ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান : স্বাধীনতার নতুন সূর্যোদয়

১৯৭১ সালে ৯ মাস যুদ্ধের পর পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল বাঙালী জাতি। ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয়েছিল সেই কাংখিত বিজয়। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে জায়গা করে নিয়েছিল অপার সম্ভাবনাময়ী বাংলাদেশ। সেসময় পুলিশ-জনতা ও অন্যান্য বাহিনী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল দেশকে মুক্ত করার জন্য। অবশেষে বাংলার মুক্তিকামী দামাল ছেলেদের এবং সশস্র বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে আত্মসমর্পন করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় পাক হানাদার বাহিনী। আনন্দে আর উচ্ছাসে ফেটে পড়ে গোটা জাতি। বিষাদের দরিয়া যেন মুহূর্তেই আনন্দকাননে পরিণত হয়ে ওঠে।

একাত্তরে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর ২০২৪ সালে যেন আরেকটি স্বাধীনতার স্বাদ পেল জাতি। প্রায় একমাস ব্যাপী আন্দোলন-সংগ্রাম ও শত শত ছাত্র-জনতার তরতাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হ’ল এবারের স্বাধীনতা। ৫ই আগস্ট সোমবার আড়াইটায় একটানা সাড়ে পনের বছরের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার মধ্যদিয়ে অর্জিত হ’ল কাংখিত এ বিজয়। এ বিজয় ছাত্র-জনতার বিজয়, এ বিজয় তারুণ্যের বিজয়, যালেম শাসকের বিরুদ্ধে মাযলূম মানবতার বিজয়, অপশাসনের বিরুদ্ধে সুশাসনের বিজয়। এ বিজয় দীর্ঘ সাড়ে পনের বছর যাবত জাতীর বুকে জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেপে বসে থাকা নির্যাতন-নিপীড়নকারী শাসকের বিরুদ্ধে নির্যাতিত-নিপীড়িত মানবতার দীর্ঘশ্বাসের বিজয়। বড় বড় শক্তিধর রাজনৈতিক দলগুলো মরণপণ চেষ্টা করেও দীর্ঘ পনের বছরে যা করতে সক্ষম হয়নি, সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে বাংলার তরুণ ছাত্র-জনতা। এতে আবারও প্রমাণিত হল, তরুণরাই পারে যুলমশাহীর তখত-তাউস ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে বিজয়মাল্য ছিঁনিয়ে আনতে। পারে বিপ্লবকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছাতে।

এ দেশের মানুষ এ যাবত তিনটি অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করেছে। আইয়ূব খার বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারীর গণঅভ্যুত্থান, এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বরের গণঅভ্যুত্থান। এরপর দীর্ঘ ৩৪ বছর পর দেখল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ৫ই আগস্টের গণঅভ্যুত্থান। ইতিপূর্বের দু’টি অভ্যুত্থানের চেয়ে চবিবশের অভ্যুত্থান ছিল অনেক বেশী ভয়াবহ, লোমহর্ষক ও রক্তাক্ত। আইয়ুব খান ও এরশাদ দেশ ছেড়ে পালাননি, কিন্তু হাসিনাকে মাত্র ৪৫ মিনেটের নোটিশে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে। ইতিপূর্বের অভ্যুত্থানে এতটা রক্তপাত হয়নি, যতটা না হয়েছে চবিবশের অভ্যুত্থানে।

প্রশ্ন হচ্ছে- কেন বার বার অভ্যুত্থানের প্রয়োজন হয়? কেন একটা জাতি দায়িত্বরত সরকারের বিরুদ্ধে এতটা বিদ্বেষ পরায়ণ হয়ে ওঠে? প্রজারা কেন রাজার বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে? জবাব হচ্ছে- যেকোন মূল্যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার অপচেষ্টা। লাশের মিছিলের উপর দাঁড়িয়ে হ’লেও ক্ষমতায় টিকে থাকার উদগ্র বাসনা। যুগে যুগে শাসকরা যখন স্বৈরশাসক হয়ে ওঠেন, শাসন যখন অপশাসনে পরিণত হয়, ন্যায়বিচার ভূলুন্ঠিত হয়, আদল-ইনসাফ উঠে যায়, রাষ্ট্রের প্রতিটা বিভাগকে যখন নিজ ও নিজ দলের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, জোরপূর্বক ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রের সমস্ত বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়, ভিন্নমতাবলম্বীদের উপর চালানো হয় দমন-পীড়ন ও অমানবিক নির্যাতন, মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়, কেড়ে নেয়া হয় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, তখনই মানুষের হৃদয়ে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। জনমনে ক্ষোভ ধুমায়িত হ’তে হ’তে একপর্যায়ে তা বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে। প্রতিবাদের বজ্রমুষ্ঠিতে গর্জে ওঠে জনতা। বুলেট-বোমার তোয়াক্কা না করে গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বস্তরের জনগণ। এভাবে তীব্র আন্দোলন ও জনরোষের শিকার হয়ে স্বৈরাচার ও তার দোসররা গদি ছাড়তে বাধ্য হয়। যুলুমের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত জনতা তখন স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। আর এটাই ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করে ঠিকই, কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। আওয়ামী দুঃশাসনের মাঝিমাল্লাদের ক্ষেত্রেও তেমনটিই ঘটেছে। যেমনিভাবে ইতিপূর্বে হাওয়া ভবন কেন্দ্রিক যুবরাজদের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল।

ঘটনাপ্রবাহ : ঘটনার সূত্রপাত সরকারী চাকরিক্ষেত্রে দীর্ঘদিন যাবত চলে আসা ৫৬ শতাংশ কোটা সংস্কারের দাবী নিয়ে। যেখানে মুক্তিযোদ্ধা ৩০, নারী ১০, যেলা ১০, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ৫ ও প্রতিবন্ধী কোটা ছিল ১ শতাংশ। ছাত্রদের তুমুল আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ঠা অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে সরকারী চাকরিতে ৯ম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণী) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণী) পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সকল কোটা বাতিল করে দেয়। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বহাল রাখে। পরবর্তীতে বেনিফিসিয়ারীদের পক্ষ থেকে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন করা হয়। দীর্ঘদিন পর গত ৫ই জুন’২৪ তারিখে হাইকোর্ট উক্ত রিটের আদেশ প্রদান করে। যেখানে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা ‘সরকারী চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল’ সংক্রান্ত পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ ৫৬ শতাংশ কোটা পুনরায় বহাল থাকল। পুরো বিষয়টিই সরকারের ইশারায় সংঘটিত হয় বলে প্রচারিত আছে। ২০১৮ সালের পরিপত্রটি স্রেফ ছাত্র আন্দোলনকে দমানোর একটি কৌশল ছিল মাত্র। পরক্ষণে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের দিয়ে রিট করানো এবং হাইকোর্টের মাধ্যমে তা বাতিল করা সবই পরিকল্পনা মাফিক করা হয়। ফলে এই রায়ের পর থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলন নতুন মোড় নিতে শুরু করে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’র ব্যানারে উক্ত রায়ের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরুতে মিছিল-মিটিং ও সভা-সমাবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ১৪ জুলাই বিকালে গণভবনে চীন সফর থেকে ফিরে প্রদত্ত প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় সাংবাদিকদের এক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, ‘(এই কোটা)মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?’ এই মন্তব্য করায় পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসাবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’ এবং ‘চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার’ সেলাগানে সেলাগানে মুখরিত করে তুলে ঢাকার রাজপথ। পরদিন ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ তার অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর লেলিয়ে দেয়। এরা লাঠিসোটা, হকিস্টিক, রড, রামদা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলে পড়ে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের উপর। একই সাথে পুলিশও আক্রমণ চালায়। ফলে ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে। এ দিন রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হ’লে আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মত পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এতদিন ‘শাটডাউন’ কর্মসূচী চললেও ১৮ জুলাই থেকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচীর ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

এদিকে সরকার আন্দোলনকারী ছাত্রদের দমন করার জন্য বিজিবি মাঠে নামায়। ১৯ জুলাই পর্যন্ত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠন, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ দিয়ে এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েও আন্দোলন থামাতে কার্যত ব্যর্থ হয় সরকার। উপায়ান্তর না দেখে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের ন্যায্য আন্দোলনকে নসাৎ করার জন্য কারফিউ জারি করে। মাঠে নামায় সেনাবাহিনীকে। সারাদেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর নির্বিচারে চালায় গুলী। এতে কয়েকদিনে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২৬৬ জন শিক্ষার্থী নিহত ও কয়েক হাযার শিক্ষার্থী আহত হয়। সহপাঠীদের নির্মমভাবে হত্যার প্রতিবাদে ছাত্ররা আরো ফুঁসে ওঠে। শিক্ষার্থীদের সাথে যোগ দেয় তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকরাও। এই ন্যায্য দাবীর পক্ষে একাত্মতা ঘোষণা করে বিভিন্ন রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, ধর্মীয় ও পেশাজীবী সংগঠনগুলো। এসময় সরকারের পেটুয়া পুলিশ বাহিনী গণগ্রেফতার শুরু করে। বাড়ী বাড়ী তল্লাশি চালিয়ে ছাত্র পেলেই তাকেই গ্রেফতার করে এবং মিথ্যা ও সাজানো মামলায় চালান দেয় এবং রিমান্ডে নিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন চালাতে শুরু করে। মাত্র কয়েকদিনে প্রায় পাঁচশত মামলা ও দশ হাযারের অধিক ছাত্র-জনতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ককেও গ্রেফতার করে ডিবি কার্যালয়ে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। কোনভাবেই আন্দোলনকে দমাতে না পেরে সরকার অবশেষে যরূরী ভিত্তিতে ২১শে জুলাই সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে শুনানী করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল ঘোষণা করে এবং সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ এবং মুক্তিযোদ্ধা ৫, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ১ ও প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করে রায় প্রদান করে। ২৩ জুলাই এ বিষয়ে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে। কিন্তু ততদিনে বহু মায়ের বুক খালি হয়ে যায়। ফলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ছাত্র হত্যার বিচার দাবী করে। তারা এর দায়ভার সরকারকে নিয়ে জাতির কাছে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়াসহ ৯ দফা দাবী পেশ করে। যথা-

১. ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। ২. ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিজ নিজ মন্ত্রণালয় ও দল থেকে পদত্যাগ করতে হবে। ৩. যেসব এলাকায় ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটেছে, সেখানকার পুলিশের ডিআইজি ও পুলিশ সুপারকে বরখাস্ত করতে হবে। ৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরকে পদত্যাগ করতে হবে। ৫. নিহত ও আহত শিক্ষার্থীদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৬. ছাত্র হত্যার দায়ে অভিযুক্ত পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীদের আটক ও হত্যা মামলা দায়ের করতে হবে। ৭. দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ও ছাত্রসংসদ চালু করতে হবে। ৮. অবিলম্বে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলগুলো খুলে দিতে হবে। ৯. আন্দোলনে অংশ নেওয়া সব শিক্ষার্থী যেন একাডেমিক ও প্রশাসনিক কোন হয়রানির শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমূদকে ২০ জুলাই বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন করে রক্তাক্ত অবস্থায় ভোর রাতে চোখ বেঁধে রাস্তায় ফেলে রাখে। সেখান থেকে বাসায় ফিরে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় পুনরায় ২৭ জুলাই ‘নিরাপত্তাজনিত’ কারণ দেখিয়ে হাসপাতাল থেকে তাদেরকে উঠিয়ে নেয় মহানগর গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি)। সাথে আরো চারজন সমন্বয়ককেও আটক করা হয়। অতঃপর নাটক সাজিয়ে আটক সমন্বয়কদের এক সারিতে বসিয়ে এক ভিডিও বার্তায় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের যবানীতে আন্দোলন স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়ানো হয়। এটি যে বলপূর্বক তা বুঝতে কারো বাকী থাকে না। ফলে বাকী মুক্ত সমন্বয়কদের ঘোষণায় আন্দোলন অব্যাহত থাকে। এবার আন্দোলনকারীরা ফ্যাসিবাদী খুনী সরকারের পতনের একদফা দাবি নিয়ে মাঠে নামে। ছাত্রদের সাথে সর্বস্তরের জনতা এতে যোগ দেয়।

২রা আগস্ট জুম‘আর দিন বিভিন্ন মসজিদে খতীবগণও সরকারের যুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তবে রাজশাহী কেন্দ্রীয় মারকাযে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর মুহতারাম আমীরে জামাআ‘ত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব অত্যন্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে সুতীব্র ভাষায় সরকারের যুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। একপর্যায়ে তিনি জাতির কাছে ক্ষমা না চাইলে যুলুমবাজ সরকারের পতন কামনা করেন। তাঁর এই ঐতিহাসিক বক্তব্যটি ছাত্র-জনতা ও দেশবাসীর জন্য গভীর অনুপ্রেরণাদায়ী ছিল।

এরপর ৪ঠা আগস্ট ‘অসহযোগ আন্দোলনে’র ডাক দেয় ছাত্ররা। একই দিনে আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী বিক্ষোভের ডাক দেয়। ফলে এদিন গোটা দেশ অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়। মুহূর্তে মুহূর্তে মায়ের বুক খালি হ’তে থাকে। বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশের উপরও আক্রমণ করে। এতে বহু পুলিশ সদস্যও হতাহত হয়। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানা আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে সেখানে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয় ১৪ জন পুলিশকে। এ দিন সারা দেশে সহিংসতায় পুলিশসহ কমপক্ষে ১০৪ জন প্রাণ হারায়। স্বাধীনতার পর যা ছিল কোন আন্দোলনে একদিনে সর্বোচ্চ হত্যা। এই গণহত্যার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা পরদিন ৫ই আগস্ট চূড়ান্ত প্রতিবাদ হিসেবে ‘রোড মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচী ঘোষণা করে এবং গণভবন ঘেরাওয়ের ডাক দেয়। রাতেই ঢাকামুখী জনতার ঢল নামে। ছাত্র-জনতার বিশাল ঢল সরকারকে হতচকিত করে তুলে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সেনাপ্রধান প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগের পরামর্শ দেন। একরোখা লৌহশাসক শেখ হাসিনা নিজের পদত্যাগ কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না। শেষতক ছাত্র-জনতাকে প্রতিহত করতে সেনাবাহিনী অপারগতা প্রকাশ করলে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। অতঃপর প্রেসিডেন্ট বরাবর পদত্যাগপত্র লিখে বেলা আড়াইটার সময় একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। সঙ্গে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে যান। এর মাধ্যমে যবনিকাপাত ঘটে দীর্ঘ সাড়ে পনের বছরের স্বৈরশাসনের। উন্মোচিত হয় স্বাধীনতার নবদিগন্ত।

অভ্যুত্থান পরবর্তী অবস্থা : হাসিনার পদত্যাগের সাথে সাথে দৃশ্যপট বদলে যায়। দীর্ঘ সাড়ে পনের বছরের স্বৈরশাসনের জগদ্দল পাথর যেন জাতির বুক থেকে সরে গেল। হাফ ছেড়ে বাঁচল ১৭ কোটি বাঙ্গালী। অনেকে সিজদায়ে শুকুর আদায় করে। রাজধানী সহ সারা দেশে উল্লাসে উন্মত্ত হয়ে পড়ে ছাত্র-জনতা সহ সর্বস্তরের মানুষ। মুহূর্তে মিষ্টির দোকানও খালি হয়ে যায়। ঢাকার রাজপথে উল্লসিত জনতার আনন্দ মিছিল আর উল্লাসনৃত্য মাইলের পর মাইল ছাপিয়ে যায়। ছাত্র-জনতার এই বিজয় উল্লাস গণভবন ও সংসদ ভবনকেও রেহাই দেয়নি। হাযার হাযার ছাত্র-জনতাকে গণভবনে প্রবেশ করে সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের প্রত্যেকটি কক্ষ, দরবার হল, পুকুর, আঙ্গিনা, বাগান সর্বত্র আনন্দ-উল্লাস করতে দেখা গেছে। শত শত ছাত্র গণভবনের পুকুরে গোসল করে, কেউ হাসিনার শয়নকক্ষে তার পালঙ্কে শুয়ে, কেউ দরবার হলের সোফায় পায়ের উপর পা উঠিয়ে বসে, কেউ সংসদ ভবনের পিছনের লেকে গোসল করে, কেউ জাতীয় সংসদের অধিবেশন কক্ষের চেয়ারে বসে, এককথায় যার যেভাবে খুশী সেভাবেই আনন্দ প্রকাশ করে। এ সময়ে গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ আসবাবপত্র ও মালামাল এমনকি হাস-মুরগী ও পুকুরের মাছও উৎসুক জনতাকে লুট করে নিয়ে যেতে দেখা গেছে।

এই অবস্থা সন্ধা নাগাদ দেখা গেলেও সন্ধার পর সারা দেশের চিত্র বীভৎসতায় রূপ নেয়। হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগে সমগ্র দেশ যেন অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তার দলের সকল নেতা-কর্মী, এমপি-মন্ত্রী, মেয়র-কাউন্সিল, চেয়ারম্যান-মেম্বার গা ঢাকা দেয়। এই সুযোগে প্রতিপক্ষের বাড়ীঘর ভাঙ্গচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে বছরের পর বছর অপরাজনীতির শিকার প্রতিহিংসাপরায়ণ গোষ্ঠী। এসময় দেশের অধিকাংশ থানাসহ বিভিন্ন সরকারী স্থাপনা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। লুটপাট করা হয় ব্যাপকহারে। ধ্বংস করা হয় পুলিশের গাড়ি, আসবাবপত্র ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র সবকিছু ।

প্রশ্নবিদ্ধ পুলিশ প্রশাসন : সেনাবাহিনীর সহায়তায় হাসিনা পালিয়ে গিয়ে স্বার্থপরের মত নিজে বেঁচে গেলেও রেখে যান মীরজাফরীর বহু আলামত। তিনি স্বীয় অপকর্মের সহযোগী মন্ত্রী-এমপি ও দলীয় নেতাদের কথা একটিবারও চিন্তা করেননি। ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-পুলিশকে ব্যবহার করে ‘পাতানো’ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে যাদের চারপাশে রেখে দীর্ঘ ১৬ বছর নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন, যুলুম-নির্যাতন করেছেন, জনগণের ওপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালিয়েছেন, সহযোগীদের হাযার হাযার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের সুযোগ করে দিয়েছেন, দেশ ছাড়ার সময় তাদের কারোরই ভবিষ্যৎ ‘পরিণতি’র কথা চিন্তা করেননি। এ অভিযোগ খোদ আওয়ামী লীগ নেতাদের।

সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতি করে গেলেন তিনি জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর। ‘পুলিশই জনতা, জনতাই পুলিশ’ এই সেলাগান গেল দশকে থানায় থানায় ও মোড়ে মোড়ে বিলবোর্ডে শোভা পেলেও, এর উল্টো দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল বিশ্ববাসী। পুলিশকে জনতার মুখোমুখি দাড় করিয়ে তিনি গোটা বাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেন। ছাত্র-জনতার উপরে নির্বিচার গুলির প্রতিবাদে পুলিশের উপর মারমুখী হয়ে ওঠে বিক্ষুব্ধ জনতা। ফলে পুলিশ হত্যা, থানা পুড়িয়ে দেওয়া, পুলিশ মেরে টাঙ্গিয়ে রাখাসহ নানা লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে অভ্যুত্থানকালীন সময়গুলোতে। হতাহত হয় বহু পুলিশ। সেকারণ হাসিনার পদত্যাগের সাথে সাথে জনরোষ থেকে বাঁচতে দেশের সর্ববৃহৎ এই বাহিনীর সকলেই কর্মস্থল ছেড়ে স্ব স্ব নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। মুহূর্তেই গোটা দেশ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ফলে দুর্বৃত্তরা বিনা বাধায় থানা লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মত ন্যাক্কারজনক কাজ করার সুযোগ পায়। দেশের প্রায় সকল থানা পুড়িয়ে দেয়া হয় কিংবা লুটপাট করা হয়।

এ ঘটনার ফলে নযীরবিহীনভাবে সপ্তাহকাল রাষ্ট্র চলে কোন পুলিশ ছাড়া। ফলে ছাত্ররাই নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে। ট্রাফিক সেবায় যোগ দেয়। নগরী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ আঞ্জাম দেয়। রাজশাহীতে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র কর্মী ছাত্ররা সংগঠনের এ্যাপ্রোন পরে গোটা শহরে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করে। অন্যান্য শহরেও কাজ করে। সারা দেশে সৃষ্টি হয় এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। কি না পারে ছাত্ররা। প্রয়োজন শুধু উদ্যমের, উৎসাহের। অবশেষে সরকারের নির্বাহী নির্দেশে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পুলিশ কাজে যোগদান করে বটে কিন্তু ধ্বংসস্ত্তপের ছাই সরিয়ে কাজের পূর্ণাঙ্গ পরিবেশ করতে না জানি কতদিন লাগবে।

বিশ্লেষকদের প্রশ্ন- বাংলাদেশের পুলিশ কি এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে? নাকি আবার পূর্বের ন্যায় সরকারের লেজুড়বৃত্তি করে জনগণের উপর ষ্টীম রোলার চালাবে? নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে ধরে এনে মিথ্যা মামলা দিবে বা গ্রেফতার বাণিজ্য করবে? মানুষের ঘুমকে হারাম করে দিয়ে ত্রাসের সৃষ্টি করবে? ঘুষ-দুর্নীতি কি আগের মত চালিয়ে যাবে, নাকি এবার ক্ষান্ত হবে? পুলিশ কি সত্যিকার অর্থে জনগণের সেবক হবে, নাকি শত্রু হবে? উন্নত বিশ্বে যেখানে কারো একটি প্রাইভেটকার বা মোটরসাইকেলের চাকা লিক হলেও ট্রিপল নাইনে ফোন করলে পুলিশ এসে বিপদগ্রস্থ নাগরিককে গন্তব্যে পৌঁছার সার্বিক ব্যবস্থা করে দেয়, সেখানে আমাদের দেশের পুলিশ রাস্তায় দাড়িয়ে চাঁদাবাজি করে। গাড়ীর কাগজপত্র চেক করার নামে উৎকোচের আশায় হাত পেতে বসে। রক্ষকরা এখনও এই ভক্ষক নীতি থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে ধরে নিব এ দেশ পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন হ’তে এখনো বাকী আছে।

অতএব পুলিশ ভাইদের বলব, সর্বাগ্রে মহান আল্লাহ্কে ভয় করুন! মনে রাখবেন আপনার নিজস্ব যোগ্যতাবলে নয়, বরং আল্লাহর দয়ায় আপনার স্কন্ধে এই গুরু দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। আপনার প্রতিটি পদক্ষেপের হিসাব তাঁর কাছেই দিতে হবে। অতএব নিরপরাধ কারো উপর যুলুমের খড়গ চাপিয়ে দিবেন না। একটি পয়সাও হারাম পকেটে ঢুকিয়ে নিজেকে জাহান্নামের খোরাক বানাবেন না। অন্যায়ের সাথে কখনো আপোষ করবেন না। তাতে আপনার চাকরি চলে গেলে যাক। এতে আখেরাতে পুরষ্কৃত হবেন। আর তাবেদারী করে অন্যায়ে লিপ্ত হ’লে দুনিয়া ও আখেরাতে উভয় জগতেই তিরষ্কৃত হবেন। আল্লাহ আমাদের হেদায়াত দান করুন- আমীন!

বিগত সরকারের গোপন বন্দীশালা আয়নাঘর: বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাউন্টার-টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) দ্বারা পরিচালিত একটি গোপন বন্দিশালার নাম ‘আয়নাঘর’। ব্যস্ততম নগরী ঢাকার সুরম্য অট্টালিকার নীচেই বিরোধী মতকে দমন-পীড়নের জন্য স্বৈরশাসক হাসিনা তৈরী করেন এই গোপন নির্যাতন সেল ‘আয়নাঘর’। যা গুয়ান্তানাবো-বে কারাগারের কথাই মনে করিয়ে দেয়। মুসলিম নির্যাতনের জন্য কিউবার দক্ষিণ-পূর্বে মার্কিন নৌ-ঘাটিতে ২০০২ সালে স্থাপিত এক বন্দিশালার নাম গুয়ান্তানামো-বে কারাগার। এই কারাগারের নির্যাতনের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় এর কিছু ছিটেফোঁটা বিবরণ মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। যা শুধু মর্মান্তিকই নয় রীতিমত অাঁতকে উঠার মতো।

২০২২ সালের আগস্টে সুইডেন ভিত্তিক নিউজ এজেন্সি ‘নেত্রনিউজে’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে প্রথম ‘আয়নাঘর’ শব্দটি উঠে আসে। এরপর আন্তর্জাতিক কয়েকটি মিডিয়ায় বিষয়টি আলোচনায় আসে। আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আয়নাঘর’ হচ্ছে ‘গুমখানা’। হাসিনার শাসনকালে ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেখানে মোট ৬০৫ জনকে গোপনে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। ঢাকা ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে নিখোঁজ হয় ৪০২ জন মানুষ। ২০২৪ সালের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট অনুযায়ী হাসিনা ক্ষমতায় আসার বছর ২০০৯ সাল থেকে তার পতন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬০০টিরও বেশি গুম হওয়ার ঘটনা ঘটে। যার অধিকাংশেরই কোন হদিস নেই।

পত্রিকান্তরে প্রকাশ শুধু ডিজিএফআইয়ের নয়, র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান (র‌্যাব)-এর ১৫টি ব্যাটালিয়ানের প্রতিটিতেই রয়েছে এরূপ গোপন বন্দীশালা বা আয়নাঘর। তাছাড়া সম্প্রতি মহানগর গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি) কার্যালয়ে আবিষ্কার হয় আয়নাঘর। সেখানেও নির্যাতনের জন্য বহু সেল তৈরী করে রাখা হয়েছে। সদ্য ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পাওয়া ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ মাহতাব এক লাইভ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেখানকার নির্যাতনের লোমহর্ষক চিত্র তুলে ধরেছেন।

মূলতঃ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা আয়নাঘর থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মিডিয়ায় এর ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। এতদিন ভয়ে মুখ না খুললেও স্বৈরশাসনের পতনের পর সকলেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে সাড়ে পাঁচ বছর পর আয়নাঘর থেকে মুক্তি পাওয়া ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টে’র (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা বলেন, ‘আয়নাঘর যেন একটি কবর, সেখানে আমরা যারা থেকেছি তারা ছিলাম ‘জিন্দা লাশ’। ওখানে থাকার চেয়ে মৃত্যু বরং ভালো’। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন ৬ আগস্ট ভোরে চট্টগ্রামের মিরসরাই এলাকার একটি জঙ্গলে হাত ও চোখ বেঁধে তাঁকে ফেলে দেওয়া হয়।

একই সময়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের পুত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আব্দুল্লাহিল আমান আযমী ও একই দলের নেতা মীর কাসেম আলীর পুত্র সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাসেম (আরমান) কেও মুক্তি দেওয়া হয়। ৫ আগস্ট সোমবার দিবাগত রাতে তাদেরকে রাজধানীর দিয়াবাড়ীতে ছেড়ে দেওয়া হয়।

মুক্তির সময় ব্যারিস্টার আরমান জানতেন না শিক্ষার্থীদের গণবিপ্লবের কারণে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তিনি ভেবেছিলেন মেরে ফেলার জন্য আয়নাঘর থেকে তাকে বের করা হচ্ছে। আট বছরে প্রথম মুক্ত বাতাসের সংস্পর্শে আসেন তিনি। পরিবারও জানতো না তিনি বেঁচে আছেন কিনা। প্রতিবছর কেবল পরিবারকে গুমের ব্যাপারে কোনো কথা না বলার জন্য সতর্ক করা হত।

মুক্তিপ্রাপ্তদের বিবরণ মতে- কবর সদৃশ ৩/৬ ফুট কারো বিবরণে ৬/১০ ফুট ছোট ছোট কক্ষে তাদের রাখা হয়। সেখানে আলো ছিলনা বললেই চলে। দিন না রাত বুঝার উপায় নেই। বাইরের কোন শব্দ বা পাশের কক্ষের কোন শব্দও তারা শুনতে পেতেন না। কক্ষের উপরের দিকে বিকট শব্দের এক্সজস্ট ফ্যান লাগানো ছিল, যেগুলো খুব জোরে শব্দ করত। উদ্দেশ্য ছিল ভিতরের কোন শব্দ যেন বাইরে না যায় এবং বাইরের কোন শব্দও যেন ভিতরে প্রবেশ না করে। ঘরের কাঠের দরজা বাইরে থেকে আটকে দেওয়া হ’ত। খাবারের সময় সেখানকার সুপারভাইজার খাবার দিয়ে যেত, কিন্তু কোন কথা বলত না। খাবারের মান ছিল খুবই খারাপ। এত পরিমাণ ঝাল যে মুখ-পেট জ্বালা করত। কখনো কখনো বাসি খাবার দিত। টয়লেট ব্যবহারের প্রয়োজন হ’লে দরজায় টোকা দিলে সুপারভাইজার এসে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে এবং হাতকড়া পরিয়ে টয়লেটে নিয়ে যেত। টয়লেটের দরজায় একটি ছোট ছিদ্র ছিল সেটি দিয়ে তারা ভেতরে দেখত। টয়লেট শেষ হ’লে চোখ বাঁধা অবস্থায় আবার হাতকড়া পরিয়ে কক্ষে এনে খুলে দিত। সুপারভাইজাররা সবসময় মাস্ক পরে থাকত। মাইকেল চাকমা বলেন, ‘আমি কখনো মনে করিনি যে, আমি আর বাঁচব। একদিন তাদের একজন এসে বলল, ‘আমরা যদি তোমাকে ৩০ বছরও আটকে রাখি দুনিয়ার কেউ তোমাকে উদ্ধার করতে পারবে না। তুমি যে বেঁচে আছ সেটিই তোমার ভাগ্য’। তখন আমি বলি, ‘এইভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে বরং মরে যাওয়া ভাল’। ‘গুলি করো’ বলে বুক পেতে দেই’। তখন আর কিছু না বলে সে চলে যায়।

ব্রিগেডিয়ার আযমী দীর্ঘ আট বছর হাসিনার এই আয়নাঘর নামীয় নির্যাতনশালায় বন্দী ছিলেন। তার ভাষ্য মতে- যত চোখের পানি তিনি নিজ গামছায় মুছেছেন তা একত্রিত করলে হয়ত একটি বিরাট দিঘী হয়ে যেত। আয়নাঘরে থাকাকালে তিনি তার মাকে হারিয়েছেন। স্ত্রী অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে শেষতক অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। ফলে আয়নাঘরে যেমন ছিলেন নিঃসঙ্গ তেমনি বের হয়েও তিনি এখন নিঃসঙ্গ। কতটা মর্মান্তিক কল্পনা করা যায়!

মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী মুহাম্মাদ ফয়েয। যিনি ৪২ দিন আয়নাঘরে থাকার পর মিথ্যা মামলায় মোট ৭৭০ দিন কারান্তরীণ ছিলেন। সরকার পতনের আগ পর্যন্ত মুখ খোলেননি। নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, এত নির্মমভাবে ওরা নির্যাতন করে যে, শরীরের হাড্ডি-মাংস যেন এক হয়ে যায়। সবচেয়ে নির্মম ব্যাপার, ২৪ ঘণ্টা চোখ বেঁধে রাখতো, হাতে হ্যান্ডকাফ পরা থাকতো, এমনকি রুমের মধ্যেও। রাত ৯টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত দু’হাত পেছনে দিয়ে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে রাখতো, রাতে যেন ঘুম না হয়। রুমের মধ্যেই কমোড, ঠিকমতো ঘুমালে কমোডে পা চলে যায়। সবরকম নির্যাতনের ব্যবস্থাই ছিল সেখানে। একেক জনের সাথে একেক রকম নির্যাতন। ওয়াটার বোর্ডিং, ইলেকট্রিক শক, বাঁশ ডলা, ছাদের সাথে ঝুলিয়ে পেটানো, নখ উপরে ফেলা আরো কত কি। ফায়েয বলেন, ৪২ দিন পর মুক্তি দেয়ার দিন প্রথমবারের মতো চোখের বাঁধন খুলে জঙ্গী হিসাবে পুলিশবাদী মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেয়। তারপর ৭৭০ দিন পর আমার জামিন হয়। তবে এখনও মামলা চলমান আছে, হাযিরা দিতে হয় মাসে মাসে।

গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি কামরুযযামানের ভাষ্যমতে আয়নাঘরের কক্ষগুলো প্রস্থে ৩ ফুট, আর দৈর্ঘে ৬ ফুট। মাথার উপরে ছোট একটি লাইট। একটি ফ্যান সার্বক্ষণিক গড়গড় করে শব্দ করে চলে। ময়লাযুক্ত একটি চট ছিল বিছানা। এরূপ আরেকটি দেওয়া হত মাথার নীচে। খাবারের মান ভীষণ খারাপ। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য মুখে দেওয়া। সেখানে আমাকে এত বেশী নির্যাতন করেছে, এতবেশি পিটিয়েছে যে আজ পর্যন্ত আমি ঠিক মতো হাটতে পারিনা, চোখে দেখতে কষ্ট হয়। আমাদেরকে শিখিয়ে দিতো, যবানবন্দীতে বলতে হবে, বাংলাদেশ হবে শ্রীলংকা, প্রধানমন্ত্রী হবে ড. ইউনুস, রাষ্ট্রপতি হবে কামাল হোসাইন। একথা না বললে নির্যাতন চলতেই থাকবে। আমার পুরো পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে। ফলে আমরা ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বীকারোক্তিমূলক যবানবন্দী দিতে বাধ্য হই।

ঢাকা, পূর্বাচলস্থ মারকাযুস সুনান মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মুফতী মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলাম র‌্যাবের আয়নাঘরের নির্যাতন কাহিনী বলতে গিয়ে বলেন, টানা ৩৬ দিন আমাকে ঘুমাতে দেয়া হয়নি। মাথায় দড়ি বেধে রেখে দীর্ঘক্ষণ দাড় করিয়ে রাখা হ’ত। হাত সবসময় বাধা থাকতো। প্লাস দিয়ে নখ তুলে ফেলা, সুই ঢুকিয়ে দেয়া, গালি-গালাজ, অপমান অপদস্ত করা, পাগলের পোষাক পরিয়ে রাখা সহ নানা নির্যাতনে পাগলপ্রায় করে ফেলা হয়েছিল আমাকে।

এদিকে বিভিন্ন সময়ে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ছবি, প্ল্যাকার্ডসহ চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে নানাবিধ কর্মসূচীর মাধ্যমে বারবার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নির্দয় নিষ্ঠুর যালেম শাসকগোষ্ঠির হৃদয়ে সামান্যতম অ^ঁাচড় কাটেনি। অবশেষে হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। খোদ রাজধানীতেই সুরম্য অট্রালিকার নীচে আলো-বাতাসহীন অন্ধকার কুঠরীতে বছরের পর বছর আটকে রেখে অমানবিক লোমহর্ষক পৈচাশিক নির্যাতন করা হ’ত তাদের উপরে। অনেকে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লে লাশ সরিয়ে ফেলা হ’ত। অনেককে সেখান থেকে নিয়ে এনকাউন্টারে হত্যা করা হ’ত।

শেষ কথা : মহান আল্লাহর চিরন্তন ঘোষণা শুনুন, ‘তুমি বল, হে আল্লাহ! তুমি রাজাধিরাজ। তুমি যাকে খুশী রাজত্ব দান কর ও যার কাছ থেকে খুশী রাজত্ব ছিনিয়ে নাও। তুমি যাকে খুশী সম্মানিত কর ও যাকে খুশী লাঞ্ছিত কর। তোমার হাতেই যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সকল কিছুর উপরে সর্বশক্তিমান’ (আলে ইমরান ৩/২৬)। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন অত্যাচারী শাসকই স্থায়ী হয়নি। আগামীতেও হবে না ইনশাআল্লাহ। নমরূদ, ফেরাঊনের মত প্রতাবশালী শাসকরাও আল্লাহর হুকুমে ধ্বংস হয়ে গেছে। ছোট্ট একটি মশা দিয়ে আল্লাহ নমরূদকে ধ্বংস করেছেন। ফেরাঊনকে সমস্ত সৈন্যবাহিনীসহ লোহিত সাগরে ডুবিয়ে ধ্বংস করেছেন। অথচ ফেরাঊন নিজের ক্ষমতাকে স্থায়ী করার জন্য সাম্রাজ্যের সদ্যজাত পুত্র সন্তানদেরকে তাদের মায়েদের চোখের সামনে জল্লাদ দিয়ে দিখন্ডিত করত। মযলূম মায়েদের নীরব কান্না ছাড়া কোন উপায় ছিল না। অবশেষে আল্লাহর ফায়ছালায় তারা নাজাত পেলেন।

বাংলাদেশেও আওয়ামী দুঃশাসন চরমে পৌঁছে যাওয়ার কারণে মহান আল্লাহর ফায়ছালা নেমে আসে। সর্বোচ্চ নেতা-নেত্রীর মুখ থেকে বেফাস কথা বের হওয়া, নিজের সন্তানদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে মিথ্যা ট্যাগ দেওয়া, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হওয়া, ছাত্রদের বিরুদ্ধে সমস্ত রাষ্ট্রশক্তি নিয়োজিত করা এসবই ছিল বিগত স্বৈরাচারী সরকারের চরম ভুল সিদ্ধান্ত। আর এ ভুলগুলো আল্লাহ্ই তাদের দ্বারা করিয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত করার প্রক্রিয়া হিসাবে। দীর্ঘ ষোল বছরের দম্ভ ও অহংকার মুহূর্তে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন তিনি। ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ ও প্রায় সহস্র প্রাণের বিনিময়ে মহান আল্লাহ এই দেশটিকে পরাধীনতার শৃংখল থেকে রক্ষা করেছেন। দিগন্তে উদিত হয়েছে স্বাধীনতার নতুন সূর্য। ফালিল্লাহিল হাম্দ।

এক্ষণে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকটে এ জাতির বহু প্রত্যাশা রয়েছে। জাতি চায় এমন একটি নতুন বাংলাদেশ, যেখানে থাকবেনা শোষন-নির্যাতন, দমন-পীড়ন, অন্যায়-অবিচার। যেখানে প্রতিটা নাগরিকের অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকবে। বিচারের নামে অবিচার ও দীর্ঘসূত্রিতা বন্ধ হবে। স্বাধীন বিচার বিভাগের মাধ্যমে জাতি ন্যায় বিচার পাবে। সূদ-ঘুষের রমরমা ব্যবসা বন্ধ হবে। অফিস-আদালত হবে শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হবে জনগণের সেবক। আর এমন একটি স্বপ্নময় রাষ্ট্রের বাস্তবায়ন দলীয় সরকার দ্বারা আদৌ সম্ভব নয়। কেননা দলীয় সরকার কখনো নির্দলীয় প্রশাসন উপহার দিতে পারে না। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে যা আমরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছি। অতএব ইসলামী খেলাফতের আদলে নির্দলীয় নিরপেক্ষ পরামর্শমূলক সরকার গঠনের মাধ্যমেই কাংখিত এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে অগ্রসর হওয়ার তাওফীক দান করুন-আমীন!






বিষয়সমূহ: রাজনীতি
জাপান : সততাই যার মূল শক্তি - \ সংকলিত \
হাইকোর্টের রায় এবং পার্বত্যচুক্তির ভবিষ্যৎ
ইস্রাঈলের সঙ্গে অঘোষিত সম্পর্ক কেন অনুচিত - আত-তাহরীক ডেস্ক
আত্মহত্যা ও সামাজিক দায় - মুহাম্মাদ ফেরদাঊস
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ - জামালুদ্দীন বারী
ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান : স্বাধীনতার নতুন সূর্যোদয় - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
পার্বত্য শান্তিচুক্তির হাল-অবস্থা - মেহেদী হাসান পলাশ
কেমন আছে মিয়ানমারের অন্য মুসলমানরা? - -আলতাফ পারভেয[প্রথম আলো ৮ই মে ২০১৮]
রোহিঙ্গা ফেরৎ চুক্তি : তবে... - শামসুল আলম শিক্ষকআল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
উইঘুরের মুসলিম ও কালো জাদুকরের থাবা - ড. মারূফ মল্লিক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা - সুকান্ত পার্থিব
বাবরী মসজিদ কলঙ্কের অবসান হোক - ড. নূরুল ইসলাম
আরও
আরও
.