রংপুর
তারাগঞ্জ উপযেলার নিচু প্রত্যন্ত এলাকা মেনানগর। এক যুগ আগেও এ গ্রামের
বাসিন্দারা ছিল অভাবী। কার্তিকের মঙ্গা শুধু নয়, ফসলাদি ভাল হ’ত না বলে ১২
মাস অভাব লেগে থাকত। কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই। ধানক্ষেতের পানিতে মাছ
চাষ, গর্ত ও পুকুরের মাছের সঙ্গে হাঁস পালন ও জমির আইলে সুপারি গাছ লাগিয়ে
এই গ্রামের মানুষ ভাগ্য বদলে ফেলেছেন। এছাড়া বসতভিটার পরিত্যক্ত জমিতে চলছে
সবজির চাষ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পালন করা হচ্ছে হাঁস, মুরগি, কবুতর, ছাগল
ও গাভি। এভাবে ঐ গ্রামের দারিদ্র্যপীড়িত দুই শত পরিবারের বেশীর ভাগেরই
অবস্থা আজ সচ্ছল।
আর গ্রামবাসীর ভাগ্য বদলের কারিগর হলেন ঐ গ্রামের বাসিন্দা ও উপযেলার হাড়িয়ালকুটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। নাম তাঁর সোলায়মান আলী। ১২ বছর ধরে গ্রামবাসীকে তিনি শেখাচ্ছেন চাষবাস ও পশুপাখি পালনের নতুন কৌশল।
সোলায়মানের সংগ্রাম : সোলায়মান অন্যের বাড়িতে জায়গির থেকে ১৯৮৫ সালে স্নাতক পাস করেন। অনেক ঘোরাঘুরি করে চাকরি না পেয়ে ১৯৮৯ সালে নিজ উদ্যোগে তিনি একটি পুকুরে মাছ চাষ শুরু করেন। এতে কিছু লাভ হওয়ায় তাঁর উৎসাহ বেড়ে যায়। কিন্তু এজন্য প্রয়োজনীয় টাকা সোলায়মানের হাতে ছিল না। বাবার কাছে টাকা চেয়ে না পেয়ে রাগ করে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। ১৯৯০ সালে সোলায়মান সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের চাকরি পেয়ে যান। টানা চার বছর চাকরি করে সেই অর্থ নিয়ে বাড়ি ফেরেন ১৯৯৪ সালে। এ বছরই একটি পুকুর খনন করে শুরু করেন মাছ ও হাঁসের চাষ। পাশাপাশি পুকুর পাড়ের চারদিকে পাঁচ শত সুপারির চারা রোপণ করেন। সেই সঙ্গে শুরু করেন ধান চাষ। কিন্তু সার, কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণের অগ্নিমূল্যের কারণে ধান চাষে তিনি লাভ করতে পারেননি। ফলে ১৯৯৮ সালে তিনি এক একর জমির ধানক্ষেতে মাছের চাষ করেন।
সোলায়মানের অর্জন : ১৬ বছর ধরে হাঁস ও মাছ চাষ এবং সুপারিগাছ লাগিয়ে সোলায়মান আধা পাকা বাড়ি করেছেন। দামি কাঠের আসবাবপত্রে সাজিয়েছেন ঘর। কিনেছেন চার একর জমি। জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য বসিয়েছেন দু’টি সেচপাম্প ও তিনটি শ্যালো মেশিন। বাড়িতে রয়েছে কবুতর, গাভি, ছাগল। খামারে রয়েছে ৬০০টি হাঁস। জমির চারদিকে লাগিয়েছেন এক হাযার সুপারি গাছ। ২৫ শতক জমিতে লিচু ও ২৮ শতক জমিতে আম-কাঁঠালের বাগান করেছেন। এ বছর চার একর ধানক্ষেতে মাছ চাষ করেছেন। তিনটি পুকুরের পানির উপর খামার করে করছেন মাছ ও হাঁসের চাষ। এখন তাঁর খামারে দু’জন কর্মচারী কাজ করছেন।
২০০৪ সালে উপযেলা কৃষি বিভাগ সোলায়মানকে আদর্শ কৃষকের ও ২০০৫ সালে মৎস্য বিভাগ দক্ষ মৎস্য চাষির পুরস্কার দেয়।
সোলায়মানের পথ ধরে : সোলায়মান গ্রামের বহু লোককে হাঁস ও মাছ চাষ এবং সুপারি গাছ লাগাতে উৎসাহিত করেছেন। মেনানগর গ্রামের অনেকেই তাঁর মতো চাষাবাদ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন।
ধানক্ষেতে মাছ চাষের পদ্ধতি : যে জমিতে কমপক্ষে তিন ইঞ্চি উচ্চতায় পানি রাখা সম্ভব তাতে মাছ চাষ করা যায়। প্রয়োজনীয় পানি আটকে রাখতে জমির চারদিকের আইলগুলো উঁচু করে দিতে হয়। ধান রোপণের ১৫-২০ দিনের মধ্যে জমিতে মাছের পোনা ছাড়তে হয়। শিং, মাগুর, সরপুঁটি, তেলাপিয়া, রুই, কাতলা, সিলভারকাপ চাষ করলে তুলনামূলকভাবে বেশী লাভ হয়। মাছ চাষ করলে খেতে কীটনাশক দেওয়া যায় না। মাছই ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের ডিম খেয়ে ফেলে। যারা ক্ষেতে দু’বার ইউরিয়া সার প্রয়োগ করেন, এক্ষেত্রে একই পরিমাণ সার তিন দফায় জমিতে দিতে হয়।
হাঁস দিয়ে ধানক্ষেত নিড়ানি : হাঁস দিয়ে ধানক্ষেত নিড়ানির কৌশল এক অভিনব উদ্ভাবন। খাবার সংগ্রহের সময় হাঁসগুলো ঠোঁট ও পা দিয়ে জমিতে বারবার আঘাত করে। এতে আগাছাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। রোপণের পর জমিতে ধান ছিটিয়ে দিলে হাঁস ধানক্ষেতে আসবে। ছিটানো ধান খাওয়ার সময় হাঁসগুলো ঠোঁট ও পা দিয়ে কাদায় বারবার আঘাত করবে। এতে নষ্ট হবে আগাছা ও আগাছার বীজ। এজন্য ধানগাছ রোপণের ১৫ দিন পর প্রতি একরে ১০ কেজি ধান ইউরিয়ার সারের মতো ছিটিয়ে দিতে হবে। এভাবে সাত দিন পরপর তিনবার ধান ছিটিয়ে দিতে হবে।
[সংকলিত]