পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ ।

তাক্বলীদের যুগ :

তাক্বলীদ (التقليد) শব্দের আভিধানিক অর্থ হ’ল অন্ধ অনুসরণ। পারিভাষিক অর্থে قبول قول الغير من غير دليل অর্থাৎ কারো কোন কথাকে বিনা দলীলে গ্রহণ করার নাম হ’ল তাক্বলীদ।

তাক্বলীদের যুগ বলতে মাযহাবী তাক্বলীদকে বুঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তাক্বলীদের যুগ শুরু হয়েছে হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর পর। যদিও অন্ধ অনুসরণের সূচনা ঘটে আরো পূর্বে হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীতেই। ছাহাবায়ে কেরামের পর তাবেঈন, তাবে‘-তাবেঈন ও তৎপরবর্তী যুগে ইসলামী শরী‘আতের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামকে ‘ইমাম’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হ’ত। এ সকল মুজতাহিদ ইমামগণের ইজতিহাদকে কেন্দ্র করে পরবর্তী যুগে তাক্বলীদের ভিত্তিতে ফৎওয়া প্রদানের যে রীতি প্রচলিত হয় তাকেই তাক্বলীদ বলা হয়। আর এ যুগকে বলা হয় তাক্বলীদের যুগ।

খলীফা মামূনের যুগে (১৯৮-২১৮ হিঃ) গ্রীক দর্শনের যে আরবীয় অনুবাদ শুরু হয়েছিল, এ যুগে তার সাথে যুক্ত হয় ইহুদী, খৃষ্টানী, মজুসী, যবরদশতী, হিন্দুস্থানী জয়াথ্রুষ্ট, তুর্কী, ইরানী আরও বিভিন্ন রকমের অনৈসলামী দর্শনের বইপত্র, যা আরবীতে অনূদিত হয়ে ইসলামী বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতকে আন্দোলিত করে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, এসব জ্ঞান বিদ্বানদেরকে পথভ্রষ্টতায় নিক্ষেপ করে। তারা ছাহাবা যুগের গৃহীত পথ ছেড়ে দিয়ে স্ব-স্ব জ্ঞানের মাধ্যমে সার্বিক বিষয়ে সমস্যার সমাধান তালাশ করতে শুরু করেন। যার ফলে সৃষ্ট কালাম ও দর্শন শাস্ত্রের কুটতর্ক, বিভিন্ন মুজতাহিদ ইমামের ফিক্বহী মতপার্থক্য, ছূফীবাদের প্রসার ইত্যাদি মুসলমানদের সামাজিক ঐক্য ছিন্নভিন্ন করে দেয়।[1]

এছাড়াও ইসলামী রাজ্যের অস্বাভাবিক বিস্তার, অসংখ্য মানুষের ইসলামে দীক্ষিত হওয়া এবং বিভিন্ন ধর্ম, জাতি, বর্ণের মানুষের আদর্শ ও মতাদর্শ ইসলামের মাঝে অনুপ্রবেশ-প্রভৃতি সমগ্র আরব জাহান তথা মুসলিম জাহানে রীতিমত চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল।[2] ফলে নানা ঘটনা-উৎপ্রেক্ষার উত্থান-পতনে মহাকালের ইতিহাসে নিত্য-নতুন বিষয় প্রযুক্ত হ’তে থাকে। এমনি এক যুগ সন্ধিক্ষণে আবির্ভাব ঘটেছিল তাক্বলীদের। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মানব মনের স্বভাবগত একটি আদি বৈশিষ্ট্য হ’ল পূর্বসূরীদের মধ্যকার অনুসরণীয় ব্যক্তিদেরকে বিশেষ শ্রদ্ধার আসনে বসানো। এই শ্রদ্ধা কখনো স্বাভাবিক শ্রদ্ধা-অনুরাগের পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকে, আবার কখনো তা সীমা ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় এক পূজনীয় অস্পৃশ্য সিংহাসনে, যা থেকেই জনম নেয় মূর্তিপূজা, কবরপূজা, ওলী-আওলিয়া পূজা, গায়রুল্লাহর পূজা প্রভৃতি নানাবিধ শিরকী প্রবণতা।

আল্লামা হাজাভী আইম্মায়ে মুজতাহেদীনের যুগের পরিসমাপ্তি এবং তাক্বলীদের সূচনার যুগ সন্ধিক্ষণকে এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘ওলামায়ে কেরামের উপর তাক্বলীদের প্রভাব গেঁড়ে বসল এবং এতেই তারা স্বস্তিবোধ করলেন। তাক্বলীদের এই প্রভাব অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকায় ৪র্থ হিজরী শতকে ইজতিহাদের প্রচেষ্টা ক্রমেই হ্রাস পেতে লাগল। অধিকাংশ বিদ্বান ইমাম আবু হানীফা, মালেক, শাফেঈ, আহমাদ বিন হাম্বল এবং অন্যান্য ইমামদের প্রচলিত মাযহাবসমূহের দিকে ঝুঁকে পড়তে লাগলেন। আর সেসকল মাযহাবের উছূলকে তারা এমনভাবে অনুসরণ করা শুরু করলেন যেন তা থেকে আর বের হওয়ার নয়। ফলে এসকল ইমামের কথা কিতাব ও সুন্নাতের মত অলংঘনীয় দলীলে পরিণত হ’ল। ক্রমে ক্রমে ইসলামী শরী‘আতের সাথে মুসলিম উম্মাহর এক বিরাট দূরত্ব তৈরী হ’ল, যা তাদেরকে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত থেকে বিস্মৃতই করে দিল। আবার ভাষার বিভিন্নতার কারণে কিতাবুল্লাহ থেকেও মানুষ দূরে সরতে থাকল। ফলে আল্লাহ প্রেরিত রাসূলের পরিবর্তে ফক্বীহদের লিখিত গ্রন্থ ও মতামতসমূহই পরিণত হ’ল ইসলামী শরী‘আতে। যাদের মাঝে ইমামদের মতামত বোঝা ও ব্যাখ্যা করার যোগ্যতা ছিল তারা ‘মুজতাহিদুল মাযহাব’ হিসাবে পরিগণিত হ’লেন। আর স্বাধীন ইজতিহাদ এমনভাবে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ল যে, ইমাম নববী তাঁর ‘শারহে মুহায্যাব’ গ্রন্থে বলেন, ‘৪র্থ হিজরী শতকে তার আর অস্তিত্বই ছিল না।’ এমনকি বিধর্মীদের কথার মতই তা অগ্রহণীয় হয়ে পড়েছিল (وهو كلام غير مسلم)।[3]

তাক্বলীদের এই আগ্রাসন বিস্তার লাভ করার পিছনে কিছু মৌলিক কারণ রয়েছে। যা নিম্নরূপ-

প্রথমত : মুজতাহিদ ইমামদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে চরম বাড়াবাড়ি। দ্বিতীয়ত : সঠিক ইলমী রীতি অনুসরণ না করে ইমামদের রায়কেন্দ্রিক ফিক্বহী গ্রন্থ প্রণয়ন এবং তাতে জাল-যঈফ হাদীছের বিপুল সমাবেশ ঘটানো। তৃতীয়ত : ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী ইসলামী খেলাফত দুর্বল হয়ে পড়া এবং আমীর-উমারা ও শাসকবর্গের মাযহাবী পরিচয়ে পরিচিত হওয়া। চতুর্থত : মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসরণকারীদের অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়া এবং নিজ নিজ ইমামের মতকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য তৎপর হয়ে লেগে পড়া। পঞ্চমত : কতিপয় ওলামার এই দাবী তোলা যে, ‘প্রত্যেক মুজতাহিদই সঠিক, তাদের ভুলও গ্রহণযোগ্য এবং অনুসরণযোগ্য’।[4] এছাড়া ইজতিহাদের দাবী নিয়ে দ্বীনী জ্ঞানে স্বল্প অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, অযোগ্য লোকদের আবির্ভূত হওয়া, কাযীর পদ লাভের আশায় কতিপয় দুনিয়াদার আলেম নামধারীদের মাযহাবপন্থী শাসকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মাযহাবী ভড়ং ধরা, সাধারণ মানুষ কর্তৃক হাদীছ বিষয়ে অজ্ঞ লোকদের কাছে ফৎওয়ার জন্য শরণাপন্ন হওয়া প্রভৃতি কারণে ইজতিহাদভিত্তিক ফৎওয়ার স্থলে ইমামদের তাক্বলীদভিত্তিক ফৎওয়া জনসমাজে অধিক বিস্তার লাভ করে।[5] শাহ ওয়ালীউল্লাহর ভাষায়,أنهم اطمأنوا بالتقليد، ودب التقليد في صدورهم دبيب النمل وهم لا يشعرون. ‘তারা তাক্বলীদের মাঝেই প্রশান্তি খুঁজে নিল এবং নিজের অজান্তেই তাক্বলীদের রোগ তাদের অন্তরে পিপীলিকার ন্যায় সন্তর্পণে অনুপ্রবেশ করল’।[6]

তাক্বলীদ বা অন্ধ অনুসরণের এই যুগে মুক্বাল্লিদ ফৎওয়া প্রদানকারীদের মধ্যে পাঁচটি শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। শ্রেণীগুলি হ’ল-

এক. আল-মুজতাহিদূন ফিল মাযহাব (المجتهدون في المذهب) অর্থাৎ যারা স্বীয় মুজতাহিদের ফিক্বহ সংক্রান্ত অনুসৃত মত ও পথের অনুসারী হয়েও বিভিন্ন বিষয়ে নিজের ইমামের সাথে মতদ্বৈততা পোষণ করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজের অনুসৃত মাযহাবের মূলনীতি হ’তে বিচ্যুত হননি। তাদের অন্যতম হ’ল হানাফী মাযহাবের ইমাম হাসান ইবনু যিয়াদ, ইমাম আবূ ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ প্রমুখ। তবে ইমাম যুফার স্বয়ংসম্পূর্ণ মুজতাহিদ ছিলেন। মালিকীদের মধ্য হ’তে ইমাম আব্দুর রহমান ইবনুল কালিম ও শাফিঈদের মধ্য হ’তে ইউসুফ ইবন ইয়াহইয়া আল-বুওয়ায়তী ও ইসমাঈল ইবনু ইয়াহইয়া আল-মালিনী প্রমুখ প্রসিদ্ধ।[7]

দুই. আল-মুজতাহিদূন ফিল মাসাইল (المجتهدون في المسائل) অর্থাৎ মাসআলাসমূহে ইজতিহাদকারীগণ। যখন কোন মাযহাবের ইমাম হ’তে বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক ও সাধারণ বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট পথ নির্দেশনা পরিলক্ষিত না হ’ত, তখন ‘মুজতাহিদ ফিল-মাসাইল’ স্বীয় ইমামের মৌলিক নীতির অনুসরণে ফৎওয়া প্রদান করতেন।[8]

তিন. আছহাবুত তাখরীজ (أصحاب التخريج) অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত বিধি-বিধানের ব্যাখ্যাকারীগণ, যাদের প্রধান কাজ হ’ল নিজেদের অনুসৃত মাযহাবের সংক্ষিপ্ত বিধি-বিধানের ব্যাখ্যা এবং অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য বিষয়কে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা।

চার. আছহাবুত তারজীহ (أصحاب الترجيح) অর্থাৎ মৌলিক বিষয়ে অগ্রাধিকার দানকারী মুজতাহিদগণ। যারা স্বীয় মত ও পথের বিভিন্ন মুজতাহিদ ইমামগণের বিতর্কিত মতসমূহের মধ্য হ’তে কোন একটি বিশেষ মতকে মৌলিক প্রমাণাদির নিরিখে গ্রহণযোগ্য বলে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।

পাঁচ. আছহাবুত তাক্বলীদ আল-মুখাছছাছ (أصحاب التقليد المخصص) অর্থাৎ খাঁটি তাক্বলীদপন্থী ওলামা। যারা ফৎওয়া প্রদানকালীন স্বীয় ইমামের মত ও পথের বাইরে কখনো যান না।

বলা আবশ্যক যে, মাযহাবী তাক্বলীদের জন্য মহামতি ইমামগণ কোনমতেই দায়ী নন। কারণ আমরা স্পষ্ট করেই জেনেছি যে, চার ইমামের কোন ইমামই তাঁর মাযহাব অনুসরণের কথা বলেন। বরং তাঁরা প্রত্যেকেই পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করতে বলেছেন।

ইমাম গায্যালী বলেন, চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর পরবর্তী সময়ে আববাসীয় খলীফাগণ বিশেষ করে হানাফী-শাফেঈ বিতর্কে ইন্ধন যোগাতে থাকেন। ফলে উভয়পক্ষে অনেক ঝগড়া-বিবাদ ও লেখনী পর্যন্ত পরিচালিত হয়। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী বলেন, চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বেকার লোকেরা কোন একজন বিদ্বানের মাযহাবের উপরে নির্দিষ্টভাবে মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। কোন বিষয় সামনে এলে যে কোন বিদ্বানের নিকট হ’তে লোকেরা ফৎওয়া জিজ্ঞেস করে নিতেন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ব্যতীত তারা আর কারুরই অনুসরণ করতেন না। কিন্তু পরবর্তীতে এর ব্যতিক্রম ঘটে গেল। যেমন (ক) ফিক্বহ বিষয়ে মতবিরোধ (খ) বিচারকদের অন্যায় বিচার (গ) সমাজ নেতাদের মূর্খতা (ঘ) হাদীছশাস্ত্রে অনভিজ্ঞ ‘মুহাদ্দিছ’ ও ‘ফক্বীহ’ নামধারী লোকদের নিকটে ফৎওয়া তলব ইত্যাদি কারণে হকপন্থী কিছু লোক বাদে অধিকাংশ মানুষ হক্ব-বাতিল যাচাই করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে এবং প্রচলিত যে কোন একটি মাযহাবের তাক্বলীদ করেই ক্ষান্ত হয়।[9] অবশেষে মাযহাবী তাক্বলীদের বাড়াবাড়ির পরিণামে হানাফী-শাফেঈ দ্বন্দ্বে ও শী‘আ মন্ত্রীর ষড়যন্ত্রে ৬৫৬ হিজরীতে হালাকু খাঁর আগমনে বাগদাদের আববাসীয় খেলাফত ধ্বংস হয়ে যায়।[10]

ফলে তাক্বলীদের যুগে মুফতীগণ মূলতঃ মাযহাবকেন্দ্রিক ফৎওয়া প্রদানেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা হাদীছ বর্ণনায় ছহীহ-যঈফ বাছাইয়ের কোন তাকীদ অনুভব করতেন না। কেবলমাত্র পূর্ববর্তী ফক্বীহদের রায় অন্ধের মত মুখস্থ রাখতেন এবং সেই মোতাবেক ফৎওয়া দিতেন। তাদের রায়ের বরখেলাফ করা, এমনকি তার সত্যতা যাচাই করাকেও তারা অপরাধ গণ্য করতেন।[11] অথচ ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, لا يجوز الفتوى بالتقليد لأنه ليس بعلم والفتوى بغير علم حرام ولا خلاف بين الناس أن التقليد ليس بعلم وأن المقلد لا يطلق عليه اسم عالم- ‘তাক্বলীদের মাধ্যমে ফৎওয়া প্রদান জায়েয নয়। কেননা তাক্বলীদ ইলম নয়। আর ইলম ব্যতীত ফৎওয়া প্রদান হারাম।[12] তাক্বলীদ কোন ইলমই নয় এবং মুক্বাল্লিদকে আলেম বলা হয় না- এ বিষয়ে মানুষের মাঝে কোন মতভেদ নেই’। ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন, إن التقليد جهل وليس لعلم ‘তাক্বলীদ হ’ল মূর্খতা; ইলম বা জ্ঞান নয়’।[13]

এই বিপরীতমুখী স্রোতের মুখেও আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম তাদের সর্বোচ্চ সাধ্য দিয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের চর্চাকে সমাজে অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। তারা মাযহাবী শাসক অধ্যুষিত সাম্রাজ্যে কাযীর পদ থেকে নিজেদেরকে সযত্নে দূরে রাখতেন। এজন্য যেসকল হক্বপিয়াসী মানুষ মাযহাবপন্থী সরকারী আলেমদের ফৎওয়া অনুসরণ না করে হাদীছভিত্তিক ফৎওয়া অনুসন্ধান করতে চাইত, তারা আহলেহাদীছ আলেমদের কাছে যেতেন এবং তাদের ফৎওয়া অনুসরণ করতেন। এমনকি অনেক ঐতিহাসিকের মতে, বর্তমান যুগে বেসরকারীভাবে ফৎওয়া প্রদানের যে রীতি সর্বত্র প্রচলিত রয়েছে, তার সূচনা আহলেহাদীছ আলেমদের মাধ্যমেই ঘটেছিল আববাসীয় শাসনামলে তাক্বলীদী আগ্রাসনের যুগে।[14] 

এ যুগে রচিত প্রসিদ্ধ ফিক্বহী গ্রন্থসমূহ :

এ যুগে শাফেঈ মুফতীগণ অনুসরণ করতেন আবু ইসহাক আশ-শীরাযী (মৃঃ ৪৭৬ হিঃ)-কে এবং আবু হামেদ আল গায্যালীর (৫০৫ হিঃ) লিখিত কিতাবসমূহকে। হাম্বলীগণ অনুসরণ করতেন, ইবনু কুদামার (৬২০ হিঃ) লিখিত কিতাবুল মুক্বনি‘ কিতাবের। আর হানাফীরা অনুসরণ করতেন ইমাম ত্বহাভী (৩২১ হিঃ), ইমাম কারখী (৩৪০ হিঃ), আবু বকর আল-জাছ্ছাছ (৩৭০ হিঃ), আবুল হাসান আল-কুদূরী[15] (৩৪০ হিঃ) আবু বকর আল-মারগেনানী[16] (৫৯৩ হিঃ) প্রমুখের লিখিত ‘মুখতাছার’ ফিক্বহী গ্রন্থসমূহের। মালেকী মাযহাবের ইবনে রুশদের (৫৯৫ হিঃ) প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘বিদায়াতুল মুজতাহিদ ও নিহায়াতুল মুক্বতাছিদ’ এ সময়ই রচিত হয়।

অপরদিকে এ যুগে হাদীছের খেদমতে যে সকল ওলামায়ে কেরাম আত্মনিয়োগ করেন তাঁদের মধ্যে ইবনুল আছীর (৬০৬ হিঃ)-জামে‘উল উছূল, হাফেয আল-হায়ছামী (৮০৭ হিঃ)-মাজমাউ‘য যাওয়ায়েদ, খত্বীব তাবরীযী (৮ম শতাব্দী হিঃ)-মিশকাতুল মাছাবীহ। এছাড়া ইবনে হাযম (৪৫৬ হিঃ) রচিত ‘আল-মুহাল্লা’, ইবনে কুদামা রচিত ‘আল-মুগনী’ ও ইমাম নববী (৬৩১ হিঃ) রচিত ‘আল মাজমূ‘ শারহুল মুহায্যব’-এর মত গুরুত্বপূর্ণ ফিক্বহী গ্রন্থসমূহ এসময় রচিত হয়। এই গ্রন্থগুলি অন্যান্য মাযহাবী তাক্বলীদপন্থী ফিক্বহ গ্রন্থগুলোর মত কেবলই মাযহাবকেন্দ্রিক ছিল না বরং দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গভাবে অনুসরণের জন্য হাদীছভিত্তিক সঠিক ইলমী রীতি অবলম্বনপূর্বক লিখিত হয়েছিল। তাই আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম এসব কিতাবকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।

[চলবে

শিহাবুদ্দীন আহমাদ

পি-এইচ.ডি. গবেষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


[1]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৮৮; ড. ওমর সোলায়মান আল-আশকার, তারীখুল ফিক্বহিল ইসলামী (কুয়েত : দারুন নাফায়েস, ১৯৯১), ১১৫-১১৬ পৃঃ।

[2]. তারীখুল ফিক্বহিল ইসলামী, পৃঃ ১১৫-১১৬; আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৮৬-৮৮; ইবনুল কাইয়্যিম, ইলামুল মু‘আক্কেঈন, পৃঃ ১৪৫ ।

[3]. তারীখুল ফিক্বহিল ইসলামী, পৃঃ ১১৬।

[4]. তদেব, পৃঃ ১৪৬-৬২।

[5]. শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ (বৈরূত : দারু ইহয়াইল উলূম, ৩য় প্রকাশ, ১৯৯৯ইং), ১/৪৪০ পৃঃ।

[6]. তদেব।

[7]. খুলাছাতু তারীখিত তাশরীইল ইসলামী, পৃঃ ৯৫; মুফীদুল মুফতী, পৃঃ ৬২।

[8]. মজতাহিদীন ফিল মাসাইলের মধ্যে হানাফী মাযহাবের ইমাম আহমাদ ইবনু ওমর আল-খাসসাফ, ইমাম তাহাবী ও আবুল হাসান আল-ফারাযী, মালিকীদের মধ্য হ’তে আবুল ওয়ালীদ আল-বাজী আল-লুযামী, কুদরী আবু বাকর ইবনুল আরাবী, ইবনু রুশদ এবং শাফিঈদের মধ্য হ’তে ইমাম আবু ইসহাক আল-ইসফারাইনী, আবূ হামেদ আল-গাযালী (রহঃ) প্রমুখ প্রসিদ্ধ।

[9]. ই‘লামুল মুআক্কেঈন, পৃঃ ১৪৫; আহলেহাদীছ আন্দোলন, ৮৮-৮৯ পৃঃ।

[10]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৮৮-৮৯।

[11]. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, পৃঃ ১/৪৪২; মুহাম্মাদ জামালুদ্দীন আল-কাসেমী, আল-ফৎওয়া ফিল ইসলাম, তাহক্বীক : মুহাম্মাদ আব্দুল হাকীম ক্বাযী (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৮৬ ইং), পৃঃ ৪৩।

[12]. ই‘লামুল মুআক্কে‘ঈন ১/৪৬।

[13]. ইরশাদুল ফুহূল, পৃঃ ২৩৬

[14]. http://ar.wikipedia.org/wiki/فتوي

[15]. তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থটির নাম ‘মুখতাছারুল কুদূরী’।

[16]. তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থটির নাম ‘আল-হিদায়াহ’।






বিষয়সমূহ: প্রশ্নোত্তর
এক নযরে হজ্জ - আত-তাহরীক ডেস্ক
নেতার প্রতি আনুগত্যের স্বরূপ - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ : একটি পর্যালোচনা (জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী সংখ্যার পর) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আমানত (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান
আলেমগণের মধ্যে মতভেদের কারণ (১ম কিস্তি) - আব্দুল আলীম বিন কাওছার
লজ্জাশীলতা উত্তম চরিত্রের ভূষণ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
তাছফিয়াহ ও তারবিয়াহ : মুসলিম জীবনে এর প্রয়োজনীয়তা (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
রোহিঙ্গারা বাঁচতে চায় - লিলবর আল-বারাদী - যশপুর, তানোর, রাজশাহী
শরী‘আতের আলোকে জামা‘আতবদ্ধ প্রচেষ্টার মূলনীতি (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আল্লামা আলবানী সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব আরনাঊত্বের সমালোচনার জবাব (৪র্থ কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
মুসলমানদের রোম ও কন্সটান্টিনোপল বিজয় (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আরও
আরও
.