ভূমিকা :

ই‘তিকাফ মানুষকে দুনিয়াবী ব্যস্ততা পরিহার করে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হওয়া শিক্ষা দেয় এবং আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক জুড়ে দেয়। এতে আল্লাহর প্রতি মহববত বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার গোনাহ মাফ করিয়ে নেওয়ার জন্য বিশেষ কিছু সুযোগ দিয়েছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল, এ মাসের শেষ দশকের বরকতময় রজনী ‘লায়লাতুল ক্বদর’ (ليلة القدر) যা হাযার মাস অপেক্ষা উত্তম। সেই রজনী পাবার জন্য ই‘তিকাফ এক বিশেষ ব্যবস্থা।

ই‘তিকাফের পরিচয় : 

ই‘তিকাফ العَكْفُ ধাতু হ’তে উৎপন্ন। যা বাবে ইফতি‘আল-এর মাছদার। অর্থ : নিজেকে কোন স্থানে বদ্ধ রাখা। শারঈ পরিভাষায় আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে নিজেকে মসজিদে ইবাদত ও তেলাওয়াতের মধ্যে বদ্ধ রাখাকে ই‘তিকাফ বলা হয়।[1] আর যে ব্যক্তি এভাবে আবদ্ধ থেকে মসজিদে ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকে তাকে বলা হয় মু‘তাকিফ (معتكف) বা আকিফ (عاكف)।[2]

ই‘তিকাফের শারঈ বিধান :

ই‘তিকাফ (الإعتكاف) শরী‘আত নির্দেশিত একটি ইবাদত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيْمَ وَإِسْمَاعِيْلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِيْنَ وَالْعَاكِفِيْنَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ- ‘আর আমরা ইবরাহীম ও ইসমাঈলের কাছে নির্দেশ পাঠিয়েছিলাম এই মর্মে যে, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারীদের জন্য, এখানে অবস্থানকারীদের জন্য এবং রুকূকারী ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো’ (বাক্বারাহ ২/১২৫)। উল্লেখিত আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ই‘তিকাফের বিধান শরী‘আত সিদ্ধ ও প্রাচীন। বিধায় আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (আঃ) ও ইসমাঈল (আঃ)-কে ই‘তিকাফকারীদের জন্য আল্লাহর ঘরকে পাক-পবিত্র রাখতে বলেছেন।

নবী করীম (ছাঃ) প্রতি বছর দশ দিন ই‘তিকাফ করেন। এমনকি যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন, সে বছর তিনি বিশ দিন ই‘তিকাফ করেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,يَعْتَكِفُ فِىْ كُلِّ رَمَضَانَ عَشْرَةَ أَيَّامٍ، فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الَّذِىْ قُبِضَ فِيهِ اعْتَكَفَ عِشْرِيْنَ يَوْمًا، ‘রাসূল (ছাঃ) প্রতি রামাযান মাসে দশ দিন ই‘তিকাফ করতেন। যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন সে বছর বিশ দিন ই‘তিকাফ করেন’।[3]

ই‘তিকাফের উদ্দেশ্য :

ই‘তিকাফের উদ্দেশ্য হ’ল আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন করা। নিজের গোনাহ মাফ করে নেওয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হ’ল ই‘তিকাফ। তাবেঈ মাসরূক (রহঃ) বলেন, ব্যক্তির জন্য করণীয় হ’ল সে এমন কোন স্থানে একাকী হবে, যেখানে সে নিজের গোনাহ স্মরণ করে তা হ’তে ক্ষমা প্রার্থনা করবে।[4] এক্ষেত্রে ই‘তিকাফ এক উত্তম মাধ্যম। আর এর মাধ্যমে ‘লাইলাতুল ক্বদরকে’ অন্বেষণ করা যায়।

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কবদরের রাত অন্বেষণের উদ্দেশ্য তাঁর কাছে স্পষ্ট হবার পূর্বে রামাযানের মধ্যেই দশ দিন ই‘তিকাফ করলেন। দশ দিন অতিবাহিত হবার পর তিনি তাঁবু তুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন। অতএব তা গুটিয়ে ফেলা হ’ল। অতঃপর তিনি জানতে পারেন যে, তা শেষ দশ দিনের মধ্যে আছে। তাই তিনি পুনরায় তাঁবু খাটানোর নির্দেশ দিলেন। তাবু খাটানো হ’ল। এরপর তিনি লোকদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে লোক সকল! আমাকে ক্বদরের রাত সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল এবং আমি তোমাদের তা জানানোর জন্য বের হয়েছিলাম। কিন্তু দু’ব্যক্তি পরস্পর ঝগড়া করতে করতে উপস্থিত হ’ল এবং তাদের সাথে ছিল শয়তান। তাই আমি তা ভুলে গেছি। অতএব তোমরা তা রামাযান মাসের শেষ দশ দিনে অন্বেষণ কর।[5]

ই‘তিকাফের প্রকারভেদ :

ই‘তিকাফ দুই প্রকার। যথা- ১. সুন্নাত ও ২. ওয়াজিব।[6] 

১. সুন্নাত : সুন্নাত ই‘তিকাফ হ’ল যেটা রাসূল (ছাঃ), তাঁর স্ত্রীগণ এবং ছাহাবায়ে কেরাম করেছেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন,اَنَّ النَّبِيَ النَّبِىُ صَلَّ اللهُ علَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَعْتَكِفُ العَشْرَ الأَواَخِرِ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللهُ، ثٌمَّ اِعْتَفَ اَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ- ‘রাসূল (ছাঃ) মৃত্যু পর্যন্ত রামাযান মাসের শেষ দশ দিন ই‘তিকাফ করেছেন। অতঃপর তাঁর পরে তাঁর স্ত্রীগণ  ই‘তিকাফ করেছেন’।[7]

২. ওয়াজিব : ওয়াজিব ই‘তিকাফ হ’ল, যা ই‘তিকাফকারী নিজের উপর আবশ্যক করে নেয়। যেমন যদি কেউ কোন ভালো কাজের উদ্দেশ্যে ই‘তিকাফ করার মানত করে তাহ’লে তার মানত পূরণ করা আবশ্যক। ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন,اَنًّ عُمَر سَأَلَ النَّبِىُ صَلَّ اللهُ علَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ كُنْتُ نَذَرْتُ فِي الجَاهِلِيَةِ أَنْ أَعْتَكِفَ لَيلةً فِي الْمَسْجِدِ الْحَرامِ قَالَ فَأَؤفِ بِنَذْرِكَ- ‘ওমর (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন যে, আমি জাহেলী যুগে মসজিদুল হারামে এক রাত ই‘তিকাফ করার মানত করেছিলাম (আমি কি তা পূরণ করব?) নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তোমার মানত পূরণ কর’।[8]

ই‘তিকাফের স্থান : মসজিদেই ই‘তিকাফ করতে হবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلَا تُبَاشِرُوْهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُوْنَ فِي الْمَسَاجِدِ- ‘আর যতক্ষণ তোমরা ই‘তিকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা কর না’ (বাক্বারাহ ২/১৮৭)

রাসূল (ছাঃ) মসজিদে ই‘তিকাফ করতেন। তদ্রূপ তাঁর স্ত্রীগণ মসজিদে ই‘তিকাফ করেছিলেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, كَانَ النَّبِيَ النَّبِىُ صَلَّ اللهُ علَيْهِ وَسَلَّم يُصْغِى اِلَى رَاسِهِ وَهُوَ مُجَاوِرُ فِى الْمَسْجِدِ فَأَرَجِّلُهُ وَاَنَا حَائِضٌ، ‘মসজিদে ই‘তিকাফরত অবস্থায় নবী করীম (ছাঃ) আমার দিকে তাঁর মাথা ঝুঁকিয়ে দিতেন আর আমি ঋতুবতী অবস্থায় তাঁর চুল অাঁচড়িয়ে দিতাম’।[9]

যে কোন মসজিদে ই‘তিকাফ করা জায়েয।[10] কেননা আল্লাহ তা‘আলা সাধারণভাবে (فِى المَسَاجِدِ) ‘মসজিদ সমূহে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৭) উল্লেখ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস এবং হাসান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছে এসেছে যে, ছালাত (তথা জামা‘আত) হয়, এরূপ মসজিদ ব্যতীত ই‘তিকাফ হবে না।[11]

ই‘তিকাফকারীর মসজিদে প্রবেশ ও বের হওয়া : ই‘তিকাফ স্থলে সূর্যাস্তের পূর্বে প্রবেশ করবে এবং ঈদের আগের দিন বাদ মাগরিব বের হবে। রাসূল (ছাঃ) রামাযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করতেন।[12] আর শেষ দশক বলতে শেষ দশ রাত্রিকে বুঝানো হয় (সূরা ফজর ২)। আর ২০ তারিখ সুর্যাস্তের মাধ্যমে ২১ তারিখ শুরু হয় এবং ১লা শাওয়ালের চন্দ্রোদয়ের মাধ্যমে শেষ হয়। কোন কোন বিদ্বান আয়েশা (রাঃ) কর্তৃক রাসূল (ছাঃ) ই‘তিকাফের ইচ্ছা করলে ফজরের ছালাত আদায় করার পর তাঁর ই‘তিকাফস্থলে প্রবেশ করতেন[13] মর্মে বর্ণিত হাদীছটি থেকে ফজরের পর ই‘তিকাফ শুরুর ব্যাপারে মত প্রকাশ করলেও তার জবাবে ওলামায়ে কেরাম বলেন, রাসূল (ছাঃ) আগের দিন সূর্যাস্তের সময় মসজিদে প্রবেশ করে ফজর পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করতেন এবং এরপর স্বীয় ই‘তিকাফস্থলে একাকী হ’তেন।[14]

মহিলাদের ই‘তিকাফের বিধান :  মহিলাদের জন্য ই‘তিকাফ করা শরী‘আত সম্মত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) বলেন,أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم ذَكَرَ أَنْ يَعْتَكِفَ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ، فَاسْتَأْذَنَتْهُ عَائِشَةُ فَأَذِنَ لَهَا،  ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রামাযান মাস শেষ দশদিন ই‘তিকাফ করবেন বলে উল্লেখ করলেন। তখন আয়েশা (রাঃ) তাঁর কাছে ই‘তিকাফের অনুমতি চাইলে তিনি তাকে অনুমতি দিলেন।[15] তিনি আরো বলেন, اَنَّ النَّبِيَ النَّبِىُ صَلَّى اللهُ علَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَعْتَكِفُ العَشْرَ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللهُ، ثٌمَّ اِعْتكَفَ اَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ، ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মৃত্য পর্যন্ত রামাযান মাসের শেষ দশদিন ই‘তিকাফ করেছেন। অতঃপর তাঁর পর তাঁর স্ত্রীগণ ই‘তিকাফ করেছেন’।[16] অতএব নিরাপদ পরিবেশ ও পৃথক ব্যবস্থাপনা থাকলে মহিলারাও ই‘তিকাফ করতে পারবে।

ই‘তিকাফ করার ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য শর্ত :

ক. স্বামীর অনুমতি : স্বামীর অনুমতি ব্যতীত মহিলারা ই‘তিকাফ করতে পারবে না। যেমন আয়েশা (রাঃ) ই‘তিকাফের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করছিলেন। তদ্রূপ হাফছাহ ও যায়নাব (রাঃ)ও অনুমতি চেয়েছিলেন।[17]

খ. ফিৎনার আশংকা না থাকা : মহিলার জন্য ই‘তিকাফ করা বৈধ হবে না, যদি তার ব্যাপারে কোন আশংকা কিংবা তার কারণে অন্য কোন পুরুষ ফিৎনায় পড়ার আশংকা থাকে। সব ধরনের ফিৎনা থেকে নিরাপদ হ’লে মহিলাদের ই‘তিকাফ করা বৈধ হবে।[18] 

মহিলাদের জন্য পর্দা দিয়ে মসজিদে আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে। রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণ যখন ই‘তিকাফ করতেন তখন মসজিদে তাদের জন্য আলাদা তাঁবু টাঙ্গানো হ’ত। কেননা মসজিদে পুরুষরা ছালাতের জন্য উপস্থিত হয়। তাই মসজিদে মহিলাদের জন্য এমন স্থান নির্ধারণ প্রয়োজন যেখানে পুরুষরা তাদেরকে দেখতে পাবে না। মূলতঃ মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকাই উত্তম।[19]   

যেসব কাজ করলে ই‘তিকাফ বাতিল হয় :

নিম্নোক্ত কাজের যে কোন একটি করলে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। যেমন-

(ক) স্ত্রী সহবাস : স্ত্রী সহবাস করলে ই‘তিকাফ বাতিল হয়ে যাবে।[20] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ ‘আর তোমরা স্ত্রীগমন করো না যখন তোমরা মসজিদে ই‘তেকাফ অবস্থায় থাক’ (বাক্বারাহ ২/১৮৭)

(খ) শারঈ ওযর ব্যতীত মসজিদ থেকে বের হওয়া : ই‘তিকাফকারী কোন অবস্থাতেই মসজিদ থেকে বের হবে না। তবে পানাহার, প্রস্রাব-পায়খানা এবং শারঈ কোন ওযর থাকলে বের হ’তে পারবে। আয়েশা (রাঃ) বলেন,كَانَ النَّبِيَ النَّبِىُ صَلَّ اللهُ علَيْهِ وَسَلَّم يُصْغِى اِلَى رَاسِهِ وَهُوَ مُجَاوِرُ فِى الْمَسْجِدِ فَأَرَجِّلُهُ وَاَنَا حَائِضٌ، ‘মসজিদে ই‘তিকাফ অবস্থায় নবী করীম (ছাঃ) আমার দিকে তাঁর মাথা ঝুকিয়ে দিতেন আর আমি ঋতুবতী অবস্থায় তাঁর চুল অাঁচড়িয়ে দিতাম’।[21] তিনি আরো বলেন,

اَلسُّنَّةُ عَلَى المُعْتَكِفِ : اَنْ لاَ يَعٌوْدَ مَرِيْضًا، ولاَ يَشْهَدَ جَنَا زَةً، وَلاَ يَمَسَّ إِمْرَأَةً، وَلا يُبَاشِرَهَا، وَلَا يَخْرُجَ لِحَاجَةٍ،اِلاًّ لمَا لَابُدَّ مِنهُ، وَلَا اِعْتِكَافَ اِلَّا بِصَوْمٍ، وَلَا اِعْتِكَافَ اِلَّافِى مَسْجِدٍ جاَمِعٍ،

ই‘তিকাফকারীর জন্য সুন্নাত হচ্ছে, সে কোন রোগীর সেবা করতে মসজিদ থেকে বের হবে না। কোন জানাযায় উপস্থিত হবে না। স্ত্রীর সাথে সহবাস করবে না। (শারঈ) প্রয়োজন ব্যতীত মসজিদ থেকে বের হবে না। ছিয়াম ব্যতীত কোন ই‘তিকাফ নেই। জামে মসজিদ ব্যতীত কোন ই‘তিকাফ নেই।[22]

ই‘তিকাফকারীর জন্য যা বৈধ :

ক. মসজিদের একাংশে তাঁবু টাঙ্গানো : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন ই‘তিকাফের ইচ্ছা করতেন তখন আয়েশা (রাঃ) মসজিদে তাঁবু টাঙ্গিয়ে দিতেন।[23] মসজিদের পিছন দিকে ই‘তিকাফকারী ছোট্ট তাঁবু টানিয়ে সেখানে ই‘তিকাফ করতে পারবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন ই‘তিকাফ করতেন, তখন আয়েশা (রাঃ) তাঁর জন্য একটি তাঁবু (خِبَاءٌ) তৈরি করে দিতেন। আর এটি তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশেই করতেন।[24] তিনি একবার একটি তুর্কী তাঁবুতে ই‘তিকাফ করেছিলেন। যার দরজায় একটি চাটাই ঝুলানো ছিল।[25]

খ. মসজিদে ওযূ ও গোসল করা : রাসূল (ছাঃ)-এর খাদেম আনাস (রাঃ) বলেন,تَوَضَّأ النَّبِىُ صَلَّ اللهُ علَيْهِ وَسَلَّمَ فِى الَمَسْجِدِ وُضُوْءًا خَفِيْفًا، ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খুব অল্প পানি খরচ করে মসজিদে ওযূ করেছেন।[26]

গ. মসজিদে বিছানার ব্যবস্থা করা : ই‘তিকাফকারীর জন্য মসজিদে বিছানা বিছানো যায়। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়,فَلَمَّا كَانَ صَبيحةً عِشْرِيْنَ نَقَلْنَا مَتَاعَنَا- ‘একুশতম দিনের সকালে আমরা আমাদের বিছানা পত্র সরিয়ে দিলাম’।[27]

ঘ. শারঈ প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া : মসজিদে পেশাব-পায়খানার ব্যবস্থা না থাকলে প্রস্রাব-পায়খানার জন্য মসজিদ  থেকে  বের  হওয়া  যাবে।   এছাড়া  শারঈ  কোন

প্রয়োজনে বের হওয়া যাবে।[28]

ঙ. স্ত্রীর সাথে কথা বলা : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর স্ত্রী ছাফিয়া (রাঃ)-এর সাথে কথা বলেছেন। ছাফিয়া (রাঃ) বলেন,  রামাযান মাসের শেষ দশ দিনে তিনি একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে দেখতে আসলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর সাথে অনেক্ষণ কথা বললেন। এরপর তিনি উঠে গেলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর সাথে উঠলেন এবং মসজিদের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।[29]

ঙ. মুস্তাহাযা মহিলার ই‘তিকাফ করা জায়েয : মুস্তাহাযা মহিলার ই‘তিকাফ করা জায়েয। তবে তাকে খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যেন মসজিদে নাপাকী না লাগে।  আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে তাঁর এক মুস্তাহাযা স্ত্রী ই‘তিকাফরত অবস্থায় ছিলেন। তাঁর লাল ও হলুদ বর্ণের রক্ত প্রবাহিত হ’ত। ছালাত আদায়কালে আমরা অনেক সময় তাঁর নীচে পাত্র রাখতাম।[30]

ই‘তিকাফকারীর শিষ্টাচার : ই‘তিকাফকারীর জন্য করণীয় হ’ল, সর্বদা আল্লাহ তা‘আলার ধ্যানে মগ্ন থেকে বেশী বেশী ছালাত আদায়, ক্বুরআন তেলাওয়াত, যিকির এবং আল্লাহর নিকট ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করা। বিশেষ করে বেজোড় রাত্রিগুলোতে লায়লাতুল ক্বদর অন্বেষণ করা। শুধু ঘুমালে ই‘তিকাফের উদ্দেশ্য হাছিল হবে না। অনেককে দেখা যায়, ই‘তিকাফে বসে দুনিয়াবী অহেতুক কথা, কাজ বা খোশ-গল্পে মত্ত থাকে, যা ই‘তিকাফের বৈশিষ্ট্য পরিপন্থী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবীগণের ই‘তিকাফ এরূপ ছিল না।

শেষ কথা : ই‘তিকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তাই লোক দেখানো এবং দুনিয়াবী স্বার্থ পরিহার করে, শুধু মাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ই‘তিকাফ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে শরী‘আতের বিধান মেনে ই‘তিকাফ করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!


[1]ফিক্বহুস্ সুন্নাহ্ ১ম খন্ড, (কায়রো, মিশর : দারুল ফাতাহ), পৃঃ ৫৩৯

[2]আল-মিছবাহুল মুনীর ২/৪২৪; লিসানুল আরব ৯/২৫২।

[3]বুখারী হা/২০৪৪; ছহীহ ইবনু খুযাইমা হা/২২২১

[4]সিলসিলা আছারুছ ছহীহাহ, আছার নং ৩৪৫।

[5]বুখারী হা/২০১৮; মুসলিম হা/১১৬৭।

[6]ফিকহুস্ সুন্নাহ, ১/৫৪০ পৃঃ।

[7]বুখারী হা/২০২৬; মুসলিম হা/১১৭২।

[8]বুখারী হা/২০৩২।

[9]বুখারী হা/২০২৮; মুসলিম হা/২৯৭)।

[10]ছহীহ্ ফিকহুস্ সুন্নাহ্ পৃঃ ১৫১।

[11]. বায়হাক্বী হা/৮৩৫৫, ৪/৩১৬; বিস্তারিত দ্রঃ মির‘আত হা/২১২৬-এর আলোচনা ৬/১৬৪-১৬৬

[12]বুখারী হা/২০২৫, মুসলিম; মিশকাত হা/২০৯৭

[13]আবুদাঊদ হা/২৪৬৪, ইবনু মাজাহ হা/১৭৭১।

[14]নববী, শরহ মুসলিম ৮/৬৮, ফিক্হুস সুন্নাহ ২/৪৩৭

[15]বুখারী হা/২০৪১-৪৫।

[16]বুখারী হা/২০২৬; মুসলিম হা/১১৭২।

[17]বুখারী হা/২০৩৩, ২০৪১-৪৫; মুসলিম হা/১১৭২-৭৩।

[18]ছহীহ্ ফিকহুস্ সুন্নাহ্ পৃঃ ১৫২।

[19]ফিকহুস্ সুন্নাহ ল্লিন্নিসা (মাকতাবাতুত্ তাওফিকিয়্যাহ), পৃঃ ২৪৭।

[20]তাফসীরে কুরতুবী, বিদয়াতুল মুজতাহিদ ১/৪৭০; ফতহুল বারী ৪/২৭২; আস-সায়লুল জারার ২/১৩৬।

[21]বুখারী হা/২০২৮।

[22]আবু দাউদ হা/২৪৭৩ সনদ ছহীহ; বায়হাক্বী  ৪/৩১৫

[23]বুখারী হা/২০৩৩।

[24]. বুখারী, হা/২০৩৩; মুসলিম, হা/১১৭৩।

[25]. মুসলিম, হা/১১৬৭; ছহীহ ইবনে খুযায়মা হা/২১৭১, ২২১৯।

[26]ছহীহ্ আহমাদ ৫/৩৬৪।

[27]বুখারী হা/২০৪০।

[28]. আবূদাঊদ হা/২৪৭৩।

[29]বুখারী হা/২০৩৫; ছহীহ্ মুসলিম, হা/২১৭৫।

[30]বুখারী হা/৩০৯; সুনান দারেমী হা/৮৭৭।





ভয়াবহ দূষণ, বিপর্যস্ত জীবন! - মুহাম্মাদ আব্দুছ ছবূর মিয়া, ঝিনাইদহ
ঈমানের গুরুত্ব ও ফযীলত - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
আশূরায়ে মুহাররম - আত-তাহরীক ডেস্ক
আল-কুরআনে বিজ্ঞানের নিদর্শন (৩য় কিস্তি) - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মুসলিম চেতনা - মুহাম্মাদ সিরাজুল ইসলাম, যশোর
পরকীয়া : কারণ ও প্রতিকার (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল
খেয়াল-খুশির অনুসরণ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ভুল সংশোধনে নববী পদ্ধতি (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আত্মসমর্পণ - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
যুবসমাজের অধঃপতন : কারণ ও প্রতিকার (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
নফল ছালাতের গুরুত্ব ও ফযীলত - ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
আরও
আরও
.