গত ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের
স্বাধীনতা দিবসে পাকিস্তানের পেশোয়ারে সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি স্কুলে ঘটে
গেল নারকীয় হত্যাকান্ড। যা সন্ত্রাসপ্রবণ পাকিস্তানের ইতিহাসে এক
নযীরবিহীন ঘটনা। জঙ্গী হামলা এ দেশে এমন এক স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে
দাঁড়িয়েছে যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে তেমন কোন বিকার দেখা যায় না;
অথচ সেই পাকিস্তানে আজ সমগ্র জাতি শোকে মুহ্যমান। কেউই মেনে নিতে পারছে না
এক সাথে এতগুলো শিশু-কিশোরের মর্মান্তিক মৃত্যু। ঠান্ডা মাথায়
সুপরিকল্পিতভাবে এমন নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করা কি কোন সুস্থ মস্তিষ্কের
মানুষের পক্ষে সম্ভব? কেন এই নিরপরাধ শিক্ষার্থীদেরকে টার্গেট করা হ’ল? এই
প্রশ্ন আজ সবার মুখে মুখে। তালেবানদের প্রতি যারা সহানুভূতিশীল ছিল, তারাও এ
ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেছে। এমনকি আফগানিস্তানের তালেবানরাও ইতিমধ্যে এর
নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। বর্বরতার সমস্ত সীমা ছাড়ানো এই মর্মান্তিক
হামলায় নিহত হয়েছে ১৪৫ জন। এর মধ্যে ১৩২ জনই ছিল শিক্ষার্থী, যাদের বয়স ৮
থেকে ১৮ বছর। খবরে বলা হয়েছে, এই হামলায় স্কুলটির নবম শ্রেণীর ছাত্রদের
মধ্যে একজন অনুপস্থিত ব্যতীত সকলেই নিহত হয়েছে।
এ ঘটনার মাত্র একদিন পূর্বেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক শিক্ষা সফরের সুবাদে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল সোয়াত ভ্যালিতে। ২০০৭ থেকে ২০০৯-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত তালেবানদের দখলে ছিল প্রায় সম্পূর্ণ সোয়াত উপত্যকা। এ সময় তারা নারী শিক্ষা এবং পশ্চিমা শিক্ষা বন্ধ করার নামে প্রায় ২০০টি স্কুল ধ্বংস করেছিল। ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল বহু সরকারী স্থাপনা। তাদের হাতে নিহত হয়েছিল কয়েক হাযার মানুষ। পরে দীর্ঘ অভিযান চালিয়ে সরকার ২০১২ সালে এসে সেখানে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। তালেবানদের বিদায়ের ৫ বছর পর এখন সেখানকার জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। যদিও পথে পথে প্রচুর আর্মি চেকপোস্ট পার হ’তে হয়। তালেবানদের স্কুল বন্ধ করার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসাবে সেখানে এখন শিক্ষা-দীক্ষায় এক নতুন জোয়ার এসেছে। মিঙ্গোরা থেকে মালাম জাববার পথে দুর্গম পাহাড়ী এলাকাতেও দেখলাম ফুটফুটে সুন্দর ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা বই হাতে নিয়ে দল বেঁধে স্কুলে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ এমনিতেই অনেক সুন্দর, তার উপর স্কুল ড্রেস পরা বাচ্চাগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন সদ্য প্রস্ফূটিত ফুল। রাস্তার ধারে অনেক জায়গায় দেখলাম নবনির্মিত সরকারী স্কুল। তালেবান আমলে ধ্বংস হয়ে যাওয়া স্কুলগুলোর উপর নতুন করে এ স্কুলগুলো তৈরী করা হয়েছে। মালাম জাববা স্কী রিসোর্টে পৌঁছে মনে হ’ল কোন পরিত্যক্ত জায়গায় এসে পড়েছি।
জানতে
পারলাম একসময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই স্থানটি পর্যটক মুখরিত থাকত।
কিন্তু ২০০৮ সালে এখানকার বিশাল সরকারী রেস্ট হাউজটি তালেবানরা বোমা মেরে
উড়িয়ে দেয়। তারপর থেকে পর্যটক আসা প্রায় বন্ধ। ধ্বংসের চিহ্নগুলো দেখে একটা
কথাই মনে হচ্ছিল যে, তালেবানরা এত ধ্বংসাত্মক বর্বর হয় কিভাবে? এরা কি
আসলেই মুসলমান? তারও উপরে এরা কি আসলে মানুষ? সরকারের সাথে বিরোধ কিংবা
পশ্চিমা শিক্ষা বা নারী শিক্ষার সাথে বিরোধ না হয় বোঝা গেল, কিন্তু
ইট-পাথরের স্থাপনাগুলো ধ্বংস করার মধ্যে কী এমন যুক্তি রয়েছে? ভবনগুলো তো
অন্য কাজেও ব্যবহার করা যেত! বিশ্বাস করতে মন একেবারেই সায় দেয় না যে একজন
মুসলমান যার অন্তরে সামান্যতম ঈমান আছে, তার দ্বারা এমন বিবেকশূন্য কাজ
হ’তে পারে!
সেখান থেকে ফেরার পর একদিন পার না হ’তেই পেশোয়ারের এই ঘৃণ্যতম শিশুহত্যার ঘটনা শুনতে হ’ল। খবরটি জানার পর একদম বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। শুধু মনে পড়ছিল একদিন আগেই দেখা সোয়াত শিশুদের ফুটফুটে চেহারা। একই প্রশ্ন বার বার মনে ভাসছিল...কোন মুসলমানের পক্ষে কি সম্ভব এই জঘন্যতম কাজ করা? কিভাবে সম্ভব? এই বিবেকহীন খারেজী অমানুষরা নিরীহ নিরপরাধ মানুষের আর কত রক্তপাত ঘটাবে?
তালেবান অপতৎপরতার শুরু
পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তালেবানদের এই ধ্বংসাত্মক অপতৎপরতা শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপট খুঁজতে গেলে পাকিস্তান সরকারের মার্কিন তোষণ নীতিই সর্বাগ্রে চলে আসে। ২০০১ সালের পর আমেরিকার কথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ যোগ দেয় পাকিস্তান। সেই যুদ্ধের অংশ হিসাবে আল-কায়েদা দমনের অজুহাতে ওয়াযীরিস্তানে পাকিস্তানী সেনার উপস্থিতি এবং সরকারী আইন-কানুন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা তালেবানরা মেনে নিতে পারেনি। তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতার শুরু সেখান থেকেই। এছাড়া আদর্শিক চরমপন্থার বিষয়টি তো আছেই। এরপর ২০০৬ সালে মার্কিন ড্রোন হামলা এবং বিশেষ করে ২০০৭ সালে পারভেজ মোশাররফ সরকারের আমলে ইসলামাবাদের লাল মসজিদে সেনাবাহিনীর অভিযান বারুদের মত উস্কে দেয় জঙ্গীবাদ। যা বিস্তৃত হতে হতে দেশটিকে আজ এক ব্যর্থ রাষ্ট্রের কাতারে ফেলে দিয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০০১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আত্মঘাতী বোমা হামলা, বন্দুক যুদ্ধ এবং দূর নিয়ন্ত্রিত বোমার মাধ্যমে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে কয়েক সহস্র জঙ্গীবাদী হামলা হয়েছে। যার শিকার হয়ে নিহত হয়েছে প্রায় ৩৫০০০ মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ৫০০০ হ’ল আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, আর বাকিরা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাসহ সাধারণ মানুষ। এছাড়া আহত হয়েছে কয়েক লক্ষ। এসব হামলা সবই যে কেবল তালেবান করেছে তা নয়, বরং রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়েছে বালুচ স্বাধীনতাকামী এবং শীআ-সুন্নী-আহমাদিয়া ইত্যাদি ধর্মীয় বিভক্তিতে ফায়দা উঠানো গোষ্ঠীগুলোও।
নববইয়ের দশকে আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থানে বিরাট ভূমিকা ছিল পাক সরকারের। কিন্তু ২০০১ সালে আফগানিস্তানে তালেবানদের উপর মার্কিন হামলা শুরু হলে মার্কিন চাপের কাছে নতি স্বীকার করে তারা হঠাৎ তালেবান বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এসময়ে মার্কিন আক্রমণে পিছু হটে আসা তালেবান ও আল-কায়েদা সদস্যরা দলে দলে আশ্রয় নিতে থাকে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী গোত্রশাসিত অঞ্চলগুলোতে। এদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক ছিল মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্যএশিয়া থেকে আগত যোদ্ধা। পরবর্তীতে তারা সংগঠিত হয়ে পাকিস্তানের মাটি থেকে আফগানিস্তানের বিভিন্ন মার্কিন লক্ষ্যবস্ত্ততে যখন হামলা চালানো শুরু করল, তখন মার্কিন সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক পাকিস্তান সরকার এই সকল যোদ্ধাদের দমন করার জন্য পদক্ষেপ নেয় এবং ২০০৩ সালে সেখানে সেনাবাহিনী প্রেরণ করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ৫৫ বছরের ইতিহাসে এই আধা-স্বায়ত্বশাসিত উপজাতি এলাকায় এটাই ছিল পাক সেনাবাহিনীর প্রথম প্রবেশ। ৮০ হাযার নিয়মিত সেনা এই অভিযানে অংশ নেয়। স্বভাবতই তালেবানরা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফলে সরকার বাধ্য হয়ে ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েক দফা তালেবানদের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে এই মর্মে যে, তারা পাকিস্তানের ভূখন্ড থেকে আফগানিস্তানে আর হামলা চালাবে না। বিনিময়ে পাকিস্তান সরকার সেনা অভিযান বন্ধ করে এবং বহু তালেবান কারাবন্দীকে মুক্তি দেয়। পরিস্থিতি দৃষ্টে মনে হয়, পাকিস্তান সরকার তাদেরকে কেবল আফগানিস্তানে হামলা চালানো থেকে নিবৃত্ত রাখার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু একটি সশস্ত্র গ্রুপ হিসাবে তারা টিকে থাকুক তাতে সরকারের আপত্তি ছিল না। কেননা তারা তাদের ভারত নীতি এবং আফগান নীতির সুরক্ষায় তালেবানদেরকে ‘প্রক্সি যোদ্ধা’ হিসাবে হাতে রাখতে চেয়েছিল। ঠিক যেভাবে নববইয়ের দশকে সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে মুজাহিদদের ‘প্রক্সি যোদ্ধা’ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল।
কিন্তু এই চুক্তি বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। ২০০৬ সালের অক্টোবরে বাজোড় এজেন্সিতে ‘তাহরীকে নেফাযে শরীআতে মুহাম্মাদী’ পরিচালিত একটি মাদরাসায় জঙ্গী দমনের অজুহাতে পাক সেনাবাহিনী রাতের আঁধারে বিমান হামলা চালালে ৮৬ জন মাদরাসা ছাত্র নিহত হয়। এই মর্মান্তিক ঘটনা স্বভাবতই তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় এবং তালেবানের সাথে পাকিস্তান সরকারের চূড়ান্ত দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ফলে তাদের আফগানিস্তানমুখী বন্দুকের নল এবার সরাসরি পাকিস্তানের দিকে ঘুরে যায়। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে পাক সেনাবাহিনীর এই ঘৃণ্য পদক্ষেপই পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তালেবানদের জঙ্গীবাদী কর্মকান্ডের সূত্রপাত ঘটায়। সমগ্র দেশও এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে তালেবানদের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল হয়ে উঠে।
এরপর ২০০৭ সালে ‘তেহরীকে তালেবান পাকিস্তান’ (টিটিপি) নামে তারা সাংগঠনিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। দলটির আমীর নির্বাচিত হন বায়তুল্লাহ মেহসূদ। সীমান্তবর্তী উপজাতীয় এজেন্সিগুলোর প্রতিনিধি এবং ছোট ছোট ১৩টি গ্রুপ নিয়ে দলটি গঠিত হয়। উল্লেখ্য, এই দলটির উত্থানে আফগান তালেবানদের কোন সম্পর্ক ছিল না। প্রাথমিকভাবে উপজাতীয় পখতুন নৃতাত্বিক গোষ্ঠীর অধিবাসীরা তালেবানদেরকে ধর্মীয় আবেগ থেকে আশ্রয় দিলেও গোল বাঁধে যখন তালেবানরা উপজাতীয় এলাকার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার জন্য প্রায় ২০০ গোত্রীয় নেতাকে হত্যা করে। ফলে দ্রুত তারা জনসমর্থন হারাতে থাকে। তবে ব্যাপকভাবে আমেরিকার ড্রোন হামলা শুরু হওয়ার পর বহু নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাতে থাকলে তালেবানরা আবার সমর্থন ফিরে পায়।
ইত্যবসরে সোয়াতে ‘তেহরীকে নেফাযে শরীআতে মুহাম্মাদী’ (টিএনএসএম)-এর প্রতিষ্ঠাতা ছূফী মুহাম্মাদের জামাই মোল্লা ফযলুল্লাহর নেতৃত্বাধীন একটি গ্রুপ সোয়াত উপত্যকার ৫৯টি গ্রাম দখল করে নেয় এবং শারঈ আদালত প্রতিষ্ঠা করে। ফযলুল্লাহ নেতৃত্বাধীন এই গ্রুপটি প্রথমে তালেবানদের সাথে যুক্ত ছিল না। ২০০৭ সালে ‘তেহরীকে তালেবান পাকিস্তান’ (টিটিপি) গঠিত হ’লে তারা দলটিতে কোয়ালিশন গ্রুপ হিসাবে যুক্ত হয়। অনেকের ধারণা, পাকিস্তানী আর্মি ইচ্ছাকৃতভাবে তাদেরকে সোয়াতে ঢোকার সুযোগ দিয়েছিল। কারণ আমেরিকা চীনের উপর নজরদারির জন্য সোয়াত ভ্যালিতে একটি ঘাঁটি গাড়তে চাচ্ছিল। আমেরিকার স্বার্থে সবকিছু উজাড় করে দিতে প্রস্ত্তত থাকলেও পাকিস্তান সরকার চায়নি বন্ধু দেশ চীনের উপর আমেরিকা নজরদারী করুক। এজন্য জঙ্গী পাঠিয়ে সোয়াত উপত্যকা অস্থিতিশীল করার মাধ্যমে কৌশলে আমেরিকার আকাংখাকে মাটি চাপা দিতে চেয়েছিল সরকার। যা হোক ২০০৭ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত টিটিপি সেখানে ভয়, আতংক ও বিশৃংখলার রাজত্ব গড়ে তোলে। ফলে কখনই তারা জনসমর্থন লাভ করতে পারেনি। অবশেষে পাক সেনাবাহিনী তাদেরকে সেখান থেকে বিতাড়িত করে এবং মোল্লা ফযলুল্লাহ আফগানিস্তানে পালিয়ে যান। ২০১৩ সালে টিটিপি নেতা হাকীমুল্লাহ মেহসূদ নিহত হলে মোল্লা ফযলুল্লাহ টিটিপি’র মূল নেতৃত্বে আসেন। ধারণা করা হচ্ছে যে, তার নির্দেশনাতেই পেশোয়ারে ১৬ ডিসেম্বর’১৪-এর নারকীয় হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়।
এদিকে তালেবান দমনে কেবল পাকিস্তান সরকারের উপর আস্থাশীল না হয়ে আমেরিকা নিজেই টিটিপি নির্মূলের জন্য ড্রোন হামলা শুরু করে। ২০০৭-০৮ সালে এই হামলা আরো বিস্তৃত হয়। তবে এতে টিটিপি’র যোদ্ধাদের চেয়ে সাধারণ নিরীহ মানুষই মারা পড়তে থাকে বেশী।[1] ফলে সারা পাকিস্তান জুড়ে আমেরিকা বিরোধী মনোভাব চাঙ্গা হয়ে উঠে। পাকিস্তান সরকার বাহ্যত ‘দেশের সার্বভৌমত্ব লংঘনে’র অভিযোগ তুলে এই ড্রোন হামলার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করলেও ভিতরে ভিতরে সমর্থনই যোগাতে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এরই মধ্যে ২০০৮ সালে পাকিস্তান সরকার তালেবান (টিটিপি)-কে নিষিদ্ধ করে এবং তাদের সম্পত্তি বাযেয়াফত করে। ফলে নিষিদ্ধ টিটিপি আরো সহিংস হয়ে ওঠে এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সেনা লক্ষ্যবস্ত্তসহ হাটে-বাযারে-মসজিদে যত্র যত্র আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে সারাদেশ অস্থিতিশীল করে তোলে। সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় তাদের পাবলিক প্লেসে বোমা হামলা চালিয়ে শত শত নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা। যার সর্বশেষ সংযোজন হ’ল পেশোয়ারের এই হত্যাকান্ড। নিরপরাধ মানুষ হত্যার এই ঘৃণ্য নীতির কারণে তালেবানদেরই কতিপয় গ্রুপ ইতিমধ্যে টিটিপি ত্যাগ করেছে।
২০১৩ সালের জুনে নাওয়াজ শরীফ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর টিটিপি’কে নিয়ন্ত্রণ করতে সামরিক অভিযানের পরিবর্তে আবার শান্তি আলোচনা শুরু করার জন্য আন্তরিক প্রয়াস গ্রহণ করেন। সকল রাজনৈতিক দল এই শান্তি প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছিল। এ বছরের শুরুতে রাজধানী ইসলামাবাদে বেশ কয়েকবার আলোচনা বৈঠকও হয়। কিন্তু তালেবানদের আভ্যন্তরীণ মতবিরোধের কারণে এই শান্তি প্রচেষ্টা সামনে এগুতে পারছিল না। এই প্রক্রিয়া চলমান থাকাকালেই ৮ই জুন ২০১৪ করাচী বিমানবন্দরে ভয়াবহ হামলা চালায় টিটিপি সংশ্লিষ্ট উজবেক জঙ্গী গ্রুপ। ফলে শান্তি আলোচনা আবারও ভেঙ্গে যায়। উপায়ান্তর না দেখে নাওয়াজ সরকার এক সপ্তাহ পরই ১৫ জুন ওয়াযীরিস্তানের তালেবান ঘাটিগুলো ধ্বংসের জন্য সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দেয়। অপারেশন ‘যারব-ই-আযাব’ নামক এই অভিযান অদ্যাবধি চলছে। সেনা ভাষ্যমতে, এই অভিযানে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে প্রায় ১৭০০ তালেবান সদস্য। মানবাধিকার সংস্থাগুলির অভিযোগ, সেনাবাহিনী সেখানে অভিযানের নামে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘন করছে এবং বহু সাধারণ মানুষ তাদের আক্রমণের শিকার হয়েছে।
সার্বিক বিশ্লেষণে যতটুকু মনে হয়, তালেবানদের এই জঙ্গীবাদী অপতৎপরতার পিছনের কারণ যতটা না ধর্মীয়, তার চেয়ে অনেক বেশী হ’ল রাজনৈতিক। আফগানিস্তান যুদ্ধে যে পাকিস্তান তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই পাকিস্তানই মার্কিন মদদে তাদের উপর অন্যায় হস্তক্ষেপ করায় এবং তাদের জান-মালের উপর হামলা চালানোয় তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই ক্ষোভ থেকেই জন্ম হয় জিঘাংসার। সেই জিঘাংসার ফলাফল হ’ল একের পর এক বেপরোয়া ও নির্মম প্রতিশোধ। কিন্তু সেই প্রতিশোধের বলি হয়েছে যতটা না প্রতিপক্ষ পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী, তার চেয়ে বেশী হয়েছে নিরীহ নিরপরাধ পাকিস্তানী জনগণ।
প্রশ্ন আসে, কেন সাধারণ জনগণ এই সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে? এ ব্যাপারে তালেবানদের চরমপন্থী তাকফীরী ব্যাখ্যা হ’ল, তাগূতী সরকারের অধীনে বসবাসরত সাধারণ জনগণও তাগূতের সহযোগী। তাই তাদের হত্যা করা জায়েয এবং তাদের হত্যাকারীরা নিহত হলে তারা হবে শহীদ। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মঘাতী হামলাকে তারা কেবল জায়েযই মনে করে না, বরং অত্যন্ত মর্যাদার কাজ মনে করে। এভাবেই প্রতিশোধপরায়ণতা এবং আক্বীদাগত বিভ্রান্তি তালেবানদেরকে এক বেপরোয়া, কান্ডজ্ঞানহীন ও নিষ্ঠুর অপশক্তিতে পরিণত করেছে।
সর্বশেষ পেশোয়ারের হামলার ঘটনায় সারা জাতি স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় মনে হচ্ছে পাক সরকার ও সেনাবাহিনীও ধৈর্যের বাঁধ হারিয়ে তালেবানদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কারাগারে যারা বন্দী রয়েছে, তাদেরকে দ্রুত ফাঁসি দিবে। কিন্তু তাতে লাভ হবে কতটুকু? কেননা এদের প্রভাব সম্প্রসারিত হয়ে রয়েছে বহু দূর পর্যন্ত। এর সাথে জড়িত রয়েছে বিদেশী শক্তিও। তাছাড়া পাকিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এদের পুরোপুরি দমন করাটা প্রায় অসম্ভবই। কারণ ভারত ও আফগানিস্তানের সাথে পাকিস্তানের যে বৈরী সম্পর্ক, তার মধ্যেই নিহিত রয়েছে এই সমস্যার মূল শিকড়। সুতরাং কৌশলে তাদেরকে বশে রাখাই হ’ত সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। সেটা না করে যদি সেনা অভিযানের নামে বাড়াবাড়ি করা হয় এবং যুলম-নির্যাতনের ধারাবাহিকতা বৃদ্ধি পায়, সেই সাথে জিহাদের নামে এই তাকফীরী চরমপন্থী আক্বীদা সংস্কারে কোন পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহ’লে তালেবানদের এই হিংসাত্মক অপতৎপরতা কখনই ঠেকানো যাবে না। ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি সেই শিক্ষাই দিয়ে যাচ্ছে।
আক্বীদাগত বিভ্রান্তি ও চরমপন্থার বিপদ
জঙ্গী তৎপরতা সম্পর্কে পাকিস্তানে প্রায় স্বতঃসিদ্ধ ও বহুল প্রচলিত একটি মন্তব্য হ’ল, জঙ্গীদের এ সমস্ত হামলার নেপথ্যে রয়েছে র, মোসাদ বা সিআইএ’র গোপন এজেন্ডা। তারাই অর্থ দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে এসব অঘটন ঘটাচ্ছে। কেননা তারা চায় যেকোন মূল্যে পারমাণবিক শক্তিধর একমাত্র মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে দুর্বল বা অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে। এছাড়া পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বিদেশী ফান্ড আনার জন্য মাঝে-মধ্যে এরূপ নাটক সাজিয়ে থাকে।
বিষয়টি নিয়ে আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে এখানে অনেককে প্রশ্ন করেছি। প্রায় প্রত্যেকেই ঠিক একই ভাষায় বিদেশী ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে ঘটনার প্রত্যক্ষ সংঘটনকারী চরমপন্থীদেরকে প্রশ্রয়মূলকভাবে তারা এক প্রকার দায়মুক্তিই দিয়ে দেন। এটা ঠিক যে, সাম্রাজ্যবাদী ইসলামবিদ্বেষী শক্তির ষড়যন্ত্রের বিষয়টি মোটেও অস্পষ্ট নয়। কিন্তু এই জাজ্বল্যমান সত্যটি কি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব যে, আমাদের সমাজে প্রকৃতই এরূপ খারেজী আক্বীদা সম্পন্ন ফ্যানাটিক ও উগ্রবাদী বর্বর মানুষের উপস্থিতি রয়েছে? বরং উদ্বেগজনক বাস্তবতা এটাই যে, এদের সংখ্যাটা বৈশ্বিক রাজনীতির অস্থিরতার সাথে তাল মিলিয়ে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষতঃ নতুনভাবে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া অতি আবেগী তরুণ ও যুবক শ্রেণীর মধ্যে দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে চরমপন্থী খারেজী আক্বীদা। মুসলিম উম্মাহর শত্রুরা কৌশলে এদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে রীতিমত মরণ খেলায় মেতে উঠেছে। তালেবান অপতৎপরতার পিছনে এই চরমপন্থী আক্বীদার ভূমিকা কোনমতেই অগ্রাহ্য করার উপায় নেই।
খারেজী তাকফীরী আক্বীদা যে কতটা ভয়ংকর তা আমরা মুসলিম দুনিয়ার সর্বত্র লক্ষ্য করছি। বর্তমানে পাকিস্তান ও ইরাক সহ বিভিন্ন দেশে যে আত্মঘাতী বোমা হামলাগুলো হচ্ছে, তার পিছনে মূল আদর্শিক শক্তি হ’ল এই বিধ্বংসী খারেজী মতবাদ। যার বিরুদ্ধে রাসূল (ছাঃ) বহু পূর্বেই মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করে গেছেন। সুতরাং এই শ্রেণীর লোকদের বিরুদ্ধে সজাগ হওয়ার কোন বিকল্প নেই। অনেকেই মুসলিম ভ্রাতৃসুলভ ভাবাবেগ থেকে তাদের অপকর্মের পিছনে যৌক্তিকতা খুঁজতে চান। এটা একটা ভুল প্রবণতা। কেননা যেটা স্পষ্ট অন্যায়, তাকে অন্যায় হিসাবে না উল্লেখ করে যদি সেই অন্যায়ের পিছনে যৌক্তিকতা খুঁজতে যাই এবং নেপথ্যের কল্পিত শত্রুর উপর সমস্ত দায় চাপিয়ে অন্যায়কারীর অন্যায়কে লঘু করে দেখি, তাহ’লে তা সরাসরি অন্যায়কে সমর্থন করারই শামিল হবে। এতে করে অপরাধী তো সংশোধন হয়ই না বরং আরও উৎসাহিত হয়।
চরমপন্থা এক প্রকার ভয়াবহ মানসিক রোগ। যার মধ্যে একবার এই রোগ ঢুকে যায়, তার মধ্যে ধর্মের নামে শয়তান ইচ্ছামত খেলা শুরু করে। এই রোগে আক্রান্তদের প্রকৃত রূপ চিনতে খুব বেশী দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এই তো সেদিন বাংলাদেশে ‘বাংলা ভাই’ নামক চরমপন্থীদের আমরা দেখেছি। এরা যে কী পরিমাণ বিকৃতমস্তিষ্ক এবং বিবেকবর্জিত তাও আমরা টের পেয়েছি হাড়ে হাড়ে। চরমপন্থী আক্বীদার ফলে তাদের স্বাভাবিক মানবীয় বোধই নষ্ট হয়ে যায়। ইসলামের নামে মানুষ হত্যা করা, সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি করাই হয়ে যায় তাদের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল থেকে এই চরমপন্থী শ্রেণী মুসলিম সমাজের জন্য বারবার হন্তারক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।
চরমপন্থীদের সবচেয়ে বড় অক্ষমতা হল ঘটনা পরবর্তী ফলাফল সম্পর্কে ধারণা না থাকা। ফলে নির্বোধের মত এমন সব অপরিণামদর্শী অযৌক্তিক কর্মকান্ড করে বসে, যা কখনই কোন সুস্থ বিবেক মেনে নেয় না। যেমন ২০০৫ রালের ১৭ই আগস্টে বাংলাদেশের ৬৩ যেলায় একইদিনে বোমা হামলা চালানো। এতে তারা জনমনে কোনরূপ স্থান করে নিতে পারেনি। অপরদিকে দ্বীন কায়েমের নবুঅতী ধারা পরিত্যাগ করে এবং রাষ্ট্রশক্তিকে তাগূত আখ্যা দিয়ে তারা মুসলিম সমাজে তৈরী করে সীমাহীন বিভক্তি ও বিশৃংখলা। যার ফল তাদের জন্য আখেরে কখনই সুখকর হয় না; না দুনিয়াবী না পরকালীন। সেই সাথে মুসলিম সমাজও পতিত হয় সংকটের গভীর অমানিশায়।
সুতরাং তালেবান হোক, বোকো হারাম হোক আর কথিত ‘ইসলামিক স্টেট’ই হোক, এদের ইসলামের নামে চরমপন্থা বিস্তারকারী আক্বীদার বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থাকাটা আমাদের মোটেও উচিৎ হবে না। এরা বিদেশী শক্তির ক্রীড়নক কি-না, সেটা নিয়ে দীর্ঘ বিশ্লেষণ করা যেতেই পারে। কিন্তু সেই বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সমস্ত দায় যদি ইসলাম বিরোধী বিদেশী শক্তির কাঁধে চাপিয়েই ক্ষান্ত হই, তবে আত্মবিনাশী খারেজীবাদের ভয়াবহ ভূমিকা আড়ালেই থেকে যাবে। এর ফলে চূড়ান্ত আঘাতটা পড়ে ইসলামের উপরেই। কেননা এরা হয়ত অস্ত্রশস্ত্র আর কুবুদ্ধি পায় বিদেশী চরদের কাছ থেকে। কিন্তু বাহ্যত তারা তো পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত পড়া মুসলিম বলেই পরিচিত। তাদের পতাকা তো সজ্জিত থাকে ইসলামের পবিত্র কালেমা দিয়েই। তাদের তথাকথিত ‘জিহাদ’ তো ‘জান্নাত লাভের’ ভ্রান্ত প্রত্যাশাতেই। নতুবা এরা আত্মঘাতী হয় কিভাবে? কিসের স্বপ্নে? সুতরাং বৃথা ষড়যন্ত্র তত্তেবর মধ্যে ডুবে না গিয়ে বাস্তবতাকে খোলা চোখে দেখতে হবে এবং সমস্যাকে চিহ্নিত করতে হবে। নতুবা কাংখিত সমাধানের পথ আমরা কখনই খুঁজে পাব না।
এক্ষণে এই বিভ্রান্ত আক্বীদার ভয়াবহতা সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান লাভ করা এবং এর বিরুদ্ধে আমাদের যুব সমাজকে সচেতন করা সময়ের দাবী। বিশেষতঃ বিপথগামী তরুণদেরকে ফিরিয়ে আনতে আলেম-ওলামাদের সামনে থেকে জোরালো ভূমিকা পালন করা অতীব যরূরী হয়ে পড়েছে। নতুবা এরা নিজ থেকেই হোক বা অপরের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েই হোক, ‘জিহাদ’ শব্দের অপব্যাখ্যা করে ইসলামকে যেভাবে মানুষের চোখে দিনে দিনে ভয়ংকর প্যানিক হিসাবে তুলে ধরছে এবং দেশে দেশে ইসলামের নামে একের পর এক যেভাবে বিপর্যয় সৃষ্টি করে যাচ্ছে, তা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনবে। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন-আমীন!
[1]. লন্ডনের একটি সংস্থার তৈরী করা পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৪ সাল থেকে ২০১৪ সালের শুরু পর্যন্ত পাকিস্তানে মোট ৩৮১ বার ড্রোন হামলা চালিয়েছে আমেরিকা। যাতে নিহত হয়েছে প্রায় ৪ হাযার মানুষ। এদের মধ্যে মাত্র ৮৪ জন তালেবান বা আল-কায়েদা সদস্য হিসাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আর বাকি সবাই সাধারণ নিরীহ মানুষ, যার মধ্যে অন্তুভূক্ত রয়েছে সহস্রাধিক নারী ও শিশুও (ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেট জার্নালিজম, লন্ডন)।
আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
এম.এস (হাদীছ), ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, ইসলামাবাদ, পাকিস্তান।