লিচু
চাষে প্রসিদ্ধ দিনাজপুরে চলতি মৌসুমে মুকুল থেকে মধু সংগ্রহের জন্য দেশের
বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই যেলায় ছুটে আসেন মৌচাষীরা। লিচুবাগানে মৌ চাষের
ফলে একদিকে মৌচাষীরা যেমন মধু সংগ্রহ করতে পারছেন, অপর দিকে মৌমাছি লিচুর
ফুলে পরাগায়ণের ফলে লিচুর ফলন বৃদ্ধি পায়। লিচু আকারে বড় হয়, রোগবালাইও কম
হয়। এই যেলায় এবার ৫ হাযার ২৮১ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হচ্ছে। বাগানগুলোতে
রয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাযার ৬৩টি লিচুর গাছ। এসব বাগান থেকে গত মৌসুমে ১০০
মেট্রিক টন মধু সংগ্রহ করেছিল মৌচাষীরা। এবারও ১০০ মেট্রিক টন মধু
সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৪৭ মেট্রিক টন
মধু সংগ্রহ করা হয়েছে। এই মৌসুমে দিনাজপুরে ৩ শতাধিক চাষী ১০ হাযারের বেশী
মৌ-বাক্স নিয়ে মৌ চাষ করছেন। তবে এবার লিচুতে মুকুল কম ধরায় মধু সংগ্রহের
লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
বাগানের এক পাশে তাঁবু গেড়ে অস্থায়ীভাবে বাস করছেন সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, সাতক্ষীরা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা মৌচাষীরা। তবে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে যেলার বাইরে থেকে আসা মৌচাষীদের মধু সংগ্রহ দেখে মৌ চাষে আগ্রহ বেড়েছে স্থানীয় লোকজনের মধ্যেও। বিরল উপযেলার মাধববাটি এলাকায় নূরুল ইসলামের বাগানে আব্দুর রশীদ বসিয়েছেন ২৫০টি মৌ-বাক্স। তন্মধ্যে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন থেকে পাওয়া ডিজিটাল মৌ-বাক্স রয়েছে ১৫০টি। রশীদ জানান, তুরস্ক থেকে আনা এই ডিজিটাল মৌ-বাক্সগুলো কাঠের বাক্সের তুলনায় আকারে কিছুটা বড়। এর ভেতর পানি ঢোকার আশঙ্কাও নেই। কাঠের বাক্সগুলোর ফ্রেমে লোহার তার ব্যবহার করা হয়। এতে মরিচা ধরে এবং রোগজীবাণুর সৃষ্টি হয়। অপর দিকে ডিজিটাল বাক্সে মৌচাকের ফ্রেমটি ফুড গ্রেড প্লাস্টিকের তৈরী হওয়ায় এটি স্বাস্থ্যসম্মত। কাঠের বাক্সে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার উপায় না থাকায় অনেক সময় মৌমাছি মরে যায়। অপর দিকে ডিজিটাল এই মৌ-বাক্স তাপমাত্রা-নিয়ন্ত্রিত। সর্বোপরি কাঠের বাক্স থেকে আধুনিক এই মৌ-বাক্সে দ্বিগুণ মধু পাওয়া যায়।
মধু সংগ্রহের পাশাপাশি এবারই প্রথম আধুনিক এই মৌ-বাক্স থেকে পোলেন তথা বাচ্চা মৌমাছির খাবার সংগ্রহ করছেন আব্দুর রশীদ। তিনি জানান, ফুলের পরাগ থেকে নির্যাস সংগ্রহের সময় মৌমাছি তার পায়ে সংগ্রহ করে নিয়ে আসে এই পোলেন। এই পোলেন জমা হয় বাক্সের পোলেন ট্রেতে। প্রতিবছর একটি বাক্স থেকে এক কেজি পর্যন্ত পোলেন সংগ্রহ করা যায়। এ প্রসঙ্গে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় মৌ চাষ নিয়ে, বিশেষত মৌ-বাক্স থেকে পোলেন সংগ্রহ নিয়ে গবেষণা চলছে। এই পোলেনের মধ্যে থাকে ভিটামিন বি। উন্নত দেশে এটি পাখির খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ক্রান্তিকালে মৌমাছির খাবার হিসাবেও ব্যবহৃত হয় পোলেন দানা। একজন মানুষ দৈনিক পাঁচ-সাতটি পোলেন দানা খেলে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। বাংলাদেশ প্রতিবছর ঔষধ তৈরীর জন্য এই পোলেন বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। প্রতি কেজি পোলেনের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য ৮ থেকে ১০ ডলার। বাংলাদেশে তাপনিয়ন্ত্রিত আধুনিক মৌ-বাক্সে ব্যাপকভাবে মৌ চাষ শুরু হ’লে তাতে একদিকে যেমন মধুর উৎপাদন বাড়বে, অন্যদিকে দেশে পোলেনের চাহিদা মিটিয়ে তা রপ্তানি করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, উন্নত প্রযুক্তিতে মৌ চাষ করলে দেশে বর্তমানে ২৫ টন পোলেন সংগ্রহ করা সম্ভব।
আধুনিক এই মৌ-বাক্সের ফ্রেম বা চাক থেকে মধু সংগ্রহের প্রক্রিয়াতেও এসেছে পরিবর্তন। আগে বিভিন্ন রকম ময়লা-আবর্জনা, ঝুট কাপড়ে আগুন লাগিয়ে ধোঁয়া তৈরি করে চাক থেকে মৌমাছিদের সরিয়ে মধু সংগ্রহ করা হ’ত। বর্তমানে নতুন এই মৌ-বাক্সে একটি ছোট হাওয়া মেশিনে নারিকেলের ছোবড়া ঢুকিয়ে তাতে আগুন দিয়ে ধোঁয়া তৈরী করা হয়ে থাকে। আগে টিন বা প্লেইন শীটের তৈরী মধুনিষ্কাশন যন্ত্রের মধ্যে চাক রেখে মধু সংগ্রহ করা হ’ত। বর্তমানে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত স্টিলের তৈরী মধুনিষ্কাশন যন্ত্রের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করা হচ্ছে।
মৌচাষীরা জানান, দিনাজপুরে ১৫ হাযারের বেশী মৌ-বাক্সে মৌ চাষ হচ্ছে। একটি মৌ-বাক্স থেকে প্রতিবছর গড়ে ৮০-১০০ কেজি পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করা যায়। সপ্তাহে এক দিন তাঁরা বাক্স থেকে মধু সংগ্রহ করে থাকেন।
\ সংকলিত \