দোতলা কৃষি পদ্ধতি
কৃষিক্ষেত্রে বাড়তি ফসলে বিপ্লব আনতে পারে ‘দোতলা কৃষি’। এই কৃষি চাষাবাদ বিষয়ে গ্রামবাংলার কৃষকের মধ্যে ধারণা রয়েছে অনেক আগে থেকেই। কৃষক একই জমিতে নিচে এক ফসল আর মাচা করে জানালায় আর এক ফসল, বসতবাটির চালে, গাছে লাউ, শসা, বটবটি, সিম, পুঁইশাক আবাদ করার সাথে পরিচিত। এই পরিচিত চাষাবাদে বিজ্ঞান প্রযুক্তির মাত্রা যোগ করেছেন পাবনার আটঘরিয়া কলেজের কৃষি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কৃষিবিদ মুহাম্মাদ জাফর সাদেক এবং তার সহোদর জ্যোতির্বিদ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ সাদেক। ভ্রাতৃদ্বয় দেশের ক্রমহ্রাসমান আবাদী জমি এবং ক্রম বৃদ্ধিমান জনসংখ্যা নিয়ে খাদ্য-ফসল ঘাটতি পূরণের চিন্তা করেন। সেই চিন্তা থেকেই তারা বাড়তি ফসলের জন্য গবেষণা শুরু করেন। সূর্যালোক বিবেচনায় এনে কৃষি ও জ্যোতির্বিদ্যার সফল প্রয়োগ পদ্ধতির মাধ্যমে দেশের প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থার বিপরীতে ‘দোতলা কৃষি’ পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ’র মাধ্যমে নিজ খাদ্য উৎপাদন করতে সূর্যের আলো প্রয়োজন হয়। কৃষিতত্ত্ব মতে ৮ ঘণ্টা সূর্যালোকই উদ্ভিদের খাদ্য উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট। কৃষিত্বাত্ত্বিক এই ধারণা নিয়ে জমির মূল ফসলের (বেসক্রপ)’র উপর উত্তর-দক্ষিণ বরাবর ভূমি হ’তে ৫ ফুট উঁচুতে এবং ৪ ফুট চওড়া ও ১৩ ফুট পরপর মাচা নির্মাণ করলে জমিতে অনধিক আড়াই ফুট উচ্চতার একটি ফসল এবং মাচায় লতা জাতীয় অন্য ফসল আবাদ করা সম্ভব। এ আবাদে বেসক্রপের কোন ক্ষতি হয় না। সূর্যের আলোর প্রতিবন্ধকতা হয় না। বরং বেসক্রপের সাথে বাড়তি ফসল উৎপাদন করে ফসল ঘাটতি কমিয়ে আনা শুধু নয়, এতে বাড়তি আয় হবে বছরে ২০ হাযার কোটি টাকা বা ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কৃষিবিদ মুহাম্মাদ জাফর সাদেক ২০০৮-০৯ সালে নওগাঁ যেলার মহাদেবপুর-বদলগাছি আসনের সংসদ সদস্য ড. আকরাম এইচ চৌধুরী পৃষ্ঠপোষকতায় নওগাঁ যেলার ধান উৎপাদনশীল জমিতে দোতলা কৃষির এই গবেষণা শুরু করেন। ঐ যেলার বদলগাছি ইউনিয়নের ডাঙ্গিসারা গ্রামের দীনের সিং এর ৭ কাঠা জমিতে মাচায় লাউ, মাটিতে বি-আর-২৮ জাতের ধান আবাদ করা হয়। সাত কাঠা জমিতে ধানের ফলন পাওয়া যায় ৮ মণ যা বিঘার হিসাবে ২৩ মণ (বাম্পার ফলন এবং জাতীয় গড় ফলনের সমান) আর এই ৭ কাঠা গবেষণালব্দ জমিতে কভারক্রপ হিসাবে মাচায় ২১৫টি লাউ উৎপাদিত হয়।
মৌমাছি পালন পদ্ধতি
অন্যান্য প্রাণীকে যেমন নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করতে হয়, মৌমাছির বেলায় তার কোন প্রয়োজন নেই। মৌমাছি নিজেরাই নিজেদের খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে। এদের খাদ্য ফুলির পরাগ রেণু এবং পুস্পরস থেকে মধু উৎপাদন করে তা ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে রাখে। তাছাড়া নিজ দেহের অভ্যন্তরে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরি করে মোম, যার দ্বারা চাক বা কুঠরি বানায়। এ কুঠরিগুলোতে মৌমাছির ডিম, শুককীট, মুককীট ইত্যাদি থাকে এবং সঞ্চিত মধু ও পরাগরেণু সংরক্ষণ করা হয়। প্রকৃতিতে যখন ফুলের সমারোহ কম থাকে কিংবা ঝড়-বৃষ্টি ও শীতের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়, সে সময় কলোনিতে খাদ্যাভাব দেখা দিলে কৃত্রিম খাদ্য সরবরাহের প্রয়োজন দেখা দেয়। এ সময় চিনি এবং পানি ১ঃ১ অনুপাতে মিশ্রিত করে মৌমাছিকে খাওয়াতে হয়। মৌচাকে মধু জমা করার পর তা মোম দ্বারা ঢেকে ফেলে। যখন চাকের অধিকাংশ কোষ মধুতে পূর্ণ হয় সে সময় মধু নিস্কাশন যন্ত্রের সাহায্যে সাবধানে তা বের করে আনতে হয়।
পরিচর্যা : সাফল্যের সঙ্গে মৌমাছি পালন করতে হলে নির্ধারিত সময় পরপর মৌ-কলোনির সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে লক্ষ্য রাখা, পর্যবেক্ষণ, সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং তার সমাধানের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। ঋতুভেদে এ পরিচর্যা ৭-১০ দিন পরপর করতে হয়। মৌমাছি পালনের ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক শ্রম দেয়ার প্রয়োজন নেই। সপ্তাহে একবার একটি মৌ-কলোনির জন্য মাত্র ৮-১০ মিনিট সময় ব্যয় করাই যথেষ্ট। এ জন্য অন্য পেশার পাশাপাশি তা করা সম্ভব।
উপযুক্ত পরিবেশ : মৌ-বাক্স রাখার জন্য নির্ধারিত স্থানটি ছায়াযুক্ত, শুকনা ও আশপাশে মৌমাছির খাদ্য সরবরাহের উপযোগী গাছ-গাছড়া দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়া আবশ্যক। প্রয়োজনে কিছু কিছু ঋতুভিত্তিক গাছ যরূরী ভিত্তিতে লাগানো যেতে পারে। নির্বাচিত স্থানের আশপাশে যেন বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী এবং ধোঁয়া উৎপাদনকারী কোন কিছু না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
মৌমাছির শত্রু ও রোগ : মৌমাছির প্রধান শত্রু মথ পোকা। এছাড়া পিঁপড়া, তেলাপোকা, বোলতা, টিকটিকি, ইঁদুর, পাখি, ফড়িং, শিয়াল, কুনোব্যাঙ ইত্যাদির হাত থেকে মৌমাছিকে রক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। উপরন্তু জীবজগতের অন্যান্য প্রাণীর মতো মৌমাছিও নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হ’তে পারে এবং এর ফলে মৌমাছির মৃত্যু হ’তে পারে। শুকটীক এবং মুককীট অবস্থায় মৌমাছি বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস এবং কীঁটাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। এছাড়া পূর্ণাঙ্গ মৌমাছি একারাইন, আমাশয়, ফাউলব্লুড. অবশতা ও ফাঙ্গাস প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হ’তে পারে। এসব রোগের নিরাময়কল্পে নির্ধারিত ওষুধ ব্যবহার করতে হয়।
মৌমাছি পালন প্রকল্প স্থাপনের জন্য আলাদাভাবে কোন জায়গার প্রয়োজন হয় না। বাড়ীর আনাচে-কানাচে, ঘরের বারান্দায়, ছাদে কিংবা বাগানেও মৌ-বাক্স রাখা যায়। অ্যাপিস সেরানা প্রজাতির ৫টি মৌ কলোনি সম্বলিত মৌ-খামার স্থাপনের জন্য মোট বিনিয়োগ হবে ১৫-১৬ হাযার টাকা। প্রতিবছর গড়ে প্রতি বাক্স থেকে ১০ কেজি মধু পাওয়া যাবে, যার বাজার মূল্য ২৫০/= টাকা হিসাবে ২৫০০/= টাকা। এ হিসাবে ৫টি বাক্স থেকে উৎপাদিত মধুর মূল্য দাঁড়াবে ৫´১০ কেজি´২৫০ টাকা (প্রতি কেজি)= ১২,৫০০/= টাকা। এই আয় ১০-১৫ বছর অব্যাহত থাকবে অর্থাৎ প্রথমে মাত্র একবার ১৫-১৬ হাযার টাকা ব্যয় করে প্রকল্প স্থাপন করলে মৌ বাক্স এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি ১০-১৫ বছর ব্যবহার করা যাবে। আর কোন বিনিয়োগ বা খরচ নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে অ্যাপিস মেলিফেরা প্রজাতির ৫টি মৌ-কলোনি সম্বলিত মৌ-খামার স্থাপনের জন্য মোট ব্যয় হবে ২৫ থেকে ২৭ হাযার টাকা। এক্ষেত্রেও ১০-১৫ বছর পর্যন্ত মৌ-বাক্স ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জামাদি ব্যবহার করা যাবে। আর কোনো অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে না। মেলিফেরা প্রজাতির প্রতিটি মৌ-বাক্স থেকে বছরে ৫০ কেজি পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করা সম্ভব, যার বাজার মূল্য ৫০ কেজি´২৫০ টাকা (প্রতিকেজি)´৫টি বাক্স= ৬২,৫০০ টাকা। প্রকল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে মাত্র ২৫-২৭ হাযার টাকা এককালীন বিনিয়োগ করে প্রতিবছর ৬০ হাযার টাকার ঊর্ধ্বে আয় করা সম্ভব। মৌ-বাক্সের সংখ্যা প্রতিবছর বৃদ্ধির মাধ্যমে এ আয় অনেকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। স্বল্প পরিশ্রমে এ ধরনের প্রকল্প স্থাপনের মাধ্যমে একদিকে যেমন আর্থিক দিক থেকে লাভবান হওয়া যায়, তেমনি পরাগায়ন প্রক্রিয়ায় সহায়তা দানের মাধ্যমে দেশের ফল ও ফসলের উৎপাদনে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা দান করা যায়।