পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ ।

ভারতীয় উপমহাদেশে ফৎওয়ার উৎপত্তি :

ইসলামের কেন্দ্রভূমি মক্কা মুকাররামাহ হতে সুদূর প্রান্তে অবস্থান করলেও মধ্যযুগ থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশ ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পাদপীঠে পরিণত হয়। মুসলিম বিশ্বে দ্বীনী জ্ঞানচর্চার বিকাশে অত্র অঞ্চলের আলেমগণ যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তা অনস্বীকার্য। ৭১১ হিজরীতে তরুণ মুসলিম সেনাপতি মুহাম্মাদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে উপমহাদেশে মুসলমানদের রাজনৈতিক বিজয় সূচিত হয়। অতঃপর ১২০৬ সালে গযনীর সুলতান মুহাম্মাদ ঘোরীর উত্তর-পূর্ব ভারত বিজয় এবং দিল্লীতে রাজধানী স্থাপনের মাধ্যমে উপমহাদেশে মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে আরব ও মধ্য এশিয়া থেকে আগত মুবাল্লিগদের মাধ্যমে এ দেশে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা বিকাশ হতে থাকে। ধীরে ধীরে ভারত উপমহাদেশের আনাচে কানাচে সর্বত্রই এই দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে যায়। একইভাবে দ্বীন শিক্ষাদানের জন্য সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে দারসগাহ ও খানকাহ স্থাপিত হতে লাগল। বিশেষত এ সময় দিল্লী, দেওবন্দ, করাচী ও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, সোনারগাঁ প্রভৃতি অঞ্চলের দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ সকল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উপমহাদেশে ফিকহ ও ফৎওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা শুরু হয়। এক্ষণে আমরা উপমহাদেশের যেসকল ওলামায়ে কেরাম ফিকহ ও ফৎওয়া চর্চায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন এবং তাদের ফৎওয়াসমূহ নিয়ে যেসকল সংকলনগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পেশ করব।

উপমহাদেশে ফৎওয়ার বিকাশ :

উপমহাদেশে ফিকহ ও ফৎওয়া চর্চার ইতিহাস পর্যালোচনায় যে বিষয়টি প্রথমেই জ্ঞাতব্য তা হল, মুহাম্মাদ ঘোরীর সামরিক বিজয়ের পর যে মুসলিম শাসকগণ ভারত শাসন করেছিলেন তারা ছিলেন নওমুসলিম তুর্কী এবং হানাফী মাযহাবভুক্ত। ফলে অত্র অঞ্চলের সুন্নী আলেমগণ ছিলেন মূলতঃ হানাফী।[1] এ কারণে উপমহাদেশে ফৎওয়ার চর্চা এবং উৎপত্তি ও বিকাশ বলা যায় একচেটিয়াভাবে হানাফী মাযহাবের উপরই ভিত্তিশীল ছিল। যদিও মুলতান, দিল্লী, বিহার, কাশ্মীর, বাংলাদেশের সোনারগাঁও প্রভৃতি অঞ্চলে হাদীছভিত্তিক ফিকহ ও ফৎওয়া চর্চার শক্তিশালী কেন্দ্র ছিল। কিন্তু শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় হানাফী মাযহাবভিত্তিক ফৎওয়াই মানুষের মাঝে সার্বজনীন প্রাধান্য বিস্তার করে।

মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনে ফৎওয়ার চর্চা অনেক পূর্বেই শুরু হলেও লিখিত আকারে ফৎওয়া সংকলনের কাজ শুরু হয় অষ্টম হিজরী শতাব্দীতে। ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম যে ফৎওয়া সংকলনের সন্ধান পাওয়া যায় তার নাম ‘ফাতাওয়া তাতারখানিয়া’। উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ এই ফাতাওয়া গ্রন্থটি বাংলাদেশের সোনারগাঁওয়ের শাসক খান-ই-আযম বাহরাম খাঁ ওরফে তাতার খানের নির্দেশে ১৩৩১ খৃষ্টাব্দে (৭৭৭ হিঃ) খ্যাতনামা আলেম ইবনুল আলা আল-আন্দারিতী আল-হানাফী সংকলন করেন।[2] এরপর ‘ফাতাওয়া হাম্মাদিয়া’র মত কিছু ফৎওয়া সংকলন প্রকাশ পেলেও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ যে ফৎওয়া সংকলনটি প্রকাশিত হয় তার নাম ‘ফাতাওয়া আলমগীরী’, যা ‘ফাতাওয়া হিন্দিয়া’ নামেও খ্যাত। মোঘল সম্রাট শাহজাহানের জ্যেষ্ঠপুত্র আওরঙ্গজেবের সুদীর্ঘ অর্ধশত বছরের (১৬৫৮-১৭০৭ খৃঃ) শাসনামলে এটি রচিত হয়, যা এখনও পর্যন্ত উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ফৎওয়া সংকলন। ‘দরবেশ সম্রাট’ খ্যাত আওরঙ্গজেবের ঐকান্তিক আগ্রহের প্রেক্ষিতে এবং মোল্লা নিযামের সুযোগ্য তত্ত্বাবধানে ফৎওয়ার এই বৃহৎ অাঁকরগ্রন্থটি রচনা সম্ভব হয়েছিল। অদ্যাবধি উপমহাদেশসহ মধ্যপ্রাচ্যেও হানাফী আলেমদের নিকট এটি একটি বহুল সমাদৃত গ্রন্থ। নিম্নে এই সংকলনটিসহ উপমহাদেশের অপরাপর ফৎওয়াগ্রন্থগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি প্রদান করা হল।

ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী : ফাতাওয়া আলমগীরী রচিত হয়েছিল হানাফী ফিকহের ভিত্তিতে। একে হানাফী মাযহাবের তৎকালীন সময় পর্যন্ত প্রকাশিত ও পরিচিত গ্রন্থসমূহের সারনির্যাসই বলা চলে। স্বয়ং সম্রাট আলমগীরের বিশেষ আগ্রহ ছিল যাতে সকল মুসলমান ঐ সমুদয় মাসআলার উপর আমল করতে পারে, যা হানাফী মাযহাবের আলেমগণ অবশ্য পালনীয় মনে করে থাকেন। কিন্তু সমস্যা ছিল যে, ওলামা ও ফুকাহাদের মতভেদ হানাফী মাযহাবের গ্রন্থসমূহে এমনভাবে মিশ্রিত হয়ে গিয়েছিল যে, একজন লোক যতক্ষণ পর্যন্ত ফিকহ শাস্ত্রে পরিপূর্ণ পারদর্শিতা লাভ করতে না পারে এবং অনেকগুলি সুর্ববৃহৎ গ্রন্থ সংগ্রহ করতে সমর্থ না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন মাসআলা সম্পর্কে পূর্ণ অবগতি লাভ করা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। সম্রাট আলমগীর তাঁর প্রবল আগ্রহের প্রেক্ষিতেই উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল হ’তে ফিকহ শাস্ত্রে পারদর্শী আলেমগণকে একত্র করলেন। তাঁর নির্দেশ মোতাবেক তাঁরা বিভিন্ন পুস্তকাদির সাহায্যে এমন একটি পূর্ণতর গ্রন্থ প্রণয়ন করেন যাতে বিস্তারিতভাবে সমস্ত মাসআলা সন্নিবেশিত হয়।

আওরঙ্গজেব গ্রন্থখানি প্রণয়ন করতে প্রায় ৫০০ ফকীহকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। যাদের মধ্যে ৩০০ জন উপমহাদেশের এবং ১০০ জন ইরাক ও ১০০ জন হেজায থেকে আগমন করেছিলেন। এটি প্রণয়নে মোট আট বছর সময় লেগেছিল এবং তৎকালীন সময়ে দুই লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল। শাহী গ্রন্থাগারের ১৩০-এর অধিক কিতাবাদি হ’তে সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছিল। ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী সংকলনের কাজ চার ভাগে বিভক্ত করে প্রসিদ্ধ ও যোগ্য চারজন আলিমের উপর অর্পণ করা হয়। যাদের একেকজনের সাহায্যের জন্য দশ দশজন আলিম নিযুক্ত করা হয়। অবশ্য সামগ্রিকভাবে পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল শায়খ নিযামুদ্দীন বুরহানপুরীর উপর।

আরবী ভাষায় লিখিত ৬ খন্ডে সমাপ্ত এই ফৎওয়া গ্রন্থটির উর্দূ, ফার্সীসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তৎকালীন উপমহাদেশের সর্বত্রই বিচারালয়সমূহে এই গ্রন্থটি অনুসৃত হত।[3]

ফাতাওয়া জাহাঁদারী : বিশ্ব সম্পর্কিত জিজ্ঞাসার জওয়াব সমৃদ্ধ ‘ফাতাওয়া-ই জাহাঁদারী’ মূলত রাজনৈতিক বিষয় সম্বলিত গ্রন্থ। গ্রন্থটির রচয়িতা ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ যিয়াউদ্দীন বারানী (১২৮৫-১৩৫৭ খৃঃ)। অবশ্য এখানে তিনি ‘ফৎওয়া’ শব্দকে কিছুটা ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতিকে ধর্ম হতে পৃথক ও স্বতন্ত্র কোনও বিষয় বলে বিবেচনা করতেন না; বরং তাঁর আকাংখা ছিল যে, রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাবলীর সমাধান খুঁজে বের করার জন্য যেন প্রাচীন জীবন-বিধানের অনুসরণ করা হয়। তাই এই গ্রন্থে তিনি কুরআন, হাদীছ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের পথনির্দেশের আলোকে সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি বিচার-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি ও সামাজিক সমস্যার সমাধানে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।[4]

ফাতাওয়া নাযীরিয়া : ‘শায়খুল কুল ফিল কুল’ ও ‘রঈসুল মুহাদ্দিছীন ওয়াল মুফাসসিরীন ওয়াল ফুকাহা’ উপাধিতে খ্যাত মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভীর অনবদ্য রচনা হল ‘ফাতাওয়া নাযীরিয়া’। যা তাঁর সারাজীবনের সাধনার ইলমী ফসল। মিয়াঁ সাহেবের মৃত্যুর পরে তদীয় খ্যাতিমান ছাত্র মাওলানা শামসুল হক্ব আযীমাবাদী (১৮৫৭-১৯১১ খৃঃ) ও মাওলানা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (১৮৮৫-১৯৩৫ খৃঃ)-এর সংশোধনী ও মাওলানা শারফুদ্দীন দেহলভী (মৃঃ ১৯৬১ খৃঃ) কর্তৃক সংক্ষিপ্ত সংযোজনীসহ ১৯১৫ খৃষ্টাব্দে দু’খন্ডে ‘ফাতাওয়া নাযীরিয়াহ’ সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। পরে দিল্লী থেকে ১৯৮৮ সালে ৩ খন্ডে ফাতাওয়া নাযীরিয়া প্রকাশিত হয়, যাতে মোট অধ্যায় রয়েছে ৫৯টি এবং ফৎওয়া ৮০৬টি। ফতাওয়া নাযীরিয়ার প্রথম বৈশিষ্ট্য হল এটি কোন আহলেহাদীছ আলেম রচিত সর্বপ্রথম ‘ফৎওয়া সংকলন’। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এখানে মাযহাবী ফিকহের পরিবর্তে সর্বত্র পবিত্র কুরআন ও হাদীছ হতে দলীল প্রদান করা হয়েছে। সাথে সাথে ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ ও প্রসিদ্ধ ইমামগণের মত প্রকাশ করা হয়েছে। তবে কোন কোন সময় ফৎওয়া জিজ্ঞেসকারীর মাযহাব অনুপাতেও ফৎওয়া প্রদান করা হয়েছে। উর্দূ ভাষায় রচিত এই ফৎওয়া সংকলনটি আজও ফৎওয়ার আঙ্গিনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স হিসাবে সমাদৃত।[5]

ফাতাওয়া হামীদিয়া : উপমহাদেশের একজন খ্যাতনামা আলিম, মুফতী ও ফকীহ আল্লামা হামীদ ইবনু মুহাম্মাদ কুনূবী (মৃঃ ৯৮৫ হিজরী)। ‘ফাতাওয়ায়ে হামীদিয়া’ নামক ফৎওয়া গ্রন্থখানি তাঁর অমর অবদান।

ফাতাওয়া হাম্মাদিয়া : প্রখ্যাত মুফতী শায়খ আবুল ফাতাহ রুকন ইবন হুস্সাম নাগারী। এই মহান ব্যক্তির অমর অবদান হল- ‘ফাতাওয়া হাম্মাদিয়া’।

ফাতাওয়া আব্দুল হাই : খ্যাতনামা হানাফী আলেম আব্দুল হাই লাখনৌভী (মৃঃ ১৩০৪ হিঃ)-এর প্রদত্ত ৮৮০টি ফৎওয়া নিয়ে ১ খন্ডে এই গ্রন্থটি সংকলিত হয়েছে। ১৯৮৯ সালে দেওবন্দ থেকে এটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। হেদায়ার অধ্যায় বিন্যাসের আলোকে এর বিষয়সূচি প্রস্ত্তত করা হয়েছে।

ফাতাওয়া দারুল উলূম : ফাতাওয়ায়ে দারুল উলূম ভারতীয় উপমহাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য ফৎওয়া গ্রন্থ। এটি সংকলন করেন মুফতী আযীযুর রহমান ওছমানী। ১৩৮২ হিজরী সনে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়।

এমদাদুল ফৎওয়া : এমদাদুল ফৎওয়া গ্রন্থখানি ভারতীয় উপমহাদেশের খ্যাতনামা হানাফী আলেম হাকীমুল উম্মাহ খ্যাত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী কর্তৃক সংকলিত। ১৩২৭ হিজরী সনে করাচী হতে এটি প্রকাশিত হয়েছে। উপমহাদেশের হানাফীদের নিকট এটি একটি অবশ্যপাঠ্য ফৎওয়া গ্রন্থ।

ফাতাওয়া আযীযিয়া : ভারতগুরু শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর জেষ্ঠ্যপুত্র শাহ আব্দুল আযীয (মৃঃ ১২৩৯ হিজরী) ভারতীয় উপমহাদেশে তৎকালীন সময়ে একজন বিখ্যাত আলেম ও মুফতী ছিলেন। ‘ফাতাওয়া আযীযিয়া’ তাঁর অমর কীর্তি।

ফাতাওয়া রশীদিয়া : ‘আল-আরফুশ শাযী’র লেখক তিরমিযীর ব্যাখ্যাকার খ্যাতনামা হানাফী আলেম মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গোহী (মৃঃ ১৯০৫ খৃঃ) এই ‘ফাতাওয়া রশীদিয়া’ রচনা করেন।

ফাতাওয়া আহমাদিয়া : উপমহাদেশের বিশিষ্ট মুফতী মাহমূদুল হাসান গাঙ্গুহী। তিনি ‘ফাতাওয়া আহমাদিয়া’ নামক মূল্যবান ফৎওয়া গ্রন্থ রচনা করেছেন।

তা‘লীমুল ইসলাম ও কিফায়াতুল মুফতী : মুফতী কিফায়াতুল্লাহ (মৃঃ ১৯৫২ খৃঃ) দিল্লীর মুফতীয়ে আযম হিসাবে খ্যাত ছিলেন। তাঁর ফৎওয়া ইসলামী বিশ্বের বহু দেশের আলিমগণের নিকটে সমর্থন লাভ করেছে। তাঁর রচিত ‘তা‘লীমুল ইসলাম’ এবং ‘কিফায়াতুল মুফতী’ উপমহাদেশের হানাফী সমাজে বিপুল সাড়া জাগিয়েছে।

ফাতাওয়া নিযামিয়া : মুফতী নিযামুদ্দীন ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দের প্রধান মুফতী। আধুনিক যুগ-জিজ্ঞাসার জওয়াবে ও সমাধানে তাঁর ‘ফাতাওয়া নিযামিয়া’ এক অমূল্য গ্রন্থ।

আদিল্লাতুল মুহাম্মাদিয়া ও তা‘লীমুল ইসলাম : মাওলানা আবু বকর সিদ্দীক ছিলেন খ্যাতিমান আলিম। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ফৎওয়া শাস্ত্রের বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে ‘আদিল্লাতুল মুহাম্মাদিয়া’ ও ‘তা‘লীমুল ইসলাম’।

আল-ফৎওয়া আল-ইয়ামানিয়্যা ফিল আহকামিস সামানিয়্যা : মাওলানা হাফেয আব্দুল আউয়াল জৌনপুরী (মৃঃ ১৯৩৯ খৃঃ) ছিলেন একজন উঁচু স্তরের মুহাদ্দিছ ও হানাফী ফকীহ। ফৎওয়া ও ফিকহী বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। ‘আল-ফাতাওয়া আল-ইয়ামানিয়্যা ফিল আহকামিস সামানিয়্যা’ ফৎওয়া বিষয়ে তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।[6]

ফাতাওয়া ছানাইয়াহ :

উপমহাদেশের বিখ্যাত আহলেহাদীছ মনীষী ফাতেহে কাদিয়ান শেরে পাঞ্জাব খ্যাত মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (১২৮৭-১৩৬৭ হিঃ) রচিত দু’টি খন্ডে সমাপ্ত একটি পূর্ণাঙ্গ ফৎওয়া গ্রন্থ। ৪৪ বছরে লিখিত এবং সম্পূর্ণ ফিকহী ধারায় সুবিন্যস্ত ইবাদত ও মু‘আমালাত সংক্রান্ত বিষয়ে সার্বিক মাসআলা সংযোজিত একটি পূর্ণাঙ্গ ফৎওয়া গ্রন্থ এটি। এর সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন পাকিস্তানের খ্যাতিমান আহলেহাদীছ আলেম মাওলানা দাউদ রায। এতে প্রয়োজনীয় টীকা সংযোজন করেছেন শায়খুল হাদীছ মাওলানা আবু সাঈদ শরফুদ্দীন দেহলভী। এ ফৎওয়া গ্রন্থটির ১ম খন্ডে সর্বমোট তিনটি অধ্যায় ও একটি পরিচ্ছেদ রয়েছে এবং ২য় খন্ডে ৬টি অধ্যায় ও সাতটি পরিচ্ছেদ রয়েছে। কখনও কখনও ফাতাওয়ায়ে নাযীরিয়াহ থেকেও উত্তর সন্নিবেশিত হয়েছে।

ফাতাওয়ায়ে ছানাইয়াহ-এর বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর বলেন, ‘ফাতাওয়ায়ে ছানাইয়াহ উর্দূ ভাষার ফৎওয়া গ্রন্থের মধ্যে সর্বাধিক বিষয়বস্ত্ত সমৃদ্ধ ও বিশুদ্ধ এবং সহজ সরল নিয়ম পদ্ধতিতে লিখিত, যা সাধারণের জন্য সহজবোধ্য এবং এটাও বলা যায় যে, ফাতাওয়া ছানাইয়াহ সর্বশ্রেণীর মানুষের জন্য উপকারী গ্রন্থ’।[7]

ফাতাওয়া ওবায়দুল্লাহ মুবারকপরী :

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত আহলেহাদীছ মনীষী ‘মিশকাত’-এর ভাষ্যগ্রন্থ ‘মির‘আতুল মাফাতীহ’-এর লেখক ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (১৯০৯-১৯৯৪খৃঃ)। দিল্লীর রহমানিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতাকালীন সময়ে এবং অবসর জীবনে ‘মুহাদ্দিছ’, ‘তর্জুমান’, ‘আখবারে আহলেহাদীছ’, ‘নূরে তাওহীদ’, ‘আস-সিরাজ’, ‘আল-ফালাহ’ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় এবং পুস্তিকা-লিফলেটের মাধ্যমে যে সকল ফৎওয়া প্রদান করেছিলেন তা সম্প্রতি সংকলিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে। বৃহদাকার দুই খন্ডে ‘ফাতাওয়া শায়খুল হাদীছ মুবারকপুরী’ শিরোনামে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১০ সালে। সংকলন করেছেন তাঁরই পৌত্র ফাওয়ায বিন আব্দুল আযীয মুবারকপুরী। এর বৈশিষ্ট্য হ’ল আহলেহাদীছের মাসলাক অনুযায়ী যথারীতি তিনি কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করেছেন। প্রকাশিত দু’খন্ড ব্যতীত তাঁর আরও অনেক ফৎওয়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, যা একত্রিত করা হ’লে সংকলনটি আরো কয়েকটি খন্ডে পরিণত হবে।[8]

রাসায়েল ও মাসায়েল : এটি জামা‘আতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদীর রচিত বৃহদাকার ফৎওয়া সংকলন। ১৯৩২ সালে ‘তরজুমানুল কুরআন’ নামক পত্রিকার মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন মাসআলা-মাসায়েলের উত্তর দিতে থাকেন। যা ১৯৫০ সালে উর্দূতে সংকলন আকারে প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৮৮ সালে তা বাংলা ভাষায় ৭ খন্ডে প্রকাশিত হয়। বঙ্গানুবাদ করেন আব্দুশ শহীদ নাসিম। এতে দৈনন্দিন মাসআলা-মাসায়েল ছাড়াও আধুনিক যুগ-জিজ্ঞাসা এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে জওয়াব প্রদান করা হয়েছে। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত এই গ্রন্থটির যথেষ্ট ইলমী মূল্য রয়েছে। যদিও বিভিন্ন মাসআলায় কুরআন-হাদীছের নীতিবিরোধী জওয়াব গ্রন্থটিকে বিতর্কিত করেছে। তাছাড়া রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পাওয়ায় অনেক শারঈ বিষয়ে শিথিলতাও দেখানো হয়েছে।

এছাড়া ‘ফাতাওয়া রহীমীয়া’, ‘ফাতাওয়া হাক্কানিয়া’, ‘ফাতাওয়া মাহমূদিয়া’, ‘আহসানুল ফৎওয়া’ প্রভৃতি ফৎওয়া সংকলন উপমহাদেশের হানাফী মহলে বেশ প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে। আহলেহাদীছ আলেমদের মধ্যে মিঁয়া নাযীর হুসাইন দেহলভী, ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরীর ফৎওয়া গ্রন্থই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।

ভারতীয় উপমহাদেশে উল্লেখিত ফৎওয়া গ্রন্থ ও মুফতী ছাড়া আরও বহু আলেম, মুফতী, ফকীহ ফৎওয়া বিষয়ে স্থান, কাল, পাত্রভেদে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’লেন- শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (মৃঃ ১১৭৬ হিঃ), মুফতী আব্দুল্লাহ টুনকী বিহারী, শায়খুল হিন্দ মাহমূদুল হাসান দেওবন্দী প্রমুখ। 

ভারত-পাকিস্তানের মত বাংলাদেশের মুফতী ও মুহাদ্দিছগণও ফৎওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। তাঁদের সংকলিত কিছু ফৎওয়া গ্রন্থের নাম নিম্নে প্রদত্ত হল :

ফাতাওয়া সিদ্দীকিয়্যা : মাওলানা নিছারুদ্দীন আহমাদ (মৃঃ ১৯৫২ খৃঃ) ছিলেন পিরোজপুরের দারুস সুন্নাহ ছারছীনা আলিয়া মাদরাসার পরিচালক। তিনি বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের সমন্বয়ে একটি ‘দারুল ইফতা’ কায়েম করেন এবং প্রধান তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এই কমিটির প্রদত্ত ফৎওয়া ‘ফাতাওয়া সিদ্দীকিয়া’ নামে সংকলিত হয়েছে।

ফাতাওয়া বরকতিয়্যা : জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের সাবেক খতীব সাইয়েদ মুফতী মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান (মৃঃ ১৩৯৪ হিঃ) একজন বিখ্যাত মুফতী ও ফকীহ ছিলেন। সাহিত্য, ফিকহ, উলূলে ফিকহ এবং হাদীছ প্রসঙ্গে তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় সংকলন ২০ হাযার ফাতাওয়ার সন্নিবেশিত গ্রন্থ ‘ফাতাওয়ায়ে বরকতিয়া’। তবে এটি এখনও অপ্রকাশিত রয়েছে।

এছাড়াও যাঁরা ফৎওয়া বিষয়ে বিশেষ অবদান রেখেছেন তাঁদের অন্যতম হলেন- মুফতী মুহাম্মাদ ইবরাহীম, মুফতী বিলায়েত হুসাইন, মুফতী মোবারক উল্লাহ, মুফতী মুহাম্মাদ আলী, মুফতী আব্দুল ওয়াহিদ (মৃত ১৪০১ বঙ্গাব্দ), মুফতী মাওলানা আব্দুর রহমান (মৃত ১৯৬৮ খৃঃ), শামসুল হক ফরিদপুরী প্রমুখ। অবশ্য এ সকল ওলামায়ে কেরাম সকলেই ছিলেন হানাফী মাযহাবভুক্ত। আহলেহাদীছ আলেমদের মাঝে আল্লামা আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কুরায়শী, মাওলানা আহমাদ আলীসহ বেশ কিছু আহলেহাদীছ আলেম বই, পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে ফৎওয়া প্রদান করলেও সেগুলোর কোন সংকলনগ্রন্থ অদ্যাবধি প্রকাশিত হয়নি।

[চলবে]

শিহাবুদ্দীন আহমাদ

পিএইচ.ডি গবেষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


[1]. যারা কেবল হানাফীই ছিলেন না, বরং তাদের ধর্মাচরণে তুর্কী, ইরানী, আফগান, মোগল এমনকি হিন্দুয়ানী বহু আক্বীদা-আমলের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। ফলে ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের আক্বীদা ও আমলের সাথে এতদঞ্চলের আলেম-ওলামা ও সাধারণ মানুষের আক্বীদা-আমলে বিস্তর পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়। দ্রঃ আহলেহাদীছ আন্দোলন, ২২৯-২৩০ পৃঃ।

[2]. ৯৫৬ হিজরীতে এই গ্রন্থটি ১ খন্ডে সংক্ষেপণ করেন ইবরাহীম হালাবী। গ্রন্থটি ‘যাদুল মুসাফির’ নামেও পরিচিত।

[3]. ইসলামী বিশ্বকোষ ১৪/৫৫৮-৫৬৪; লেখকমন্ডলী, ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৪), পৃঃ ৮১।

[4]. ইসলামী বিশ্বকোষ ১৪/৫৬৪-৫৬৫।

[5]. ফাতাওয়া নাযীরিয়া (দিল্লী : নূরুল ঈমান প্রকাশনী, ১৯৮৮), পৃঃ ৫; তারাজিমে ওলামায়ে হাদীছ হিন্দ, পৃঃ ১৪৯; আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৩৩৪-৩৫।

[6]. ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন, পৃঃ ৮০-৮৪

[7]. ফৎওয়া ছানাইয়াহ (দিল্লী : মাকতাবায়ে তারজুমান, ২০০২), ২য় খন্ড, পৃঃ ১৭

[8]. ফাতাওয়া শায়খুল হাদীছ মুবারকপুরী, সংকলনে : ফাওয়ায আব্দুল আযীয(দিল্লী : মাকতাবায়ে তারজুমান, ২০১০), ২য় খন্ড, পৃঃ ২৫-২৭; নূরুল ইসলাম, ‘ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী’, মাসিক আত-তাহরীক, ১৪/২ সংখ্যা, নভেম্বর ২০১০, পৃঃ ৩২






দাঈর সফলতা লাভের উপায় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
হজ্জ সফর (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
আল্লাহর উপর ভরসা (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
হজ্জ : গুরুত্ব ও ফযীলত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আদর্শ সমাজ গঠনে সালামের ভূমিকা - মুহাম্মাদ মাইনুল ইসলাম
নিভে গেল ছাদিকপুরী পরিবারের শেষ দেউটি - ড. নূরুল ইসলাম
মুসলিম সমাজে মসজিদের গুরুত্ব (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ঈমান (শেষ কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
মোবাইল ব্যবহারের আদব ও সতর্কতা - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
হাদীছ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পরিক্রমা (৩য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
তাক্বলীদের বিরুদ্ধে ৮১টি দলীল (৬ষ্ঠ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আহলেহাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম (২য় কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
আরও
আরও
.