২০১১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে লিবিয়ার অবিসংবাদিত নেতা গাদ্দাফীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ যখন দানা বেঁধে উঠছিল, সেসময় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে তাঁর ছেলে সাইফ আল-ইসলাম যেসব আশঙ্কার কথা বলে দেশবাসীকে সতর্ক করেছিলেন, সেগুলোর বেশির ভাগই এখন দৃশ্যমান। সেই ভাষণে সাইফ দেশবাসীর প্রতি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অরাজক পরিস্থিতির দিকে দেশকে ঠেলে না দেয়ার অনুরোধ জানান। এ সময় সাইফ দেশের বিভিন্ন প্রকল্পে ২০ হাযার কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের কথা উল্লেখ করে বলেন, এই বিদ্রোহ সব ধূলিসাৎ করবে। দেশকে ঠেলে দেবে গৃহযুদ্ধের দিকে। জাতি ও গোষ্ঠীগত বিরোধ দেশকে টুকরো করে ফেলবে। ফায়দা লুটবে বাইরের দুর্বৃত্ত ও পশ্চিমারা। প্রাণ ঝরবে হাযারো মানুষের। তিনি বলেছিলেন, এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের মানুষের নিরাপত্তার অভাব দেখা দেবে। অর্থনৈতিক শক্তির মূল ভিত্তি তেল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। বিপর্যস্ত হবে অর্থনীতি। এই সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে ধর্মান্ধ সংগঠন ও গোষ্ঠীগুলো। দেশে যে সংকট সৃষ্টি হবে এর জের ধরে বহু লিবীয় বাস্ত্তভিটা হারাবে। আশ্রয়ের আশায় যাযাবরের মতো তারা ভীনদেশের দ্বারে দ্বারে ঘুরবে।

শতবর্ষ আগের দুঃসময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সাইফ বলেছিলেন, ১৯১১ সালে ইতালী তাদের দেশ দখল করে নেয়ার পর যে ভয়ানক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল, সেই সংকটাপন্ন দিনগুলো ফিরে আসবে। ঐ সময় লিবিয়ার হাযারো মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রায় ৪০ মিনিটের এই ভাষণে সাইফ সতর্ক করে বলেন যে, তাদের মূল সম্পদ প্রাকৃতিক তেল অন্যদের হাতে চলে যাবে, বিপুল পরিমাণ তেল পুড়ে নষ্ট হবে। বারোটা বেজে যাবে দেশের অর্থনীতির। সাইফের ঐ ভাষণ সে সময় সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ করা হয়।

কিন্তু তার এই সতর্কবার্তা বেশির ভাগ মানুষ আমলে নেয়নি। আন্দোলনরত মানুষ উল্টো ক্ষুব্ধ হয়েছিল। বিশ্লেষক ও সমালোচকেরা কঠোর ভাষায় সাইফের নিন্দা করে বলেছিলেন, গণতন্ত্র পেলে লিবিয়া বরং উন্নয়ন আর সমৃদ্ধিতে ফুলে-ফেঁপে উঠবে। এরপর অনেক কিছুই ঘটে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের সহযোগিতায় বিদ্রোহীরা গাদ্দাফীর পতন ঘটিয়েছে। বন্দী হয়েছেন সাইফ আল-ইসলাম। যুদ্ধাপরাধের দায়ে তিনি বর্তমানে কারাগারে।

সাইফের ভাগ্যে যা-ই ঘটুক না কেন, পাঁচ বছর আগে তিনি যেসব কথা বলেছেন, তা আজ অতি নির্মমভাবে বাস্তব। লিবিয়ায় এখন জাতিসংঘ-সমর্থিত একটি ঐক্যের সরকার প্রতিষ্ঠিত হ’লেও আঞ্চলিক প্রশাসনে এর নিয়ন্ত্রণ নেই। ২০১০ সালে যে লিবিয়ায় প্রতিদিন গড়ে ১৬ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদিত হ’ত, সেখানে এখন তেল উৎপাদন চার-পাঁচ লাখ ব্যারেল। ২০১১ সাল থেকে বিদ্যুৎ-সংকট লিবিয়ার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। দেশটির  একজন এমপির তথ্যমতে, ৬৪ লাখ লোকের দেশটিতে প্রায় দুই কোটি অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। অভাব-অনটন দেশজুড়ে। দুর্নীতি ও অনাচারে ভরে গেছে দেশ। উন্নত জীবনের আশায় মানুষ দূরদেশের দিকে ছুটছে। অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকের ঘটছে সলিলসমাধি।

আর গাদ্দাফীর পতনের মাধ্যমে সুখী দেশ গড়ার স্বপ্ন যারা পেছন থেকে দেখিয়েছিল, এই পরদেশী মিত্ররা সটকে পড়েছে। মাঝখান থেকে নিরীহ সাধারণ মানুষের যত দুর্ভোগ। এর শেষ কোথায়, এরও কোন আভাস নেই। কেবল লিবিয়াই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে গণতন্ত্রের সুবাস নিয়ে আরব বসন্তের ফুল ফুটেছিল, সে ফুল ঝরে পাপড়ি শুকিয়ে গেছে। তবে এই ফুল এটাই শিক্ষা দিয়েছে যে সমঝোতার মনোভাব না থাকলে, সত্যিকারের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হ’লে, কোন দেশেই শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসে না।






আরও
আরও
.