কুরআন সংকলনের ইতিহাস

ভূমিকা :

কুরআন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহাগ্রন্থ। এ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর সুদীর্ঘ ২৩ বছরে অবতীর্ণ হয়েছে। পূর্ববর্তী নবীদের উপর অবতীর্ণ সকল কিতাব লিখিত হ’লেও একমাত্র কুরআনই পঠিত আসমানী কিতাব। জিব্রীল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে ‘অহি’ পাঠ করে শুনাতেন।[1] কুরআন আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হ’লেও এর আহবান ও আবেদন সার্বজনীন। এটি সমগ্র মানবজাতির হেদায়াতের জন্য নাযিল হয়েছে। আসমানী কিতাবসমূহের মধ্যে কুরআনই সর্বাধুনিক। তাওরাতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুহাম্মাদ! আমি তোমার উপর সর্বাধুনিক কিতাব নাযিল করেছি’।[2] দুনিয়ার সর্বাধিক পঠিত এ গ্রন্থ বার বার পঠিত হয় বলে একে ‘কুরআন’ বলা হয়। কুরআন সত্য-মিথ্যার প্রভেদকারী কিতাব। সেকারণ কুরআনকে ‘ফুরক্বান’ও বলা হয়। ‘কুরআন’ শব্দটি পবিত্র কুরআনে সত্তর বার এসেছে।[3] ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে হেরা পর্বতে সূরা আলাক্বের প্রথম পাঁচটি আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে কুরআন নাযিলের সূচনা হয়।[4] অতঃপর পূর্ণ ত্রিশপারা কুরআন তেইশ বছরে স্থান-কাল পাত্রভেদে নাযিল হয়েছে। সে কারণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় সম্পূর্ণ কুরআন গ্রন্থাকারে সংকলন সম্ভব হয়নি। তাছাড়া কুরআনের কোন আয়াত বা বিধান মানসূখ বা রহিত হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর বিধান রহিত হওয়ার সম্ভাবনা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।[5] ফলে কুরআন গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকে না। তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশাতেই সম্পূর্ণ কুরআন লিপিবদ্ধ হয়, যা খন্ড খন্ড আকারে বিভিন্ন ছাহাবীর নিকটে সংরক্ষিত ছিল। ওমর (রাঃ)-এর পরামর্শে প্রথম খলীফা আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর শাসনামলে (৬৩২-৬৩৪ খৃ.) তাঁর নির্দেশে সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ কুরআন গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর তৃতীয় খলীফা ওছমান (রাঃ) কুরআন সংকলন করে সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে একই ক্বিরাআতের উপর ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে কুরআন সংকলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হ’ল।-

কুরআন পরিচিতি :

কুরআনের মূল পরিচয় হ’ল এটি ‘কালামুল্লাহ’ (كَلاَمُ اللهِ) বা আল্লাহর কালাম। যা সরাসরি আল্লাহর নিকট থেকে এসেছে।[6] সৃষ্টিজগত দুনিয়াবী চোখে কখনোই তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে দেখতে পাবে না (আন‘আম ৬/১০৩)। তবে তাঁর ‘কালাম’ দেখে, পড়ে, শুনে ও বুঝে হেদায়াত লাভ করতে পারবে। কুরআনের ভাব ও ভাষা, এর প্রতিটি বর্ণ, শব্দ ও বাক্য আল্লাহর। জিব্রীল (আঃ) ছিলেন কুরআনের বাহক[7] এবং রাসূল (ছাঃ) ছিলেন এর প্রচারক ও ব্যাখ্যাতা।[8] কুরআন লওহে মাহফূযে (সুরক্ষিত ফলকে) লিপিবদ্ধ’ (বুরূজ ৮৫/২১-২২)। সেখান থেকে মহান আল্লাহর হুকুমে পর্যায়ক্রমে নাযিল হয়েছে।[9]

কুরআন সংকলনের বিভিন্ন পর্যায়

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে কুরআন সংরক্ষণ :

৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই আগষ্ট মোতাবেক ২১শে রামাযান সোমবার ক্বদরের রাত্রিতে প্রথম কুরআন নাযিল হয়।[10] অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর ২৩ বছরের নবুঅতী জীবনের বাঁকে বাঁকে বাস্তবতার নিরিখে আসমানী তারবার্তা হিসাবে কুরআন নাযিল হয়েছে পরম্পরাগতভাবে। নুযূলে কুরআনের শুরু থেকে নবুঅতের শুরু এবং নুযূলে কুরআনের সমাপ্তিতে নবী জীবনের সমাপ্তি।[11] কুরআনের কোন সূরা কিংবা সূরার অংশ বিশেষ যখন নাযিল হ’ত তখন ছাহাবায়ে কেরাম তা মুখস্থ করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা লিখিয়ে নিতেন।[12] সুতরাং রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে দু’ভাবে কুরআন সংরক্ষণ করা হতো। ১. মুখস্থকরণের মাধ্যমে। যেমন- আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, আমি কুরআন মুখস্থ করেছি এবং তা প্রতি রাতে সম্পূর্ণ তিলাওয়াত করি’।[13] ২. লেখার মাধ্যমে। যেমন আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) ব্যতীত আর কারো নিকট আমার চেয়ে অধিক হাদীছ নেই। কারণ তিনি লিখতেন, আর আমি লিখতাম না’।[14]

যে সকল ছাহাবী অহি লেখার কাজে নিয়োজিত ছিলেন তাঁদেরকে ‘কাতেবুল অহি’ বা অহি লেখক বলা হয়। বিশিষ্ট অহি লেখক যায়েদ ইবনে ছাবেত (রাঃ) ‘কাতেবুন নবী’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। অহি লেখকদের সংখ্যা সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ তাদের সংখ্যা চল্লিশ বলে উল্লেখ করেছেন।[15] প্রফেসর ড. আলী ইবনু সুলাইয়মান আল-আবীদ বলেন, তাদের সংখ্যা ৪৪জন।[16] তৎকালে আরবে লেখার উপকরণ সহজলভ্য ছিল না। ফলে হাড়, কাঠফলক, পাথরখন্ড, গাছের পাতা, খেজুরের ডাল ও চামড়ায় কুরআন লিপিবদ্ধ করা হ’ত।[17] সূরা নিসার ৯৫ নম্বর আয়াত নাযিল হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘যায়েদকে ডাক, সে যেন ফলক, দোয়াত ও হাড় নিয়ে আসে’।[18] যায়েদ ইবনে ছাবেত (রাঃ) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য অহি লিপিবদ্ধ করতাম। যখন তাঁর উপর অহি নাযিল হ’ত তখন তাঁর দেহ মোবারক ঘর্মাক্ত হয়ে যেত। পবিত্র দেহে ঘামের ফোঁটা মুক্তার দানার ন্যায় চকমক করত। যখন এ অবস্থা শেষ হয়ে যেত তখন আমি দুম্বার চওড়া হাড় অথবা লিখনযোগ্য কোন বস্ত্ত নিয়ে হাযির হ’তাম। আমি লিখতে থাকতাম আর তিনি লিখাতে থাকতেন। এমনকি যখন আমি লেখা শেষ করতাম তখন কুরআন নকল করার ওযন আমার কাছে এমন অনুভব হ’ত যেন আমার পা ভেঙ্গে যাবে এবং আমি আর কখনো আমার পায়ের উপর চলতে পারব না। লেখা শেষ হ’লে তিনি বলতেন, ‘পড়’। আমি তখন পড়ে শুনাতাম। আমি কোন ভুল-ত্রুটি করলে তিনি তা সংশোধন করে দিতেন। তারপর সেটাকে লোকদের সামনে নিয়ে আসতাম’।[19]

প্রাথমিক পর্যায়ে লিখে এবং মুখস্থ করেই কুরআন সংরক্ষণ করা হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম আবাসিক এবং পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘আছহাবে ছুফফাহ’। ইমাম ইবনে তায়মিয়া (১২৬৩-১৩২৮)-এর মতে, ‘এই প্রতিষ্ঠানে একসাথে ৭০/৮০ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকত এবং মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৬০০/৭০০ জন’।[20] এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাত-দিন কুরআন-সুন্নাহ শিখতেন এবং আলোচনা-পর্যালোচনা ও গবেষণা করতেন। আর তাদেরকে পরবর্তীতে কুরআন শিক্ষা দেয়ার জন্য শিক্ষক হিসাবে বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। ফলে হাফেয ও শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা কুরআনের হেফাযত ও সংরক্ষণ কর। সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন! অবশ্যই উট তার রশি থেকে যেমন দ্রুত পালিয়ে যায় তারচেয়েও দ্রুত বেগে এ কুরআন চলে যায়’।[21] তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি অন্তরে কুরআন গেঁথে (মুখস্থ) রাখে তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঐ মালিকের ন্যায়, যে উট বেঁধে রাখে। যদি সে উট বেঁধে রাখে, তবে সে উট তার নিয়ন্ত্রণে থাকে, কিন্তু যদি সে বাঁধন খুলে দেয়, তবে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়’।[22] মহান আল্লাহ বলেন, ‘(এটা তো লিপিবদ্ধ আছে) সম্মানিত ফলক সমূহে, যা উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ও পবিত্র। (যা লিখিত হয়েছে) লিপিকার ফেরেশতাদের হাতে’ (আবাসা ৮০/১৩-১৫)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাণী ছাহাবীগণ হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতেন। ছাহাবীদের মধ্যে কুরআন লেখা ও মুখস্থ করার ব্যাপারে রীতিমত প্রতিযোগিতা হ’ত। প্রখ্যাত অহি লেখক যায়েদ ইবনে ছাবেত (রাঃ)ও কুরআনের হাফেয ছিলেন। অনেকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যক্তিগতভাবে কুরআনের সূরা বা আয়াত লিখে সংরক্ষণ করতেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা কুরআন পাঠ কর। আর (বাড়ীতে) রক্ষিত কুরআন যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে। কেননা আল্লাহ ঐ অন্তরকে কখনোই শাস্তিত দিবেন না, যা কুরআনের সংরক্ষক’।[23] তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি কুরআনকে ভালবাসে, সে যেন সুসংবাদ গ্রহণ করে’।[24] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তিনি আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রেরিত একজন রাসূল, যিনি আবৃত্তি করেন পবিত্র পত্র সমূহ’ (বায়্যেনাহ ৯৮/২)। সুতরাং বলা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায়ই কুরআনের খন্ড খন্ড কপি তৈরী হয়ে গিয়েছিল।

জিব্রীল (আঃ)-এর নিকট থেকে নির্দেশনা পেয়েই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আয়াতের ধারাবাহিকতার নির্দেশ দিতেন। সে মোতাবেক অহি লেখকগণ নাযিলকৃত আয়াতগুলো বিভিন্ন সূরার আওতায় বিন্যস্ত করতেন।[25] অহির মাধ্যমে কুরআনের সূরা ও আয়াতসমূহ সাজানো হয়েছে। প্রতি বছর রামাযানে একবার করে জিব্রীল (আঃ) মহানবী (ছাঃ)-কে কুরআন পাঠ করে শুনাতেন। এমনকি মহানবী (ছাঃ)-এর মৃত্যুর বছর জিব্রীল (আঃ) দু’বার তাঁকে কুরআন পাঠ করে শুনান।[26] সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশাতেই পরিপূর্ণভাবে কুরআন লিপিবদ্ধ, সাজানো ও সংরক্ষণের কাজ সমাপ্ত হয়।

কুরআনের আয়াতসমূহের বিন্যাস ও সূরা সমূহের নামকরণ সবই আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ওছমান (রাঃ) বলেছেন, যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর কোন আয়াত নাযিল হ’ত, তখন তিনি অহী-লেখক কাউকে ডেকে বলতেন, এই আয়াতটি অমুক সূরার মধ্যে অমুক স্থানে রাখো। সূরা আনফাল প্রথম দিককার মাদানী সূরা এবং সূরা তওবা শেষের দিককার মাদানী সূরা। দু’টি সূরার বিষয়বস্ত্ত প্রায় একই। সেজন্য সূরা দু’টিকে আমি পাশাপাশি রেখেছি। কিন্তু তিনি বলেননি যে, এটি ওটার অন্তর্ভুক্ত। সেজন্য আমি দু’টি সূরার মাঝে বিসমিল্লাহ.. লিখিনি’।[27] এতে বুঝা যায় যে, কুরআনের বিন্যাস আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। জিবরীল (আঃ) প্রতিবছর রামাযানে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসে কুরআন পাঠ করতেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর বছরে দু’বার পাঠ করে শুনান।[28] এখান থেকেও বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।

আবুবকর (রাঃ)-এর সময় কুরআন সংকলন :

মহানবী (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে আবুবকর (রাঃ) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় ভন্ড নবীদের অপতৎপরতা, স্বধর্ম ত্যাগীদের বিদ্রোহ, যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু, হাফেযদের শাহাদতবরণ, বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খখলায় কুরআনের কোন অংশ বিলীন হ’তে পারে এমন আশংকা থেকে আবুবকর (রাঃ) কুরআন সংকলনের কাজ আরম্ভ করেন।[29] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সময় কুরআন লিপিবদ্ধ ও মুখস্থ করে স্মৃতিতে ধরে রাখার কাজ সমাপ্ত হয়। সেগুলো বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্নভাবে রক্ষিত ছিল। আবুবকর (রাঃ) বিক্ষিপ্ত অংশগুলোকে একত্রিত করে সংকলনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করলেন। অন্যদিকে ১২ হিজরী মোতাবেক ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত ইয়ামামার যুদ্ধে ৫শ’ মতান্তরে ৬৬০জন ছাহাবী শহীদ হন।[30] অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ঐ যুদ্ধে ৭০০ মুসলিম যোদ্ধা শহীদ হন। যাদের মধ্যে ৭০জন ছিলেন কুরআনের হাফেয।[31] এমন পরিস্থিতিতে সর্বপ্রথম ওমর (রাঃ) আবুবকর (রাঃ)-কে কুরআন সংকলনের জন্য অনুরোধ করেন।

অহি লেখক যায়েদ ইবনু ছাবিত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইয়ামামার যুদ্ধে বহু লোক শহীদ হবার পর আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) আমাকে ডেকে পাঠালেন। এ সময় ওমর (রাঃ)ও তাঁর কাছে উপস্থিত ছিলেন। আবুবকর (রাঃ) বললেন, ওমর (রাঃ) আমার কাছে এসে বললেন, ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদদের মধ্যে ক্বারীদের সংখ্যা অনেক। আমি আশংকা করছি, এমনিভাবে যদি ক্বারীগণ শহীদ হয়ে যান, তাহ’লে কুরআন মাজীদের বহু অংশ হারিয়ে যাবে। অতএব আমি মনে করি যে, আপনি কুরআন সংকলনের নির্দেশ দিন। উত্তরে আমি ওমর (রাঃ)-কে বললাম, যে কাজ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) করেননি, সে কাজ তুমি কিভাবে করবে? ওমর (রাঃ) জবাবে বললেন, আল্লাহর কসম! এটা একটি উত্তম কাজ।

ওমর (রাঃ) এ কথাটি আমার কাছে বার বার বলতে থাকলে অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা এ কাজের জন্য আমার বক্ষকে উন্মোচন করে দিলেন এবং এ ব্যাপারে ওমর যা ভাল মনে করলেন আমিও তাই করলাম। যায়েদ (রাঃ) বলেন, আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) আমাকে বললেন, তুমি একজন বুদ্ধিমান যুবক। তোমার ব্যাপারে আমার কোন সংশয় নেই। তদুপরি তুমি রাসূল (ছাঃ)-এর অহি লেখক ছিলে। সুতরাং তুমি কুরআন মাজীদের অংশগুলোকে তালাশ করে একত্রিত কর। আল্লাহর শপথ! তারা যদি আমাকে একটি পর্বত এক স্থান হ’তে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিতেন, তাহ’লেও তা আমার কাছে কুরআন সংকলনের নির্দেশের চেয়ে কঠিন বলে মনে হ’ত না। আমি বললাম, যে কাজ রাসূল (ছাঃ) করেননি, আপনারা সে কাজ কিভাবে করবেন? তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! এটা একটা কল্যাণকর কাজ।

এ কথাটি আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) আমার কাছে বার বার বলতে থাকেন, অবশেষে আল্লাহ আমার বক্ষকে উন্মোচন করে দিলেন এ কাজের জন্য, যে কাজের জন্য তিনি আবুবকর এবং ওমর (রাঃ)-এর বক্ষকে উন্মোচন করে দিয়েছিলেন। এরপর আমি কুরআন অনুসন্ধানের কাজে লেগে গেলাম এবং খেজুর পাতা, প্রস্তরখন্ড ও মানুষের বক্ষ থেকে তা সংগ্রহ করতে থাকলাম। এমনকি আমি সূরাহ তওবার শেষাংশ আবূ খুযায়মাহ আনছারী (রাঃ) থেকে সংগ্রহ করলাম। এ অংশটুকু তিনি ব্যতীত আর কারো কাছে পাইনি। আয়াতগুলো হচ্ছে এই, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট এসেছেন তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল, যার নিকট তোমাদের দুঃখ-কষ্ট বড়ই দুঃসহ। তিনি তোমাদের কল্যাণের আকাঙ্ক্ষী। তিনি মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়ালুু’ (তওবা ৯/১২৮)। এরপর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তুমি বলো, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই। আমি তাঁরই উপর নির্ভর করি এবং তিনি মহা আরশের অধিপতি’ (তওবা ৯/১২৯)। তারপর সংকলিত ছহীফাসমূহ মৃত্যু পর্যন্ত আবুবকর (রাঃ)-এর কাছে রক্ষিত ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তা ওমর (রাঃ)-এর কাছে সংরক্ষিত ছিল, যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন। অতঃপর তা ওমর (রাঃ)-এর কন্যা হাফছাহ (রাঃ)-এর কাছে সংরক্ষিত ছিল’।[32]

আবুবকর (রাঃ) কুরআন সংকলনের বিষয়ে ওমর (রাঃ) ও যায়েদ (রাঃ)-কে বলেন, ‘তোমরা দু’জন মসজিদের দরজায় বস। কেউ আল্লাহর কিতাবের কোন অংশ দু’জন সঙ্গীসহ নিয়ে আসলে তা লিপিবদ্ধ করবে’।[33] এই নির্দেশনার আলোকে যায়েদ (রাঃ) দীর্ঘ এক বছরের প্রচেষ্টায় কুরআন সংকলনের কাজ শেষ করেন। যখন কোন সূরা বা আয়াত তাঁর নিকটে আনা হ’ত তখন তিনি হাফেযদের স্মৃতিতে রক্ষিত কুরআনের সাথে তা মিলিয়ে দেখতেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সামনে লিপিবদ্ধ হয়েছে কি-না তাও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। দু’জনের কাছে লিখিত আয়াত একই রকম হ’লেই কেবল তা গ্রহণ করতেন। সূরা তওবার শেষ দু’টি আয়াত শুধু আবু খুযায়মাহ আল-আনছারী (রাঃ)-এর নিকট পেয়েছিলেন। অন্যদের কাছে পাননি।[34] এই দু’টি আয়াত অন্য কারো কাছে পাওয়া না গেলেও তিনি গ্রহণ করেন। কারণ এ দু’টি আয়াতের পক্ষে হিফয ও লিখন দু’ধরনের সাক্ষী ছিল। তাছাড়া আয়াত দু’টি যায়েদসহ হাফেযদের স্মৃতিতে সংরক্ষিত ছিল। আবুবকর (রাঃ)-এর সময় সংকলিত কুরআন সেটি, যা জিব্রীল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে তাঁর জীবনের শেষ বছরে উপস্থাপন করেছিলেন। আবুবকর (রাঃ) সংকলিত কুরআনকে উম্ম বা আদি কুরআন বলা হয়। এটি সাত ক্বিরাআতে হীরার[35] হস্তাক্ষরে লেখা হয়।[36] তিনি মৃত্যুর পূর্বে সংকলিত মূল কুরআন উম্মুল মুমিনীল হাফছাহ (রাঃ)-এর নিকট হস্তান্তর করেন।

ওছমান (রাঃ)-এর সময় কুরআন সংকলন :

ওছমান (রাঃ) ৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম জাহানের তৃতীয় খলীফা হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁকে ‘জামেঊল কুরআন’ বলা হয়। কুরআন সংকলন তাঁর জীবনের মহৎ কীর্তি। দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ)-এর শাসনামলে (৬৩৪-৬৪৪ খৃ.) রোমান ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যসহ বহু অঞ্চল মুসলিম সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। মূলত তখন ইসলাম আরবের গন্ডি পেরিয়ে রোম ও ইরানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বিজিত অঞ্চলে দলে দলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। ফলে এ অঞ্চলগুলোতে মানুষের মধ্যে কুরআন পাঠে ভিন্নতা দেখা দেয়। এমনকি মানুষের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক, একে অপরকে অবজ্ঞা ও হেয় প্রতিপন্ন করা এবং রেষারেষি শুরু হয়। এই পরিস্থিতির মধ্যে হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) সিরিয়া ও ইরাক যোদ্ধাদের সাথে আর্মেনিয়া ও আজারবাইযান অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে কুরআন পাঠের ভিন্নতা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। বিষয়টি অবগত হয়ে ওছমান (রাঃ) করণীয় নির্ধারণ করার জন্য অভিজ্ঞ ছাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেন। যাঁদের মধ্যে আলী (রাঃ)ও ছিলেন। ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে, হাফছাহ (রাঃ)-এর নিকটে রক্ষিত কপি হ’তে অনুলিপি প্রস্ত্তত করে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করতে হবে। এরপর হাফছাহ (রাঃ)-এর সাথে যোগাযোগ করা হ’লে তিনি তাঁর কাছে রক্ষিত কুরআনের কপিগুলো ওছমান (রাঃ)-এর কাছে পাঠিয়ে দেন।[37]

ইমাম বুখারী স্বীয় গ্রন্থে এভাবে উল্লেখ করেছেন যে, আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুযায়ফাহ ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) একবার ওছমান (রাঃ)-এর কাছে আসলেন। এ সময় তিনি আরমিনিয়া ও আযারবাইজান বিজয়ের ব্যাপারে সিরীয় ও ইরাকী যোদ্ধাদের জন্য যুদ্ধ-প্রস্ত্ততির কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কুরআন পাঠে তাঁদের মতবিরোধ হুযাইফাকে ভীষণ চিন্তিত করল। সুতরাং তিনি ওছমান (রাঃ)-কে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! কিতাব সম্পর্কে ইহুদী ও নাছারাদের মতপার্থক্যে লিপ্ত হবার পূর্বে এই উম্মতকে রক্ষা করুন। তারপর ওছমান (রাঃ) হাফছাহ (রাঃ)-এর কাছে এক ব্যক্তিকে এ বলে পাঠালেন যে, আপনার কাছে সংরক্ষিত কুরআনের ছহীফাসমূহ আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন, যাতে আমরা সেগুলোকে পরিপূর্ণ মাছহাফসমূহে লিপিবদ্ধ করতে পারি। এরপর আমরা তা আপনার কাছে ফিরিয়ে দেব। হাফছাহ (রাঃ) তখন সেগুলো ওছমান (রাঃ)-এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এরপর ওছমান (রাঃ) যায়েদ ইবনু ছাবিত (রাঃ), আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাঃ), সাঈদ ইবনুল আছ (রাঃ) এবং আব্দুর রহমান ইবনু হারিছ ইবনে হিশাম (রাঃ)-কে নির্দেশ দিলেন। তাঁরা মাছহাফে তা লিপিবদ্ধ করলেন। এ সময় ওছমান (রাঃ) তিনজন কুরাইশী ব্যক্তিকে বললেন, কুরআনের কোন ব্যাপারে যদি যায়েদ ইবনু ছাবিতের সঙ্গে তোমাদের মতভেদ দেখা দেয়, তাহ’লে তোমরা তা কুরাইশদের ভাষায় লিপিবদ্ধ করবে। কারণ কুরআন তাদের ভাষায় নাযিল হয়েছে। সুতরাং তাঁরা তাই করলেন। যখন মূল লিপিগুলো থেকে কয়েকটি পরিপূর্ণ গ্রন্থ লেখা হয়ে গেল, তখন ওছমান (রাঃ) মূল লিপিগুলো হাফছাহ (রাঃ)-এর কাছে ফিরিয়ে দিলেন। তারপর তিনি কুরআনের লিখিত মাছহাফ সমূহের এক একখানা মাছহাফ এক এক প্রদেশে পাঠিয়ে দিলেন এবং এছাড়া আলাদা আলাদা বা একত্রিত কুরআনের যে কপিসমূহ রয়েছে তা জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।[38]

কুরআন সংকলন কমিটি গঠন :

কুরআন সংকলনের জন্য ওছমান (রাঃ) পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সংকলন কমিটি গঠন করেন। কমিটির সদস্যবৃন্দ হ’লেন, যায়েদ বিন ছাবেত (রাঃ), আব্দুল্লাহ বিন যুবায়র (রাঃ), আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ), আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনিল আছ (রাঃ) ও আব্দুর রহমান ইবনুল হারেছ ইবনে হিশাম (রাঃ)।[39] কেউ কেউ একজন আনছার ও ৩জন মুহাজির ছাহাবীর সমন্বয়ে চার সদস্যের কমিটির কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা হলেন, যায়েদ, আব্দুল্লাহ বিন যুবায়র, সাঈদ ইবনুল আছ ও আব্দুর রহমান ইবনুল হারেছ।[40] যায়েদ ইবনে হারেছ (রাঃ) আবুবকর (রাঃ)-এর সময়ও কুরআন সংকলনের গুরু দায়িত্ব পালন করেন। চার সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটির মধ্যে যায়েদ ইবনে ছাবেত (রাঃ) ছিলেন আনছারী এবং বাকী ৩জন ছিলেন কুরায়শী। তাঁরা ২৫ হিজরীতে কুরআন সংকলনের কাজ শুরু করেন। ওছমান (রাঃ) তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘কুরআনের কোন শব্দের ব্যাপারে যায়েদ ইবনে ছাবেত (রাঃ)-এর সাথে তোমাদের মতপার্থক্য হ’লে কুরায়শী ভাষায় লিপিবদ্ধ করবে। কারণ এই কিতাব তাদের ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে’।[41] কমিটির সকল সদস্য কুরআনের হাফেয হ’লেও তাঁরা হাফছাহ (রাঃ)-এর নিকট থেকে সংগৃহীত কপির উপর ভিত্তি করে কুরআনের কয়েকটি কপি প্রস্ত্তত করেন। গ্রন্থাকারে কুরআনের নতুন কপি প্রস্ত্তত হওয়ার পর মূল কপি পুনরায় হাফছাহ (রাঃ)-এর নিকট ফেরৎ পাঠানো হয়। আবুবকর (রাঃ)-এর সময়ে তৈরীকৃত কুরআনের ন্যায় ওছমান (রাঃ)-এর সময় প্রস্ত্ততকৃত কুরআনে হরকত ও নুকতা ছিল না। তবে তিনি সাত ক্বিরাআতের পরিবর্তে এক ক্বিরাআত, আঞ্চলিক একাধিক ভাষার পরিবর্তে প্রমিত এক ভাষায় কুরআন সংকলন করেছিলেন।[42] সে কারণে কুরআনের কপি বিভিন্ন প্রদেশে পাঠানোর সময় সাথে একজন ক্বারীকেও প্রেরণ করা হ’ত। যাতে তিনি জনগণকে একই পদ্ধতির ক্বিরাআতে প্রশিক্ষণ দিতে পারেন। যেমন- আব্দুল্লাহ ইবনে সায়ব (রাঃ)-কে মক্কায়, আল-মুগীরা ইবনে শিহাব (রাঃ)-কে সিরিয়ায়, আবু আবদিল্লাহ আস-সুলামা (রাঃ)-কে কূফায়, আমর ইবনে ক্বায়েস (রাঃ)-কে বছরায় এবং যায়েদ ইবনে ছাবেত (রাঃ)-কে মদীনায় প্রেরণ করা হয়।[43]

কুরআন সংকলনের সিদ্ধান্তে ছাহাবায়ে কেরাম খুশীতে বিমোহিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আপনার সিদ্ধান্ত কতইনা উত্তম এবং আপনি চমৎকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন’।[44] ওছমান (রাঃ)-এর সমালোচনাকারীদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে আলী (রাঃ) বলেন, ‘ওহে জনগণ! ওছমানের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করো না, তাঁর ব্যাপারে ভাল বৈ অন্য কিছু বল না। আল্লাহর শপথ! কুরআন সংকলনের ব্যাপারে তিনি তো আমাদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আল্লাহর শপথ! আমি যদি দায়িত্বে থাকতাম তবে অনুরূপ সিদ্ধান্তই নিতাম’।[45]

কুরআনে হরকত ও নুকতা সংযোজন :

কুরআন নাযিলের সময় তাতে কোন হরকত ও নুকতা ছিল না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হরকত ও নুকতা ছাড়াই কুরআন সংরক্ষণ করে গেছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম আরবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় কুরআনের পঠন-পাঠনে কোন সমস্যা হয়নি। তাছাড়া কোন সমস্যা হ’লে তাৎক্ষণিক রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছ থেকেই তার সমাধান পাওয়া যেত। আবুবকর (রাঃ)-এর সময় কুরআন হুবহু সেভাবেই সংকলন করা হয়েছে। ওছমান (রাঃ)ও এক্ষেত্রে কোন সংযোজন করেননি। পরবর্তীতে অনারব ভাষাভাষী বহু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলে কুরআন পাঠে দুর্বোধ্যতা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কুরআনে হরকত ও নুকতা সংযোজন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি কে করেছিলেন তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। একটি অংশ বলেছেন, বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ আবুল আসাদ দুআলী এ মহৎ কাজটি করেছেন। তিনি আলী (রাঃ)-এর সম্মতি নিয়েই তা করেন। উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক (৬৪৬-৭০৫ খৃ.)-এর নামও ঐতিহাসিক সূত্রে পাওয়া যায়। তিনি আরবীকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান করলে আরবী শিক্ষার ব্যাপারে মানুষ ব্যাপক তৎপর হয়ে ওঠে। তাঁর আমলে আরবী ব্যাকরণও আবিষ্কার হয়। তাঁর সময়ে হরকত ও নুকতা সংযোজনের এটিও কারণ হ’তে পারে।

আবার উমাইয়া খিলাফতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হাজ্জাজ বিন ইউসুফ (৬৬১-৭১৪)-এ কাজটি করেছিলেন বলে আরেকটি অংশ মত প্রকাশ করেছেন। তিনি ইয়াহ্ইয়া বিন ইয়ামার (রহঃ) ও নাছর বিন আছেম (রহঃ)-এর সহায়তায় সংযোজনের কাজটি সমাপ্ত করেন। পরবর্তীতে আরবী ভাষা সকল ভাষাভাষী মানুষের জন্য সহজীকরণ করার লক্ষ্যে ভাষাবিজ্ঞানীদের গবেষণার ভিত্তিতে আরবী অক্ষরেও হরকত ও নুকতা সংযোজন করা হয়, যা কুরআনেও সন্নিবেশিত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে সাড়ে ৬ কোটির বেশী কুরআনের হাফেয রয়েছেন।[46] মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বেই মুসলমানদের উদ্যোগে কুরআনের লাখ লাখ কপি হাতে প্রস্ত্তত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যায়।

উপসংহার :

মুখস্থকরণ ও লিখনের মাধ্যমে কুরআন সংকলন এবং সংরক্ষণের ধারা মহানবী (ছাঃ) থেকে অদ্যাবধি অব্যাহত আছে। ১৪শ’ বছর আগে হস্তাক্ষরে লেখা কুরআনের সাথে আধুনিক কম্পিউটার যুগের কুরআনের কোন পার্থক্য নেই। অদ্যাবধি এতে কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন কিংবা সংযোজন-বিয়োজন হয়নি। আর হবেও না ইনশাআল্লাহ। কেননা মহান আল্লাহ নিজেই কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন (হিজর ১৫/৯)। বিশ^ব্যাপী কুরআনের কোটি কোটি হাফেয রয়েছেন। সবগুলো কুরআন পুড়িয়ে ফেললেও নতুন কুরআন ছাপাতে কোন বেগ পেতে হবে না। পৃথিবীতে এমন কোন গ্রন্থ নেই যা কুরআনের ন্যায় মানুষের স্মৃতিতে আগাগোড়া সংরক্ষিত আছে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে কুরআনের মর্যাদা রক্ষার তাওফীক দান করুন- আমীন!

 ড. মুহাম্মাদ আজীবর রহমান

রেজিস্ট্রার ও সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ,
নর্থবেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী।


[1]. মুফতী আহমাদ ইয়ার খান নঈমী, তাফসীরে নঈমী (ইলাহাবাদ : মাকতাবাতুল হাবীব জামি‘আ হাবীবিয়া, তাবি), ১ম খন্ড, পৃ. ৮।

[2]. দারেমী হা/৩৩৭০, সনদ হাসান; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩১৭৩৮।

[3]. ড. মোহাম্মদ আব্দুল অদুদ, বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ (ঢাকা : আল-কুরআন ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ একাডেমী, মার্চ ২০০৪), পৃ. ৯-১০।

[4]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় সংস্করণ, ১৪৩৭ হি./২০১৫ খ্রী.), পৃ. ৮৪।

[5]. ছুবহী ছালিহ, মাবাহিছ ফী উলূমিল কুরআন (বৈরূত: দারুল ইলম লিল মালাঈন, ১৯৯৯), পৃ. ৭৩।

[6]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৭৭৪; নিসা ৪/৮২।

[7]. বাক্বারাহ ২/৯৭; শু‘আরা ২৬/১৯৪; তাকভীর ৮১/১৯।

[8]. মায়েদাহ ৫/৬৭; নাহল ১৬/৪৪, ৬৪।

[9]. আলে ইমরান ৩/৩; ইসরা ১৭/১০৬; ফুরক্বান ২৫/৩২; যুমার ৩৯/২৩।

[10]. সীরাতে ইবনু হিশাম ১/২৩৬; সূরা ক্বদর ৯৭/১-৫; ড. আকরাম যিয়া উমরী, সীরাহ ছহীহাহ ১/১২৫

[11]. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ. ৮০১।

[12]. বুখারী, ‘কুরআনের মর্যাদা’ অধ্যায়, ‘কুরআন সংরক্ষণ’ অনুচ্ছেদ।

[13]. বুখারী হা/১৯৭৮, ৫০৫২-৫৪; মুসলিম হা/১১৫১-২; তিরমিযী হা/২৯৪৯; নাসাঈ হা/২৩৯০, ২৪০০।

[14]. বুখারী হা/১১৩।

[15]. মাবাহিছ ফী উলূমিল কুরআন পৃ. ১০১।

[16]. প্রফেসর ড. আলী ইবনু সুলায়মান আল-আবীদ, জামউল কুরআনিল কারীম হিফযান ওয়া কিতাবান, (সঊদী আরব : জামি‘আতুল ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সঊদ আল-ইসলামিয়াহ, তাবি.), পৃঃ ২৫।

[17]. তিরমিযী হা/৩৯৫৪; আহমাদ হা/২১৬৪৭; বুখারী হা/৪৯৮৬, ৭১৯১; ফাতহুল বারী ৯/১১ পৃঃ; জামউল কুরআনিল কারীম হিফযান ওয়া কিতাবান, পৃঃ ২৭-২৮।

[18]. বুখারী হা/৪৯৯০।

[19]. তাবারাণী, মু‘জামুল আওসাত; নূরুদ্দীন হায়ছামী, মাজমাউয যাওয়াইদ, ১/১৫২, হা/৬৮৪, এর বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য।

[20]. মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১১শ খন্ড (সঊদী আরব : মাজমাউ মালিক, ১৯৯৫), পৃ. ৭-৮১।

[21]. বুখারী হা/৫০৩৩; মিশকাত হা/২১৮৭; ছহীহুল জামে‘ হা/২৯৫৬।

[22]. বুখারী হা/৫০৩১; মুসলিম হা/৭৮৯; আহমাদ হা/৪৬৬৫।

[23]. দারেমী হা/৩৩১৯, সনদ ছহীহ; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩০০৭৯।

[24]. দারেমী হা/৩৩২৩, সনদ ছহীহ।

[25]. মুস্তাদরাকে হাকেম হা/২৮৭৫, ২/২৪১ পৃঃ, সনদ ছহীহ; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৭৯৫৩।

[26]. বুখারী হা/৩৬২৪; ছহীহাহ হা/৩৫২৪; ছহীহুল জামে‘ হা/২০৫৪।

[27]. আহমাদ, তিরমিযী হা/৩০৮৬; আবুদাঊদ হা/৭৮৬; মিশকাত হা/২২২২ ‘কুরআনের ফযীলত সমূহ’ অধ্যায়।

[28]. বুখারী হা/৪৯৯৭, ৪৯৯৮।

[29]. মুহাম্মাদ ইবনু আবী বকর আব্দুল্লাহ ইবনে মূসা আল-আনছারী (৬৪৫ হিঃ), আল-জাওহারাহ ফী নাসাবিন নাবী ওয়া আছহাবিহিল আশারাহ, (রিয়ায : দারু রিপাঈ, ১ম প্রকাশ, ১৪০৩হি./১৯৮৩খ্রী.), ২/১৭৩।

[30]. জামউল কুরআনিল কারীম হিফযান ওয়া কিতাবান, পৃ. ৩০।

[31]. আল্লামা আহমাদ ইবনু ইয়াহ্ইয়া ইবনে জারির আল-বাগদাদী বালাযুরী (রঃ), ফুতূহুল বুলদান (ইফাবা, ১৯৯৮), পৃ. ৮৯; জামউল কুরআনিল কারীম হিফযান ওয়া কিতাবান, পৃ. ৩০।

[32]. বুখারী, ‘কিতাবু ফাযাইলিল কুরআন’, ‘বাবু জাম’ইল কুরআন’, হা/৪৯৮৬, ২৮০৭; ‘কিতাবুত তাফসীর’ হা/৪৩১১।

[33]. জালালুদ্দীন আস-সুয়ূতী, আন-ইতকান ফী ঊলূমিল কুরআন (কায়রো : মাতবাআ হিজাযী, ১৯৪১), ১/১০০; ড. আব্দুল ক্বাইয়ূম আব্দুল গফুর আস-সানাদী, জামউল কুরআনিল কারীম ফী আহদিল খুলাফাইর রাশেদীন, পৃঃ ১৮।

[34]. বুখারী হা/৪৯৮৬।

[35]. হীরা আরবের একটি প্রাচীন গোত্রের নাম। দ্রঃ ওমর ইবনু রিযা কুহালা, মু‘জামু ক্বাবাইলিল আরব আল-ক্বাদীমাহ ওয়াল হাদীছাহ, (বৈরূত : মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ৭ম সংস্কারণ, ১৪১৪হি./ ১৯৯৪খ্রী.), ১/৩২২।

[36]. ১৩ হিজরীতে শুরু হয়ে পূর্ণ এক বছর মতান্তরে প্রায় দু’বছরে সমাপ্ত হয়। দ্র. তাহের আল-কুরদী, তারীখুল কুরআনিল কারীম, ১ম খন্ড, পৃ. ২৮।

[37]. ফাতহুল বারী, ৮/৬৭৮-৭৯।

[38]. বুখারী হা/৪৯৮৭, ৩৫০৬; মিশকাত হা/২২২১।

[39]. জাম‘উল কুরআনিল কারীম ফী আহদিল খুলাফাইর রাশিদীন, পৃঃ ৩৩।

[40]. ঐ, পৃঃ ৩৩।

[41]. বুখারী, ‘কিতাবু ফাযাইলিল কুরআন’ ‘বাবু জামইল কুরআন’।

[42]. তাকি উছমানী, উলূমুল কুরআন, পৃ. ১৮৬-৮৭।

[43]. ড. যুবাইর মুহাম্মাদ এহসানুল হক, আমীরুল মুমিনীন ওছমান ইবনু আফফান (রাঃ) থেকে কুরআন সংকলনের ইতিহাস। গৃহীত আয়ওয়াউল বায়ান ফী তারীখিল কুরআন, পৃ. ৭৭।

[44]. ফিতনাতু মাকতালি ওছমান, ১/৭৮।

[45]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী, ৯/১১।

[46]. বার্তা ২৪.কম, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩।






বিষয়সমূহ: কসম ও মানত
সীমালংঘন ও দুনিয়াপূজা : জাহান্নামীদের দুই প্রধান বৈশিষ্ট্য (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
খেয়াল-খুশির অনুসরণ - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আহলেহাদীছ মসজিদে হামলা : ইসলামী লেবাসে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন (ফেব্রুয়ারী’২১ সংখ্যার পর) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
মাদ্রাসার পাঠ্যবই সমূহের অন্তরালে (৯ম কিস্তি) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
তাক্বলীদের বিরুদ্ধে ৮১টি দলীল - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
যাকাত সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে শিথিলতা : আমাদের করণীয় (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
হেদায়াতের পথে প্রতিবন্ধকতা - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আহলেহাদীছ জামা‘আতের বিরুদ্ধে কতিপয় মিথ্যা অপবাদ পর্যালোচনা (২য় কিস্তি) - তানযীলুর রহমান - শিক্ষক, বাউটিয়া দাখিল মাদ্রাসা, রাজশাহী
পিতা-মাতার উপর সন্তানের অধিকার - মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলাম
মাদ্রাসার পাঠ্যবই সমূহের অন্তরালে (৬ষ্ঠ কিস্তি) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মুনাফিকী (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আরও
আরও
.