পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ ।
জড়তা ও স্থবিরতার যুগ :
৬৫৬ হিজরীতে (১২৫৮ খৃঃ) আববাসীয় শাসনামলের পতনের পর সমগ্র মুসলিম বিশ্ব জুড়ে নেমে আসে বিপর্যয়ের ঘনঘটা। এ বিপর্যয় ছিল বহুমুখী। তবে বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতার যে বিপদ তাদের উপর নেমে এসেছিল, তা ছিল সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক। রাজনৈতিক হতাশা তাদের কর্মজগত ও চিন্তাজগতকে জমাট ও অসাড় করে তুলেছিল। কোন জ্ঞানভিত্তিক প্রাগ্রসর চিন্তা-চেতনা তাদের মাঝে পরিলক্ষিত হ’ত না। বড় জোর পূর্ববর্তী ওলামায়ে কেরামের কিতাবসমূহ অধ্যয়ন ও তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকেই তারা যথেষ্ট মনে করতেন। এমনকি আববাসীয় আমলে তারা কালামশাস্ত্র সহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের আরো যেসকল শাখায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন তাও এ যুগে পরিত্যক্তপ্রায় হয়ে পড়ে। এজন্য এ যুগকে ‘জড়তা ও স্থবিরতার যুগ’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। আধুনিক যুগ তথা বিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ৭০০ বছর যাবৎ এ অবস্থাই অব্যাহতভাবে চলে আসছিল। অবশ্য এ অন্ধকার যুগেও সজীব ছিল হানাফী-শাফেঈ বিতর্ক। বিশেষতঃ ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর মাযহাব নিয়ে আলেমগণ বিতর্ক-বাহাছে লিপ্ত হ’তেন এবং এক মাযহাব আরেক মাযহাবের ত্রুটি-বিচ্যুতি অনুসন্ধান করে বই-পত্র রচনায় ব্যস্ত থাকতেন। ফলে চার মাযহাবের বিতর্ক এসময় অনেকটা দুই মাযহাবের বিতর্কে সীমিত হয়ে আসে।[1] ওছমানীয় তুর্কী খেলাফতের শাসকগণ ছিলেন হানাফী মাযহাবপন্থী। এজন্য বিশেষতঃ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র হানাফী মাযহাবের একাধিপত্য সৃষ্টি হয়। যার প্রভাব অদ্যাবধি বিদ্যমান।
জড়তা ও স্থবিরতার এই যুগে তৎকালীন বিশ্বে প্রচলিত চারটি মাযহাব একমাত্র অনুসরণযোগ্য মাযহাব হিসাবে পরিগণিত হ’তে থাকে। এমনকি অনেক আলেম প্রচারণা চালাতে থাকেন যে, সকল মুসলমানের উপর চার মাযহাবের একটিকে অনুসরণ করা ফরয। অতঃপর মিসরের বাহরী মামলূক সুলতান রুকনুদ্দীন বায়বারাসের আমলে মিসরীয় রাজধানীতে সর্বপ্রথম চার মাযহাবের লোকদের জন্য পৃথক পৃথক কাযী নিয়োগ করা হয়। যা ৬৬৫ হিজরী থেকে ইসলাম জগতের সর্বত্র চালু হয়ে যায় এবং চার মাযহাব বহির্ভূত কোন উক্তি বা সিদ্ধান্ত কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হ’লেও তা অনুসরণ করা নিষিদ্ধ বলে গণ্য হয়।[2] বুরজী মামলূক সুলতান ফারজ বিন বারকুক-এর আমলে হিজরী ৮০১ সনে মুক্বাল্লিদ আলেম ও জনগণকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে মুসলিম ঐক্যের প্রাণকেন্দ্র কা‘বাগৃহের চারপাশে চার মাযহাবের জন্য পৃথক পৃথক চার মুছাল্লা কায়েম করা হয়। আর এই প্রধানতম কারণে তাক্বলীদের কু-প্রভাবে মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি স্থায়ী রূপ ধারণ করে।[3] অবশেষে ১৩৪৩ হিজরীতে বর্তমান সঊদী শাসক পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আব্দুল আযীয আলে সঊদ উক্ত চার মুছাল্লা উৎখাত করেন। ফলে মুসলমানগণ বর্তমানে একই ইবরাহীমী মুছল্লায় এক ইমামের পিছনে এক সাথে ছালাত আদায় করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে।[4]
এ যুগে রচিত প্রসিদ্ধ ফিক্বহী ও ফৎওয়া গ্রন্থসমূহ :
এ যুগের যে সকল মাযহাবী কিতাব প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল সেগুলির মধ্যে আলাউদ্দীন আল-হাছকাফী হানাফীর (১০৮৮ হিঃ) ‘আদ-দুররুল মুখতার’, আমীন ইবনু আবেদীনের (১২৫২হিঃ) লিখিত ‘রাদ্দুল মুহতার হাশিয়াতু ইবনে আবেদীন’, হাম্বলী মাযহাবের শারফুদ্দীন আবু নাজা (৯৬০ হিঃ)-এর ‘যাদুল মুসতাক্বনি’ ও মানছূর বিন ইউনুস আল-ভূতীর মুখতাছার, শাফেঈ মাযহাবের ‘মুখতাছার আবুশ শুজা’, আশ-শারবীনীর ‘আল-ইকনা‘, আশ-শাবরাভীর মুখতাছার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
এ যুগে হাদীছের খেদমতে যেসকল ওলামায়ে কেরাম আত্মনিয়োগ করেন, তাঁদের মধ্যে ‘আল-মাতালিব আল-আলিয়াহ’ ও ‘বুলূগুল মারামে’র লেখক ইবনু হাজার আসক্বালানী (৮৫২ হিঃ), জাম‘উল জাওয়ামে‘, আল-জামে‘ আছ-ছাগীর ও যিয়াদাতুহু এর লেখক জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (৯১১ হিঃ) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। সাথে সাথে পূর্ববর্তী ফিক্বহ গ্রন্থসমূহের ছহীহ-যঈফ হাদীছসমূহও যাচাই-বাছাই করেন কতিপয় মুহাদ্দিছ। যেমন জামালুদ্দীন আয-যায়লাঈ (৭৬২ হিঃ) হানাফী মাযহাবের ‘হিদায়াহ্’ গ্রন্থটির তাখরীজ করে রচনা করেন ‘নাছবুর রায়াহ’, ইবনু হাজার আসক্বালানী শাফেঈ মাযহাবের ‘শারহুল ওয়াজীয’ গ্রন্থের তাখরীজ করে রচনা করেন ‘তালখীছুল হাবীর’।[5] এই যুগেই ইমাম ইবনু তায়মিয়া (৭২৮ হিঃ)-এর ফৎওয়াসমূহ সর্বপ্রথম গ্রন্থাবদ্ধ করে ফৎওয়ার উপর একটি পূর্ণাঙ্গ সংকলন ৩৭ খন্ডে প্রকাশিত হয়, যা ‘মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়া’ নামে খ্যাত। এছাড়া ইমাম সুয়ূতীর কিতাবুল হাভী লিল ফৎওয়া, যাকারিয়া আনছারী আশ-শাফেঈর (৯২৬ হিঃ) ফৎওয়া সংকলন এবং ইবনু হাজার হায়ছামীর (৯৭৪ হিঃ) ফৎওয়া সংকলন এই সময়েই সংকলিত হয়।[6]
জড়তা ও স্থবিরতার যুগের দুর্ভাগ্যজনক ফলাফল :
মুসলিম সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক জড়তা ও স্থবিরতার এই যুগে ইসলামী শরী‘আত বিভিন্ন গোষ্ঠী ও দলের মাঝে ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে গিয়েছিল। রাসূল (ছাঃ) প্রচারিত যে ইসলাম স্বচ্ছতা ও সরলতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে মানবসমাজকে চিরমুক্তির পথ বাতলে দিয়েছিল, সে ইসলাম এ যুগে দলাদলির গ্যাড়াকলে আটকা পড়েছিল। মাযহাবী দলাদলির পরিণামে মুসলিম সমাজ শত শত বছর ধরে যেসকল কুপ্রভাব ও ফলাফল বয়ে বেড়াচ্ছিল তা ড. ওমর সোলায়মান আল-আশকার উল্লেখ করেছেন- (১) ইজতিহাদ পরিত্যাগ (২) যারা ইজতিহাদের প্রয়াস নিয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধে মাযহাবী আলেমদের যুদ্ধ ঘোষণা (৩) তর্ক-বিতর্ক, বাহাছ-মুনাযারার বিস্তৃতি (৪) শত্রুতা, বিভক্তি ও পারস্পরিক ঘৃণার প্রসার (৫) জ্ঞানী ও মর্যাদাবান ব্যক্তিদের অবমর্যাদা (৬) তাক্বলীদ ও গোঁড়ামিজনিত কারণে সৃষ্ট ফিতনা-ফ্যাসাদের সর্বব্যাপকতা (৭) মাযহাবী সংকীর্ণতাবাদ ও আত্মকেন্দ্রিকতা এবং (৮) মূর্খতা বৃদ্ধি ও জ্ঞানের স্বল্পতা সৃষ্টি ইত্যাদি।
তিনি মুক্বাল্লিদদের দুরবস্থা বর্ণনা করে বলেন যে, মাসআলাগত মতবিরোধ যে ছাহাবায়ে কেরাম বা পরবর্তী ওলামায়ে কেরামের মধ্যে ছিল না তা নয়; তবে তাদের এই মতদ্বৈততা ছিল কেবল প্রাকৃতিক স্বভাবজাত বোধগম্যতার কম-বেশীর কারণে। সে বিরোধিতা কখনো স্বেচ্ছাকৃত হ’ত না। কিন্তু মুক্বাল্লিদদের অবস্থা ছিল ভিন্ন। তাদের সামনে যদি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দলীল পেশ করা হ’ত তবুও তারা স্বীয় মাযহাবের রায় যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখত। আল্লাহর কিতাবকে পশ্চাতে নিক্ষেপ করতে তাদের মোটেও বুক কাঁপত না। ছাহাবায়ে কেরাম ও আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের মাঝে যে মতবিরোধ ছিল তাতে পারস্পরিক ঘৃণা-বিদ্বেষের কোন ব্যাপার ছিল না। তারা একে অপরকে দাওয়াত করতেন, এক সাথেই ছালাত আদায় করতেন, এক সাথেই উঠাবসা করতেন। কিন্তু মুক্বাল্লিদরা পরস্পরের প্রতি এতই ঘৃণা এবং বিদ্বেষ পোষণ করত যে, ভিন্ন মাযহাবের ইমামের পিছনে ছালাত আদায় করাকে পর্যন্ত তারা অপরাধ মনে করত। এমনকি ভিন্ন মাযহাবভুক্ত পরিবারে বিবাহ-শাদীকেও তারা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ফৎওয়া দিয়েছিল।[7]
এ যুগে কিছু বিখ্যাত যুগসংস্কারক ওলামায়ে কেরামের জন্ম হয়, যাঁদের অমূল্য খেদমত ইসলামের ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। কোন মাযহাব বা মতবাদ নয়; বরং হক্ব সন্ধানই ছিল তাদের একমাত্র ব্রত। আর এজন্য তাদেরকে সমাজ কর্তৃক বহু নির্যাতনের শিকার হ’তে হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আল-ইয বিন আব্দুস সালাম (৬৬০ হিঃ), শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (৭২৮ হিঃ), ইবনুল ক্বাইয়িম (৭৫১ হিঃ), ইবনু কাছীর (৭৭৪ হিঃ), মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (১২০৬ হিঃ), মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আছ- ছান‘আনী (১১৮২ হিঃ), আল্লামা শাওক্বানী (১২৫০ হিঃ) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
[চলবে]
শিহাবুদ্দীন আহমাদ
পিএইচ.ডি. গবেষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. হুজ্জাতুলাহিল বালিগাহ, ১/৪৪০ পৃঃ।
[2]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৮৯।
[3]. ঐ।
[4]. ঐ।
[5]. তারীখুল ফিক্বহিল ইসলামী, পৃঃ ১৪২; ড. ইউসুফ আল-কারযাভী, আল-ফৎওয়া বায়নাল ইনযিবাত্ব ওয়াত তাসাইয়ুব (কায়রো : দারুছ ছাহওয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৮৮ ইং), ১৫ পৃঃ।
[6]. তারীখুল ফিক্বহিল ইসলামী, ১৪২ পৃঃ।
[7]. ড. ওমর সোলায়মান আল-আশকার, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৭২।