ভাসানচরে নতুন জীবন শুরু করেছে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজার ক্যাম্প থেকে ১ হাযার ৬৪২ জনকে স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গারা পেয়েছে এক নতুন ঠিকানা। গত ৪ঠা ডিসেম্বর ছয়টি জাহাযে করে চট্টগ্রাম থেকে তাদের নিয়ে আসা হয় নোয়াখালীর ভাসানচরে। থাকার পরিবেশ ও নতুন ঘর পেয়ে আনন্দিত স্বেচ্ছায় ভাসানচরে আসা রোহিঙ্গারা। এদের মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে জেনে খুব শিগগির আরও রোহিঙ্গারা আসবে ভাসানচরে।

কক্সবাজার বালুখালি থেকে আসা হাবীবুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে আমাদের যে সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে তা দেখে আমরা খুবই আনন্দিত। নিজ দেশে মিয়ানমারে সরকার আমাদের চরম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে আমাদের ঘরছাড়া করেছে। আর বাংলাদেশের সরকার ভাসানচরে আমাদের নতুন ঘর দিয়েছে। কুতুপালং ক্যাম্প থেকে আসা রামাযান আলী বলেন, ‘আমি, আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে মোট ছয়জন ভাসানচরের নতুন শহরে এসেছি। এখানে আমাদের এমন ঘর দিয়েছে যা কক্সবাজারে চিন্তাও করা যায় না। এমনকি এমন ঘর মিয়ানমারেও ছিল না।

কক্সবাজার থেকে আসা পারভীনের অভিব্যক্তি, কক্সবাজারের ক্যাম্পের তুলনায় ভাসানচরের সুযোগ-সুবিধা আকাশ-পাতাল ফারাক। এখানে আমাদের জন্য যে এত কিছু করে রাখা হয়েছে, তা আগে ভাবতেও পারিনি। যারা এখনও কক্সবাজারে রয়েছে, তারা দ্রুতই ভাসানচরে চলে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।

অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মুহাম্মাদ শামসুদ্দোজা বলেন, আপাতত ২২টি এনজিওর মাধ্যমে তাদের খাদ্য, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটানো হবে। প্রতি পরিবারকে গ্যাস সিলিন্ডার ও প্রয়োজনীয় রান্নার উপকরণ দেওয়া হবে। তারা রান্না করে খাবে। পাশাপাশি তাদের ননফুড আইটেমও দেওয়া হবে।

সরেযমীনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, মূলত ক্লাস্টার হাউস, শেল্টার স্টেশন বা গুচ্ছগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এ নগর। প্রকল্পে রয়েছে মোট ১২০টি ক্লাস্টার হাউস। প্রতিটি হাউসে ১২টি ঘর ও প্রতি ঘরে ১৬টি রুম। প্রতিটি রুমে পরিবারের চারজন করে থাকতে পারবে। নারী-পুরুষের জন্য রয়েছে আলাদা টয়লেট ও গোসলখানা। এছাড়া দুর্যোগ থেকে রক্ষায় প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসের সঙ্গে রয়েছে একটি করে ৪ তলা বিশিষ্ট সাইক্লোন শেল্টার। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় রোহিঙ্গারা সেখানে আশ্রয় নিতে পারবে। এক্ষেত্রে প্রতিটিতে ১ হাযার করে ১২০টি সেন্টারে ১ লাখ ২০ হাযার মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। এছাড়া প্রতিটি সাইক্লোন শেল্টারের নিচতলায় আশ্রয় নিতে পারবে ২০০ করে গবাদি পশু।

আবাসন এলাকা পরিবেশসম্মত করা এবং বাতাস ঠান্ডা রাখার জন্য প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসের সামনে তৈরী করা রয়েছে একটি করে পুকুর। ২৪ ঘণ্টাই রাখা হয়েছে কেন্দ্রীয়ভাবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা। সাথে সাথে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থাও রয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে করা হয়েছে বায়োগ্যাস প্লান্ট। খাদ্য মওজুদের জন্য এখানে সুবিশাল গোডাউন নির্মাণ করা হয়েছে। রয়েছে চারটি সুরক্ষিত খাদ্য গুদাম। এসব গুদামে ১ লাখ মানুষের তিন মাসের খাবার মওজুদ রাখা যাবে। তৈরি করা হয়েছে তিনটি মসজিদ। স্বাস্থ্যসেবায় রয়েছে দু’টি ২০ শয্যার হাসপাতাল ও চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক।

পুরো ভাসানচরে মোট ৪৩ কিলোমিটার পাকা রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। রাতে নিরাপত্তার জন্য রয়েছে এলইডি লাইট। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জনপদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রত্যেক মোড়ে মোড়ে আছে মোট ১২০টি ডাস্টবিন। রয়েছে চার তলা বিশিষ্ট ৩টি মসজিদ, দু’টি স্কুল, চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক, ২০ শয্যা বিশিষ্ট দু’টি হাসপাতাল ও তিনটি বাজার। তৈরি হয়েছে দু’টি ইয়াতীমখানাও।  অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার থেকে শুরু করে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা সম্বলিত এসব হাসপাতাল থেকে রোগীদের ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা ও ফ্রী ওষুধ সেবা দেওয়া হবে। সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য আর্মড পুলিশের ৭০০ সদস্যের সমন্বয়ে একটি ব্যাটালিয়ন করতে যাচ্ছে সরকার।

এছাড়া সরকারী কমিশন, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা-এর কর্মকর্তা সহ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। আছে দু’টি স্বয়ংসম্পূর্ণ হেলিপ্যাডও।

ভাসানচরে প্রকল্প বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে রোহিঙ্গারা ত্রাণ সহায়তার আওতায় খাবার ও রেশন পাওয়ায় তাদের কোন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নেই। কিন্তু ভাসানচরে পরীক্ষামূলক জীবিকা নির্বাহ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যে আছে মৎস্য চাষ, মুরগী পালন, গবাদিপশু পালন, কবুতর এবং হাঁস পালন, দুগ্ধ খামার, ধান ও সবজি চাষ, হস্তশিল্প, মহিলাদের জন্য সেলাই কাজ, বিভিন্ন ভোকেশনাল ট্রেনিং সহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সুযোগ। দ্বীপে এখন প্রায় ছয় হাযার মহিষ আছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত এসব মহিষের পাশাপাশি সরকারীভাবে প্রকল্প নিয়ে মহিষের দুধ থেকে দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন করা হবে। বর্তমানে ছাগল ও ভেড়া পালনের যে পরীক্ষামূলক উদ্যোগ চলছে সেখানে উৎপাদন বৃদ্ধির হার যথেষ্ট ভালো দেখা গেছে। প্রকল্পের দু’টি বিশাল লেকে পরীক্ষামূলকভাবে মৎস্য চাষ করেও সফলতা পাওয়া গেছে। এছাড়া খালি থাকা বিশাল জমিতে যে কোন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

ভাসানচর প্রকল্প পরিচালক কমডোর আব্দুল্লাহ আল-মামূন চৌধুরী বলেন, ‘অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।  পতেঙ্গা পয়েন্ট থেকে ৫১.৮, হাতিয়া থেকে ২৪.৫ ও সন্দ্বীপ থেকে ৮.৩ কি.মি. দূরের ভাসানচরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এজন্য বঙ্গোপসাগরে গত ১৭২ বছরে হওয়া সব ধরনের ঝড়ের ডাটা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৯ ফুট উচ্চতার ১২.১ কিমি বাঁধের নির্মাণ শেষ হয়েছে। এছাড়া ৯ থেকে ১৯ ফুট বাঁধের উচ্চতা বাড়ানোর কাজ গত জানুয়ারীতে শুরু হয়েছে। ভাসানচর মোট ১৩ হাযার একরের হ’লেও মাত্র ১৭০০ একর জমির চারদিকে বাঁধ দিয়ে ৪৩২ একরের ওপর আবাসন ও অন্যান্য স্থাপনা করা হয়েছে। বাকী ৩৫২ একর জমি নৌবাহিনী জন্য এবং আরও ৯৩২ একর ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণের জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছে। ফলে এখন ১ লাখ রোহিঙ্গাকে এখানে স্থানান্তরের পর, চাইলে পুরো ১০ লাখকেই ভাসানচরে ধীরে ধীরে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা সম্ভব।

তিনি আরো বলেন, ভাসানচরের দক্ষিণে বাঁধ দেওয়ায় দ্বীপটি ক্রমেই উত্তর দিকে বড় হচ্ছে। এর সবচেয়ে কাছের ভূখন্ড সন্দ্বীপ। বর্ষা মৌসুমে দুই দ্বীপের দূরত্ব সাড়ে আট কিলোমিটার হ’লেও শুষ্ক মৌসুমে তা দাঁড়ায় তিন থেকে চার কিলোমিটারে। সেখানে পলির পরিমাণ বেড়েই চলছে। ১০ বছর পর এটি হয়তো সন্দ্বীপের সঙ্গে যুক্তও হ’তে পারে। এতে ভবিষ্যতে ভাসানচরের যোগাযোগ ব্যবস্থা আমূল পাল্টে যাবে।






আরও
আরও
.