ভূমিকা :
কালের আবর্তন কত ভাবেই না নাড়া দেয় বিশ্বকে। এ বছরের (২০১১) গোড়ার দিকে বিশ্ব নড়ে ওঠে এক নতুন কম্পনে। এরূপ কম্পন পৃথিবীর বুকে এটাই প্রথম। ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ জাপানের কাঁপুনি বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিল নাকি? না, এটি ‘সাইবার ওয়্যার’ তথা তথ্যযুদ্ধের আলোড়ন। একটি ওয়েবসাইট ‘উইকিলিকসে’র দোলা। কেউ কেউ বলেন, ১৯৪৫ সালের ৯ আগষ্ট জাপানের নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমাটি পড়ার পর এত বড় বিস্ফোরণ আর দেখেনি বিশ্ববাসী। একটি ওয়েবসাইট এটি কিভাবে পারে? ওয়েবসাইটটিই বা কার? তার উদ্দেশ্য কি? এসব আলোচনার জন্যই আমাদের এই উপস্থাপনা।
উইকিলিকস কি :
শব্দটি দু’টি বিশেষ্যের সমন্বয়ে গঠিত। একটি হচ্ছে Wiki, অপরটি Leaks. Wiki শব্দের অর্থ এক কথায় বলতে গেলে, তথ্যের মাধ্যমে পরিবর্তনশীল ওয়েবসাইট। Oxford Advanced Learners Dictionary-তে বলা হয়েছে, A website that allows any user to change or add to the information it contains. ‘এমন একটি ওয়েবসাইট, যা যেকোন ব্যবহারকারীকে তাতে অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোকে তথ্যের মাধ্যমে পরিবর্তন বা সংযোজনের অনুমতি দেয়’ (P. 1763)।
Leak শব্দের অর্থ ফাঁটল, ছিদ্র, নির্গত, প্রকাশ প্রভৃতি। Oxford-এর ভাষ্য অনুযায়ী To allow liquid or gas to get in or out through a small hole or crack. ‘গর্ত বা ছোট ছিদ্র দিয়ে তরল কিংবা বায়বীয় পদার্থ আগমন-নির্গমন হ’তে দেয়া’ (P. 875)।
সুতরাং WikiLeaks শব্দের অর্থ দাঁড়ায়, পরিবর্তনশীল এমন একটি ওয়েবসাইট, যা থেকে তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। মোটকথা উইকিলিকস হচ্ছে গোপন তথ্য ফাঁসকারী ওয়েবসাইট।
অ্যাসাঞ্জের পরিচয় :
নাম জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জ। ১৯৭১ সালের ৩ জুলাই ওশেনিয়া মহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের টাউন্সভিল নামের ছোট্ট শহরে জন্মগ্রহণ করেন এই ‘ওয়ার্ল্ড সাইবার অরিয়র’। আর দশটি শিশুর মত শুরু হয়নি অ্যাসাঞ্জের শিক্ষা জীবন। মা ক্রিস্টিন ক্লেয়ার মনে করতেন, ধরাবাঁধা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন মানুষের কৌতূহলী মনটাকে মেরে ফেলে। মা তার ক্ষীপ্রবুদ্ধিদীপ্ত এই শিশুকে তাই কোন প্রতিষ্ঠানে দেননি। তিনি নিজেই ছিলেন তার শিক্ষক। তিনি তাকে পড়ে শোনাতেন গ্রীক সাহিত্যের গল্প, উপন্যাস, নাটক। অ্যাসাঞ্জের কৈশোরের কয়েক বছর কাটে ছোট্ট দ্বীপ ম্যাগনেটিক আইসল্যান্ডে। বয়সে যেমন দুরন্ত কিশোর, তেমনি দ্বীপের পরিবেশ! সেই সাথে ছিল একটি ঘোড়া। আর ঠেকায় কে? ঘোড়ায় চড়ে সারা দ্বীপ দাপিয়ে বেড়াতেন দাপুটে বীরের মত। রোদে পুড়তেন, বৃষ্টিতে ভিজতেন। সাগরে মাছ ধরতেন। এ যেন কৈশোরের উচ্ছ্বলতার পূর্ণ আস্বাদন।
তিনি মেলবোর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ও পদার্থবিদ্যা পড়েছেন। কিন্তু ডিগ্রি অর্জন করা পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে পারেননি। তাতে কি? ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন, বিজ্ঞান, বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয়ে ছিল তার অতীব আগ্রহ। এসব বিষয়ে ব্যাপক পড়াশুনা করেন তিনি।
উইকিলিকসের জন্ম ও উদ্দেশ্য :
২০০৬ সালের ডিসেম্বরে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেন মিডিয়া ওয়েবসাইট উইকিলিকস। তাঁর মতে, গোপনীয়তাই সমস্ত অন্যায়ের হাতিয়ার। একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে থাকে পাহাড়সম গোপনীয়তা নিয়ে। কোন সংস্থা বা ক্ষমতাধর ব্যক্তির অফিসিয়াল ব্যাপারে কোন গোপনীয়তা থাকতে পারবে না। গোপনীয়তার মাধ্যমে ক্ষমতাধরেরা দুর্নীতিবাজ ও ষড়যন্ত্রপরায়ণ হয়ে ওঠে। আমজনতার স্বার্থে তারা ক্ষমতা ভোগ করবে, অথচ তাদের কাছে কোন জবাবদিহিতা থাকবে না, তা হ’তে পারে না। সমস্ত গোপনীয়তার পর্দা ছিঁড়ে দিতে পারলে একটা স্বচ্ছ পৃথিবী গড়া সম্ভব হবে। এমন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। এ উদ্দেশ্যেই তিনি আলোড়ণ সৃষ্টিকারী ওয়েবসাইটটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন সবার জন্য উন্মুক্ত ইন্টারনেটে। যোগাযোগ রাখেন হুইসেল ব্লোয়ারদের সাথে। সরকার, রাজনীতি, যুদ্ধ, গণহত্যা, বাণিজ্য, সংস্কৃতি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, দুর্নীতি, কূটনীতি, গোয়েন্দা, আবহাওয়া, ধর্মীয় ইত্যাকার সমস্ত বিষয়ের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন তিনি। ওয়েবসাইটটি চালু হওয়ার একমাস পরে ঘোষণা দেয়, তাদের হাতে ১২ লাখ নথি রয়েছে। এগুলো নিরীক্ষণের পর পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করবে উইকিলিকস।
উইকিলিকসের ইশতেহার বলে খ্যাত অ্যাসাঞ্জের প্রবন্ধ `Conspirecy as governence'-এ বলেন, ‘আমরা যদি নিষ্ক্রিয়ভাবে অন্যায়-অবিচার দেখে যাই, কিছুই না করি, তবে আমাদের অবস্থা দাঁড়ায় সে অন্যায়ের পক্ষে। নিষ্ক্রিয়ভাবে অন্যায় দেখতে দেখতে আমরা দাসে পরিণত হই। অধিকাংশ অন্যায় ঘটে খারাপ শাসন ব্যবস্থার কারণে; শাসন ব্যবস্থা ভাল হ’লে অবিচার কমে যায়। ... আমাদের এমন কিছু করতে হবে যেন খারাপ শাসন ব্যবস্থার জায়গায় ভাল কিছু আসে’।
ভাল কিছু উপহার দেয়ার জন্য তিনি হানা দেন গোপন তথ্যের বায়বীয় ভান্ডারে। তিনি যেন মার্জিত আচরণে বাধ্য করলেন ক্ষমতাবানদেরকে। এখন তাই সব শীর্ষ-দাপুটেরা সস্তা ও দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যমে ইলেকট্রিক মিডিয়াকে বেশ মেপেজোখে চলে।
যেভাবে চলে উইকিলিসক :
উইকিলিকসের কোন স্থায়ী তহবিল নেই। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে অগণিত ভক্ত। তাদের আর্থিক সহযোগিতায় চলে উইকিলিকস। তার কোন স্থায়ী অফিস বা অফিসিয়াল স্টাফ নেই। স্থায়ী স্টাফ বলতে রয়েছেন মোটামুটি চার জন। দু’জন কম্পিউটার টেকনিশিয়ান আর দু’জন ওয়েবসাইটের ডিজাইনার। রয়েছে কয়েকশ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। অ্যাসাঞ্জ তাদেরকে ইন্টারনেটে কাজ দেন। তারা সেগুলো সম্পন্ন করে আবার ইন্টারনেটেই ফেরত পাঠায়। তাদের সাথে অ্যাসাঞ্জের যোগাযোগ হয় ইন্টারনেটের এনক্রিপটেড লাইনের চ্যাটরূমে। উইকিলিকসে যেকোন ব্যক্তি নাম-পরিচয় গোপন রেখে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী আপলোড করতে পারে। উইকিলিকস তার নাম-পরিচয় কিছুই জানতে চায় না। আবার তথ্য প্রদানকারীও বিনিময়ে কোন টাকা-পয়সা দাবী করে না।
উইকিলিকসের প্রকাশভঙ্গি :
উইকিলিকসের হোমপেজে লেখা আছে, Help us, Keep government open. তাঁর মতে, সরকারকে স্বচ্ছ রাখতে হ’লে তার সব কিছুই প্রকাশ্য হ’তে হবে, লুকোচুরি থাকবে না কোন সেক্টরে। গোপনীয়তার বাঁকা পথে সে দুর্নীতির পথ উন্মুক্ত পায়। তাই অ্যাসাঞ্জ সরকারের গোপনীয়তার দিকে মনোনিবেশ করেন। এতে ব্যাপক সফল হন তিনি। পেয়ে যান গোপনীয়তার মাধ্যমে মানবতা বিধ্বংসী মার্কিন মোড়লের রেকর্ডসংখ্যক দলীল-দস্তাবেজ। ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মার্কিন বাহিনী কর্তৃক প্রেরিত প্রায় ৫ লাখ নথি। তথ্য-প্রমাণসহ বিশ্বকে জানিয়ে দেন, কিভাবে ইরাক, আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটো বাহিনী নিরীহ মানুষকে হত্যা করে চলেছে। ধারণা করা হয়, মার্কিন সামরিক বাহিনীর তরুণ সেনা গ্রেফতারকৃত ব্র্যাডলি ম্যানিং এগুলো তাকে দিয়েছে। এছাড়া তিনি আরও সংগ্রহ করেন লক্ষ লক্ষ তারবার্তা ও নথি। দু’চার বছর নয়; ১৯৬৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ২০১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নথিপত্রের বিশাল সংগ্রহ এটি। বিশ্বজুড়ে মার্কিনের ২৭৪টি দূতাবাস, কনস্যুলেট ও কূটনৈতিক মিশন রয়েছে। এসব দফতরে কর্মরত রয়েছেন রাষ্ট্রদূত, চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স ও কনসাল জেনারেলসহ বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ। অ্যাসাঞ্জ যে বিপুল পরিমাণ তারবার্তা সংগ্রহ করেন, তার মধ্যে ২ লাখ ৫১ হাযার ২৭৮টি রয়েছে মার্কিন তারবার্তা, যা উপরোক্ত কর্মকর্তাগণ তাদের স্ব স্ব দপ্তর থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন।
২০১০ সালের ৫ এপ্রিল একটি ভিডিও ফুটেজ (যেটি Collateral murder বা হত্যাযজ্ঞের সমর্থনকারী নামক প্রামাণ্যচিত্র হিসাবে পরিবেশিত) প্রকাশ করে উইকিলিকস। ইরাকের বাগদাদে মার্কিন সেনাদের অ্যাপাচি হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে রয়টারের দু’জন সাংবাদিকসহ ১৮ জন বেসামরিক মানুষকে হত্যা করার নৃশংস ও বর্বর দৃশ্য দেখা যায় তাতে। এটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের সাথে উইকিলিকসের পরিচয় ঘটে। কেনিয়ার গণহত্যা, যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের নেত্রী সারাহ পেলিনের ইয়াহু অ্যাকাউন্টের বার্তাসহ বহু ‘হট নিউজ’ প্রকাশ করলেও বিশ্ববাসীর নিকট তেমন পরিচিত হয়ে ওঠতে পারেননি তিনি। কিন্তু সর্দার মার্কিনের প্রতিরক্ষা বিভাগ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ বিভাগে হস্তক্ষেপ করাতে রাতারাতি ‘টক অব ওয়ার্ল্ডে’ পরিণত হন। খোদ মার্কিন সহ বিশ্বজুড়ে অ্যাসাঞ্জ ও তার প্রতিষ্ঠিত ওয়েবসাইটকে নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়। অ্যাসাঞ্জ সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন মন্তব্য করলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজ্জনক জীবিত ব্যক্তি’।
তার বিপুল সংগ্রহের নথিপত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য তিনি বেছে নেন ব্রিটেনভিত্তিক ক্ষমতাধর প্রিন্ট মিডিয়া গার্ডিয়ানের মত পত্রিকা। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধ সম্বলিত প্রায় ৫ লাখ নথি তিনি গার্ডিয়ানকে দিতে চান। গার্ডিয়ানের সম্পাদক অ্যালান রাসব্রিজার মার্কিনের পত্রিকা ‘টাইম’-এর সম্পাদক বিল কেলারকে নিয়ে যৌথভাবে উক্ত নথিগুলো নিরীক্ষণ ও প্রকাশের প্রস্তাব দেন। বিল কেলার উক্ত প্রস্তাবে সম্মতি প্রকাশ করেন। বিল কেলার নিউইয়র্ক থেকে ব্রিটেনের লন্ডনে পাঠান যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদক ও কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড রিপোর্টিংয়ে সিদ্ধহস্ত প্রতিবেদক। জার্মানীর ‘ডের স্পিগেল’ পত্রিকা থেকে এসে যোগ দেয় একই ধরনের তুখোড় একটা বাহিনী। তাদের সাথে ছিলেন অ্যাসাঞ্জ নিজেও। লন্ডনের গার্ডিয়ান কার্যালয়ে শুরু হয়ে যায় এক গোপন নিরীক্ষণ কর্মযজ্ঞ। সময়টা ছিল ২০১০ সালের জুনে। অতঃপর পত্রিকা ৩টি আফগান যুদ্ধের নথিগুলোর ভিত্তিতে ২০১০ সালের জুলাই মাস থেকে একযোগে প্রতিবেদন প্রকাশ করা শুরু করে। অতঃপর ইরাক যুদ্ধের নথির ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করে অক্টোবর থেকে। এরপর তিনি তাদেরকে দেন আড়াই লাখের বেশি মার্কিন কূটনৈতিকদের তারবার্তার ফাইলটি। একাজে যোগ দেয় বিশ্ববিখ্যাত আর দুই পত্রিকা ফ্রান্সের ‘লা মঁদ’ ও স্পেনের ‘আল পাইস’। পত্রিকা ৫টি তারবার্তাগুলোর ভিত্তিতে একযোগে প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করলে বিশ্বব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। অল্প সময়ে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন অ্যাসাঞ্জ। কেউ বলেন, তিনি চরম নৈরাজ্যবাদী। কেউ কেউ বলেন, ইন্টারনেট যুগের বিশ্ববিদ্রোহী। তিনি বরং এটাকে Media insergency বা বিদ্রোহী যোগাযোগ মাধ্যম বলতে প্রীতবোধ করেন।
সমস্যা বাঁধে যাতে :
অ্যাসাঞ্জ তারবার্তাগুলো যখন পত্রিকাগুলোকে দেন তখন এরূপ চুক্তি হয়েছিল যে, এগুলো তারা রিডেক্ট বা সম্পাদনা করে প্রকাশ করবেন। অর্থাৎ এমন ব্যক্তিদের নাম তারবার্তা থেকে মুছে দেয়া হবে যাদের নাম পরিচয় প্রকাশ হ’লে উল্লেখযোগ্য কোন ক্ষতি বা মৃত্যুর ঝুঁকিতে তারা পড়তে পারেন। সম্পাদনা করে প্রকাশ হয়েও আসছিল। কিন্তু গার্ডিয়ানকে অ্যাসাঞ্জ একটি পাসওয়ার্ড দিয়েছিলেন। পত্রিকাটির সাংবাদিক ডেভিড লুই ও লুক হার্ডিং উইকিলিকসকে নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন। তাতে তারা পাসওয়ার্ডটি ছেপে দেন। কারণ অ্যাসাঞ্জ নাকি তাদের বলেছিলেন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাসওয়ার্ডটি বদলে ফেলা হবে। মুদ্রিত পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে কেউ উইকিলিকসের সার্ভার থেকে ডাউনলোড করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়। ২০১১ সালের ৩০ আগষ্ট অসম্পাদিত অবস্থায় প্রকাশ হয়ে পড়ে আড়াই লাখের তারবার্তার ফাইলটি। পত্রিকা ৫টি তাকে নিন্দা জানিয়ে এক সঙ্গে বিবৃতি দিয়ে বলল, ‘তিনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে খুবই দায়িত্বহীনের মত কাজ করেছেন’। অ্যাসাঞ্জ যখন দেখলেন ফাইলটি ‘লিক’ হয়েই গেছে তখন তিনিও এটিকে উইকিলিকসে প্রকাশ করে দেন। আসলে এটা ছিল অ্যাসাঞ্জের অনাকাঙ্খিত ভুল।
উইকিলিকসে বাংলাদেশ :
উইকিলিকস যেসব তারবার্তা প্রকাশ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তারবার্তাগুলোর উৎস দেখাতে তাতে গ্রাফ বা লেখচিত্র রয়েছে। গ্রাফে স্থান পেয়েছে ৪৫টি দূতাবাস। তন্মধ্যে বাংলাদেশের ক্রমিক নং ৩৭। ১৯৮৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী থেকে ২০১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ঢাকা থেকে প্রেরিত বাংলাদেশ বিষয়ক মার্কিন তারবার্তার সংখ্যা ২,১৮২টি। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তারবার্তার সংখ্যা মাত্র ৫টি। বেশিরভাগ তারবার্তা ২০০৫ সাল থেকে। কি সরকার-রাজনীতি, কি গোয়েন্দা-সেনাবাহিনী, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ হেন সেক্টর নেই- যা উঠে আসেনি তাদের প্রেরিত তারবার্তায়। রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ব্যাধিগুলো প্রমাণসহ প্রকাশ হয়ে পড়ে জনসমক্ষে।
ক্ষমতাসীনদের আশে-পাশে থাকে গুণকীর্তনকারী বাহিনী। যারা সব সময় প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য, যা বললে তিনি খুশি হন তারা তাই বলেন। কথা সাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এই বাহিনীর নাম দিয়েছেন ‘হ্যাপিনেস বাহিনী’। জনগণের বাস্তবতা ও সরকারের মাঝে এই বাহিনী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। নেতা-নেত্রীকে তারা সবসময় নিজেদের ইতিবাচক দিকগুলো শুনায়। আড়ালে থেকে যায় কঠিন বাস্তবতা। ফলে দ্রব্যমূল্য, জ্বালানী, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাকার বিষয়ে জনগণ নিষ্পেষিত হয়ে ‘আনহ্যাপি’ থাকলেও তাদের ‘হ্যাপিনেসে’ কোন ঘাটতি হয় না। এরূপ আচরণ দায়িত্বশীলদের জন্য অশনি সংকেত বটে।
উইকিলিসক যখন কানাডিয়ান পরামর্শক সংস্থার দুর্নীতি ফাঁস করল, তখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রফুল্লচিত্তে বলেন, ‘সরকার যে দুর্নীতিবাজ তা আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণিত’।
এবার জোট সরকারের দুর্নীতি, হাওয়া ভবন ও তারেক রহমানের সীমাহীন দুর্নীতি ইত্যাদির সংবাদ প্রকাশ হ’তে থাকলে এগুলোকে মিথ্যা অভিহিত করে মহাসচিব বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘উইকিলিকসে প্রচারিত বার্তাগুলো বড় কোন ষড়যন্ত্রের অংশ’।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির ২০০৮ সালের ১৮ জুন ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রেরিত তারবার্তায় প্রকাশ হয়- হাসিনাকে মুক্তি না দিতে দলটির তৎকালীন সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু অনুরোধ করেছেন ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে। বিবৃতি দিয়ে তিনিও সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
প্রকাশ হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শমসের মুবিন চৌধুরী কর্তৃক হাসিনার পাসপোর্ট জব্দ করতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধের খবর। তিনিও বিবৃতি দিয়ে অভিযোগ অস্বীকার করেন।
তাদের অবস্থাদৃষ্টে একটি কৌতুক বলতে হয়। দেশের বিখ্যাত ব্যক্তিদের বিনা পয়সায় ট্রেন ভ্রমণের সুযোগ দেয়া হয়। টিকেট চেক করতে টি.টি. আসলে এদেশের বিখ্যাত এক রাজনৈতিক বলেন, আমি অমুক পার্টির অমুক ক্ষমতাশীল রাজনীতিবিদ। টি.টি. বলেন, গত সপ্তাহে সাবিনা ইয়াসমিন গান গেয়ে প্রমাণ করে বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণ করেছেন। তার আগের সপ্তাহে জুয়েল আইচ জাদু দেখিয়ে প্রমাণ করে সুবিধা গ্রহণ করেছেন। আপনি রাজনীতিবিদ-প্রমাণ করেন। রাজনীতিবিদ বলে ওঠেন, সাবিনা ইয়াসমিন, জুয়েল আইচ ওদের আমি চিনি না। টি. টি বলেন, এবার প্রমাণ করেছেন, আপনি একজন রাজনীতিবিদ।
কোন কোন রাজনীতিবিদ যখন যা ইচ্ছা তাই বলেন, চাই কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক। হাযারো গুমরের হাঁড়ি ভেঙ্গে দিয়ে, উইকিলিকস দিন, তারিখসহ সবকিছু উল্লেখ করে তাদের মাথা গরম করেছে। অভিযোগ অস্বীকার করলেও জনগণের ধারণা তাদের ব্যাপারে এরূপই।
উইকিলিকস দিন-তারিখ ও দলীল প্রমাণসহ যেসব তারবার্তা প্রকাশ করেছে সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিবৃতি নিষ্ফল।
উইকিলিকস পরিবেশিত তথ্যের সত্যতা :
উইকিলিকস পরিবেশিত তথ্য সম্পর্কে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন এগুলোর সত্যতা নিয়ে। এটি সংবাদ পরিবেশনকারী নয়; বরং বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা, রাষ্ট্র তাদের নিজ নিজ খবরদারীর জন্য যেসমস্ত প্রমাণপঞ্জি সংরক্ষণ করেছিল, এগুলো হুবহু অ্যাসাঞ্জ হাতে পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকট থেকে। আর তারবার্তাগুলো মার্কিন কর্মকর্তারা পাঠিয়েছে যখন বৈঠকে কারো সাথে আলোচনা হয়েছে তার ভিত্তিতে। দিন, তারিখ ব্যক্তির নাম, আলোচনার বিষয়বস্ত্ত সবই তারা উল্লেখ করেছেন তারবার্তায়। যিনি লিখেছেন আর যার সাথে আলাপ হয়েছে তারাই বলতে পারবেন এগুলোর সত্যতা।
আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে, পৃথিবীর শাসক মার্কিন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা দফতরগুলোর মাধ্যমে সকল রাষ্ট্রে নজরদারি করছে। তাদের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাগণ কোন যুক্তিতে ভিত্তিহীন সংবাদ দিবে? আরেকটু লক্ষ করলে আমরা দেখব, যারা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তারা একথা একবারও বলেননি যে, মার্কিন কর্মকর্তারা অসত্য সংবাদ দিয়েছে নিজ দেশকে। তারা বলেছেন, উইকিলিকসের তথ্য মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। অথচ একথা সবাই জানে যে, তারবার্তাগুলো অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অসম্পাদিত অবস্থায় অবিকল প্রকাশ হয়ে পড়েছে। মিথ্যার সংস্পর্শের প্রশ্ন নেই এখানে।
অ্যাসাঞ্জের বর্তমান অবস্থা :
২০১০ সালের আগষ্ট মাসে সুইডেনে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা হয় যৌন অভিযোগের ভিত্তিতে। ‘অভিযোগ গুরুতর নয়’ বলে মামলা দু’টি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। সেই মামলাগুলোকে অন্য আইনজীবী দিয়ে বাঁচিয়ে তোলা হয়। ইন্টারপোলকে দিয়ে সুইডিশ পুলিশ ইউরোপিয়ান অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি করায়। মানসিক চাপ এড়াতে অ্যাসাঞ্জ পুলিশের সাথে কথা বলতে যান। অ্যারেস্ট করে যামিন দেয়া হয়। লন্ডন থেকে ৪০ কি.মি. দূরে এক বন্ধুর বাড়িতে তিনি গৃহবন্দী থাকবেন। পায়ে বাঁধা থাকবে ইলেকট্রিক ট্যাগ। কখন, কোথায় যাচ্ছেন, সব থাকবে পুলিশ কর্তৃপক্ষের নখ দর্পণে। বাড়ির বাইরে চবিবশ ঘণ্টা থাকবে শক্তিশালী ক্যামেরা। তাকে প্রতিদিন একবার করে নিকটস্থ পুলিশ স্টেশনে গিয়ে হাজিরা খাতায় সাইন করে আসতে হয়। বিরোধটা তার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হওয়ায় অনেকে তাকে ‘সাইবার শহীদ’ বলছেন। শহীদ হ’তে তিনি নারাজ। বিশ্ববাসী তাকে মুক্ত জীবনে ফিরে পেতে চায়। তিনি মুক্ত জীবন লাভ করবেন, নীরবে, নিভৃতে তথ্যের বোমা ফাটিয়ে যাবেন, এটাই কামনা।
শরীফা বিনতে আব্দুল মতীন
কোরপাই, বুড়িচং, কুমিল্লা।