বাংলাদেশের উত্তরোত্তর উন্নয়নের দিকে এগিয়ে চলার একমাত্র প্রতিবন্ধকতা হ’ল দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদা মেটাতে গিয়ে কখনও সেচনির্ভর ধান উৎপাদন অথবা কখনও উৎপাদিত ফসল, শাক-সবজি, ফলমূল ইত্যাদি সংরক্ষণে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। ফলে নষ্ট হচ্ছে জমির ফসল, পচে যাচ্ছে হিমাগারে সংরক্ষিত সবজি বা অন্যান্য ফলমূল। অন্যদিকে পর্যাপ্ত হিমাগার সঙ্কট তো রয়েছেই। এ সমস্যার সমাধানে স্বল্প ব্যয়ে এবং সহজে বিদ্যুৎ বিহীন হিমাগার তৈরির এক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরি অনুষদের কৃষি শক্তি এবং যন্ত্রবিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মাদ পারভেজ ইসলাম। বহুদিনের চিন্তা থেকে তিনি এ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সফল হন।

এ গবেষণা কাজ হয় ঢাকার অদূরে গাযীপুরের ভবানীপুরে অবস্থিত একটি নার্সারী ও হর্টিকালচার সেন্টারে। পরীক্ষামূলকভাবে সেখানে একটি শিতলীকরণ চেম্বার তৈরি করা হয়। দীর্ঘদিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গ্রীষ্মকালীন শাক-সবজি ও ফলের সংরক্ষণে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়।

হিমাগার তৈরির পদ্ধতি : প্রথমে ৯০ সে.মি. মাটি গর্ত করে ইট দিয়ে আয়তকার (দৈর্ঘ্য ১৬৫ সে.মি. ও প্রস্থ ১১৫ সে.মি.) একটি মেঝে তৈরি করতে হবে। মেঝের চারপাশে দ্বিস্তর বিশিষ্ট দু’টি দেয়াল তৈরি করতে হবে, যেন তৈরিকৃত স্তর দু’টির মধ্যে ৫ ইঞ্চি পরিমাণ ফাঁকা জায়গা থাকে। ফাঁকা স্থানটির নীচের অংশে প্রথমে ছোট ছোট পাথরের টুকরা ও মাটি দিয়ে ভরাট করতে হবে। পরে অবশিষ্ট ফাঁকা স্থানটুকু নদীর ভেজা বালু দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিতে হবে। কক্ষটি ঢেকে রাখার জন্য বাঁশ দিয়ে একটি ঢাকনা বানাতে হবে। এরপর শুকনো খড় অথবা গোলপাতা দিয়ে কক্ষটির চারপাশে একটি দোচালা ছাউনি বানাতে হবে, যাতে সূর্যের সরাসরি আলো বা তাপ কক্ষটির ওপর পড়তে না পারে। এরপর কক্ষটি ঠান্ডা রাখতে ঘরের দুই দেয়ালের মাঝে রাখা বালিতে ফোঁটা ফোঁটা আকারে নির্দিষ্ট পরিমাণে পানি দিতে হবে। এজন্য কক্ষের পাশেই একটু উঁচু স্থানে একটি ঢাকনাযুক্ত পানির  ট্যাংক বা ড্রাম রাখতে হবে। ঐ ট্যাংক বা ড্রামের সঙ্গে সংযুক্ত পাইপের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় ধরে ঠান্ডা পানি সরবরাহ করতে হয়, যাতে দুই দেয়ালের মাঝের বালি সর্বদা ভিজা থাকে। ফলে দুই দেয়ালের মাঝে রাখা ঠান্ডা বালি বাইরের গরম তাপমাত্রাকে যেমন ভেতরে যেতে দেয় না, তেমনি ভেতরের ঠান্ডা তাপমাত্রাকে বাইরে আসতে বাধা দেয়। এ পদ্ধতিতে তৈরিকৃত কক্ষের ভেতরের ও বাইরের তাপমাত্রার মধ্যে প্রায় ১০০ সে.-এর মতো পার্থক্য থাকে এবং কক্ষের মধ্যে অধিক আর্দ্রতার জন্য শাক-সবজি ও ফলমূল দীর্ঘদিন সতেজ থাকে। এ ধরনের একটি শিতলীকরণ চেম্বার তৈরি করতে প্রায় ৬ হাযার টাকার মতো লাগে এবং এটাতে ২০০ কেজির বেশি শাক-সবজি ও ফলমূল সংরক্ষণ করে রাখা যায়। এছাড়া প্রতিটি তৈরিকৃত কক্ষের স্থায়িত্বকাল কমপক্ষে পাঁচ বছর।

এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রীষ্মকালে ঢেঁড়শ, বেগুন, মরিচ, পটোল, টমেটো, করলা ও সাজনা সংরক্ষণের মেয়াদ ৮দিন থেকে ১০ দিন পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। শীতকালে এ সময়কাল প্রায় দ্বিগুণ হয়। সম্পূর্ণ বিদ্যুৎবিহীন হিমাগার তৈরির প্রযুক্তটি বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষক পর্যায়ে এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য অত্যন্ত উপযোগী হবে।

গাভী পালন করে স্বাবলম্বী

পাবনার সাঁথিয়া পৌরসভাধীন বোয়াইলমারী গ্রামের মৃত রওশন আলীর ছেলে উদ্যমী বেকার যুবক বেলায়েত হোসাইন গাভী পালন করে হয়েছেন স্বাবলম্বী। ১৯৮৮ সালে এসএসসি পাস করে পারিবারিক সমস্যার কারণে লেখাপড়া করতে পারেননি। শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকায় দীর্ঘদিন বেকার থাকা বেলায়েত বেকারত্বের অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে ১৯৯৮ সালে একটি গাভী ও একটি বকনা বাছুর কিনে মাত্র ১৪ হাযার টাকা পুঁজি দিয়ে নিজের বাড়িতে গাভী পালন শুরু করেন। বর্তমানে তার ফিজিয়াম, শাহিয়াল ও জার্সি জাতের ৯টি গাভী, দু’টি ষাঁড়, ৪টি বকনা ও ৯টি বাছুরসহ মোট ২৪টি গরু আছে। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২০ লাখ টাকা। তার গাভী থেকে প্রতিদিন প্রায় ৯০ লিটার দুধ হয় এবং প্রতিদিন আয় হয় প্রায় ৩ হাযার টাকা। খেয়ে-পরে সংসার চালিয়ে খরচ বাদে বছর শেষে তার সঞ্চয় হয় দু’লক্ষাধিক টাকা। এছাড়া গরুর গোবর থেকে তৈরী জৈবসার রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জমিতে দিয়ে ভাল ফসলও উৎপাদন করছেন। গোবর থেকে বায়োগ্যাস তৈরী করে রান্নার কাজে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করছেন এবং বিদ্যুতের অভাবও পুষিয়ে নিচ্ছেন এ থেকে। তিনি ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জাতীয় শ্রেষ্ঠ সমবায়ী হিসাবে স্বর্ণপদক ও ১৫ হাযার টাকা পুরস্কার পান। তার সফলতায় এলাকার অনেক যুবকই গরুর খামার করেছেন।

নার্সারী খুলেছে ভাগ্যের দুয়ার

গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপযেলার উত্তর ফরিদপুর গ্রামের ইসমাঈল হোসাইন বাদশা নার্সারী করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন। ১৯৮৬ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ১০ শতাংশ জমিতে নার্সারী করে ফলদ, বনজ ও ওষুধি চারা রোপণ করেন। এর মাধ্যমেই তার ভাগ্য পরিবর্তনের যাত্রা শুরু হয়। এখন তিনি ৬ বিঘা জমির উপর একটি বিশাল আকারের নার্সারী স্থাপন করেছেন। তার নার্সারীতে ফলদ, বনজ ও ওষুধিসহ সব ধরনের গাছের প্রায় ৩শ’ প্রজাতির ১৩ লাখেরও অধিক চারা রয়েছে। তার নার্সারীতে ফল জাতীয় গাছের চারার মধ্যে রয়েছে- আম, কাঁঠাল, লিচু, সবেদা, পেয়ারা, ডালিম, বেল, জলপাই, কমলা, লেবু, মালটা, তেতুলসহ ২শ’ প্রজাতি। অপরদিকে বনজ বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে মেহগনি, লম্বু, রেইনটি, বেলজিয়াম, নিম, সেগুনসহ ১শ’ প্রজাতি। এছাড়া তার নার্সারীতে বাসক, আমলকি, বহেরা, বাসিক, খবচ, তুলসী, থানকুনি, গন্ধক ইত্যাদি ঔষধী বৃক্ষের চারা পাওয়া যায়। প্রতিবছর মৌসুমে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ করে ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা আয় আসে। এই দিয়ে তিনি সচ্ছল জীবন যাপন করছেন। অনেকে তার নার্সারী থেকে সরাসরি চারা সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। আবার নিজস্ব লোক দিয়েও বিভিন্ন হাট-বাজার এবং শহরে চারা বিক্রি করা হয়। উন্নত জাতের চারা উৎপাদনের জন্য এই নার্সারী চারার যথেষ্ট কদর রয়েছে। ইসমাঈল হোসাইন বাদশা  ২০১১ সালে ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক’ পান। এছাড়াও তিনি সার্টিফিকেট, নগদ অর্থসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তার নার্সারীতে ১৫-২০ জন পুরুষ ও নারী শ্রমিক কাজ করে।






আরও
আরও
.