পাটের
অাঁশ ছাড়িয়ে নেওয়ার পরে কেউ কেউ এর কাঠি জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করেন।
আবার কেউ কেউ পাটকাঠি দিয়ে ঘরের বেড়া দেন। অল্প কিছু এলাকায় এটি অবশ্য
পানের বরজে ব্যবহার করা হয়, যাতে পানগাছ বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠতে পারে। তবে
পাটকাঠি থেকে অ্যাকটিভেটেড কার্বন বা চারকোল তৈরি করেও আর্থিকভাবে ওপরে ওঠা
যায়।
পাটকাঠির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে দেশে বর্তমানে অন্তত ৩৩টি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে। এ রকমই একটি হ’ল তাজী অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি এখন চারকোল রপ্তানির মাধ্যমে বছরে পাঁচ কোটি টাকা আয় করে।
তাজী অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মাদ নাজমুল ইসলাম জানান, পাইরোলাইসিস পদ্ধতিতে পাটকাঠি পুড়িয়ে বেশী ঘনত্বের কয়লা তৈরি করা হয়, যেটির শোষণ ও রাসায়নিক সক্ষমতা অনেক বেশী। এ ধরনের কয়লাকে বাণিজ্যিকভাবে অ্যাকটিভেটেড কার্বন বা চারকোল বলা হয়। প্রতি তিন কেজি পাটকাঠি থেকে এক কেজি কার্বন তথা চারকোল পাওয়া যায়।
তিনি জানান, সুইচ ও বালবসহ আরও কয়েকটি ব্যবসার সঙ্গে তিনি পাটকাঠির কয়লা বা চারকোল তৈরির কাজটিও করেন। এ জন্য ঝিনাইদহে ৪৫৬ শতাংশ জমির ওপর একটি কারখানা করেছেন। সেখানে পাটকাঠি পুড়িয়ে চারকোল তৈরি করা হয়। নাজমুল বলেন, পাটকাঠির কয়লা থেকে তৈরি চারকোল মুঠোফোনের ব্যাটারি, বুলেটের বারুদ, প্রসাধনী, প্রিন্টারের কালি তৈরি, পানি শোধনের ফিল্টার, কৃষিজমির উর্বরাশক্তি বাড়ানোসহ ৫২টির বেশী কাজে ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে প্রতি টন চারকোলের দাম বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৬৪ হাযার ৫০০ টাকার সমান।
লক্ষ্মীপুরের ছেলে নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে স্নাতক সম্মান দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় আমি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ নিই। সেই গবেষণার কাজে আমি পুরান ঢাকার ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে মেশার সুযোগ পাই। সেই সুবাদে আমি সিএফএল বালব বা বাতি বিক্রির কাজে যুক্ত হই’। নাজমুল জানান, কিছুদিন পরিবেশক হিসাবে ঢাকার আমদানি-কারকদের কাছ থেকে বালব নিয়ে তিনি বিভিন্ন যেলায় বিতরণ করতেন। একপর্যায়ে তিনি সরাসরি বালব আমদানি করতে চীনে যান। তখন সেই দেশে একজনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। নাজমুল বলেন, ২০১০ সালে আমি চীনে গেলে সেই বন্ধু আমাকে তাঁর চাংসা প্রদেশের গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে তাঁর পরিবারকে পাটকাঠি থেকে অ্যাকটিভেটেড কার্বন তৈরী করতে দেখি। পাটকাঠি থেকে তৈরী হওয়ায় আমি এই ব্যবসায়ে আগ্রহী হই।
ঐ বন্ধুর পরামর্শে নাজমুল চীনা প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশী পাটকাঠি থেকে চারকোল উৎপাদনে অর্থ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। পাশাপাশি চারকোল বিক্রির দায়িত্ব নিতে রাযী হন ঐ চীনা বন্ধু। এভাবে যাত্রা শুরু হয় তাজী অ্যাগ্রোর। কারখানা প্রতিষ্ঠায় তিন বছর লাগে। ২০১৩ সালে ঝিনাইদহের সদর উপযেলার অচিন্তপুর গ্রামে তাজী অ্যাগ্রোর চারকোল কারখানা গড়ে ওঠে। সেবারই তাঁরা চীন ও ভারতে চারকোল রফতানী শুরু করেন। প্রথম বছরে রফতানী হয় ২০০ টন, যা এত দিনে কয়েক গুণ বেড়েছে।
আলাপকালে নাজমুল বলেন, বাংলাদেশের পাটের মতো পাটকাঠির মানও বেশ ভালো। ফলে তা থেকে উৎপাদিত চারকোল আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো দামে বিক্রি করা যায়। অবশ্য শুরুর দিকে প্রতি টন ১ হাযার ৬০০ থেকে ১ হাযার ৭০০ ডলারে বিক্রি হ’লেও এখন প্রতিযোগিতা বাড়ায় দাম পড়ে গেছে। তবে অনেক প্রতিষ্ঠান আসার কারণে নিজের একচেটিয়া বাজার খর্ব হ’লেও কাঁচামাল প্রাপ্তি ও পণ্য রফতানিতে সুবিধা হয়েছে বলে মনে করেন নাজমুল।
কানাডাভিত্তিক আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ‘অ্যালাইড মার্কেট রিসার্চে’র তথ্য অনুযায়ী চলতি ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে চারকোলের চাহিদা দাঁড়াতে পারে ২৭ লাখ ৭৬ হাযার টন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০০ কোটি ডলার।
দেশে একে একে বহু পাটকল বন্ধ হওয়ায় এবং প্লাস্টিক পণ্যের দাপটে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার কমে যাওয়ায় মাঝে পাট উৎপাদনে ভাটা পড়েছিল। এখন পাটপণ্যে কিছুটা হ’লেও বৈচিত্র আসায় এবং পাটকাঠির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় দেশে আবারও পাটের উৎপাদন বাড়ছে বলে মনে করেন নাজমুল।
দেশে পাটকাঠি থেকে চারকোল তৈরির ব্যবসায়ে নেতৃত্বের পর্যায়ে থাকায় সদ্য বিদায়ী বছরে (২০২১ সাল) ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশন মুহাম্মাদ নাজমুল ইসলামকে বর্ষসেরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কার দিয়েছে। নাজমুল আশা করেন, ভবিষ্যতে তিনি শুধু চারকোলই তৈরী করবেন না; বরং এটি ব্যবহার করে যেসব পণ্য তৈরী হয় সেগুলো উৎপাদনের কারখানাও স্থাপন করবেন দেশে।
\ সংকলিত \