ব্যতীত তাকে ফুঁক দিতে পারবে না।[9]
সঊদী
আরবের স্থায়ী ফৎওয়া বোর্ডের সদস্যবৃন্দ বলেন, ফুঁকদানকারী মহিলা রোগীর
শরীর স্পর্শ করতে পারবে না। স্পর্শ ব্যতীত ফুঁক দিবে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের
বিষয়টি ভিন্ন। কেননা চিকিৎসকের পক্ষে আক্রান্ত স্থান স্পর্শ না করে অনেক
ক্ষেত্রে চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না। পক্ষান্তরে ফুঁকদানকারী কেবল দো‘আ বা
আয়াত পড়বে আর ফুঁক দিবে। স্পর্শ করা তার জন্য আবশ্যক নয়।[10]
ঝাড়-ফুঁকের প্রকারভেদ :
ঝাড়-ফুঁক চার প্রকার। যথা-
১. কুরআনের আয়াত এবং আল্লাহর সুন্দর নাম সমূহ ও গুণাবলী দ্বারা ঝাড়-ফুঁক।
২. ছহীহ হাদীছ দ্বারা সাব্যস্ত যিকির-আযকার ও দো‘আ সমূহ দ্বারা ঝাড়-ফুঁক।
৩. এমন যিকির-আযকার ও দো‘আ দ্বারা ঝাড়-ফুঁক, যা কোন ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়। কিন্তু কুরআন-সুন্নাহর বিপরীতও নয়।
৪.
এমন মন্ত্র দ্বারা ঝাড়-ফুঁক করা, যার অর্থ বুঝা যায় না। যেমনভাবে জাহেলী
যুগে করা হ’ত। এ প্রকার মন্ত্র দ্বারা ঝাড়-ফুঁক করা হারাম এবং এসব হ’তে
দূরে থাকা ওয়াজিব। কারণ এর মধ্যে শিরক থাকতে পারে অথবা শিরক পর্যন্ত
পেঁŠছাতে পারে।[11]
ঝাড়-ফুঁকের জন্য শর্তসমূহ :
ঝাড়-ফুঁকের জন্য শর্ত তিনটি। যথা-
১. কুরআনের আয়াত অথবা আল্লাহর নামসমূহ ও গুণাবলী দ্বারা হ’তে হবে।
২. আরবী ভাষায় হ’তে হবে অথবা এমন ভাষা দ্বারা হ’তে হবে যার অর্থ রোগী বুঝে। দুর্বোধ্য ও অজ্ঞাত ভাষায় হবে না।
৩.
যিনি ঝাড়-ফুঁক করবেন এবং যাকে ঝাড়-ফুঁক করা হবে উভয়ে এ বিশ্বাস রাখবেন যে,
ঝাড়-ফুঁকের নিজস্ব কোন কার্যকারিতা নেই। বরং আল্লাহর অনুমতিতে ঝাড়-ফুঁকের
প্রভাব পড়ে।[12]
শারঈ ঝাড়-ফুঁকের নিয়ম :
ঝাড়-ফুঁককারী
রোগীর ব্যথার স্থানে ঝাড়বেন বা হাত দিয়ে রোগীকে মাসাহ করবেন বা পানি ও
অনুরূপ তরল পদার্থ দ্বারা রোগীকে মালিশ করে দিবেন অথবা ঝাড়-ফুঁকের পর
রোগীকে থুক দিবেন।[13]
শারঈ ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমে রোগের চিকিৎসা :
শারঈ ঝাঁড়-ফুকের মাধ্যমে বহু রোগের চিকিৎসা করা যায়। নিমেণ কয়েকটি রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি বর্ণনা করা হ’ল।
বদ নযর :
নযর লাগা বা চোখ লাগা অর্থ যখন কেউ কোন ব্যক্তি বা জিনিসের প্রতি আশ্চর্য হয়ে কিংবা হিংসা করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতঃ ‘বারাকাল্লাহু ফীকা’ বা ‘বারাকাল্লাহু ফীহ্’ না বলে মনে মনে বা সশব্দে তার গুণাগুণ বর্ণনা করে, তখন শয়তান সে সময় বর্ণিত ব্যক্তি বা জিনিসের মাঝে ঢুকে পড়ে তার ক্ষতি করে বসে। এটাকে বদ নযর বলে।
নবী করীম (ছাঃ) বলেন, إِذَا رَأَى أَحَدُكُمْ مِنْ أَخِيهِ
أَوْ مِنْ نَفْسِهِ أَوْ مِنْ مَالِهِ مَا يُعْجِبُهُ فَلْيُبَرِّكْهُ
فَإِنَّ الْعَيْنَ حَقٌّ- ‘যখন তোমাদের কেউ তার ভাইয়ের অথবা নিজের কিংবা
তার সম্পদের কিছু দেখে আশ্চর্যবোধ করে তখন যেন তার জন্য বরকতের দো‘আ করে।
কেননা নযরলাগা সত্য’।[14]
অন্যত্র তিনি বলেন,
الْعَيْنُ حَقٌّ وَلَوْ كَانَ شَىْءٌ سَابَقَ الْقَدَرَ سَبَقَتْهُ
الْعَيْنُ ‘নযর লাগা সত্য। যদি কোন কিছু ভাগ্যের লিখনকে অতিক্রম করত,
তাহ’লে নযর লাগাই করত’।[15] তিনি আরো বলেন, ‘বদনযর (মানুষকে) কবরে এবং উটকে পাতিলে প্রবেশ করেই ছাড়ে’।[16]
বদ নযরের ঝাড়-ফুঁক :
বদ নযর থেকে আরোগ্যের জন্য নিম্নোক্ত দো‘আ দ্বারা ঝাড়-ফুঁক করা যায়।
(1) أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ، وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لاَمَّةٍ
(১)
‘আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমা সমূহের মাধ্যমে আশ্রয় চাচ্ছি যাবতীয় শয়তান ও
বিষধর জন্তু থেকে এবং যাবতীয় ক্ষতিকর চক্ষু (বদনযর) থেকে’।[17]
(2) أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ.
(২) ‘আল্লাহ পরিপূর্ণ কালেমা সমূহের অসীলায় আমি তাঁর নিকট তাঁর সৃষ্টির ক্ষতি থেকে আশ্রয় চাই’।[18]
(3) بِاسْمِ اللهِ يُبْرِيْكَ وَمِنْ كُلِّ دَاءٍ يَشْفِيكَ وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ وَشَرِّ كُلِّ ذِىْ عَيْنٍ.
(৩)
‘আল্লাহর নামে তিনি তোমাকে সুস্থ করবেন। তিনি তোমাকে আরোগ্য দান করবেন সব
রোগ থেকে, সব হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে আর সব বদনযরকারীর
অনিষ্ট থেকে’।[19]
(4) بِاسْمِ اللهِ أَرْقِيكَ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيْكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ اللهُ يَشْفِيْكَ بِاسْمِ اللهِ أَرْقِيكَ
(৪)
‘আল্লাহর নামে আমি তোমাকে ঝাড়-ফুঁক করছি ঐসব বস্তু থেকে যা তোমার ক্ষতি
করে, আর আত্মার অনিষ্ট বা হিংসুক নযর থেকে। আল্লাহ তোমাকে রোগমুক্ত করুন।
আল্লাহর নামে আমি তোমার ঝাড়-ফুঁক করছি’।[20]
জাদু :
জাদুকর
জাদুর মাধ্যমে মানুষের নানাবিধ ক্ষতি সাধন করে থাকে। জাদুকরের কবল থেকে
রাসূল (ছাঃ)ও রেহাই পাননি। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জাদু
করা হয়েছিল। এমনকি জাদুর প্রভাবে তাঁর কাছে এমন কিছু কাজের ধারণা হ’ত যা
তিনি করেননি’।[21]
জাদুর কুপ্রভাব কুরআন-হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। তবে জাদুর বিভিন্ন প্রকার ও ধরন রয়েছে।
জাদু থেকে মুক্তির জন্য করণীয় :
(ক) জাদু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে করণীয় :
১. সকাল-সন্ধ্যায় ৩ বার এ দো‘আ পাঠ করা :
بِسْمِ اللهِ الَّذِىْ لَا يَضُرُّ مَعَ اِسْمِهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ،
‘আল্লাহর নামে যাঁর নামের সাথে আসমান ও যমীনে কোন কিছুই ক্ষতি করতে পারে না। আর তিনি সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী’।[22]
২. প্রতি ছালাতের পর, ঘুমের সময় এবং সকাল-সন্ধ্যায় ‘আয়াতুল কুরসী’ পাঠ করা।[23]
৩. সকাল-সন্ধ্যায় ও ঘুমের সময় ৩ বার তিন কুল অর্থাৎ সূরা ইখলাছ, ফালাক্ব ও নাস পাঠ করা।
৪.
প্রতিদিন ১০০ বার নিমেণাক্ত দো‘আ পাঠ করা :لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ
وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ، وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهْوَ
عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيْرٌ- ‘একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোন হক ইলাহ নেই, তাঁর
কোন শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, সমস্ত প্রশংসাও তাঁর আর তিনি সকল কিছুর উপর
ক্ষমতাবান’।[24]
৫. সম্ভব হ’লে ৭টি ‘আজওয়া’
খেজুর সকাল বেলা খালি পেটে খাওয়া। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সাতটি
আজওয়া খেজুর দিয়ে সকাল করবে, কোন বিষ বা জাদু সে দিনে তার কোন ক্ষতি করতে
পারবে না’।[25]
(খ) জাদু সংঘটিত হওয়ার পরে করণীয় :
প্রথমতঃ জাদু বের করে নষ্ট করে ফেলা, যদি এর স্থান শরী‘আত সম্মত উপায়ে
জানা যায়। এটি জাদুকৃত ব্যক্তির চিকিৎসার সবচেয়ে কার্যকারী মাধ্যমগুলোর
অন্যতম।[26] অতঃপর শরী‘আত সম্মত রুক্বইয়া বা ঝাড়-ফুঁক করা।[27]
১. أعوذ بالله من الشيطان الرجيم ‘বিতাড়িত শয়তান হ’তে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি’ দো‘আ পড়ে পানিতে ফুঁক দিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঐ পানি দিয়ে গোসল করানো।
পানিতে
ফুঁক দিয়ে তা থেকে আক্রান্ত ব্যক্তি তিন বার পান করবে ও অবশিষ্ট পানি দিয়ে
গোসল করে ফেলবে। তাতেই ইনশাআল্লাহ রোগমুক্ত হবে। যদি তা দুই বা ততোধিক বার
প্রয়োজন হয়, তবে সমস্যা নেই। রোগ দূর না হওয়া পর্যন্তকরতে থাকবে।[28]
২.
সূরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসী, সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত সূরা ইখলাছ, সূরা
ফালাক্ব, সূরা নাস ৩ বার পড়ে ফুঁক দিবে ও আক্রান্ত স্থানে ডান হাত দিয়ে
বুলাবে।[29]
(গ) সামগ্রিকভাবে আশ্রয় লাভের কিছু দো‘আ ও ঝাড়-ফুঁক :
১. আমি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, যিনি মহান আরশের রব, তিনি যেন আপনাকে রোগমুক্ত করেন (সাতবার)।[30]
২. রোগী তার শরীরের যে অংশে ব্যথা অনুভব করবে, সেখানে হাত রেখে তিন বার,بِاسْمِ اللهِ ‘আল্লাহর নামে’ বলবে। অতঃপর সাতবার বলবে,
‘এই যে ব্যথা আমি অনুভব করছি এবং যার আমি আশঙ্কা করছি, তা থেকে আমি আল্লাহর এবং তাঁর কুদরতের আশ্রয় প্রার্থনা করছি’।[31]
৩.
‘হে মানুষের রব! আপনি সমস্যা দূর করে দিন। আপনি রোগ মুক্ত করে দিন। আপনিই
আরোগ্য দানকারী। আপনার আরোগ্য ব্যতীত কোন আরোগ্য নেই। অতএব এমন আরোগ্য দিন,
যা কোন রোগকে ছাড়বে না’।[32]
৪. ‘আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমা সমূহের আশ্রয় নিচ্ছি যাবতীয় শয়তান ও বিষধর জন্তু থেকে এবং যাবতীয় ক্ষতিকর চক্ষু (বদনযর) থেকে’ (বুখারী হা/৩৩৭১)।
৫. ‘আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমা সমূহের অসীলায় আমি তাঁর নিকট তাঁর সৃষ্টির ক্ষতি থেকে আশ্রয় চাই’ (মুসলিম হা/২১৯১)।
৬.
‘আমি আশ্রয় চাই আল্লাহর পরিপূর্ণ বাক্যসমূহের অসীলায় তাঁর ক্রোধ থেকে,
তাঁর শাস্তি থেকে, তাঁর বান্দাদের অনিষ্ট থেকে এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা ও
তাদের উপস্থিতি থেকে’।[33]
৭. ‘আমি আল্লাহর ঐ সকল
পরিপূর্ণ বাণী সমূহের সাহায্যে আশ্রয় চাই, যা কোন সৎলোক বা অসৎলোক অতিক্রম
করতে পারে না। আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন, অস্তিত্বে এনেছেন এবং তৈরী করেছেন
তার অনিষ্ট থেকে আসমান থেকে যা আসে তার অনিষ্ট থেকে, যা আকাশে উঠে তার
অনিষ্ট থেকে, যা পৃথিবীতে তিনি সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট থেকে, যা পৃথিবী
থেকে বেরিয়ে আসে তার অনিষ্ট থেকে; দিন-রাতে সংঘটিত ফিৎনার অনিষ্ট থেকে, আর
রাত্রিবেলা হঠাৎ করে আগত অনিষ্ট থেকে, তবে রাতে আগত যে বিষয়ে কল্যাণ নিয়ে
আসে তা ব্যতীত, হে দয়াময়’![34]
৮. ‘হে আল্লাহ! হে আসমান
সমূহের রব, যমীনের রব, মহান আরশের রব, আমাদের রব ও প্রত্যেক বস্তুর রব! হে
শস্য-বীজ ও আঁটি বিদীর্ণকারী! হে তাওরাত, ইনজীল ও কুরআন নাযিলকারী! আমি
প্রত্যেক এমন বস্তুর অনিষ্ট থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি, যার
মাথার অগ্রভাগ আপনি ধরে রেখেছেন (নিয়ন্ত্রণ করেছেন)। হে আল্লাহ! আপনিই
প্রথম, আপনার পূর্বে কিছুই ছিল না। আপনিই সর্বশেষ আপনার পরে কোন কিছু থাকবে
না। আপনি সব কিছুর উপরে, আপনার উপরে কিছুই নেই। আপনি সর্বনিকটে, আপনার
চেয়ে নিকটবর্তী কিছু নেই’।[35]
৯.
‘আল্লাহর নামে আমি তোমার ঝাড়-ফুঁক করছি ঐসব বস্তু থেকে যা তোমার ক্ষতি করে
আর হিংসুক আত্মা বা বদ নযরের অনিষ্ট থেকে। আল্লাহ তোমাকে রোগ মুক্ত করুন।
আল্লাহর নামে আমি তোমার ঝাড়-ফুঁক করছি’।[36]
১০.
‘আল্লাহর নামে, তিনি তোমাকে সুস্থ করবেন। তিনি তোমাকে মুক্ত করবেন সব রোগ
থেকে, সব হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে, আর সব বদনযরকারীর অনিষ্ট
থেকে’।[37]
১১.
‘আল্লাহর নামে তোমার ঝাড়-ফুঁক করছি ঐসব বস্তু থেকে, যা তোমার ক্ষতি করে।
কোন হিংসুকের হিংসা থেকে, আর সকল বদ নযর থেকে। আল্লাহ তোমাকে রোগমুক্ত
করুন’।[38]
এসব দো‘আ ও ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমে জাদু, বদ নযর জিনের আছর ও সকল রোগের চিকিৎসা করা যায়। কেননা আল্লাহর রহমতে এগুলো সামগ্রিকভাবে উপকারী ঝাড়-ফুঁক।
(ঘ) প্রাকৃতিক ঔষধ :
কিছু উপকারী প্রাকৃতিক চিকিৎসা হ’ল মধু,[39] কালো জিরা[40] ও যমযম পানি,[41] যয়তুন তেল। কেননা নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা যয়তুন তেল খাও এবং তা মাখ। কেননা তা এক বরকতময় গাছ থেকে তৈরি’।[42]
জিন ধরা রোগীর ঝাড়-ফুঁক :
আল্লাহ তা‘আলার বাণী,الَّذِيْنَ يَأْكُلُوْنَ الرِّبَا لاَ يَقُوْمُوْنَ إِلاَّ كَمَا يَقُوْمُ الَّذِيْ يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ‘যারা সূদ ভক্ষণ করে, তারা (ক্বিয়ামতের দিন) দাঁড়াতে পারবে না জ্বিনে ধরা রোগীর ন্যায় ব্যতীত’ (বাক্বারাহ ২/২৭৫)।
নবী করীম (ছাঃ)
তাঁর ছাহাবীদেরকে বলেন, ‘গত রাত্রে একজন দুষ্ট জিন হঠাৎ করে এসে আমার ছালাত
নষ্ট করতে চেয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা তাকে ধরার জন্য আমাকে শক্তি দান করেন।
আমি তাকে মসজিদের খুঁটির সাথে বেঁধে রাখার ইচ্ছা পোষণ করি, যাতে করে তোমরা
সবাই সকালে তাকে দেখতে পাও। কিন্তু আমার ভাই সুলাইমান (আঃ)-এর কথা- وَهَبْ
لِيْ مُلْكًا لاَ يَنْبَغِيْ لِأَحَدٍ مِنْ بَعْدِيْ ‘আর আমাকে এমন রাজত্ব
দান কর, যা আমার পরে আর কেউ যেন না পায়’ (ছোয়াদ ৩৮/৩৫) স্মরণ করে ছেড়ে দিয়েছি। আর তাকে নিরাস করে ভাগিয়ে দিয়েছি’।[43]
নবী
করীম (ছাঃ)-এর নিকট একজন পাগল বাচ্চাকে নিয়ে আসা হ’লে তিনি বলেন, আল্লাহর
দুশমন বের হও! আমি আল্লাহর রাসূল। রাবী বলেন, এরপর বাচ্চাটি আরোগ্য লাভ
করে’।[44]
ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, মানুষের
উপর জিন আছর করে বা তার মাঝে প্রবেশ করে। এটা মুসলমানদের কেউ অস্বীকার করে
না। বরং এটা আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামাতের আক্বীদা। আর যে অস্বীকার করে সে
শরী‘আতকে মিথ্যারোপ করে।[45]
জিনের আছরের কিছু আলামত :
জিনে ধরা মানুষ অস্বাভাবিক আচরণ করে। কখনও হাসে, কখনও কাঁদে। একাকী কথা বলে। উপসর্গ ছাড়াই তার বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
জিনের আক্রমণ থেকে বাঁচার ঝাড়-ফুঁক :
সূরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসী, সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত, সূরা ইখলাছ, সূরা ফালাক্ব, সূরা নাস ৩ বার পড়ে ফুঁক দিবে ও আক্রান্ত ব্যক্তির গায়ে হাত দিয়ে বুলাবে।[46] এগুলো পড়ে পানিতে ফুঁক দিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে খাওয়ানো ও গোসল করানো যায়।
ঝাড়-ফুঁক চিকিৎসা জীবিকা হিসাবে গ্রহণ :
ঝাড়-ফুঁক চিকিৎসা জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ। ঝাড়-ফুঁককারী রোগীর নিকট থেকে পারিশ্রমিক নিতে পারবেন।[47]
সমাপনী :
ইসলামী শরী‘আতে ঝাড়-ফুঁক বৈধ যদি তা কুরআন ও হাদীছ দ্বারা করা হয় এবং পদ্ধতি শিরক-বিদ‘আত মুক্ত হয়। বর্তমানে অধিকাংশ ঝাড়-ফুঁককারীই শিরকের মাধ্যমে এসব করে থাকে। তাদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে শিরক থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দিন- আমীন!
[1]. ইবনুল কাইয়্যিম, আল-জাওয়াবুল কাফী লিমান সাআলা আনিদ দাওয়াইশ শাফী, পৃঃ ২০।
[2]. যাদুল মা‘আদ, ৪/৩৫২।
[3]. আল-জাওয়াবুল কাফী, পৃঃ ২২-২৫।
[4]. আহমাদ হা/২২০৯৭; তিরমিযী হা/৩৫৪৮, সনদ হাসান।
[5]. ইবনু মাজাহ হা/৯০, ৪০২২; ছহীহাহ হা/১৫৪।
[6]. ইবরাহীম মুছতাফা ও অন্যান্য, আল-মু‘জামুল ওয়াসীত, (দারুদ দা‘ওয়াহ), ২/৩৬৭ পৃঃ।
[7]. ইবনু মানযূর, লিসানুল আরব, (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফ), ৩/৪৯৮ পৃঃ।
[8]. বুখারী হা/৫৭৩৫।
[9]. ড. আব্দুর রহমান জীবরীন, আন-নাযিরুল উরয়ান, পৃঃ ২৬৭।
[10]. মানশূরাতু দারিল ওয়াতান, ১০ম খন্ড, ফৎওয়া নং ২০৩৬১।
[11]. মুবারক ইবনু মুহাম্মাদ, রিসালাতুশ শিরক, (দারু রায়া, ১ম সংস্করণ, ২০০১), পৃঃ ২৪৬।
[12]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফৎহুল বারী, ১০/১৯৫; ইমাম নববী, শরহু মুসলিম, ১৪/১৬৪।
[13]. বুখারী হা/৫৭৩৫, ৫৭৫১।
[14]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৫৭০০; ছহীহাহ হা/২৫৭২।
[15]. মুসলিম হা/৫৮৩১; তিরমিযী হা/২১৯৯।
[16]. হিলয়াতুল আউলিয়া, ছহীহুল জামে‘ হা/৪১৪৪, হাদীছ হাসান।
[17]. বুখারী হা/৩৩৭১।
[18]. মুসলিম হা/২১৯১, ২৭০৮; মিশকাত হা/২৪২২।
[19]. মুসলিম হা/২১৮৫।
[20]. মুসলিম হা/২১৮৬; তিরমিযী হা/৯৭২; ইবনু মাজাহ হা/৩৫২৩।
[21]. বুখারী হা/৩১৭৫, ৩০৯৫, ৫৪৩০, ৫৪৩৩, ৫৭১৬, ৬০২৮।
[22]. তিরমিযী হা/৩৩৮৮; ইবনে মাজাহ হা/৩৮৬৯, হাদীছ ছহীহ।
[23]. হাকেম ১/৫৬২; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হ/৬৫৮।
[24]. বুখারী হা/৮৪৪, ১১৫৪; মুসলিম হা/৫৯৩।
[25]. বুখারী হা/৫৪৪৫, ৫৭৬৯; মুসলিম হা/২০৪৭; মিশকাত হা/৪১৯০।
[26]. যাদুল মা‘আদ, ৪/১২৪ পৃঃ; বুখারী হা/৫৭৬৫, মুসলিম হা/২১৮৯; মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে বায, ৩/২২৮।
[27]. ফাতহুল হাক্ক আল-মুবীন ফী ‘ইলাজিস ‘সার’ই ওয়াস সিহরি ওয়াল আইন, পৃঃ ১৩৮।
[28]. ফাতাওয়া ইবনে বায, ৩/২৭৯; ফতহুল মাজীদ. পৃঃ ৩৪৬; ওয়াহীদ আব্দুস সালাম, আস-সারিমুল বাত্তার ফিত তাসাদ্দী লিস সাহারাতি ওয়াল আশরার, পৃঃ১০৯-১১৭; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, ১১/১৩, ইবন হাজার, ফতহুল বারী, ১০/২৩৩।
[29]. বুখারী হা/৫০১৬; মুসলিম হা/২১৯২; ফৎহুল বারী ১০/২০৮।
[30]. আবূদাঊদ হা/৩১০৬; তিরমিযী হা/২০৮০; ছহীহুল জামে‘ হা/৩২২।
[31]. মুসলিম হা/২২০২।
[32]. বুখারী হা/৫৭৫০; মুসলিম হা/২১৯১।
[33]. আবুদাঊদ হা/৩৮৯৮; তিরমিযী, হা/৩৫২৮, হাদীছ হাসান।
[34]. মুসনাদ আহমাদ হা/১৫৪৬১; ছহীহাহ ৭/১৯৬।
[35]. মুসলিম হা/২৭১৩।
[36]. মুসলিম হা/২১৮৬।
[37]. মুসলিম হা/২১৮৫।
[38]. ইবনু মাজাহ হা/৩৫২৭ সনদ ছহীহ।
[39]. নাহল ১৬/৬৯।
[40]. বুখারী হা/৫৬৮৭-৮৮; মুসলিম হা/২২১৫; মিশকাত হা/৪৫২০।
[41]. ইবনু মাজাহ হা/৩০৬২; ছহীহাহ হা/৮৮৩, ১০৫৬।
[42]. আহমদ হা/১৬০৫৫; তিরমিযী হা/১৮৫১; সনদ ছহীহ।
[43]. বুখারী হা/৩৪২৩।
[44]. আহমাদ হা/১৭৫৪৯, ১৭৫৫৯, ১৭৫৬৩, ১৭৫৬৪, ১৭৫৬৫।
[45]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ২৪/২৭৬-২৭৭।
[46]. বুখারী হা/৫০১৬; মুসলিম হা/২১৯২; ফৎহুল বারী ১০/২০৮।
[47]. মুসলিম হা/৫৮৬৩।