বাংলাদেশের জমি যেমন উর্বর এদেশের মানুষের মনও তেমন উর্বর। অর্থাৎ ধর্মের জন্য নরম। সুতরাং ইসলাম ধর্মের আলোকে সোনার বাংলার কৃষকদেরকে অধিকতর নরম করে ধান চাষে উদ্বুদ্ধ করার সম্ভাবনা অনেক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাস্তবে হাতে-কলমে বিষয়গুলো কৃষকদের দেখিয়ে এবং শিখিয়ে দেয়ার অভাব।
আল-কুরআনের আলোকে ধান চাষ বিষয়ে আমি গবেষণা করে আসছি ২০১৫ সাল থেকে। যদিও ধারণাটি পেয়েছিলাম ২০১৩ সালের শেষের দিকে কোন এক বিকেল বেলা ‘সুইডিস ইউনিভার্সিটি অফ এগ্রিকালচারাল সায়েন্স’-এর লাইব্রেরীতে। পড়াশুনা ভাল না লাগলে কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করতাম। আইফোনে একটি অ্যাপসের সাহায্যে হঠাৎ করে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সূরা বাক্বারার ২৬১নং আয়াত এবং সূরা ইউসুফের ৪৭নং আয়াত দু’টিতে চোখ আটকে গেল। উক্ত দু’টি আয়াত আমাকে ধান চাষের ক্ষেত্রে ভাবিয়ে তুলেছিল বাংলাদেশ থেকে হাযার হাযার মাইল দূরে সুইডেনের উপসালা শহরে।
উল্লেখ্য, সুইডেনে ধান উৎপাদন হয় না বিধায় সেখানে এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ ছিল না। সেখানে পড়াশুনা শেষ করে ২,৫০,০০০/- টাকা বেতনের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ইউরোপের রেসিডেন্স পারমিট ছেড়ে দিয়ে চলে আসলাম দেশে। সবাই আমাকে বোকা বলেছিল। কারণ ইউরোপের নাগরিকত্ব আর চাক্যচিক্যময় জীবন ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসার সিদ্ধান্তকে কেউই ভালভাবে নেয়নি। তবে আমি বুঝেছিলাম আল্লাহ আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করবেন এবং আমি আমার মেধাকে দেশের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারব।
দেশে এসে জমি থেকে ধানের শীষ সংগ্রহ করে শীষসহ রেখে দিলাম সূরা ইউসুফের ৪৭নং আয়াত অনুসারে। পরের বছর নিজের রেখে দেয়া শীষকে বীজ হিসাবে ব্যবহার করা হ’ল যেখানে বীজ গজানোর হার ছিল ৯৫% এর অধিক। ভ্রূণগুলো এত মোটা ও শক্ত ছিল যে অন্যান্য কৃষকদের বীজগুলো চোখেই ধরছিল না। নিজের বীজ দিয়ে সূরা বাক্বারার ২৬১নং আয়াতের আলোকে বারি-২৮ এর চারা একটি করে রোপণ করা হয়েছিল। যদিও আমাদের কৃষকগণ হাইব্রিডের ক্ষেত্রে ১-২টি করে চারা রোপণ করে। দেশী ধানের ক্ষেত্রে ৪-১০টি পর্যন্ত চারা রোপণ করে। এতে চারার অপচয় হয় বহুগুণ।
আমার জমিতে সর্বোচ্চ একটি চারা বীজ থেকে ৩৭টি চারা উৎপাদিত হয় এবং গড়ে ১৫-২২টি করে চারা জন্মায়; যেখানে সর্বোচ্চ শীষের দৈর্ঘ্য ১২ ইঞ্চি হয়েছিল আলহামদুলিল্লাহ। সাংবাদিকগণ একটি শীষের ধান মেপে হিসাব করে শতাংশে প্রায় এক মনের হিসাব পান। এ বিষয়টি সংবাদপত্রে ও টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত হ’লেও আল-কুরআনের আলোকে ধান চাষের বিষয়টি সবাই এড়িয়ে যায় কাকতালীয়ভাবে।
চলতি বছর চলনবিলে এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আমার তত্তবাবধানে ২৬ বিঘা জমিতে একটি করে চারা রোপণ পদ্ধতি পরীক্ষা করা হয়। ১৫ই জানুয়ারী ২০১৮ তারিখে বারি-২৯ এর চারা রোপণ করা হয় এবং ১৮ই মে ধান কাটা হয়। প্রতি শতাংশে ৩৯ কেজি ৫০০ গ্রাম ধান উৎপাদিত হয়। অর্থাৎ শতাংশে প্রায় ১ মণ। এবার একটি চারা থেকে ধান গাছ উৎপাদিত হয়েছে সর্বোচ্চ ৪৩টি এবং ৪২টি লম্বা শীষ জন্মেছে।
ধান গাছের গোড়াগুলো এতই সবল ছিল যে বাতাসে হেলে ধানের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি যা অন্যান্য জমিতে হয়েছে। কৃষকের বীজের খরচ বহুগুণ কমেছে (প্রায় ৬-৮গুণ) এবং সার ব্যবহার করতে হয়েছে যে কোন বছরের তুলনায় কম এবং বীজতলা থেকে চারা সংগ্রহের খরচও কমে গেছে ব্যাপকভাবে। যে কৃষক আল-কুরআনের আলোকে একটি চারা রোপণ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন, তিনি তার কৃষিজীবনে সর্বোচ্চ ফলন এবছর পেয়েছেন। অতএব এটাকে নিঃসন্দেহে একটা সফল ঘটনা বা ‘‘সাকসেস ষ্টোরি’’ বলা যেতে পারে।
কিন্তু শুরুটা সন্তোষজনক ছিল না। ২৬ বিঘা জমিতে একটি করে দেশী ধানের চারা রোপণকে অন্যান্য কৃষকগণ তামাসা হিসাবে নিয়েছিল। এক পর্যায়ে যে কৃষক একটি চারা পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন, তিনি ও তার পরিবারকে কাঁদতে হয়েছিল এই ভেবে যে, এবার মান-সম্মান ও ফসল সবই গেল। একইভাবে ২০১৫-১৬ সালে আমাকে আমার গ্রামবাসী পাগল বলেছিল এটা মনে করে যে, বিদেশ থেকে পড়াশুনা করে এসে আমি পাগল হয়ে গেছি। শেষ হাসি আমরা হেসেছিলাম যখন ফলন ভাল হয়েছিল। যদিও সবাই আশাহত ছিল একটি বীজ থেকে ধান উৎপাদনের বিষয়ে।
একটি করে চারা রোপণ পদ্ধতির মূল সমস্যা হ’ল আস্থার সংকট। যেহেতু বিষয়টি একাধিকভাবে জমিতে পরীক্ষিত ও প্রমাণিত এখনই সময় একটি চারা পদ্ধতির প্রয়োগ সম্ভাবনাকে প্রান্তিক পর্যায়ে কাজে লাগানোর। কারণ একটি চারা রোপণ পদ্ধতিতে খরচ ও শ্রম কম কিন্তু উৎপাদন বেশী।
মসজিদে, মিডিয়াতে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি চারা পদ্ধতিতে ব্যাপক প্রচার করলে প্রসার হবে ইনশাআল্লাহ। এজন্য দরকার সমন্বিত প্রয়াস। সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি এই অধমকে দিয়ে কাজটি করিয়েছেন। অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের কৃষিতে ধান চাষে কুরআনিক পদ্ধতি একটি চারা রোপণ পদ্ধতি দেশের মাটি পেরিয়ে সারা বিশ্বে প্রয়োগ হবে এবং মহান আল্লাহর কালিমা যমীনে প্রতিষ্ঠিত হবে এটাই আমাদের একান্ত কাম্য।
\ সংকলিত \