রাজহাঁস শুধু বাড়ীর শোভাবর্ধন করে না। বাড়ি-ঘর পাহারা দেয়, চোর তাড়ায়, ঘাস সমান করে খেয়ে নেয়। পোকা-মাকড় খেয়ে জায়গা-জমি ঝকঝকে করে দেয়। রাজহাঁসের গোশত খাওয়া হয়। ওর পলক দিয়ে লেপ-তোষক, বালিশ তৈরি হয়। বছরে খুব কম ডিম দেয়। এই কারণে রাজহাঁস পালনকারী তার ডিম না খেয়ে সেটা থেকে বাচ্চা উৎপাদন করতেই বেশি উৎসাহী হয়ে থাকেন।
রাজহাঁসের প্রজাতি : রাজহাঁসের বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। তার মধ্যে টুলুজ, এমডেন, চিনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
রাজহাঁসের বাসস্থান : রাজহাঁসের ঘর খোলা-মেলা, বায়ু চলাচলযুক্ত হবে। কিন্তু রোদ বৃষ্টি যাতে ভিতরে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মেঝে নানা ধরনের হ’তে পারে- পাকা, শক্ত অথচ কাঁচা।
ঘরে যাতে চোর না ঢোকে এবং শেয়াল বা অন্য কোন বন্যপ্রানী এদের ক্ষতি না করে। ঘরের সামনে বা পিছনে কিছুটা জায়গা তারের জাল দিয়ে ঘিরে দিলে ভাল হয়। এই জায়গাটা ওদের বিচরণের কাজে আসবে। এই ধরনের জায়গা হাঁস পিছু ৪ বর্গ মিটার দিতে হবে। রাজহাঁসের ঘরের মধ্যে এবং বাইরে তিনটি হাঁস পিছু একটি করে ডিম পাড়ার বাক্স দিতে হবে। বাক্সে মাপ হবে ৫০ বর্গ সেঃ মিঃ। পানি ও খাবার জন্য আলাদা পাত্র থাকবে।
রাজহাঁসের প্রজনন করাতে চাইলে ভারি জাতের ৩/৪ টি মাদি হাঁস পিছু একটি মর্দা হাঁস রাখতে হবে। রাজহাঁসদের এক বছর বয়স না হ’লে প্রজনন কাজে ব্যবহার না করাই ভাল। সবচেয়ে ভাল হয় যদি ওদের দু’বছর বয়সে প্রজনন কাজে লাগানো যায়। মাদি হাঁস ১৫ বছর পর্যন্ত প্রজননক্ষম থাকে। কিন্তু মর্দা সাত বছরে প্রজননে কিছুটা অক্ষম হয়ে পড়ে।
ডিম ও ডিম ফোটানো : সাধারণত এরা বসন্তকালে ডিম দিতে শুরু করে। চিনে রাজহাঁস শুরু করে শীতকালে। এরা সকালের দিকেই ডিম দেয়। প্রথম বছরের তুলনায় দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বছরে বেশি ডিম দিয়ে থাকে। ২য় এবং ৩য় বছরের ডিম আকারেও বেশ বড় হয়ে থাকে। শঙ্কর জাতীয় রাজহাঁস অর্থাৎ অক্সিকান রাজহাঁস বা চিনে এবং টুলুজ বা এমডেনের সঙ্কর রাজহাঁস এমডেন বা টুলুজ চিনে রাজহাঁস দের চেয়ে বেশি ডিম দেবে।
ডিমে তা দেওয়া : রাজহাঁস নিজের ডিম ফুটিয়ে থাকে এবং যখন ডিমে তা দেয় তখন ডিম পাড়া বন্ধ রাখে। সুবিধা থাকলে টার্কি মুরগি বা মস্কোডি হাঁস দিয়ে রাজহাঁসের ডিম ভালোভাবে ফুটিয়ে নেওয়া যায়।
মুরগি দিয়েও রাজহাঁসের ডিম ফোটানো যায়। এক্ষেত্রে মুরগি প্রতি ৪/৬ টি ডিম এবং রাজহাঁস দিয়ে বসালে রাজহাঁস পিছু ১০-১৫ টি ডিম বসাতে হবে। মুরগির নিচে রাজহাঁসের ডিম বসানো হ’লে ডিম ঘোরানোর ব্যবস্থা খামারীকে নিজেই করতে হবে। কারণ বড় আকারের বলে মুরগি রাজহাঁসের ডিম ঘোরাতে পারে না।
রাজহাঁসের বাচ্চাদের খাবার : রাজহাঁসের খাবার মোটামুটি সাধারণ হাঁসের খাবারের মতো। তবে প্রথমে চার সপ্তাহ রাজহাঁসের বাচ্চারা খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে বলে বাচ্চা হাঁসের তুলনায় ওদের খাবারে আমিষের ভাগ বেশি হওয়া দরকার। ভারি জাতের রাজহাঁসের একদিনের বাচ্চার ওযন প্রায় ৮৫ গ্রাম এবং ৪ সপ্তাহে এর ওজন ১ কেজি ৬০০ গ্রাম পর্যন্ত।
প্রজননক্ষম রাজহাঁসের যত্ন : প্রাপ্তবয়স্ক রাজহাঁস দের প্রজনন ঋতুর আগে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত ভালোভাবে ঘাসে চরতে দিতে হবে। ওদের এই সময় প্রতিদিন ১৬৫ গ্রাম সুষম খাদ্য খেতে দিতে হবে, যাতে আমিষের ভাগ থাকবে শতকরা ১৬ ভাগ।
রাজহাঁসের রোগ : রাজহাঁস পালন তথা ব্যবসায় এটা একটা বড় সুবিধা যে এদের তেমন রোগ-ব্যধি হয় না। রোগের মড়ক নেই বললেই চলে। বাজারে বিক্রি করার বয়স পর্যন্ত মৃত্যুর হার শতকরা ২ ভাগও নয়। তবে রাজহাঁস পালনে নিম্নোক্ত রোগ সম্বন্ধে সচেতন হওয়া উচিত ককসিডিও সিস, কলেরা, কোরাইজ, স্পাইরোকিটোসিস, অপুষ্টিজনিত রোগ প্রভৃতি।
মানুষের সেবায় রাজহাঁসের পাহারাদারী : রাজহাঁস তার পারিপার্শ্বিক প্রতিটি জিনিসের সঙ্গে খুব সহজেই ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে এবং সেই সুবাদে যে কোন অপরিচিত শব্দ, লোকজন, জন্তু, জানোয়ার দেখামাত্র প্যাঁক-প্যাঁক শব্দ করে আশ-পাশের সকলকে তটস্থ করে তোলে। এমনকি প্রবল উত্তেজনায় অনেক সময় আক্রমণ পর্যন্ত করে বসে। তবে রাজহাঁসের মধ্যে পাহারাদারি কাজে চীনা রাজহাঁস দক্ষতম।
রাজহাঁসের ডিম এবং গোশত : রাজহাঁসের গোশত ও ডিম উপাদেয় খাবার হিসাবে সমাদৃত। ১০ সপ্তাহ বয়সের রাজহাঁস গোশত হিসাবে খাওয়া চলে এবং সেই সময় ঐ গোশতের ব্যবসাও ভালো চলে। দশ সপ্তাহ বয়সে রাজহাঁসের ওযন ৪.৫ কেজি হয়। গোশত হিসাবে কাটার ১২ থেকে ১৮ ঘন্টা আগে আগে রাজহাঁসের পানি ছাড়া সবরকম খাবার খাওয়ানো বন্ধ করতে হবে।
রাজহাঁসের পালক বিক্রয় : রাজহাঁসের পালক দিয়ে গদি, লেপ, তোষক, তাকিয়া, কুশন এককথায় বসবার এবং হেলান দেবার সব জিনিস তৈরি করা যায়। এই গদি তৈরির জন্য রাজহাঁসের বুক পিঠ এবং পেটের নরম পালকের খুব চাহিদা। রাজহাঁসের পালক তুলতে হবে রাজহাঁস যখন প্রথম ডিম পাড়া বন্ধ করবে। বছরে তিন থেকে চারবার এই পালক তোলা হয়। শীতকালে পালক তোলা উচিত নয়। ৫০ টি পূর্ণবয়স্ক রাজহাঁস সাড়ে চার কেজি পালক দিতে পারে।