ভুট্টা চাষ পদ্ধতি
গ্রীষ্মকালীন ভুট্টা চাষে এখনই উপযুক্ত সময়। শুভ্রা, বর্ণালী ও মোহর জাতের ভুট্টার জন্য হেক্টর প্রতি ২৫-৩০ কেজি এবং খই ভুট্টা জাতের ১৫-২০ কেজি হারে বীজ বুনতে হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৭৫ সেমি। সারিতে ২৫ সেমি দূরত্বে একটি গাছ রাখতে হবে। প্রতি হেক্টর জমিতে ২১৬-২৬৪ কেজি ইউরিয়া, ১৩২-২১৬ কেজি টিএসপি, ৭২-১২০ কেজি এমওপি, ৯৬-১৪৪ কেজি জিপসাম, ৭-১২ কেজি জিংক সালফেট, ৫-৭ কেজি বরিক এসিড ও ৪-৬ টন গোবর দিলে ফলন ভাল হয়।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি : জমি তৈরির শেষ পর্যায়ে ইউরিয়ার এক-তৃতীয়াংশ ও অন্যান্য সারের সবটুকু ছিটিয়ে জমি চাষ দিতে হবে। বাকি ইউরিয়া সমান ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তি বীজ গজানোর ২৫-৩০ দিন পর এবং দ্বিতীয় কিস্তি বীজ গজানোর ৪০-৫০ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে। চারা গজানোর ৩০ দিনের মধ্যে জমি থেকে অতিরিক্ত চারা তুলে ফেলতে হবে। চারার বয়স এক মাস না হওয়া পর্যন্ত জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
ভুট্টার বীজ পচা এবং চারা গাছের রোগ দমন : বীজ পচা এবং চারা নষ্ট হওয়ার কারণে সাধারণ ক্ষেতে ভুট্টা গাছের সংখ্যা কমে যায়। নানা প্রকার বীজ ও মাটি বাহিত ছত্রাক যেমন পিথিয়াম, রাইজকটনিয়া, ফিউজেরিয়াম, পেনিসিলিয়াম ইত্যাদি বীজ বপন, চারা ঝলসানো, গোড়া ও শিকড় পচা রোগ ঘটিয়ে থাকে। জমিতে রসের পরিমাণ বেশি হ’লে এবং মাটির তাপমাত্রা কম থাকলে বপনকৃত বীজের চারা বড় হ’তে অনেক সময় লাগে। ফলে এ সময় ছত্রাকের আক্রমণের মাত্রা বেড়ে যায়। এ রোগের প্রতিকার পেতে হ’লে সুস্থ, সবল ও ক্ষতমুক্ত বীজ এবং ভুট্টার বীজ পচা প্রতিরোধী বর্ণালী ও মোহর জাত ব্যবহার করতে হবে। ভালভাবে জমি তৈরি করে পরিমিত রস ও তাপমাত্রায় (১৩ ডিগ্রি সে. এর বেশি) বপন করতে হবে। থিরাম বা ভিটাভেক্স (০.২৫%) প্রতি কেজি বীজে ২.৫-৩.০ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করলে ভুট্টার বীজ পচা রোগের আক্রমণ অনেক কমে যায়।
ভুট্টার পাতা ঝলসানো রোগ ও প্রতিকার : হেলমিনথোসপোরিয়াম টারসিকাম ও হেলমিনথোসপোরিয়াম মেইডিস নামক ছত্রাক ভুট্টার পাতা ঝলসানো রোগ সৃষ্টি করে। হেলমিনথোসপোরিয়াম টারসিকাম ছত্রাক থেকে আমাদের দেশে ভুট্টার পাতা ঝলসানো রোগ বেশি হ’তে দেখা যায়। এ রোগে আক্রান্ত গাছের নীচের দিকের পাতায় লম্বাটে ধূসরে বর্গের দাগ দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে গাছের উপরের অংশে তা বিস্তার লাভ করে। রোগের প্রকোপ বেশি হ’লে পাতা আগাম শুকিয়ে যায় এবং গাছ মরে যায়। এ রোগের জীবাণু গাছের আক্রান্ত অংশে অনেক দিন বেঁচে থাকে। জীবাণুর বীজকণা বা কনিডিয়া বাতাসের সাহায্যে অনেক দূর পর্যন্ত সুস্থ গাছে ছড়াতে পারে। বাতাসের আর্দ্রতা বেশি হ’লে এবং ১৮-২৭ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় এ রোগের আক্রমণ বেড়ে যায়। এ রোগ থেকে রক্ষা পেতে হ’লে রোগ প্রতিরোধী জাতের ভুট্টা ‘মোহর’ চাষ করতে হবে। আক্রান্ত ফসলে টিল্ট ২৫০ ইসি (০.০৪%) ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। ভুট্টা উঠানোর পর জমি থেকে আক্রান্ত গাছ সরিয়ে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
ভুট্টার মোচা-দানা পচা রোগ ও প্রতিকার : মোচা ও দানা পচা রোগ ভুট্টার ফলন, বীজের গুণাগুণ ও খাদ্যমান কমিয়ে দেয়। বিভিন্ন প্রকার ছত্রাক যথা ডিপ্লোডিয়া মেডিস, ফিউজেরিয়াম মনিলিফরমি প্রভৃতি এ রোগ ঘটায়। আক্রান্ত মোচার খোসা ও দানা বিবর্ণ হয়ে যায়। দানা পুষ্ট হয় না, কুঁচকে অথবা ফেটে যায়। অনেক সময় মোচাতে বিভিন্ন দানার মাঝে বা উপরে ছত্রাকের উপস্থিতি খালি চোখেই দেখা যায়। ভুট্টা গাছে মোচা আসা থেকে পাকা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত বেশি থাকলে এ রোগের আক্রমণ বাড়ে। পোকা বা পাখির আক্রমণে বা কান্ড পচা রোগে গাছ মাটিতে পড়ে গেলে এ রোগ ব্যাপকতা লাভ করে। রোগের জীবাণু বীজ অথবা আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশে বেঁচে থাকে। একই জমিতে বার বার ভুট্টার চাষ করলে এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এ রোগের প্রতিকার হচ্ছে- একই জমিতে বার বার ভুট্টার চাষ না করা, জমিতে পোকা ও পাখির আক্রমণ রোধ করা, ভুট্টা পেকে গেলে তাড়াতাড়ি কেটে ফেলা ও কাটার পর ভুট্টার পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলা।
ভুট্টার কান্ড পচা রোগ ও প্রতিকার : বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাক যথা ডিপ্লোডিয়া মেডিস, ফিউজেরিয়াম মনিলিফরমি-এর কারণে কান্ড পচা রোগ হয়ে থাকে। প্রাথমিক লক্ষণ হিসাবে গাছের কান্ড পচে যায় এবং গাছ মাটিতে ভেঙ্গে পড়ে। জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি এবং পটাশের পরিমাণ কম হ’লে ছত্রাকজনিত কান্ড পচা রোগ বেশি হয়। এ রোগ থেকে বাঁচতে হ’লে ছত্রাকনাশক ভিটাভেক্স-২০০ দিয়ে বীজ শোধন করে লাগাতে হবে, সুষম হারে সার ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে নাইট্রোজেন ও পটাশ পরিমিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে, ভুট্টা কাটার পর পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে, শিকড় ও কান্ড আক্রমণকারী পোকা-মাকড় দমন করতে হবে ও আক্রান্ত জমিতে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
ভুট্টা সংগ্রহ : দানার জন্য ভুট্টা সংগ্রহের ক্ষেত্রে মোচা চকচকে খড়ের রং ধারণ করলে এবং পাতা কিছুটা হলদে হ’লে সংগ্রহের উপযুক্ত হয়। এ অবস্থায় মোচা থেকে ছাড়ানো বীজের গোড়ায় কালো দাগ দেখা যাবে। ভুট্টা গাছের মোচা ৭৫-৮০ ভাগ পরিপক্ক হ’লে ভুট্টা সংগ্রহ করা যাবে। বীজ হিসাবে মোচার মাঝামাঝি অংশ থেকে বড় ও পুষ্ট দানা সংগ্রহ করতে হবে।
\ সংকলিত \