মানব
জীবনের অতি প্রয়োজনীয় বস্ত্ত হচ্ছে আহার ও পানীয়। জীবন ধারণের জন্য
পানাহারের কোন বিকল্প নেই। খাদ্য-পানীয় মানুষের দেহ-মন সুস্থ ও সতেজ রাখার
প্রধান উপকরণ। এগুলির অভাবে মানুষের শরীর ভেঙ্গে যায় এবং দুর্বল ও নিস্তেজ
হয়ে পড়ে। ইবাদতে মন বসে না এবং কোন কাজে স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে না। তাই
খাদ্য-পানীয় মানুষের জন্য অতি যরূরী। তবে এ খাদ্য-পানীয় হালাল হওয়া আবশ্যক।
নবী করীম (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لاَ يَقْبَلُ إِلاَّ طَيِّبًا-
‘অবশ্যই আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র ব্যতীত কোন কিছুই কবুল করেন না’।
আল্লাহ মুমিনদেরকে সেই নির্দেশ দিয়েছেন, যা তিনি নবী-রসূলগণকে দিয়েছিলেন।
তিনি নবী-রসূলগণের উদ্দেশ্যে বলেন,يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوْا مِنَ
الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوْا صَالِحًا إِنِّيْ بِمَا تَعْمَلُوْنَ عَلِيْمٌ،
‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্ত্তসমূহ থেকে আহার কর এবং সৎকাজ কর। তোমরা
যা কর সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত (মুমিনূন ২৩/৫১)। আর
মুমিনদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا كُلُوْا
مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ، ‘হে মুমিনগণ! আমরা তোমাদেরকে যে সকল
রিযিক দান করেছি তা থেকে পবিত্র বস্ত্ত আহার কর’ (বাক্বারাহ ২/১৭২)।
অতঃপর তিনি এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফর করে এসেছে। তার
চুলগুলো বিক্ষিপ্ত, অবিন্যস্ত এবং শরীর ধূলিমলিন। এমতাবস্থায় সে নিজ হাত
দু’টিকে আকাশের দিকে উঠিয়ে দো‘আ করে, হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রভু!
কিন্তু তার খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পরিধেয় পোশাক হারাম এবং
হারাম দ্বারাই তার দেহ পরিপুষ্ট হয়েছে। অতএব তার দো‘আ কিভাবে কবুল হ’তে
পারে’?[1]
আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) একদা কা‘ব বিন
উজরার উদ্দেশ্যে বললেন,يَا كَعْبَ بْنَ عُجْرَةَ، إِنَّهُ لَنْ يَدْخُلَ
الْجَنَّةَ لَحْمٌ نَبَتَ مِنْ سُحْتٍ، ‘হে কা‘ব বিন উজরাহ! সে গোশত কোন
দিন জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার পুষ্টিসাধন হারাম খাদ্য দ্বারা করা
হয়েছে’।[2]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন,يَا
كَعْبَ بْنَ عُجْرَةَ، إِنَّهُ لاَ يَرْبُو لَحْمٌ نَبَتَ مِنْ سُحْتٍ
إِلاَّ كَانَتِ النَّارُ أَوْلَى بِهِ، ‘হে কা‘ব বিন উজরাহ! যে গোশত হারাম
খাদ্য দ্বারা পরিপুষ্ট হবে, তার জন্য জাহান্নামই উপযুক্ত’।[3]
ইসলামে পানাহারের বিভিন্ন আদব বা শিষ্টাচার রয়েছে। যেগুলি পালন করলে ছওয়াব লাভ হয় এবং সুস্বাস্থ্য গড়ে ওঠে। তনমধ্যে কিছু নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
১. স্বর্ণ-রৌপ্যের পাত্রে পানাহার না করা :
স্বর্ণ-রূপার
পাত্র হচ্ছে কাফেরদের জন্য। যাতে অহংকার প্রকাশ পায়। সোনা-রূপার পাত্রে
পানাহার করতে নবী করীম (ছাঃ) নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,لَا تَشْرَبُوْا فِيْ
آنِيَةِ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَلَا تَلْبَسُوا الْحَرِيْرَ
وَالدِّيبَاجَ فَإِنَّهَا لَهُمْ فِي الدُّنْيَا وَلَكُمْ فِي الْآخِرَةِ،
‘তোমরা সোনা-রূপার পাত্রে পানাহার কর না। আর তোমরা রেশমী বস্ত্র পরিধান কর
না। কারণ তা দুনিয়াতে কাফেরদের জন্য এবং আখেরাতে তোমাদের জন্য’।[4] তিনি
আরো বলেন,الَّذِيْ يَشْرَبُ فِيْ إِنَاءِ (آنِيَةِ) الْفِضَّةِ إِنَّمَا
يُجَرْجِرُ فِيْ بَطْنِهِ نَارَ جَهَنَّمَ ‘যে ব্যক্তি রূপার পাত্রে
পানাহার করে, সে ব্যক্তি নিজ উদরে জাহান্নামের আগুন পূর্ণ করে’।[5]
২. খাবার পাত্রের মধ্যস্থল থেকে না খাওয়া :
পাত্রের মধ্যস্থল থেকে খাবে না, বরং এক পার্শ্ব থেকে খাবে।[6]
রাসূল (ছাঃ) বলেন,البَرَكَةُ تَنْزِلُ وَسَطَ الطَّعَامِ فَكُلُوا مِنْ
حَافَتَيْهِ وَلاَ تَأْكُلُوا مِنْ وَسَطِهِ، খাদ্যের মধ্যস্থলে বরকত নাযিল
হয়। সুতরাং তোমরা পার্শ্ব থেকে খাও, মধ্যস্থল থেকে খেও না।[7]
তিনি
আরো বলেন, إِذَا أَكَلَ أَحَدُكُمْ طَعَامًا فَلَا يَأْكُلْ مِنْ أَعْلَى
الصَّحْفَةِ، وَلَكِنْ لِيَأْكُلْ مِنْ أَسْفَلِهَا، فَإِنَّ الْبَرَكَةَ
تَنْزِلُ مِنْ أَعْلَاهَا، ‘তোমাদের কেউ যখন খাবার খায়, তখন সে যেন পাত্রের
উপর (মাঝখান) থেকে না খায়। বরং পাত্রের নিচে (একধার) থেকে খায়। কারণ বরকত
তার উপর (মাঝখান) অংশে নাযিল হয়।[8]
৩. ঠেস বা হেলান দিয়ে না খাওয়া :
ঠেস
বা হেলান দিয়ে পানাহার করা সুন্নাতী তরীকা নয়। তাই এভাবে পানাহার না করে
সোজা হয়ে বসে পানাহার করতে হবে। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, لَا آكُلُ مُتَّكِئًا
‘আমি হেলান দিয়ে খাই না।[9] তিনি হেলান দিয়ে খেতে নিষেধও করেছেন। তিনি বলেন, لَا تَأْكُلْ مُتَّكِئًا ‘হেলান দিয়ে খেয়ো না’।[10]
অনুরূপভাবে
উপুড় হয়ে শুয়ে খাওয়া নিষেধ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَأَنْ يَأْكُلَ الرَّجُلُ
وَهُوَ مُنْبَطِحٌ عَلَى بَطْنِهِ ‘কোন ব্যক্তি যেন উপুুড় হয়ে পেটের উপর ভর
করে না খায়’।[11]
৪. খাবার প্রস্ত্তত হয়ে গেলে এবং ছালাতের সময় হ’লে আগে খাবার খাওয়া : খাবার
তৈরী হয়ে গেলে ছালাতের সময় হ’লেও আগে খাবার খেয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া
হয়েছে। কেননা ক্ষুধার্ত অবস্থায় ছালাত শুরু করলে একাগ্রতা থাকে না। এজন্য
নবী করীম (ছাঃ) বলেন, إِذَا أُقِيْمَتِ الصَّلَاةُ وَحَضَرَ الْعَشَاءُ
فَابْدَءُوْا بِالْعَشَاءِ، ‘ছালাতের ইক্বামত হ’লে এবং রাতের খানা উপস্থিত
হ’লে, আগে খানা খেয়ে নাও’।[12]
তিনি আরো
বলেন,إِذَا كَانَ أَحَدُكُمْ عَلَى الطَّعَامِ فَلاَ يَعْجَلَنَّ حَتَّى
يَقْضِىَ حَاجَتَهُ مِنْهُ وَإِن أُقِيْمَتِ الصَّلاَةُ، ‘যখন কেউ খেতে
বসবে তখন খাওয়া শেষ না করা পর্যন্ত সে যেন তাড়াহুড়া না করে, যদিও ছালাতের
ইক্বামত হয়ে যায়’।[13]
৫. খাবার শুরু করার আগে ও পরে উভয় হাত ধৌত করা :
খাওয়ার পূর্বে হাত ভালভাবে ধুয়ে নিবে।[14] আর খাবার পরে হাত ধোয়া যরূরী। রাসূল (ছাঃ) খাবার পরে কুলি করেছেন এবং হাত ধুয়েছেন।[15]
তিনি
বলেন,مَنْ نَامَ وَفِي يَدِهِ غَمَرٌ، وَلَمْ يَغْسِلْهُ فَأَصَابَهُ
شَيْءٌ، فَلَا يَلُومَنَّ إِلَّا نَفْسَهُ، ‘যে ব্যক্তি হাতে গোশতের গন্ধ ও
চর্বি না ধুয়ে তা নিয়েই ঘুমায়, অতঃপর কোন বিপদ ঘটে, তাহ’লে সে যেন নিজেকে
ছাড়া আর কাউকে দোষারোপ না করে’।[16]
এখানে বিপদ বলতে, হাত না ধুয়ে ঘুমানোর ফলে চর্বির গন্ধে তেলাপোকা, ইঁদুর বা অন্য কোন প্রাণী হাত বা আঙ্গুল কামড়াতে পারে। তাছাড়া এতে কোন রোগ-ব্যাধি হওয়ারও সম্ভাবনা থাকতে পারে।
৬. খাবার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ ও শেষে ‘আলহামদুল্লিাহ’ বলা :
খাবারের
শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ ও শেষে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা সুন্নাত। ইমাম আহমাদ
বলেন, খাবারে ৪টি জিনিস জমা হ’লে সে খাবার পরিপূর্ণ হয়; খাবার আগে
‘বিসমিল্লাহ’ বলা, শেষে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা, (একাধিক লোকের) অনেক হাত পড়া
এবং তা হালাল হওয়া।[17]
বিসমিল্লাহ বলে শুরু
করলে শয়তানের প্রভাব ও শরীক হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। রাসূল (ছাঃ)
বলেন,إِنَّ الشَّيْطَانَ لَيَسْتَحِلُّ الطَّعَامَ الَّذِي لَمْ يُذْكَرِ
اسْمُ اللهِ عَلَيْهِ- ‘অবশ্যই শয়তান (মুসলিমের) খাবার খেতে সক্ষম হয়; যদি
খাওয়ার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ না বলা হয়’।[18]
তিনি
আরো বলেন,إِذَا دَخَلَ الرَّجُلُ بَيْتَهُ فَذَكَرَ اللهَ عِنْدَ
دُخُولِهِ، وَعِنْدَ طَعَامِهِ، قَالَ الشَّيْطَانُ: لَا مَبِيتَ لَكُمْ
وَلَا عَشَاءَ، وَإِذَا دَخَلَ فَلَمْ يُذْكَرِ اللهَ عِنْدَ دُخُولِهِ
قَالَ الشَّيْطَانُ: أَدْرَكْتُمُ الْمَبِيتَ، فَإِذَا لَمْ يَذْكُرِ اللهَ
عِنْدَ طَعَامِهِ قَالَ: أَدْرَكْتُمُ الْمَبِيتَ وَالْعَشَاءَ- ‘তোমাদের
কেউ নিজ বাড়িতে প্রবেশকালে এবং খাওয়ার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বললে, তখন শয়তান
(তার সঙ্গীদেরকে) বলে, ‘তোমাদের জন্য রাত্রি যাপনের স্থানও নেই এবং রাতের
খাবারও নেই’। আর সে বাড়িতে প্রবেশকালে ‘বিসমিল্লাহ’ বললে এবং রাতে খাবার
সময় না বললে শয়তান বলে, ‘তোমরা রাতের খাবার পেলে, কিন্তু রাত্রি যাপনের
জায়গা নেই। আর যখন সে খাবার সময়েও বিসমিল্লাহ না বলে, তখন শয়তান বলে,
‘তোমরা রাত্রি যাপনের জায়গাও পেলে এবং খাবারও পেলে’।[19]
উল্লেখ্য যে, খাওয়ার শুরুতে কেবল ‘বিসমিল্লাহ’ বলবে। এর সঙ্গে ‘আর-রাহমানির রাহীম’ যোগ করার কোন দলীল নেই।
খাওয়ার
শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে ভুলে গেলে নির্দিষ্ট দো‘আ পড়তে হয়। আল্লাহর
রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ কোন খাবার খাবে, তখন সে যেন
‘বিসমিল্লাহ’ বলে। প্রথমে বলতে ভুলে গেলে স্মরণ হওয়া মাত্র বলবে, بِسْمِ
اللهِ أَوَّلَهُ وَآخِرَهُ، ‘বিসমিল্লাহি আওয়ালাহু ওয়া আ-খিরাহু’। অর্থ:
আল্লাহর নামে খাওয়ার শুরু ও শেষে।[20]
খাবার পর ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ বা নির্দিষ্ট দো‘আ পড়তে হয়। যেমন-
(ক) اَللّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِيْهِ وَأَطْعِمْنَا خَيْراً مِّنْهُ،
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা বা-রিক লানা ফীহি ওয়া আত্বইমনা খায়রাম মিন্হু।
অর্থঃ ‘হে আল্লাহ! আমাদের জন্য এতে বরকত দাও এবং এর চেয়ে উত্তম আহার দান কর।[21]
(খ) খাবার শেষে নিম্নোক্ত দো‘আটি পাঠ করলে পূর্বের গোনাহ মাফ হয়ে যায়।[22]
اَلْحَمْدُ للهِ الَّذِيْ أَطْعَمَنِيْ هذَا وَرَزَقَنِيْهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِّنِّيْ وَلاَ قُوَّةً-
উচ্চারণ : আলহামদু লিল্লা-হিল্লাযী আত্ব্‘আমানী হা-যা ওয়া রাযাক্বানীহি মিন গাইরি হাওলিম মিন্নী ওয়ালা ক্বুউওয়াহ।
অর্থ : ‘সেই আল্লাহর যাবতীয় প্রশংসা যিনি আমাকে এই খাদ্য খাওয়ালেন এবং জীবিকা দান করলেন, আমার কোন চেষ্টা ও সামর্থ্য ছাড়াই’।[23]
(গ) রাসূল (ছাঃ) খাবার শেষে বলতেন,
اللَّهُمَّ أَطْعَمْتَ وَأَسْقَيْتَ وَهَدَيْتَ وَأَحْيَيْتَ فَلَكَ الْحَمْدُ عَلَى مَا أَعْطَيْتَ-
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা আত্ব‘আমতা ওয়া আসক্বায়তা ওয়া হাদাইতা ওয়া আহ্য়াইতা, ফালাকাল হাম্দু ‘আলা মা আ‘ত্বায়তা।
অর্থ
: ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে আহার করিয়েছ, পান করিয়েছ, হেদায়াত দিয়েছ এবং
আমাকে জীবিত রেখেছ। সুতরাং তুমি যা আমাকে দিয়েছ, তার জন্য তোমার সমস্ত
প্রশংসা’।[24]
(ঘ) দুধ পান শেষে বলতে হয়, اَللّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِيْهِ وَزِدْنَا مِنْهُ উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা বা-রিক-লানা ফীহি ওয়া যিদনা মিন্হু।
অর্থঃ ‘হে আল্লাহ! আমাদের জন্য এতে বরকত দান কর এবং আমাদেরকে এর চেয়ে আরো বৃদ্ধি করে দাও’।[25]
খাবার
খাওয়ার মাঝে অথবা প্রত্যেক লোকমা খাওয়ার পরে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলার স্পষ্ট
দলীল নেই। কেউ কেউ এ হাদীছকে দলীল হিসাবে পেশ করেন যে, নবী করীম (ছাঃ)
বলেছেনإِنَّ اللهَ لَيَرْضَى عَنِ العَبْدِ أَنْ يَأْكُلَ الأَكْلَةَ، أَوْ
يَشْرَبَ الشَّرْبَةَ، فَيَحْمَدَهُ عَلَيْهَا- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পসন্দ
করেন যে, বান্দা খাবার খেয়ে তাঁর জন্য প্রশংসা করুক এবং পানীয় পান করে তাঁর
জন্য প্রশংসা করুক’।[26] এখানে ‘খাবার ও পানীয়’ বলতে এক সময়ের খাদ্য ও পানীয়কে বুঝানো হয়েছে। কারো মতে, প্রত্যেক লোকমা বুঝানো হয়েছে।[27]
৭. ডান হাতে পানাহার করা : ডান
হাতে পানাহার করতে হবে। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِذَا أَكَلَ
أَحَدُكُمْ فَلْيَأْكُلْ بِيَمِينِهِ، وَإِذَا شَرِبَ فَلْيَشْرَبْ
بِيَمِينِهِ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ يَأْكُلُ بِشِمَالِهِ، وَيَشْرَبُ
بِشِمَالِهِ ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যেন তার বাম হাত দ্বারা না খায় এবং পান না
করে। কারণ শয়তান তার বাম হাত দিয়ে পানাহার করে থাকে’। বর্ণনাকারী বলেন,
নাফে‘ (রাঃ) দু’টি কথা আরো বেশী বলতেন, ‘কেউ যেন বাম হাত দ্বারা কিছু গ্রহণ
না করে এবং অনুরূপভাবে তা দ্বারা কিছু প্রদানও না করে’।[28]
ওমর
বিন আবী সালামাহ (রাঃ) বলেন, আমি শৈশবকালে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে খাবার সময়
আমার হাত পাত্রের যেখানে-সেখানে পড়লে তিনি আমাকে বললেন,يَا غُلاَمُ سَمِّ
اللهَ وَكُلْ بِيَمِيْنِكَ وَكُلْ مِمَّا يَلِيْكَ، ‘হে বৎস! বিসমিল্লাহ
বল, তোমার ডান হাত দিয়ে খাও এবং নিজের পার্শ্ব থেকে খাও’।[29]
একদা এক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট বাম হাত দিয়ে কিছু খাচ্ছিল। তিনি তা লক্ষ্য করে তাকে বললেন,كُلْ بِيَمِينِكَ، قَالَ: لَا أَسْتَطِيعُ، قَالَ: لَا اسْتَطَعْتَ، مَا مَنَعَهُ إِلَّا الْكِبْرُ ‘তুমি ডান হাত দিয়ে খাও। সে বলল, আমি পারি না। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি যেন না পার। অহংকারই ওকে (আদেশ পালনে) বিরত রেখেছে। রাবী সালামাহ বলেন,فَمَا رَفَعَهَا إِلَى فِيه ‘সুতরাং (এই বদ দো‘আর ফলে) সে আর তার হাতকে মুখ পর্যন্ত উঠাতে পারেনি’।[30] তবে যার ডান হাত নেই অথবা ডান হাত ব্যবহার করার ক্ষমতা নেই, সে বাম হাত ব্যবহার করবে।
রুটি, খেজুর প্রভৃতি খাবার বৃদ্ধা, তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে খাওয়া যায়। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এই তিনটি আঙ্গুল দিয়ে খাবার খেতেন।[31]
৮. খাবার শেষে আঙ্গুল ও প্লেট চেঁটে খাওয়া :
খাবার
শেষে আঙ্গুল ও প্লেট চেটে খাওয়া উচিত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরূপ করতেন এবং
অপরকে করতে আদেশ করতেন। তিনি বলেন,إِذَا أَكَلَ أَحَدُكُمْ فَلاَ يَمْسَحْ
يَدَهُ حَتَّى يَلْعَقَهَا أَوْ يُلْعِقَهَا- ‘যখন তোমাদের কেউ খাবার খায়
তখন সে যেন তার আঙ্গুল চেঁটে খাওয়ার আগে তা না মুছে বা না ধোয়’।[32]
জাবের
বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, ‘নবী করীম (ছাঃ) আঙ্গুল ও প্লেটকে চেঁটে খেতে
আদেশ করেছেন এবং বলেছেন,إِذَا أَكَلَ أَحَدُكُمْ فَلَا يَمْسَحْ
أَصَابِعَهُ حَتَّى يَلْعَقَهَا فَإِنَّهُ لَا يَدْرِيْ فِيْ أَيِّ
طَعَامِهِ كَانَتِ الْبَرَكَةُ، ‘যখন তোমাদের কেউ খাবার খাবে আঙ্গুল চেঁটে
না খেয়ে হাত মুছবে না। কেননা সে জানে না যে, কোন খাবারে বরকত আছে’।[33] অন্য বর্ণনায় আছে, শেষের খাবারে বরকত নিহিত আছে।[34]
খাওয়ার শেষে আঙ্গুল চেঁটে খাওয়া উত্তম। কারণ আঙ্গুলের মাথা হ’তে এক প্রকার পদার্থ নির্গত হয়, যা খাদ্য হজমে সাহায্য করে। আর এজন্যই তরকারীতে আঙ্গুল ডোবালে তরকারী খুব তাড়াতাড়ি খারাপ হয়ে যায়।
উল্লেখ্য, প্লেট চেঁটে খেলে প্লেট দো‘আ বা ইস্তিগফার করে এ ধারণা সঠিক নয়। এ মর্মে বর্ণিত হাদীছ ছহীহ নয়।[35]
৯. খাবার শেষে কুলি করা : খাবার শেষে কুলি করা, যাতে খাদ্যের অবশিষ্টাংশ মুখ থেকে বের হয়ে যায়। রাসূল (ছাঃ) খাবার শেষে কুলি করতেন।[36]
১০. দস্তরখানা উঠানোর সময় দোআ পাঠ করা : খাবার শেষে দস্তরখানা ও থালা-বাসন উঠানোর সময় নিম্নোক্ত দোআ পাঠ করতে হয়।-
الْحَمْدُ لِلَّهِ حَمْدًا كَثِيْرًا طَيِّبًا مُّبَارَكًا فِيْهِ غَيْرَ مَكْفِىٍّ وَّلاَ مُوَدَّعٍ وَّلاَ مُسْتَغْنًى عَنْهُ رَبَّنَا-
উচ্চারণ : আল-হামদু লিল্লা-হি হাম্দান্ কাছীরান্ ত্বাইয়্যিবাম্ মুবা-রাকান্ ফীহি গায়রা মাকফিইয়্যিন ওয়ালা মুওয়াদ্দা‘ঈন ওয়ালা মুস্তাগ্নান্ ‘আনহু রাববানা।
অর্থ :
‘হে আল্লাহ! সমস্ত প্রশংসা তোমার, অধিক অধিক প্রশংসা, যা পবিত্র ও বরকতময়।
হে প্রভু! তোমার অনুগ্রহ হ’তে মুখ ফিরানো যায় না, আর এর অন্বেষণ ত্যাগ করা
যায় না এবং এর প্রয়োজন হ’তে মুক্ত থাকা যায় না’।[37]
১১. খাবারের কোন কিছু পড়ে গেলে তা উঠিয়ে পরিস্কার করে খাওয়া : পড়ে যাওয়া খাবার তুলে নিয়ে ময়লা পরিস্কার করে খাওয়ার নির্দেশ এসেছে হাদীছে। কারণ ঐ পতিত খাবারে বরকত থাকতে পারে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
إِذَا سَقَطَتْ لُقْمَةُ أَحَدِكُمْ فَلْيُمِطْ عَنْهَا الْأَذَى وَلْيَأْكُلْهَا، وَلَا يَدَعْهَا لِلشَّيْطَانِ، وَأَمَرَنَا أَنْ نَسْلُتَ الْقَصْعَةَ، قَالَ: فَإِنَّكُمْ لَا تَدْرُونَ فِي أَيِّ طَعَامِكُمُ الْبَرَكَةُ،
‘তোমাদের কারো খাবারের লোকমা হাত থেকে পড়ে
গেলে তার ময়লা দূর করে সে যেন তা খেয়ে ফেলে। আর শয়তানের জন্য তা ছেড়ে না
দেয়। তিনি আমাদেরকে প্লেট চেঁটে খাওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, তোমরা জান
না যে, তোমাদের কোন্ খাবারে বরকত আছে’।[38]
১২. পানীয়তে মাছি পড়লে তা ডুবিয়ে দিয়ে তুলে ফেলা : পানীয়তে মাছি পড়লে সেটিকে সরাসরি না তুলে পূর্ণরূপে তাতে ডুবিয়ে, অতঃপর তা তুলে ফেলে পান করা কর্তব্য। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
إِذَا وَقَعَ الذُّبَابُ فِيْ شَرَابِ أَحَدِكُمْ فَلْيَغْمِسْهُ ثُمَّ لِيَنْزِعْهُ (لِيَنْتَزِعْهُ) فَإِنَّ فِيْ إِحْدَى جَنَاحَيْهِ دَاءً وَالْأُخْرَى شِفَاءً-
‘যখন তোমাদের কারো পানীয় দ্রব্যে মাছি পড়বে, তখন তাকে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দিবে। তারপর তাকে বাইরে ফেলে দিবে। কারণ তার দু’টি ডানার মধ্যে একটিতে আছে রোগজীবাণু এবং অপরটিতে আছে রোগমুক্তি’।[39] মাছি যে ডানাতে রোগজীবাণু থাকে সেটিকে ডুবিয়ে দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করে। অতএব তা সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দেওয়ার পর ফেলে দেওয়া উচিত।
১৩. গরম খাবার ঠান্ডা হ’লে খেতে শুরু করা :
অধিক
গরম খাবার খেলে জিহবা বা মুখ পুড়ে যেতে পারে এবং খাবারের আসল স্বাদও
আস্বাদন করা যায় না। বেশী গরম খাবার গিলে ফেললে পেটেরও কোন ক্ষতি হ’তে
পারে। এজন্যই খাবার ঠান্ডা করে খেতে হবে। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, إِنَّهُ
أَعْظَمُ لِلْبَرَكَةِ ‘(খাবারের বেশী গরমভাব দূর করে খেলে) তাতে বরকত বেশী
হয়’।[40]
আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, ‘ভাপ না চলে যাওয়া পর্যন্ত কোন খাবার খাওয়া উচিত নয়’।[41]
১৪. খাদ্য ও পানীয়তে ফুঁক দিয়ে না খাওয়া :
গরম
খাবার ঠান্ডা করার জন্য অথবা পানীয়তে পতিত কোন ময়লা দূর করার জন্য ফুঁক
দেওয়া উচিত নয়। আর আহার্য বা পানপাত্রে নিঃশ্বাস ছাড়া যাবে না। কারণ এর ফলে
খাদ্য ও পানীয়তে ফুঁকের সাথে নির্গত কার্বনডাই-অক্সাইড গ্যাস মিশ্রিত হবে।
ফলে সে দূষিত গ্যাস শরীর ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। নবী করীম (ছাঃ)
বলেন,إِذَا شَرِبَ أَحَدُكُمْ فَلاَ يَتَنَفَّسْ فِي الإِنَاء، ‘তোমাদের
কেউ যখন কিছু পান করে, তখন সে যেন পানপাত্রে নিঃশ্বাস না ছাড়ে অথবা ফুঁক না
দেয়’।[42] তিনি খাদ্য ও পানীয়তে ফুঁক দিতে নিষেধ করেছেন।[43]
১৫. খাদ্যের দোষ বর্ণনা না করা :
খাদ্যের
কোন প্রকার ত্রুটি বর্ণনা না করে তা পসন্দ হ’লে খেতে হবে অন্যথা খাবে না।
কারণ তাতে রাঁধুনী মনে কষ্ট পায়। মহানবী (ছাঃ) কখনো খাবারের ত্রুটি বর্ণনা
করতেন না। কিছু খেতে ইচ্ছা হ’লে খেতেন, না হ’লে তা বর্জন করতেন।[44]
১৬. দাঁড়িয়ে পানাহার না করা :
কোন
পানীয় দাঁড়িয়ে পান করা উচিত নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ يَشْرَبَنَّ
أَحَدٌ مِنْكُمْ قَائِمًا فَمَنْ نَسِىَ فَلْيَسْتَقِئْ ‘তোমাদের মধ্যে কেউ
যেন দাঁড়িয়ে পান না করে। কেউ ভুলে গিয়ে পান করে থাকলে সে যেন তা বমি করে
ফেলে’।[45]
আনাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ)
নিষেধ করেছেন যে, কোন লোক যেন দাঁড়িয়ে পান না করে। আনাস (রাঃ)-কে দাঁড়িয়ে
খাওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে উত্তরে তিনি বললেন, ‘এটা তো আরো খারাপ এবং
আরো নিন্দনীয়।[46] কিন্তু বসার মত জায়গা বা পরিবেশ না থাকলে অথবা অন্য কোন অসুবিধা বা প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে পানাহার করা যায়।[47]
১৭. পানীয় তিন নিঃশ্বাসে পান করা :
পানীয়
এক নিঃশ্বাসে পান না করে তিন নিঃশ্বাসে পান করবে। রাসূল (ছাঃ) তিন
নিঃশ্বাসে পানি পান করতেন এবং বলতেন, إِنَّهُ أَرْوَى وَأَبْرَأُ وَأَمْرَأ
‘এতে বেশী তৃপ্তি আসে বা পিপাসা নিবারণ হয়, পিপাসার কষ্ট থেকে অথবা কোন
ব্যাধি সৃষ্টির হাত থেকে বাঁচা যায় এবং হজম, পরিপাক ও দেহের উপকার বেশী
হয়’।[48]
এর অর্থ এই নয় যে, এক নিঃশ্বাসে পানি পান করা বৈধ নয়। বরং উদ্দেশ্য হ’ল, এক নিঃশ্বাসে পান করা অপেক্ষা তিন নিঃশ্বাসে পান করা উত্তম।
১৮. পানপাত্রে নিঃশ্বাস না ফেলা : কোন পানীয় পান করার সময় পাত্রের বাইরে ৩ বার নিঃশ্বাস ফেলবে।[49] পানির পাত্রে বা খাবারে নিঃশ্বাস ছাড়বে না বা ফুঁক দিবে না।[50]
১৯. জগ বা কলসীর মুখে মুখ লাগিয়ে পানি পান না করা : কলসী, জগ বা এ জাতীয় পাত্রের মুখে মুখ লাগিয়ে পান করা উচিত নয়। নবী করীম (ছাঃ) এভাবে পান করতে নিষেধ করেছেন।[51] এভাবে পানি পান করলে জগ বা কলসীর ভিতরে কোন ময়লা বা পোকা-মাকড় থাকলে তা পেটে চলে যেতে পারে। তাছাড়া এভাবে পান করলে সংক্রামক ব্যাধির জীবাণু অন্যের মাঝে সংক্রমিত হ’তে পারে।
২০. পরিবেশনকারীর সবার শেষে খাওয়া :
যে ব্যক্তি খাবার পরিবেশন করবে তার জন্য মুস্তাহাব হ’ল যে, সে সবার শেষে
খাবে। রাসূল (ছাঃ) এরূপ করেছেন ও বলেছেন, إِنَّ سَاقِيَ الْقَوْمِ
آخِرُهُمْ شُرْبًا، ‘যে লোকদেরকে পানি পান করায়, সে যেন সবার শেষে পান
করে’।[52]
২১. একাকী না খেয়ে একত্রে খাওয়া :
একাকী না খেয়ে একাধিক লোক একত্রে খাওয়া ভাল। এতে বরকত রয়েছে। নবী করীম
(ছাঃ) বলেন,طَعَامُ الْوَاحِدِ يَكْفِى الاِثْنَيْنِ وَطَعَامُ
الاِثْنَيْنِ يَكْفِى الأَرْبَعَةَ وَطَعَامُ الأَرْبَعَةِ يَكْفِى
الثَّمَانِيَةَ ‘একজনের খাবার ২ জনের জন্য, ২ জনের খাবার ৪ জনের জন্য এবং ৪
জনের খাবার ৮ জনের জন্য যথেষ্ট’।[53]
তিনি
বলেন, كُلُوا جَمِيعًا، وَلَا تَفَرَّقُوا، فَإِنَّ الْبَرَكَةَ مَعَ
الْجَمَاعَةِ ‘তোমরা এক সাথে খাও এবং পৃথক পৃথক খেয়ো না। কারণ জামা‘আতের
সাথে (খাবারে) বরকত আছে’।[54]
একদা ছাহাবীগণ বললেন,
يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّا نَأْكُلُ، وَلَا نَشْبَعُ، قَالَ: فَلَعَلَّكُمْ تَأْكُلُونَ مُتَفَرِّقِينَ؟ قَالُوا: نَعَمْ، قَالَ: فَاجْتَمِعُوا عَلَى طَعَامِكُمْ، وَاذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَيْهِ، يُبَارَكْ لَكُمْ فِيه-
‘হে
আল্লাহর রাসূল! আমরা খাই, কিন্তু পরিতৃপ্ত হই না। তিনি বললেন, সম্ভবতঃ
তোমরা পৃথক পৃথক খাও। তাঁরা বললেন, জী হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহ’লে তোমরা
খাবারে এক সাথে বস এবং আল্লাহর নাম নাও, তাহ’লে তোমাদের খাবারে বরকত হবে’।[55]
তিনি
আরো বলেন, إِنَّ أَحَبَّ الطَّعَامِ إِلَى اللهِ مَا كَثُرَتْ عَلَيْهِ
الْأَيْدِي، ‘আল্লাহর নিকট সবচেয়ে পসন্দনীয় খাবার হ’ল সেই খাবার, যার উপর
অনেক হাত পড়ে’।[56]
তবে একাকী খাওয়াও বৈধ। মহান আল্লাহ বলেন,لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَأْكُلُوْا جَمِيْعًا أَوْ أَشْتَاتًا، ‘তোমরা একত্রে আহার কর অথবা পৃথক পৃথকভাবে আহার কর তাতে তোমাদের জন্য কোন অপরাধ নেই’ (নূর ২৪/৬১)।
উল্লেখ্য, কোন মজলিসে বা একত্রে খাওয়ার ক্ষেত্রে আগেভাগে উঠে না যাওয়া এবং বসে থেকে খাওয়ার ভান করার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীছটি অত্যন্ত যঈফ।[57] সুতরাং এ বিষয়টিকে সুন্নাত জ্ঞান করা ঠিক নয়।
২২. একাধিক লোক এক পাত্রে খাবার খেলে বেশী খাওয়ার চেষ্টা না করা :
একত্রে
খাবার খাওয়ার সময় সবার চেয়ে বেশী খাওয়ার চেষ্টা করা উচিত নয়। বরং সবার
চেয়ে কম খাওয়ার চেষ্টা করা উচিত। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহ’লে সকলের সমান
খাওয়ার চেষ্টা করা উচিত। আর খাবার সময় ভালো জিনিসটি আগে-ভাগে তুলে না খাওয়া
এবং বড় বড় লোকমা ধরে না খাওয়া। একটির স্থলে দু’টি এক সাথে তুলে খাওয়া এবং
স্বাভাবিকতার সীমালংঘন করে গোগ্রাসে খাওয়া সমীচীন নয়। রাসূল (ছাঃ) সঙ্গীর
অনুমতি ব্যতীত এক সঙ্গে দু’টি করে খেজুর খেতে নিষেধ করেছেন।[58]
২৩. কেউ খাওয়ার জন্য ডাকলে এবং ক্ষুধা ও খাবারের চাহিদা থাকলে মিথ্যা ওযর পেশ না করা :
কেউ কাউকে খাবার জন্য আহবান করলে এবং ক্ষুধা ও খাবারের চাহিদা থাকলে এগুলি
গোপন করে মিথ্যা ওযর পেশ করে খাওয়ার দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয়।[59]
২৪. খাদেম খানা প্রস্ত্তত করলে খাবারে তাকেও শরীক করা :
খাবার
তৈরীতে খাদেম পরিশ্রম করে, খাদ্যের সুগন্ধ তার নাকে যায় এবং হয়তো তার মন ঐ
খাবারের প্রতি আকৃষ্টও হয়। এজন্যই রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ হ’ল, তাকে বসিয়ে
এক সাথে খাওয়া। আর তাকে বসানো যদি সম্ভব না হয় বা সে বসতে না চায়, তাহ’লে
সেই খাবার হ’তে কিছু অংশ তুলে তাকে দেওয়া।[60]
২৫. যে মজলিসে মদ বা অন্য কোন হারাম জিনিস পরিবেশন করা হয় সেখানে অংশগ্রহণ না করা : যে অনুষ্ঠানে কোন হারাম খাদ্য-পানীয় পরিবেশন করা হয়, সেখানে যাওয়া মুসলমানের জন্য বৈধ নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَاليَوْمِ الآخِرِ فَلَا يَجْلِسْ عَلَى مَائِدَةٍ يُدَارُ عَلَيْهَا بِالخَمْر-
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে সে যেন কখনই সেই ভোজ অনুষ্ঠানে না বসে যাতে মদ পরিবেশিত হয়’।[61]
২৬. খাবারের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা : এত অধিক খাবার না খাওয়া যাতে স্বাভাবিক নড়াচড়ায় সমস্যা হয়। আবার বেশী খেলে পেটের পীড়া ও শরীর ভারী হ’তে পারে। ফলে ইবাদতে অলসতা আসতে পারে। আর বেশী খাওয়া আসলে কাফেরদের অভ্যাস। হদীছের নির্দেশ মোতাবেক খাবার খেলে শরীর ও স্বাস্থ্য ভাল থাকবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,الْكَافِرُ يَأْكُلُ فِى سَبْعَةِ أَمْعَاءٍ وَالْمُؤْمِنُ يَأْكُلُ فِى مِعًى وَاحِدٍ ‘মুসলিম খায় একটি মাত্র অন্ত্রে, পক্ষান্তরে কাফের খায় সাত অন্ত্রে।[62] তিনি আরো বলেন,مَا مَلَأَ آدَمِيٌّ وِعَاءً شَرًّا مِنْ بَطْنٍ. بِحَسْبِ ابْنِ آدَمَ أُكُلَاتٌ يُقِمْنَ صُلْبَهُ، فَإِنْ كَانَ لَا مَحَالَةَ فَثُلُثٌ لِطَعَامِهِ وَثُلُثٌ لِشَرَابِهِ وَثُلُثٌ لِنَفَسِهِ- ‘উদর অপেক্ষা নিকৃষ্টতর কোন পাত্র মানুষ পূর্ণ করে না। আদম সন্তানের জন্য ততটুকু খাদ্যই যথেষ্ট যতটুকুতে তার পিঠ সোজা থাকে। আর যদি এর চেয়ে বেশী খেতেই হয়, তাহ’লে সে যেন তার পেটের এক-তৃতীয়াংশ আহারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ব্যবহার করে’।[63] তবে এত কম খাওয়াও ঠিক নয়, যাতে শরীর ভেঙ্গে যায়। কারণ স্বাস্থ্য দুর্বল হয়ে পড়লে ইবাদতেও দুর্বলতা আসবে। সুতরাং পানাহারে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা উচিত।
২৭. প্লেট বা দস্তরখানা উঠানোর সময় দো‘আ পড়া : পানাহার শেষে প্লেট বা দস্তরখানা উঠানোর সময় বলবে, الْحَمْدُ لِلَّهِ حَمْدًا كَثِيْرًا طَيِّبًا مُبَارَكًا فِيْهِ، ‘আল-হামদুলিল্লা-হি হামদান কাছীরান ত্বাইয়েবাম মুবা-রাকান ফীহি’। অর্থ : ‘আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা বহু প্রশংসা পবিত্র প্রশংসা রবকতময় প্রশংসা। [64]
২৮. দাওয়াত খেলে মেযবানের জন্য দো‘আ করা :
কারো বাড়ীতে মেহমান হ’লে মেযবানের জন্য দো‘আ করা সুন্নাত। সুতরাং মেযবানের
জন্য এ দো‘আ করবে, اللهُمَّ أَطْعِمْ مَنْ أَطْعَمَنِي، وَأَسْقِ مَنْ
أَسْقَانِي ‘আল্লা-হুম্মা আত্ব‘ইম মান আত্ব‘আমানী ওয়াসক্বি মান সাক্বা-নী’। ‘হে আল্লাহ! যে আমাকে খাওয়ায়েছে তাকে তুমি খাওয়াও। আর যে আমাকে পান করিয়েছে তাকে তুমি পান করা’।[65]
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে পানাহারের উক্ত আদবগুলি মেনে চলার তাওফীক দিন-আমীন!
[1]. মুসলিম হা/১০১৫; তিরমিযী হা/২৯৮৯; মিশকাত হা/২৭৬০।
[2]. দারেমী হা/২৮১৮/২৮১৮; মুসনাদে আহমাদ হা/১৪৪৮১; ছহীহ, ইমাম মুসলিমের শর্তে সনদ শক্তিশালী।
[3]. ছহীহ তিরমিযী হা/৬১৪।
[4]. বুখারী হা/৫৬৩৩; মুসলিম হা/২০৬৭।
[5]. বুখারী হা/৫৬৩৪; মুসলিম হা/২০৬৫।
[6]. বুখারী হা/৫৩৭৬; তিরমিযী হা/১৮০৫; মিশকাত হা/৪১৫৯, ৪২১১।
[7]. তিরমিযী হা/১৮০৫; ইবনু মাজাহ হা/৩২৭৭; ছহীহ আত-তারগীব হা/২১২৩।
[8]. আবূদাঊদ হা/৩৭৭২; তিরমিযী হা/১৮০৫; ইবনু মাজাহ হা/৩২৭৭।
[9]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৮২৭৯; বুখারী হা/৫৩৯৮-৯৯।
[10]. ছহীহাহ হা/৩১২২।
[11]. আবূদাঊদ হা/৩৭৭৪; ইবনু মাজাহ হা/৩৩৭০; ছহীহাহ হা/২৩৯৪।
[12]. বুখারী হা/৫৪৬৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৭৪।
[13]. বুখারী হা/৬৭৪; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৫২৪২।
[14]. তুহফাতুল আহওয়াযী ৫/৪৮৫; আল-আদাবুশ শারইয়্যাহ ৩/২১৪।
[15]. মুসনাদে আহমাদ হা/২৭৪৮৬; ইবনু মাজাহ হা/৪৯৩।
[16]. আহমাদ হা/৭৫১৫; আবূদাঊদ হা/৩৮৫২; তিরমিযী হা/১৮৬০; ইবনু মাজাহ হা/৩২৯৭; দারেমী হা/২০৬৩।
[17]. যাদুল মা‘আদ ৪/২৩২।
[18]. মুসলিম হা/২০১৭; আবূদাঊদ হা/৩৭৬৬।
[19]. মুসলিম হা/২০১৮; আবূদাঊদ হা/৩৭৬৫।
[20]. আবূদাঊদ হা/৩৭৬৭; তিরমিযী হা/১৮৫৮।
[21]. আবূদাঊদ হা/৩৭৩০; তিরমিযী হা/৩৪৫৫।
[22]. ছহীহ তিরমিযী ৩/১৫৯।
[23]. তিরমিযী হা/৩৪৫৮; ইবনু মাজাহ হা/৩২৮৫।
[24]. আহমাদ হা/১৬১৫৯; ছহীহাহ হা/৭১।
[25]. আবূদাঊদ হা/৩৭৩০; তিরমিযী হা/৩৪৫৫।
[26]. মুসলিম হা/২৭৩৪; তিরমিযী হা/১৮১৬; নাসাঈ।
[27]. তুহফাতুল আহওয়াযী ৫/৪৩৭।
[28]. মুসলিম হা/২০২০; তিরমিযী হা/১৮০০; আবূদাউদ ৩৭৭৬।
[29]. বুখারী হা/৫৩৭৬; মুসলিম হা/৫৩৮৮৮।
[30]. মুসলিম হা/২০২১।
[31]. মুসলিম হা/২০৩২; আবূদাঊদ হা/৩৮৪৮।
[32]. বুখারী হা/৫৪৫৬; মুসলিম হা/২০৩১।
[33]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৩৮০৯; মুসলিম হা/২০৩৩; ইবনু মাজাহ হা/৩২৭০।
[34]. নাসাঈ, ইবনু হিববান হা/১৩৪৩; ইরওয়াউল গালীল ৭/৩২।
[35]. যঈফুল জামে‘ হা/৫৪৭৮।
[36]. বুখারী হা/৫৩৯০।
[37]. বুখারী হা/৫৪৫৮; মিশকাত হা/৪১৯৯।
[38]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৪২১৮; মুসলিম হা/২০৩৪।
[39]. বুখারী হা/৩৩২০; ইবনু মাজাহ; মিশকাত হা/৪১১৫।
[40]. মুসনাদে আহমাদ হা/২৬৪১৮; দারেমী হা/২০৪৭; ছহীহাহ হা/৩৯২।
[41]. বায়হাক্বী, ইরওয়াউল গালীল হা/১৯৭৮।
[42]. বুখারী হা/৫৬৩০; মুসলিম হা/২৬৭; আবূদাঊদ হা/৩৭২৮; তিরমিযী হা/১৮৮৮; ইবনু মাজাহ হা/৩৪২৯।
[43]. আহমাদ, ছহীহুল জামে‘ হা/৬৯১৩।
[44]. বুখারী হা/৫৪০৯; মুসলিম হা/২০৬৪।
[45]. মুসলিম হা/২০২৬; মিশকাত হা/৪২৬৭।
[46]. মুসলিম হা/২০২৪।
[47]. বুখারী হা/১৬৩৭, ৫৬১৫; মুসলিম হা/২০২৭; ইবনু মাজাহ হা/৩৩০১।
[48]. বুখারী, মুসলিম হা/২০২৮।
[49]. বুখারী হা/৫৬৩১; ছহীহাহ হা/৩৮৭।
[50]. বুখারী হা/১৫৩; মিশকাত হা/৪২৭৭।
[51]. বুখারী হা/৫৬২৭; ৫৬২৯; মুসলিম হা/১৬০৯।
[52]. মুসলিম হা/৬৮১।
[53]. মুসলিম হা/৫৪৮৯; ছহীহ তিরমিযী হা/১৮২০; ইবনু মাজাহ হা/৩২৫৪।
[54]. ইবনু মাজাহ হা/৩২৮৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৫০০।
[55]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৫৬৪৮; আবূ দাঊদ হা/৩৭৬৪; ইবনু মাজাহ হা/৩২৮৬; ছহীহুল জামে‘ হা/১৪২।
[56]. মুসনাদু আবী ইয়ালা হা/২০৪৫; আল-মু‘জামুল আওসাত হা/৭৩১৭; ছহীহুল জামে‘ হা/১৭১।
[57]. সিলসিলাহ যঈফাহ হা/২৩৮-২৩৯।
[58]. বুখারী হা/২৪৫৫; মুসলিম হা/২০৪৫।
[59]. আহমাদ, ইবনে মাজাহ, ছহীহুল জামে‘ হা/৭২৩০।
[60]. বুখারী হা/৫৪৬০; মুসলিম হা/১৬৬৩।
[61]. আহমাদ, তিরমিযী হা/২৮০১; হাকেম, আল-মুসতাদরাক হা/৭৭৭৯; আদাবুয যিফাফ পৃঃ ১৬৩-১৬৪, মেহমান নেওয়াযীর আদব দ্রঃ।
[62]. বুখারী হা/৫৩৯৬; মুসলিম হা/৫৪৯৩; ইবনু মাজাহ হা/৩২৫৭।
[63]. তিরমিযী হা/২৩৮০; ইবনু মাজাহ হা/৩৩৪৯; হাকেম ৪/১২১; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৬৭৪।
[64]. বুখারী হা/৫৪৫৮; মিশকাত হা/৪১৯৯।
[65]. মুসলিম হা/২০৫৫; আহমাদ হা/২৩৮৬০, সনদ ছহীহ।