টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা
ময়দানে তাবলীগের দুই পক্ষের দফায় দফায় ব্যাপক সংঘর্ষে ইসমাঈল মন্ডল (৭০)
নামে একজন নিহত ও তিন শতাধিক আহত হয়েছে। গত ১লা ডিসেম্বর’১৮ শনিবার সকাল
থেকে দুপুর পর্যন্ত সংঘর্ষের পর বিকেল থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি
নিয়ন্ত্রণে আনে। জানা যায়, ৩০শে নভেম্বর থেকে ৪ঠা ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ
দিনের জোড় ইজতেমার আয়োজন করার কথা ছিল তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় আমীর
ভারতের মাওলানা সা‘দ কান্ধলভীর অনুসারীদের। আর তার বিরোধীরা ঘোষণা দিয়েছিল,
৭ই ডিসেম্বর থেকে ১১ই ডিসেম্বর পর্যন্ত জোড় আয়োজনের।
প্রতিষ্ঠাকাল : মাওলানা সা‘দের দাদা ভারতের উত্তর প্রদেশের মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী (১৮৮৫-১৯৪৪ খৃ.) ১৯২০-এর দিকে তাবলীগ জামাতের সূচনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর আমীর হন তাঁর পুত্র মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী (১৯১৭-১৯৬৫ খৃ.)। তাঁর পরে আমীর হন তাঁর বিশ্বস্ত সাথী এনামুল হাসান কান্ধলভী (১৯১৮-১৯৯৫ খৃ.)। তাঁর মৃত্যুর পরে ১৮ বছর কোন একক আমীর ছিলেন না। একটি শূরা কমিটি তাবলীগ জামাত পরিচালনা করতেন। ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সদস্য ও মুরববী মাওলানা জোবায়েরুল হাসানের মৃত্যুর পর তাবলীগ জামাতের একাংশ মাওলানা ইলিয়াসের পৌত্র মাওলানা সা‘দ বিন হারূণ বিন ইলিয়াস (জন্ম : ১৯৬৫ খৃ.)-কে একক আমীর ঘোষণা করেন। অন্য অংশ তা না মানায় নেতৃত্বের কোন্দল শুরু হয়। যা বাড়তে বাড়তে বর্তমানে রক্তাক্ত সংঘর্ষের রূপ নিয়েছে।
মূল মারকায : তাবলীগ জামাতের মূল মারকায হ’ল দিল্লীর হযরত নিযামুদ্দীনে অবস্থিত বেঙ্গলওয়ালী মসজিদে। ঢাকার কাকরাইল ও লাহোরের রাইবেন্ডের মারকায হ’ল শাখা মারকায। এই দুই স্থানে প্রতিবছর ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তবে কেবল বাংলাদেশের ইজতেমায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তাবলীগের অনুসারীরা যোগ দেন।
তাবলীগ জামাতে বিভক্তি : তাবলীগ সংশ্লিষ্টদের মতে দিল্লী ও লাহোরের নেতৃত্বের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে তাবলীগ জামাত। এই বিভক্তি অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও ছড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশের দ্বন্দ্বে কওমী মাদ্রাসার আলেমদের বড় অংশ যুক্ত হয়েছে। তারা একটি পক্ষকে সমর্থন দেওয়ায় সহজে এ বিরোধ নিষ্পত্তি হচ্ছে না বলে মনে করছেন ভুক্তভোগী ব্যক্তিগণ।
২০১৫ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের লাহোরের রাইবেন্ডে ইজতেমা চলার সময় সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৩ সদস্যের একটি ‘আলমী শূরা’ গঠনের প্রস্তাব আসে। মাওলানা সা‘দ সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তারপরও ইজতেমা শেষে রাইবেন্ড থেকে শূরা বোর্ড গঠনের একটি চিঠি বিভিন্ন দেশে তাবলীগের দায়িত্বশীলদের কাছে পাঠানো হয়। এরপর এক পক্ষ সা‘দের সিদ্ধান্তের পক্ষে এবং আরেক পক্ষ ‘আলমী শূরা’ গঠনের পক্ষে অবস্থান নেয়। জানা যায়, তাবলীগের এই বিভক্তির জেরে প্রথম প্রকাশ্য বিরোধ ও মারামারি হয় ২০১৬ সালের ১৯শে জুন দিল্লীতে সংগঠনটির মূল কেন্দ্র নিযামুদ্দীন মারকাযে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এই বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নেয় যুক্তরাজ্যে। ফলে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ মারকাযটি দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে দেয়।
ঢাকার শাখা মারকায : প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৪৮ সালে তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় আমীর মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভীর উপস্থিতিতে ঢাকার কাকরাইলে সর্বপ্রথম তাবলীগের বার্ষিক ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে, ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে এবং পরবর্তীতে ১৯৬০, ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে বার্ষিক ইজতেমা সমূহ অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার রমনা ময়দানে। অতঃপর ১৯৬৬ সালে সর্বপ্রথম টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে ইজতেমার আয়োজন করা হয়। তখন থেকে অদ্যাবধি এখানে নিয়মিতভাবে তাবলীগ জামাতের বার্ষিক ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। যা আশির দশক হ’তে বিশ্ব ইজতেমায় রূপ নেয়। ১৯৯৬ সালে ১৬০ একরের বিস্তীর্ণ ও বিশাল এই ময়দানটি তাবলীগের বিশ্ব ইজতেমার জন্য রাজউকের পক্ষ হ’তে বরাদ্দ দেওয়া হয়। যদিও তার মধ্যে ২০ একর জমি ইতিমধ্যে বেদখল হয়ে গেছে। কিছু জমি তুরাগ নদীর ভাঙনে চলে গেছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশ থেকে এখানে তাবলীগপন্থীরা ইজতেমায় সমবেত হন।
মাওলানা সা‘দকে নিয়ে বাংলাদেশে বিভেদ প্রকাশ্যভাবে দেখা দেয় ২০১৮ সালের জানুয়ারীতে বিশ্ব ইজতেমা থেকে। তাবলীগ জামাতের যে অংশটি মাওলানা সা‘দের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগ দেয় কওমী মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সংগঠন ‘হেফাজতে ইসলাম’। সে বছর প্রবল বিরোধিতার কারণে টঙ্গী ইজতেমায় অংশ নিতে পারেননি মাওলানা সা‘দ। তখন তিনি ও তাঁর অনুসারীরা কাকরাইল মারকাযে অবস্থান নেন। অতঃপর তিনি দেশে ফিরে যান। এরপর থেকে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। ২০১৮ সালের ২৬শে এপ্রিল রাজধানীর বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে ছাত্রদের নিয়ে এসে কাকরাইল মারকাযের নিয়ন্ত্রণ নেন সা‘দবিরোধীরা। পরদিন কয়েক হাযার সা‘দপন্থী কাকরাইলে উপস্থিত হ’লে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়।
সা‘দপন্থী শূরা সদস্যরা বলেন, সা‘দের বক্তব্য মুখ্য বিষয় নয়। কেননা ইতিমধ্যে তিনি তাঁর বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। বরং তাবলীগের নিয়ন্ত্রণ দিল্লীর মারকায থেকে সরিয়ে লাহোরের রাইবেন্ডে নিয়ে যাওয়াই হ’ল বিরোধীদের মূল লক্ষ্য। মাওলানা সা‘দ প্রায় ২২ বছর ধরে ইজতেমায় বক্তব্য দিচ্ছেন। এতদিন কোন আপত্তি ছিল না। নেতৃত্ব নিয়ে লাহোরের রাইবেন্ডের অবস্থানের পরপরই তাঁর বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ : বাংলাদেশে তাবলীগের ১৪ জন শূরা সদস্য আছেন। তাদের মধ্যে ৭ জন আছেন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। এদের মধ্যে ২০১১ সালে ‘ফায়ছাল’ বা ‘আমীর’ হন মাওলানা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম। তারপর থেকে বিশ্ব ইজতেমার সময় অর্জিত অর্থ, কাকরাইল মসজিদ নির্মাণের জন্য দেওয়া দেশী-বিদেশী অনুদানসহ তাবলীগের ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, তাবলীগকে রাজনীতি করণ এবং প্রতিপক্ষকে দমনে সন্ত্রাসী লালন প্রভৃতির বিরুদ্ধে বহুদিন ধরেই তাবলীগে ক্ষোভ বিরাজ করছিল। ২০১২ সালে সর্বপ্রথম ওয়াসিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। অতঃপর বিরোধ বাড়তে থাকে এবং তার অপসারণ দাবীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জুবেরী’ ভবনে ২০১৪ সালের ১৮ই মে সংবাদ সম্মেলন হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ৮ই জানুয়ারী ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। ঐদিনই পুলিশের তৎকালীন আইজি একেএম শহীদুল হক-এর আহবানে বিরোধী নেতা ও তাবলীগে ব্যাপক প্রভাবশালী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুশফিকুর রহমান সহ অন্যান্যগণ সেখানে প্রায় ৩-ঘণ্টা বৈঠক করেন। পরবর্তীতে তিনি ২০১৫ সালের ২২শে মার্চ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
পত্রিকান্তরে প্রকাশ, তাবলীগ জামাতের মুরববীদের আর্থিক অনিয়মের তদন্ত এবং কাকরাইল মসজিদের আর্থিক লেনদেনে সরকারের নিয়ন্ত্রণসহ বেশকিছু প্রস্তাব দিয়ে ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে জাতীয় সংসদে বিল পাসের জন্য ডেপুটি স্পিকারের কাছে আবেদন করেছিলেন যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়। বর্তমানে এ দ্বন্দ্বটি কেন্দ্রীয় আমীর মাওলানা সা‘দ কান্ধলভীর পক্ষে ও বিপক্ষে রূপ লাভ করেছে।
[ইসলামের বিধান অনুযায়ী কেন্দ্রে একজন আমীর থাকা অপরিহার্য। আর নেতৃত্বের লোভ দমন করা ইসলামের কঠোর নির্দেশ। তাদের জামাতে সর্বত্র আমীর থাকলেও কেন্দ্রে আমীর থাকতে বাধা কোথায়? তারা দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করুন, এটাই সকলের কাম্য। সেই সাথে ছহীহ আমলের তাবলীগ করার জন্য এবং ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল শিক্ষা দানের জন্য তাদের মুরববীদের প্রতি আহবান রইল (স.স.)]