পর্ব ১ । শেষ পর্ব ।

১.

৭ই আগস্ট ২০১৮ইং (১৪৩৯হিঃ)। ভোরের আভা কেবল ফুটছে। ৫.১৫ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানের চাকা আলতোভাবে মদীনার পবিত্রভূমি ছুঁয়ে গেল। এ যেন প্রিয়জনের সাথে কোন দূরাগত মুসাফিরের আবেগময় মিলনস্পর্শ। আনমনে দরূদ পড়ি আছ-ছালাতু ওয়াস-সালামু ‘আলাইকা ইয়া আইউহান্নাবিউ ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু...। শেষাবধি পৌঁছলাম সেই চিরপ্রতীক্ষিত মদীনাতুন্নবীর পবিত্র ভূখন্ডে! আলহামদুলিল্লাহ। ইমিগ্রেশনে এসে অপেক্ষার প্রহর আর শেষ হয় না। চঞ্চলমতি তরুণ অফিসারদের দিয়ে এ কাজ করানো হচ্ছে। যে কাজ ৫ মিনিটে শেষ হয়, সে কাজ ২০-৩০ মিনিট লেগে যাচ্ছে। তবুও তাদের মাঝে কোন তাড়া নেই। কেবলই একে অপরের সাথে গল্প ও হাসাহাসি। দীর্ঘ প্রায় ২ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর নিস্তার মেলে। এখানেই শেষ হয় না, কাস্টমসে এসে আরও একবার বাঁধা। সাথে থাকা বই এবং এ্যালোপ্যাথিক ঔষধ নিয়ে ঝামেলা বাধায় অফিসার। একজন ডাক্তার এসে প্রতিটি ঔষধের নাম চেক করে। এভাবে আরও আধাঘন্টার বেশী সময় গেল। শেষ পর্যন্ত যখন মুক্তি পেলাম, তখন সকাল ৮টা বেজে গেছে। মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় ‘যুবসংঘ’-এর সভাপতি মীযানুর রহমান (গোবিন্দগঞ্জ), গোলাম কিবরিয়া (নওগাঁ), রূহুল আমীন (বগুড়া) এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে এসেছিল। আরও উপস্থিত ছিলেন আমাদের সফর ব্যবস্থাপক ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য ও ঢাকা যেলা ‘আন্দোলন’-এর অর্থ সম্পাদক জনাব কাযী হারূনুর রশীদ। সবাই একসাথে প্রিন্স মুহাম্মাদ বিন আব্দুল আযীয বিমানবন্দর বের হয়ে গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। সেখান থেকে প্রায় ২৫ কি.মি. গমনের পর মসজিদে নববীর ১৭নং গেইট সন্নিহিত ‘দারুল ঈমান ইন্টারকন্টিনেন্টাল’ হোটেলে এসে পৌঁছলাম। এভাবেই শুরু হল আমাদের পবিত্র হজ্জ সফর।        

৩০শে জুন ২০১৬ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা থেকে অবসর নেওয়ার পর আববা নিয়ত করেছিলেন যে সপরিবারে হজ্জে যাবেন। ২০১৮ সালের জন্য সিরিয়াল নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও অল্পের জন্য পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তা সম্ভব হয় আলহামদুলিল্লাহ। ইতিপূর্বে ১৯৯৩ ও ২০০০ সালে আববা হজ্জব্রত পালন করলেও আমাদের বাকী সদস্যদের জন্য এটি প্রথম হজ্জ সফর। ঢাকা থেকে ৬ই আগষ্ট সোমবার দিবাগত রাত ১-৪০ মিনিটে আববা, ছোট ফুফু আম্মা এবং আমরা তিন ভাই (আমি, নাজীব ও শাকির) বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটযোগে রওয়ানা হই। সফরের পূর্বে ২ ও ৩ আগষ্ট বৃহস্পতি ও শুক্রবার সংগঠনের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ ও যেলা সভাপতিদের নিয়মিত মাসিক বৈঠক ছিল (আমাদের সফর উপলক্ষ্যে এক সপ্তাহ এগিয়ে আনা হয়)। ফলে দেশের প্রায় সকল সাংগঠনিক যেলার প্রতিনিধিদের কাছে বিদায় নেয়ার সুযোগ হয়। বিশেষ করে রংপুর যেলা ‘আন্দোলন’-এর প্রধান উপদেষ্টা জনাব ডাঃ মুহাম্মাদ শাহজাহান (৬৫) অসুস্থতা সত্ত্বেও শুধু হজ্জপূর্ব সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে নিজেই প্রাইভেট কার চালিয়ে যেলা সভাপতি অধ্যাপক (অবঃ) হেলালুদীন (৬৫)-কে সাথে নিয়ে মারকাযে আসেন। আল্লাহ তাঁদের মঙ্গল করুন।  পরে ঢাকা আশকোনা হজ্জ ক্যাম্প থেকে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দসহ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাযীপুর যেলার দায়িত্বশীল ও শুভাকাঙ্খীগণ আমাদেরকে বিদায় জানান। 

২.

দারুল ঈমানের ৬২১ ও ৬৩৯ নং রুম দুটি বুক করা ছিল। সেখানে পৌঁছে সকালের নাশতা ও বিশ্রাম সেরে নেই। অতঃপর যোহরের ছালাতে প্রথম হাযিরা দেই মসজিদে নববীতে। লাখো মুছল্লীর জামা‘আত। ভেতরে জায়গা নেই। বাইরে মসজিদের তপ্ত আঙ্গিনায় ছালাত আদায় করলাম। শেষ রাকা‘আতে তাশাহ্হুদ ও দরূদ পাঠের সময় রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি সালাম পেশ করার অনুভূতি এত জীবন্ত হ’ল, যার সাথে কখনও পরিচয় ঘটেনি ইতিপূর্বে। এরপর থেকে প্রতিবার যখন দরূদ পাঠ করেছি, মনে হয়েছে এই তো রাসূল (ছাঃ) সন্নিকটেই। যেন সরাসরি তাঁর প্রতি সালাম পেশ করছি, সুবহানাল্লাহ।  

সেদিন বিকেলেই বাবুস সালাম গেইট দিয়ে ঢুকে রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর দুই প্রিয়তম ছাহাবী ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ দুই মানব হযরত আবূবকর (রাঃ) এবং ওমর (রাঃ)-এর প্রতি সালাম পেশ করার সৌভাগ্য হ’ল। ফালিল্লাহিল হামদ। তারপর থেকে সুযোগ পেলেই বাবুস সালাম গেট দিয়ে ঢুকেছি আর আবেগের ঢেউয়ে ভেসে বহু মানুষের সাথে হাত উঁচু করে তাঁর কবরে সালাম পেশ করেছি। বিমুগ্ধচিত্তে উপলব্ধি করেছি মানুষের হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার তড়প আর তাদের চোখে-মুখে কম্পমান আকুল অভিব্যক্তি। ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম...। আল্লাহ রাববুল আলামীন তাঁর রাসূলের প্রতি মুসলিম উম্মাহর এই ভালবাসাকে কবুল করে নিন এবং এর বিনিময়ে আমাদেরকে তাঁর অনুগ্রহপ্রাপ্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন। আমীন!

পুরো মসজিদটি এদিন বিকেলে ঘুরে দেখলাম আমরা। ১.৭ মিলিয়ন বর্গফুট আয়তনের এই মসজিদে বর্তমানে একসাথে ৬-১০ লক্ষ মুছল্লী ছালাত আদায় করতে পারেন। অবশ্য নতুনভাবে সম্প্রসারণ কার্যক্রম চলছে। পূর্বপার্শ্বে নতুন মসজিদ ভবনের মূল কাঠামো নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের পথে। পূর্বপার্শ্ব শেষ হলে পশ্চিমপার্শ্বেও সম্প্রসারণ করা হবে। এই সম্প্রসারণের পর মসজিদে প্রায় ১৬ লক্ষ মুছল্লীর সংকুলান হওয়ার কথা। মসজিদের উন্মুক্ত চত্বরের শোভাবর্ধন এবং মুছল্লীদের রৌদ্র ও বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য চারিদিকে স্থাপন করা হয়েছে ২৫০টি বিশেষ ছাতাসদৃশ হাইটেক চাঁদোয়া। মসজিদের ভেতর ছাদেও মোট ২৭টি চলন্ত গম্বুজ রয়েছে যেগুলো দিনের বেলা খুলে দেয়া হয়। এছাড়া পুরো মসজিদের অভ্যন্তরভাগ শ্বেতপাথর এবং দৃষ্টিনন্দন জমকালো রঙ্গিন মোটিফে মোড়া, যেন দূর অতীতের স্পেনের আল-হামরা প্রাসাদের প্রতিচ্ছবি। রয়েছে চারিদিকে অনেকগুলো গুরুভার সদর দরজা। পশ্চিমে ১ নং গেইট বাবুস সালাম থেকে শুরু করে বিপরীতদিকে পূর্ব পার্শ্বে ৪১নং বাক্বী গেইটে এসে দরজাগুলি শেষ হয়েছে। মসজিদের পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে কয়েকটি যাদুঘর যেমন আল-কুরআন মিউজিয়াম, মদীনা মিউজিয়াম, আসমাউল হুসনা গ্যালারী প্রভৃতি। তবে কোনটাই খোলা না পাওয়ায় ভেতরে পরিদর্শনের সুযোগ হয়নি।           

৩.

পরদিন ৮ই আগস্ট বাদ ফজর রাসূল (ছাঃ) ও শায়খাইনের কবর যিয়ারত করার পর ৩৭ নং মক্কা গেইট দিয়ে বেরিয়ে বাক্বী‘ গারক্বাদ কবরস্থান যিয়ারতে গেলাম। রাসূল (ছাঃ)-এর যুগ থেকে অদ্যাবধি মদীনাবাসীদের কবরস্থান হিসাবে এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পূর্বে গারক্বাদ বৃক্ষ দ্বারা আবৃত ছিল বলে স্থানটি এই নামে প্রসিদ্ধ। তবে অনেকেই এই কবরস্থানকে ‘জান্নাতুল বাক্বী’ বলে থাকেন, যা ভিত্তিহীন।   এখানে প্রায় দশ হাযার ছাহাবীর কবর রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। যাদের মধ্যে রয়েছেন হযরত ওছমান (রাঃ), ফাতিমা (রাঃ), আয়েশা (রাঃ), হাসান (রাঃ) প্রমুখ। এই স্থানটিকে রাসূল (ছাঃ) কবরস্থান হিসাবে নির্ধারণ করার পর সর্বপ্রথম দাফন করা হয়েছিল প্রখ্যাত আনছারী ছাহাবী আস‘আদ ইবনু যুরারাহ (রাঃ)-কে। যদিও কোন কবরই বিশেষভাবে চিহ্নিত নেই। পূর্বে অনেক ছাহাবীর কবরের ওপর গম্বুজ নির্মিত হয়েছিল, যা সঊদী সরকার মিটিয়ে দিয়েছে। কেবল ওছমান (রাঃ) এবং ফাতেমা (রাঃ)-এর কবর কিছুটা চিহ্নিত করা রয়েছে লক্ষ্য করা যায়। অনেক মানুষ সেখানে ভিড় করছেন। বিশেষ করে ফাতিমা (রাঃ)-এর কল্পিত কবরটি ঘিরে শীআ‘দের তৎপরতা চোখে পড়ে। তবে সেখানে সরকার নিযুক্ত দাঈগণ সর্বক্ষণ দর্শনার্থীদের কবরপূজাসহ কোন প্রকার বিদআ‘তী কর্ম থেকে সতর্ক করে যাচ্ছেন। কবরস্থানের বিভিন্ন জায়গায় বিলবোর্ড স্থাপন করে কয়েকটি ভাষায় সরকারীভাবে লেখা কবর যিয়ারতের দো‘আ ও সতর্কবাণীসমূহ রয়েছে। এর মধ্যে বাংলা ভাষার বিলবোর্ডটি আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফীর প্রাক্তন ছাত্র এবং মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় যুবসংঘ-এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক সহপাঠী ভাই আব্দুল আলীমের লিখিত। এতে অঙ্কিত ‘ছাল্লাল্লাহু...’-এর নকশাটি ছোট ভাই নাজীবের করা। এটি তাদের জন্য স্থায়ী ছওয়াবের কর্ম হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ।

এদিন বেলা ১০টার দিকে আমরা মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে গেলাম। মীযানুর রহমান এবং গোলাম কিবরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেইট থেকে আমাদেরকে ভেতরে নিয়ে গেল। ছুটির কারণে ক্যাম্পাস ছাত্রশূন্য। প্রথমে আমরা লাজনাতুল কুবুল তথা ভর্তিসংক্রান্ত অফিসে গেলাম। উদ্দেশ্য ছিল ছোটভাই শাকিরকে মৌখিক পরীক্ষায় (মুক্বাবালা শাখছিয়াহ) অংশগ্রহণ করানো। এই বিভাগের ডীন ডঃ আব্দুল্লাহ বিন ওছমান আল-ইয়াতীমী (সহযোগী অধ্যাপক, আরবী ভাষা বিভাগ)-সহ অন্যান্য কর্মকর্তাগণ তখন উপস্থিত ছিলেন। ড. ইয়াতীমীর অফিসে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হল। আববার পরিচয় পেয়ে উনারা খুশী হলেন। নওদাপাড়া মাদরাসা সম্পর্কে আববা তাদেরকে জানালেন এবং সেখানে ইতিপূর্বে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সকল শিক্ষক আরবী ভাষা কোর্স উপলক্ষ্যে গমন করেছিলেন, তাদের কথা উল্লেখ করলেন। তাঁরাও বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা তথ্য নিলেন। সব মিলিয়ে খুব সুন্দর আন্তরিকতাপূর্ণ বৈঠক হল। বিদায়ের সময় ড. ইয়াতীমী আববাকে একটি ‘ক্রেস্ট’ উপহার দিলেন।

অফিস থেকে বেরিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে দেখলাম। সাজানো-গোছানো সুপরিকল্পিত ক্যাম্পাস। তবুও কেমন যেন অস্বস্তি হয়। সবুজের চিহ্ন প্রায় বিরল। ধুসর, রুক্ষ, পাথুরে ক্যাম্পাস। আমাদের সবুজে অভ্যস্ত চোখ সেখানে এক টুকরো সবুজের জন্য হাহাকার করতে থাকে। ছুটির কারণে আরও খা খা করছে ক্যাম্পাস। এই সেই দরসগাহ যেটি বর্তমান বিশ্বে সালাফী আক্বীদা ও মানহাজের প্রচার ও প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রতি বছর এখান থেকে বের হচ্ছে অসংখ্য দাঈ ইলাল্লাহ। যারা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ইসলামের বিশুদ্ধ শিক্ষা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফালিল্লাহিল হাম্দ

এদিন সন্ধ্যায় আমরা মসজিদে ক্বোবায় গিয়ে মাগরিবের ছালাত আদায় করলাম। যে ব্যক্তি স্বীয় গৃহ থেকে ওযূ করে বের হয়ে এই মসজিদে এসে দুই রাকা‘আত ছালাত আদায় করবে, তার জন্য একটি ওমরার নেকী লেখা হবে (ছহীহাহ হা/৩৪৪৬)। কেবাবার পথে গাড়ীতে বসেই মাসজিদুল জুম‘আহ অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ) মদীনায় এসে সর্বপ্রথম যেখানে জুম‘আর ছালাত আদায় করেছিলেন সেই মসজিদটি এবং মুনাফিকদের নির্মিত ‘মসজিদে যেরার’-এর ধ্বংসস্থলটি দেখলাম।

মাগরিবের ছালাত আদায় করে বের হয়ে মসজিদ চত্বরে দাঁড়ালাম। একদল শিশু সেখানে খেলাধূলায় রত। তাদের মধ্য থেকে একজন একটা আতর নিয়ে এল এবং হাতে সেটি গছিয়ে দিয়ে ৫ রিয়ালের আবদার করল। জিজ্ঞেস করলে জানালো সে সিরিয়ার অভিবাসী। বুঝতে পারলাম যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এরা উদ্বাস্ত্ত হিসাবে এ দেশে এসেছে। আরও বেশকিছু সিরীয় মহিলা ও শিশুদের মসজিদের সিঁড়িতে বিক্ষিপ্তভাবে বসে থাকতে দেখলাম। চেহারায় আভিজাত্যের ঝলক থাকলেও বেশ-ভূষা মলিন। এদেরকে উদ্বাস্ত্ত ভাবতে বড় কষ্ট হয়। কি মর্মান্তিক! একদিন যাদের সব ছিল, তারা আজ সর্বহারা। রোহিঙ্গাদের মতই করুণ অবস্থা এদের।  

মসজিদে ক্বোবা থেকে বেরিয়ে গাড়ী নিয়ে আমরা মাসজিদুল ক্বিবলাতাইনে এলাম এশার ছালাত পড়ার জন্য। এই মসজিদে জামা‘আত চলা অবস্থায় সূরা বাক্বারাহ ১৪৪ আয়াত নাযিল হয় এবং উত্তরে বায়তুল আক্বছার বদলে দক্ষিণে কা‘বার দিকে ফিরে বাকী ছালাত আদায় করা হয়। এজন্য এর নাম ‘দুই ক্বিবলার মসজিদ’। মসজিদের এক তলার উপরে উত্তর দিকে জায়নামাযের ছবি দিয়ে সেই স্মৃতিই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। ছালাত শেষে একজন সঊদী বক্তা নছীহত করলেন। ভাল লাগল। বক্তব্য শেষ হলে আববা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করলেন এবং জানতে চাইলেন মদীনার তথ্যাবলী সম্বলিত কোন সরকারী প্রকাশনা আছে কি-না। উনি মীযানকে একটি বইয়ের নাম ও প্রাপ্তিস্থান জানালেন। পরদিন মীযান বইটি সংগ্রহ করে দিল যেটি এক বছর আগে ১৪৩৮ হিজরীতে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে।

ক্বিবলাতাইন মসজিদ থেকে হোটেলে ফেরার পথে খন্দক যুদ্ধের স্থান দেখলাম। র্দীর্ঘ তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ঐতিহাসিক স্থানগুলো পূজারীদের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য সঊদী সরকারের এমন প্রচেষ্টা সর্বত্র নযরে পড়ে। এখানে সালা‘ পাহাড়ের পাদদেশে আল-ফাতহ নামে একটি বড় মসজিদ তৈরী হয়েছে, যেখানে রাসূল (ছাঃ) খন্দক যুদ্ধের সময় ছালাত আদায় করেছিলেন। এছাড়া পাশাপাশি আরও ৬টি প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। সবগুলো মসজিদকে একসাথে মসজিদ সাব‘আহ বা সাত মসজিদ বলা হয়।

ফেরার পথে গাড়ীর ড্রাইভার ছিলেন একজন সঊদী। কমবয়সী এই ড্রাইভার জানান সঊদী আরবের নাযুক অর্থনৈতিক অবস্থার মন্দ ফল তারা এখন ভোগ করছেন। তার বর্ণনামতে অবিশ্বাস্য শোনালেও, এটা সত্য যে স্বয়ং সঊদীদের মধ্যে এমন বহু অভাবী লোক রয়েছে, যারা দিন আনে দিন খায়। ধনী-গরীবের বিরাট বৈষম্য নাকি এদেশেও বর্তমান, যেখানে ধনীরা গরীবের রক্ত শোষণ করছে। আমরা তার স্পষ্ট উচ্চারণে বেশ অবাক হলাম। কোন সঊদী আজনবীদের কাছে সঊদী সমাজব্যবস্থার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করবে, এটি বেশ কৌতুহলপ্রদই। যদিও এই দুরবস্থার জন্য তিনি আমেরিকাকেই দায়ী করলেন।         

৪.

৯ই আগস্ট সকালে ঢাকা যেলা ‘আন্দোলন’-এর সহ-সভাপতি মোশাররফ চাচা এলেন। ওনাকে সাথে নিয়ে আমরা ওহোদ যুদ্ধস্থলে গেলাম। ওহোদ পাহাড়ের নীচে কাঁচের দেয়ালে ঘেরা একটি বিস্তৃত সমতল এলাকা। এখানে কবর দেয়া হয়েছিল হামযাহ (রাঃ)-সহ ওহোদ যুদ্ধের ৭০ জন শহীদকে। তবে কোন কবরের চিহ্ন নেই। এখানে একটি স্থানে দাঁড়িয়ে বিদ‘আতীদের দল বেঁধে জোরে জোরে দো‘আ পড়তে দেখলাম।

সেখান থেকে পাহাড়ের মধ্যস্থলের সেই উন্মুক্ত এলাকায় এলাম যেখানে তিরন্দাজদেরকে মোতায়েন করা হয়েছিল এবং তাদের ভুলের সুযোগে বিরোধী সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালীদ পেছন থেকে হামলা করে মুসলিম বাহিনীর সাক্ষাৎ বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেন। স্মৃতির জানালায় সেসব ঘটনা বার বার উঁকি দিয়ে গেল।

সেখান থেকে ফিরে বাঙ্গালী মার্কেটে এসে হোটেল এশিয়াতে সকালের নাশতা সারলাম। মালিক চট্টগ্রামের। তন্দুর রুটি আর লাউয়ের সবজিসহ ডিমভাজি ও গোশত। অতিরিক্ত ঝাল ও মসলাদার। তবুও পাঁচ তারকা হোটেলের হরেক প্রকারের বিচিত্র নাশতার তুলনায় সুস্বাদু। আববার পরিচয় পেয়ে হোটেল মালিক বেশ সমাদর করলেন এবং মূল্য কম রাখলেন। এই এলাকাটি ‘সূক্ব বাঙ্গাল’ বা বাঙ্গালী মার্কেট নামে পরিচিত। বাঙ্গালী হাজীগণ সাধারণত এই এলাকাতেই থাকেন। খাওয়ার হোটেল প্রায় সবই বাঙ্গালীদের। সাইনবোর্ডও বাংলা ভাষায় লেখা। হোটেল এশিয়া, শেরাটন, সোনারগাঁও ইত্যাদি বাহারী নাম।

হোটেলে ফেরার জন্য ট্যাক্সি ডাকা হল। কিন্তু বাঙালী ট্যাক্সিওয়ালা আববাকে দেখার পর ভাড়া বলতে চাইল না। সব অনুরোধ ব্যর্থ হল। গাড়ীতে উঠার পর বলল, স্যার আপনি কবে রিটায়ার করলেন? আপনার জন্মস্থান সাতক্ষীরা নয়? আববা হতবাক। বলল, স্যার আজ ১৩ বছর এখানে আছি। ইউটিউবে আপনার লেকচার নিয়মিত শুনি। নামার সময় বারবার দো‘আ চাইল এবং কার্ড দিল। দেখলাম উনি ‘দৈনিক আমার সময়’-এর Special Correspondent নাম মাকছূদুর রহমান শামীম। বরিশালে বাড়ী। আল্লাহ তার মঙ্গল করুন। আমীন!

মাগরিবের ছালাতের পর মসজিদে নববীর দ্বিতীয় তলায় লাইব্রেরী পরিদর্শনে গেলাম। সুবৃহৎ লাইব্রেরী। বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য বইয়ের সমাহার। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সাধারণত এখানে পড়াশোনা করে। বিদেশী ভাষা বিভাগে গিয়ে আর-রাহীকুল মাখতূমের বঙ্গানুবাদসহ কিছু বাংলা বই পেলাম যার মধ্যে আববার অনূদিত ও সঊদী সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ‘ইসলাম ও জাহেলিয়াতের দ্বন্দ্ব’ বইটি দেখলাম। পরে লাইব্রেরীর একজন দায়িত্বশীলের সাথে কথা বলে আববার অন্যান্য কিছু বই হাদিয়া দিতে চাইলাম। তিনি রাযী হলেন। সেই মোতাবেক কয়েকদিন পর আববার লিখিত তাফসীর, নবীদের কাহিনী ১, ২, ৩, ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) বাংলা ও ইংরেজী, হজ্জ-ওমরাহ এবং থিসিস বইগুলি মীযান নিয়ে গিয়েছিল এবং লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছিল।

এশার ছালাতের পর রাত সাড়ে ১০-টায় ‘আন্দোলন’-এর সঊদী আরব শাখার কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি হাফেয আখতার মাদানী এলেন আল-ক্বাছীম থেকে গাড়ি চালিয়ে। সঙ্গে নিয়ে এলেন রাইস কুকার সহ বাসায় রান্না করা গরম ভাত, করল্লা ভাজি, চিংড়ী, উট ও মুরগীর গোশত। সেই সাথে বারহী তাযা খেজুর, সুক্কারী খেজুর ও সুমিষ্ট আঙ্গুর। সঙ্গী হিসাবে এলেন কক্সবাজারের অধিবাসী তাঁর একজন সাথী আব্দুল্লাহ ভাই। দেশী রান্না খেয়ে আমরা সবাই তৃপ্ত হলাম। এদিন মেহমান হিসাবে আমাদের সাথে আরও শরীক হলেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. আফসার ছিদ্দীক্বী ও তাঁর প্রবাসী কয়েকজন আত্মীয়। খাওয়া-দাওয়ার পর তাঁদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হল।    

ঐ খাবার পরদিন শুক্রবার সকালে, দুপুরে এমনকি শনিবার সকালেও পান্তা ভাতের সাথে আমরা খেলাম হোটেলের বিলাসী খানা বাদ দিয়ে।

৫.

১০ই আগস্ট শুক্রবার। ফজরের ছালাত পড়ালেন শায়খ হুযায়ফী। দু’রাক‘আতে সূরা দোখান পড়লেন, যদিও প্রত্যাশা ছিল সূরা সাজদাহ ও দাহর পড়বেন। শায়খ হুযাইফী (৭১) তাঁর সাহসিকতা এবং স্পষ্টভাষিতার জন্য বিখ্যাত। ১৯৭৯ সালে ইরানী বিপ্লবের পর প্রথমবারের মত সঊদী আরবে আগত ইরানী প্রেসিডেন্ট হাশেমী রাফসানজানী ১৯৯৮ সনে মদীনায় এসে রাসূল (ছাঃ)-এর কবর যেয়ারত করার পরিকল্পনা করলেন। এ কথা জেনে শায়খ হুযায়ফী স্বয়ং তার উপস্থিতিতে ঐদিন শী‘আদের ভ্রান্ত আক্বীদার উপর কড়া খুৎবা দেন। শোনা যায় যে এই খুৎবার কারণে তাকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর সেই তেজোদ্দীপ্ত খুৎবার ক্যাসেট আমরা ইতিপূর্বে শুনেছি। বহু বছর পর আজ ফজরের ছালাতে তাঁর কণ্ঠের ক্বিরা‘আত সরাসরি শুনে প্রাণটা ভরে গেল। পরে তাঁর জুমআর খুৎবাও শুনতে পারব ভেবেছিলাম। তবে অন্য একজন খুৎবা দিলেন এবং চমৎকার খুৎবা হল। খত্বীবের নাম অবশ্য জানা হল না।

বিকালে মোশাররফ চাচা ও ঢাকা যেলা ‘আন্দোলন’-এর তাবলীগ সম্পাদক শফীকুল ইসলাম (ত্রিশাল) এলেন। শফীক ভাই জনাব এহসানুল্লাহ ছাহেবের কাফেলায় সহযোগী হিসাবে গত তিন মৌসুম হজ্জে এসেছেন। বাদ মাগরিব মোশাররফ চাচা পুনরায় এলেন আরেকজনকে নিয়ে। নাম বশীর। বাড্ডা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। বয়স ৬৫। হজ্জের পর আর রাজনীতি করবেন না। এখন স্রেফ দ্বীনদারী নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চান। তিনি ফ্রী বিতরণের জন্য ১০০০ কপি ছালাতুর রাসূল ও হজ্জ-ওমরাহ বই সহ আববার সব বই এক সেট নিবেন বলে জানালেন এবং আগামী তাবলীগী ইজতেমায় রাজশাহী যাবেন বলে ওয়াদা করলেন।

এশার ছালাতের পর শায়খ হাফেয আখতার মাদানী সঊদী আরবের জনপ্রিয় ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্ট চেইন ‘আল-বাইক’-এর চিকেন ব্রোস্ট কিনে আনলেন। খাবারগুলো সুস্বাদু এবং তুলনামূলক সুলভ মূল্যের হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি ঈর্ষণীয় গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। এর যে কোন শাখায় রাত-দিন সব সময় ভিড় লেগেই থাকে। ডা. আফসার আলী ছিদ্দীকী এবং মোশাররফ চাচা আমাদের সাথে রাতের খাবারে অংশগ্রহণ করলেন। সেরাতেই হাফেয আখতার মাদানী আল-ক্বাছীমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। আল্লাহ তাঁকে উত্তম জাযা দান করুন। আমীন!

৬.

পরদিন শনিবার মদীনায় কাটিয়ে রবিবার ১২ই আগস্ট সকালে মক্কায় রওয়ানা হওয়ার প্রস্ত্ততি নিলাম। বেলা ১২টায় একটি জিএমসি গাড়িতে রওয়ানা হলাম হোটেল থেকে। পথে যুলহুলায়ফা এসে ইহরাম বেঁধে নিলাম। এখানে বিরাট একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে এবং ইহরাম পরিধান ও গোসলের সুব্যবস্থা রয়েছে। ইহরাম পরার অভিজ্ঞতা আমার জন্য প্রথম। লাববাইকা উমরাতান.. পাঠ করে তালবিয়া পড়া শুরু করলাম আমরা। কথা ছিল মক্কা যাওয়ার পুরোনো রোড তথা বদর প্রান্তর হয়ে আমরা মক্কা যাব। কিন্তু পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো পুলিশ। আমরা বারকোড ভিসাধারী হওয়ায় আলাদা ‘তাছরীহ’ বা হজ্জের অনুমোদনপত্রের প্রয়োজন নেই জানিয়েছিল বাংলাদেশ হজ্জ মিশন। কিন্তু অনভিজ্ঞ পুলিশ তা মানতে নারায। ফলে বেশ হয়রানির মধ্যে পড়ে আমাদের আবার মদীনা ফিরে আসতে হল। পরে বাংলাদেশ হজ্জ মিশনের সহযোগিতায় সরকারী বাস সাপ্টকোতে চড়ে রওয়ানা হতে সন্ধ্যা ৭টা বাজল। বাসের যাত্রী বলতে আমরা পাঁচজন সহ আর কয়েকজন। পথে মোট ৬ বার চেকপোস্ট পড়ল এবং পুলিশ ২ বার আমাদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করল। তবে বারকোড ভিসা লক্ষ্য করে এবার বিশেষ কিছু বলল না। অথচ পূর্ববর্তী চেকপোস্টে স্রেফ পুলিশের অজ্ঞতার কারণে আমাদের এতটা হয়নারীর শিকার হতে হ’ল। প্রায় ৫ ঘন্টা পর রাত ১২টার দিকে আমরা মক্কায় পৌঁছলাম। আমাদের হজ্জ ব্যবস্থাপক জনাব কাযী হারূণ এবং রূহুল আমীন ছাহেব বাসস্টান্ডে রিসিভ করলেন। সেখান থেকে আমরা মাসজিদুল হারামের নিকটবর্তী মিসফালাহ এলাকায় অবস্থিত হোটেল ফাহাদে পৌঁছলাম। অতঃপর রাতের খাবার সেরে ওমরাহ করার জন্য প্রস্ত্ততি নিয়ে ফেললাম। রাত তখন ২টা বাজে। 

৭.

প্রচলিত আছে যে মক্কা-মদীনায় রাত নামে না। রাস্তায় নেমে সে কথাই মনে পড়ল। আমাদের মত শত শত ওমরাহ পালনকারী হেঁটে চলেছে হারামের পথে। দোকানদাররা সমানে খরিদদারদের আকর্ষণ করে যাচ্ছে। অথচ তখন ঘড়ির হিসাবে গভীর রাত। কবুতর চত্বর দিয়ে হারামে প্রবেশ করলাম। কিং আব্দুল আযীয গেইটের সামনে এসে ভীড়ের মধ্যে উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে সামনে তাকাই। দূরে কালো পোশাকে অর্ধাবৃত কা‘বাঘর নযরে আসে। একরাশ মগ্নতায় ভরা তোলপাড় অনুভূত হয় অন্তরাত্মা জুড়ে। এই তো আল্লাহর ঘর! পৃথিবীর কোটি কোটি মুসলমান যেখানে আসার জন্য অধীর প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করে, সেখানে আজ মহান প্রভূ সত্যিই আমাদের ডেকে নিলেন! যুয়ূফুর রহমান হওয়ার এই গৌরব, এই অনপনেয় সৌভাগ্য আবেগের জোয়ার হয়ে হৃদয়সমুদ্রের কুলে কুলে আছড়ে পড়তে থাকে। মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে যাই চক্রাকারে ঘোরা ভক্তপ্রাণদের মিছিলে যোগ দিতে। হাজারে আসওয়াদ বরাবর সবুজ বাতি থেকে শুরু হয় তাওয়াফ। ফুফুকে শক্ত হাতে ধরে এগুতে থাকি। কা‘বাকে বাম হাতে রেখে, পিপাসার্ত চোখে এক নিরিখে কা‘বার ওপর দৃষ্টি রেখে একবার, দু’বার, তিনবার... সাতবারের চক্র সম্পন্ন করি। ঘন্টাখানেক লাগে তাওয়াফ শেষ হতে। আমি শত-সহস্র মানুষের আবেগ-অনুভূতি দেখি আর শিহরিত হই। হাতীমের সাথে শরীর ঠেকিয়ে, মুলতাযামে গা মিশিয়ে, হাজারে আসওয়াদে চুমু খাওয়ার অক্লান্ত প্রতিযোগিতা করে, কাবার দেওয়ালে সশ্রদ্ধ চুম্বন করে কত মানুষ যে আজীবন লালিত স্বপ্ন পূরণের আবেগ মেটাচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। ভীষণ রকম ভাল লাগা কাজ করে এই সুখী দৃশ্যগুলো দেখতে।

আববাকে নিয়ে সালমান ফারেসী ভাই একটু এগিয়ে গিয়েছিলেন বলে আমাদের বেশ আগেই আববার তাওয়াফ সমাপ্ত হয়। ফলে আমাদের না পেয়ে তিনি দ্বিতীয় তলায় সাঈ করেন। আমরাও আববাকে না পেয়ে নীচ তলায় সাঈ শুরু করলাম। মাতাফের তুলনায় ভীড় কম হওয়ায় অনেকটা সহজ হয়ে গেল। ছাফা থেকে শুরু করে মারওয়া পর্যন্ত মোট সাতবার সাঈ করতে হয়। নীচ তলা থেকে ছাফা-মারওয়া পাহাড়ের মূল অংশ নযরে এলেও ওপর তলাগুলো থেকে দেখা যায় না। এসির তাপমাত্রা ওপর তলাগুলোতে এত নিম্নে থাকে যে, ইহরাম পরা অবস্থায় অসহনীয় রকম ঠান্ডায় কাবু হতে হয়। সাঈ শেষ করতেও প্রায় ঘণ্টাখানেক  লেগে যায়।  মোট  দুই ঘন্টায় ওমরাহর কার্যক্রম শেষ করতেই ফজরের আযান দিল।

আমরা ছালাত শেষে হারাম থেকে বের হয়ে মাথার চুল কাটিয়ে নেই। অতঃপর হোটেলে এসে ইহরাম খুলে হালাল হয়ে যাই। এভাবেই সমাপ্ত হ’ল ওমরাহ।

পরদিন ১৪ই আগস্ট বিকালে হোটেল রুমে এলেন মরহূম আব্দুল মতীন সালাফী চাচার ছেলে মতীঊর রহমান ভাই। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র মতি ভাই তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তাঁর পরিচালিত কিষাণগঞ্জের মাদ্রাসা ও মারকাযসমূহ দেখাশোনা করছেন। খুবই চৌকস মানুষ। ইতিমধ্যে সঊদীআরবের বিভিন্ন মহলে বিশেষ পরিচিতি তৈরী করে ফেলেছেন। আমার সাথে ইতিপূর্বে ফোনে কথা হলেও এই প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎ। হজ্জে এসেছেন সরকারী আমন্ত্রণে। আমরা এসেছি জানতে পেরে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। তাঁর সাথে দীর্ঘ আলাপ ও খোশ-গল্প হ’ল।                    [চলবে]


[1]. তিরমিযী হা/৩৩৭২; আবূদাউদ হা/১৪৭৯; ইবনু মাজাহ হা/৩৮২৮, হাদীছ ছহীহ।

[2]. ছহীহুল জামে‘ হা/১১২২; ছহীহাহ হা/১৫৭৯।

[3]তিরমিযী হা/৩৪৭৬; নাসাঈ হা/১২৮৪, সনদ ছহীহ

[4]. তিরমিযী হা/৩৪৭৭, ছহীহ তিরমিযী হা/২৭৬৫, ২৭৬৭।

[5]. তরাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত ১/২২০; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৩৯৯; ছহীহাহ হা/২০৩৫।

[6]তিরমিযী হা/৪৮৬; ছহীহাহ হা/২০৫৩।

[7]মুসলিম হা/১৭৬৩।

[8]আবূদাউদ হা/১৪৮৮; ছহীহ আবূদাউদ হা/১৩২০।

[9]আবূদাউদ হা/১৪৮৬; ছহীহ  আবূদাউদ হা/১৩১৮।

[10]আশ-শারহুল মুমতি‘ ৪/২৫।

[11]. আবূদাউদ হা/১৪৮৫; তিরমিযী হা/৩৪৭৯; ছহীহ তিরমিযী হা/২৭৬৬; ইবনু মাজাহ হা/৩৮৫৪, হাদীছ হাসান।

[12]বুখারী হা/৬৩৪০; মুসলিম হা/২৭৩৫।

[13]বুখারী হা/৬৩৩৯; মুসলিম হা/২৬৭৯।

[14]বুখারী হা/২৪০; মুসলিম হা/১৭৯৪।

[15]মুসলিম হা/১০১৫

[16]ইবনু রজব আল-হাম্বলী, জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম, ১ম খন্ড (বৈরূত : দারুল মারিফাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪০৮ হিঃ), পৃঃ ২৯৩।

[17]. তিরমিযী হা/৩৫১৩, হাদীছ ছহীহ। 

[18]. বুখারী হা/১১৪৫। 

[19]. তিরমিযী হা/৩৪৯৯, হাদীছ হাসান।

[20]. যাদুল মা‘আদ ১/৩০৫। 

[21]. আবূদাঊদ হা/৫২১; তিরমিযী হা/২১২; ছহীহুল জামে হা/২৪০৮।  

[22]. ইবনুস সুন্নী, আমালুল ইয়াওমি ওয়াল-লায়লা হা/৯৮; ছহীহুল জামে হা/৮০৩; ছহীহাহ হা/১৪১৩।

[23]. আবূদাঊদ হা/; ছহীহুল জামে হা/৩০৭৯।  

[24]. বায়হাকী, মারিফাতুস সুনান ওয়াল আছার হা/৭২৩৬; ছহীহুল জামে‘ হা/১০২৬; ছহীহাহ হা/১৪৬৯।

[25]. আবূদাঊদ হা/২৫৪০; ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৭৮।  

[26]. মুসলিম হা/৭৫৭।   

[27]. আবূদাউদ হা/১৩১৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৩২৪৩।

[28]. বুখারী হা/৯৩৫।    

[29]. মুসলিম হা/৪৮২।    

[30]. বুখারী হা/২৩০৪; মুসলিম হা/২৭২৯।    

[31]. তিরমিযী হা/৩৫০৫, হাদীছ ছহীহ।  

[32]. মুসলিম হা/৯১৪।   

[33]. মুসলিম হা/৯২০।    

[34]. মুসলিম হা/৯১৯।    

[35]. বুখারী হা/১৪৯৬; আবূদাঊদ হা/১৫৮৪।    

[36]. তাবারানী, আদ-দো‘আ হা/১৩১৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৩৮২।    

[37]. বায়হাকী হা/৬৩৯২; ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৩২।     

[38]. তিরমিযী হা/৩৪৪৮।     

[39]. মুসলিম হা/৪৩১০; তিরমিযী হা/১৩৭৬; নাসাঈ হা/৩৬৫১।     

[40]. তিরমিযী হা/৪৭৮, হাদীছ ছহীহ।

[41]. বুখারী হা/১১৫৪।   

[42]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭১০, হাদীছ হাসান।





ঈদায়নের কতিপয় মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
যুবসমাজের অধঃপতন : কারণ ও প্রতিকার - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
দ্বীনী ইলমের গুরুত্ব ও ফযীলত - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
ছাওম ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞান - শামসুল আলম
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ইসলামে ভ্রাতৃত্ব (শেষ কিস্তি) - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
প্রাক-মাদ্রাসা যুগে ইসলামী শিক্ষা - আসাদুল্লাহ আল-গালিব (শিক্ষার্থী, ইংরেজী বিভাগ, ২য় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
পুলছিরাত : আখেরাতের এক ভীতিকর মনযিল - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
মুসলিম সমাজে মসজিদের গুরুত্ব (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
প্রগতি ও সংকট - আফতাব আহমদ রহমানী
গীবত : পরিণাম ও প্রতিকার (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
আরও
আরও
.