তালাক শব্দের অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়া, বন্ধন মুক্ত হওয়া ইত্যাদি। পরিভাষায় তালাক অর্থ ‘বিবাহের বাঁধন খুলে দেওয়া’ বা বিবাহের শক্ত বন্ধন খুলে দেওয়া। অর্থাৎ স্বামী কর্তৃক তার স্ত্রীর সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া। জীবনে বিপর্যয় থেকে স্বামী-স্ত্রী উভয়কে রক্ষার জন্য ইসলামে তালাকের সুযোগ রাখা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যখন চরমভাবে বিরোধ দেখা দেয়, পরস্পর মিলে মিশে শান্তিপূর্ণ ও মাধুর্যমন্ডিত জীবন যাপন যখন একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে, পারস্পরিক সম্পর্ক যখন হয়ে পড়ে তিক্ত, একজনের মন যখন অপরজন থেকে এমনভাবে বিমুখ হয়ে যায় যে, তাদের মাঝে সমঝোতার আর কোন সম্ভাবনা থাকে না; ঠিক তখনই এই চূড়ান্ত পন্থা অবলম্বন তথা তালাকের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আলোচ্য নিবন্ধে তালাক সংঘটিত হওয়ার কারণ সমূহ উপস্থাপন করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
ইসলামে নারীর একটা সম্মানজনক অবস্থান আছে। এজন্যই ইসলাম স্বামীকে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক তালাকের অনুমতি দিয়েছে। স্ত্রীকে সতর্ক করার জন্য স্বামী সর্বোচ্চ দু’বার এই শব্দ ব্যবহার করার সুযোগ পাবে। প্রথম দু’বার উক্ত শব্দ প্রয়োগের পর ভুল শুধরে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার অবকাশ আছে। কিন্তু তৃতীয়বার আর সেই অবকাশ থাকে না।
মূলতঃ তালাক দেয়ার সুন্নাতী নিয়ম হ’ল, এক তুহুরে এক তালাক দেয়া। এরপর তিন ঋতু পর্যন্ত অপেক্ষা করা। যদি বনিবনা হয়ে যায়, তাহ’লে স্বামী তার স্ত্রীকে ইদ্দতের মধ্যে ফিরিয়ে নিতে পারবে। আর যদি বনিবনা না হয়, তাহ’লে তিন ঋতু (ইদ্দত) অতিবাহিত হ’লে বিবাহ ভেঙ্গে যাবে। এরপর স্বামী-স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে চাইলে নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফিরিয়ে নিতে পারবে। এভাবে আবার প্রয়োজন হ’লে দ্বিতীয় তালাক দিতে পারবে স্বামী। এরপর আবার তিন ঋতু পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। চাইলে ইদ্দতের মধ্যে ফিরিয়ে নিবে, না ফেরালে বিয়ে ভেঙ্গে যাবে। ইদ্দত শেষে নতুন বিবাহের মাধ্যমে আবার ফিরিয়ে নিতে পারবে। দুই দুই বার তালাক দেয়ার পর ইসলাম স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে। কিন্তু তিন তালাকের পর আর এই সুযোগ নেই।
বৈধ কারণে ইসলাম তালাক প্রদান করাকে জায়েয করেছে (বাক্বারাহ ২/২২৯)। তবে এটা হ’তে হবে তিন তুহুরে (পবিত্রাবস্থায়) তিন তালাক। আল্লাহ বলেন,
يَاأَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَطَلِّقُوْهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ وَأَحْصُوْا الْعِدَّةَ وَاتَّقُوا اللهَ رَبَّكُمْ لَا تُخْرِجُوْهُنَّ مِنْ بُيُوْتِهِنَّ وَلَا يَخْرُجْنَ إِلَّا أَنْ يَأْتِيْنَ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ وَتِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ وَمَنْ يَتَعَدَّ حُدُودَ اللهِ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ لَا تَدْرِيْ لَعَلَّ اللهَ يُحْدِثُ بَعْدَ ذَلِكَ أَمْرًا،
‘হে নবী! যখন তোমরা স্ত্রীদের তালাক দাও, তখন তাদেরকে ইদ্দত অনুযায়ী তালাক দাও এবং ইদ্দত গণনা করতে থাক। আর তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় কর। তালাকের পর স্ত্রীদের তাদের গৃহ থেকে বিতাড়িত করো না এবং তারাও যেন স্বামীগৃহ ছেড়ে বেরিয়ে না যায়। যদি না তারা স্পষ্ট ফাহেশা কাজে লিপ্ত হয়। এগুলি হ’ল আল্লাহর সীমারেখা। যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমারেখা লংঘন করে, সে তার নিজের উপর যুলুম করে। তুমি জানো না, হয়ত আল্লাহ এরপর কোন (সমঝোতার) পথ বের করে দিবেন’ (তালাক ৬৫/১)।
এক্ষেত্রে তালাক সংঘটিত হওয়ার অসংখ্য কারণ পরিলক্ষিত হয়। নিমেণ তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
১. শয়তানের প্ররোচনা : যুগ যুগ ধরে শয়তানের প্ররোচনায় তালাক সংঘটিত হচ্ছে। শয়তান তালাককে পসন্দ করে। কারণ এতে মুসলিমের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়। এটা দ্বীন-দুনিয়ার সর্বপ্রকার মুছীবত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ইবলীস তার সঙ্গীদের এই ব্যপারে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
إِنَّ إِبْلِيسَ يَضَعُ عَرْشَهُ عَلَى الْمَاءِ ثُمَّ يَبْعَثُ سَرَايَاهُ فَأَدْنَاهُمْ مِنْهُ مَنْزِلَةً أَعْظَمُهُمْ فِتْنَةً يَجِيْءُ أَحَدُهُمْ فَيَقُوْلُ فَعَلْتُ كَذَا وَكَذَا فَيَقُوْلُ مَا صَنَعْتَ شَيْئًا قَالَ ثُمَّ يَجِيْءُ أَحَدُهُمْ فَيَقُوْلُ مَا تَرَكْتُهُ حَتَّى فَرَّقْتُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ امْرَأَتِهِ قَالَ فَيُدْنِيْهِ مِنْهُ وَيَقُوْلُ نِعْمَ أَنْتَ قَالَ الْأَعْمَشُ أُرَاهُ قَالَ فَيَلْتَزِمُهُ،
‘ইবলীস পানির উপর তার আসন স্থাপন করতঃ তার বাহিনী প্রেরণ করে। তন্মধ্যে তার সর্বাধিক নৈকট্য অর্জনকারী সে, যে সবচেয়ে বেশী ফিতনা সৃষ্টিকারী। তাদের একজন এসে বলে, আমি অমুক অমুক কাজ করেছি। সে বলে, তুমি কিছুই করনি। অতঃপর অন্যজন এসে বলে, অমুকের সাথে আমি সকল প্রকার ধোঁকার আচরণ করেছি। এমনকি তার থেকে তার স্ত্রীকে আলাদা করে দিয়েছি। তারপর শয়তান তাকে তার নিকটবর্তী করে নেয় এবং বলে হ্যাঁ, তুমি খুব ভাল। রাবী আ‘মাশ বলেন, আমার মনে হয় তিনি বলেছেন, অতঃপর শয়তান তার সাথে আলিঙ্গন করে’।[1]
২. স্বামী-স্ত্রীর অনৈক্য : আমাদের দেশে অধিকাংশ পরিবারের অল্প শিক্ষিত বা অধিক শিক্ষিত নারীরা স্বামীর কথা মানতে নারায। কারণ স্ত্রী নিজেকে স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে চাকুরীর পেছনে হন্যে হয়ে ঘুরে। চাকুরী পেলে স্বামীকে তোয়াক্কা করে না। সৃষ্টি হয় অনৈক্যের। অবশেষে তালাকের মাধ্যমে সমাধান হয়। সেটা কখনো স্ত্রীর পক্ষ থেকে আবার কখনো স্বামীর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। আল্লাহকে ভয় করে সৎকাজ করলে এমনটি হ’ত না। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,
مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ،
‘পুরুষ হৌক নারী হৌক মুমিন অবস্থায় যে ব্যক্তি সৎকর্ম সম্পাদন করে, আমরা অবশ্যই তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং অবশ্যই তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম অপেক্ষা অধিক উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করব’ (নাহল ১৬/৯৭)।
৩. ইসলাম থেকে দূরে সরে পড়া : স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বাকবিতন্ডার মূল ইস্যু বা সূত্রপাত হয় আল্লাহর রাস্তা থেকে দূরে সরে পড়ার কারণে। এজন্য পারিবারিক যত সমস্যা, অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয় সবই আল্লাহর রাস্তা থেকে দূরে সরে পড়ার কারণে। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
إِنَّ اللهَ إِذَا أَحَبَّ عَبْدًا دَعَا جِبْرِيْلَ فَقَالَ إِنِّي أُحِبُّ فُلَانًا فَأَحِبَّهُ قَالَ فَيُحِبُّهُ جِبْرِيْلُ ثُمَّ يُنَادِيْ فِي السَّمَاءِ فَيَقُوْلُ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ فُلَانًا فَأَحِبُّوْهُ فَيُحِبُّهُ أَهْلُ السَّمَاءِ قَالَ ثُمَّ يُوْضَعُ لَهُ الْقَبُوْلُ فِي الْأَرْضِ وَإِذَا أَبْغَضَ عَبْدًا دَعَا جِبْرِيْلَ فَيَقُوْلُ إِنِّيْ أُبْغِضُ فُلَانًا فَأَبْغِضْهُ قَالَ فَيُبْغِضُهُ جِبْرِيْلُ ثُمَّ يُنَادِيْ فِيْ أَهْلِ السَّمَاءِ إِنَّ اللهَ يُبْغِضُ فُلَانًا فَأَبْغِضُوْهُ قَالَ فَيُبْغِضُوْنَهُ ثُمَّ تُوْضَعُ لَهُ الْبَغْضَاءُ فِي الْأَرْضِ،
‘আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে মহববত করেন তখন জিবরীলকে ডেকে বলেন, আমি অমুককে মহববত করি, অতএব তুমি তাকে মহববত কর। তিনি বলেন, ‘ফলে জিবরীল তাকে মহববত করে। অতঃপর সে আসমানে ঘোষণা করে, আল্লাহ অমুককে মহববত করেন অতএব তোমরা তাকে মহববত কর। ফলে আসমানবাসী তাকে মহববত করে। তিনি বলেন, অতঃপর যমীনে তার জন্য গ্রহণযোগ্যতা রাখা হয়। আর যখন তিনি কোন বান্দাকে অপসন্দ করেন জিবরীলকে ডেকে বলেন, ‘আমি অমুককে অপসন্দ করি অতএব তুমি তাকে অপসন্দ কর’। তিনি বলেন, ‘ফলে জিবরীল তাকে অপসন্দ করেন। অতঃপর সে আসমানবাসীদের মধ্যে ঘোষণা করেন যে, আল্লাহ অমুককে অপসন্দ করে। অতএব তোমরা তাকে অপসন্দ কর’। তিনি বলেন, ‘ফলে তারা তাকে অপসন্দ করে। অতঃপর যমীনে তার জন্য নিন্দা রাখা হয়’।[2]
বর্তমানে অনৈসলামিক শিক্ষা বিস্তৃতি লাভ করায় শিক্ষিত হওয়ার পরও এক শ্রেণীর মুসলিম ধর্মহীন থাকে। ধীরে ধীরে তারা আল্লাহর দ্বীন থেকে দূরে সরে পড়ে। ফলে বস্ত্তগত উন্নতি তাদের কাছে মুখ্য হয়। দ্বীনদারীর বিষয় তাদের কাছে গৌন থাকে। আর তারা অভ্যস্ত থাকে যথেচ্ছা জীবন-যাপনে। উচ্ছৃংখল ও বাধাহীন চলাচলের ফলে সৃষ্টি হয় পারিবারিক অশান্তি। এক পর্যায়ে তার সমাধান ঘটে তালাকের মাধ্যমে। কারণ পাপ ও অবাধ্যতা সাংসারিক জীবন ও রিযিক সংকীর্ণ করে দেয়। আর আনুগত্য ও ইসলামে সুদৃঢ় থাকলে রিযিকে প্রবৃদ্ধি হয়। জীবনযাত্রা হয় স্বাচ্ছন্দ্যময়। আল্লাহ বলেন, وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِيْ فَإِنَّ لَهُ مَعِيْشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى، ‘আর যে ব্যক্তি আমার উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে, তার জীবন-জীবিকা সংকুচিত হবে এবং আমরা তাকে ক্বিয়ামতের দিন অন্ধ করে উঠাব’ (ত্ব-হা ২০/১২৪)।
৪. ইবাদত ত্যাগকারী : কখনো কখনো স্বামী ছালাত আদায়কারী এবং স্ত্রী ছালাত ত্যাগকারী অথবা এর বিপরীত অবস্থানে থাকে। এতে ছালাত আদায়কারী চায় অপরকে দ্বীনের দিকে ও ইবাদতের দিকে বুঝিয়ে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু প্রতিপক্ষ মেনে নিতে রাযী হয় না। ফলে বিপত্তি ঘটে। মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
أُخْبِرُكَ بِرَأْسِ الْأَمْرِ كُلِّهِ وَعَمُوْدِهِ وَذِرْوَةِ سَنَامِهِ قُلْتُ بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ رَأْسُ الْأَمْرِ الْإِسْلَامُ وَعَمُوْدُهُ الصَّلَاةُ وَذِرْوَةُ سَنَامِهِ الْجِهَاد،
‘আমি কি সমস্ত কাজের মূল, স্তম্ভ ও সর্বোচ্চ চূড়া সম্পর্কে তোমাকে অবহিত করব না? আমি বললাম, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, সকল কাজের মূল হ’ল ইসলাম, স্তম্ভ হ’ল ছালাত এবং সর্বোচ্চ শিখর হ’ল জিহাদ’।[3]
জাবের (রাঃ) বলেন যে, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, বান্দা এবং শিরক ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ছালাত ছেড়ে দেয়া’।[4]
এমন অনেক মুসলিম পরিবার রয়েছে যারা ছালাত আদায়ে অমনোযোগী অথবা ছালাত ধর্মের স্তম্ভ বা খুঁটি বলে বিশ্বাস করে না। আবার অনেকে ছালাত আদায় করলেও জামা‘আতে ছালাত আদায়ের গুরুত্ব দেয় না। স্বামী অথবা স্ত্রী অনিয়মিত ছালাত আদায়কারী। এগুলো বৈবাহিক সম্পর্ক ধ্বংসের এক বিশেষ কারণ হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا، ‘নিশ্চয়ই ছালাত মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারিত’ (নিসা ৪/১০৩)।
তিনি আরো বলেন,فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّيْنَ الَّذِيْنَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُوْنَ، ‘অতএব দুর্ভোগ সেসব ছালাতীদের, যারা তাদের ছালাত থেকে উদাসীন’ (মা‘উন ১০৭/৫)। আয়াতের তাফসীরে ইবনে কাছীর (রহঃ) বলেন,هم الذين يؤخرون الصلاة عن وقتها، ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা নির্দিষ্ট সময়ে ছালাত আদায় না করে দেরীতে আদায় করে’।[5]
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ لَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ آمُرَ بِحَطَبٍ فَيُحْطَبَ ثُمَّ آمُرَ بِالصَّلَاةِ فَيُؤَذَّنَ لَهَا ثُمَّ آمُرَ رَجُلًا فَيَؤُمَّ النَّاسَ ثُمَّ أُخَالِفَ إِلَى رِجَالٍ فَأُحَرِّقَ عَلَيْهِمْ بُيُوتَهُمْ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ يَعْلَمُ أَحَدُهُمْ أَنَّهُ يَجِدُ عَرْقًا سَمِينًا أَوْ مِرْمَاتَيْنِ حَسَنَتَيْنِ لَشَهِدَ الْعِشَاءَ، ‘যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ! আমার ইচ্ছা হয়, জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করতে আদেশ দেই। অতঃপর ছালাত কায়েমের নির্দেশ দেই। অতঃপর ছালাতের আযান দেয়া হোক। এরপর এক ব্যক্তিকে লোকদের ইমামতি করার দায়িত্ব দেই। অতঃপর আমি লোকদের নিকটে যাই এবং তাদের (যারা ছালাতে শামিল হয়নি) বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেই। যে মহান সত্তার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর কসম! যদি তাদের কেউ জানত যে, একটি গোশতহীন মোটা হাড় বা ছাগলের ভাল দু’টি পা পাবে তাহ’লে অবশ্যই সে এশার ছালাতের জামা‘আতেও হাযির হ’ত’।[6]
এমন ইবাদতবিমুখ লোকের পারিবারিক সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। এদেরকে শয়তান কুমন্ত্রণা দিয়ে পরিবার বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যায়। যার শেষ পরিণতি ঘটে তালাকের মাধ্যমে।
৬. হারাম উপার্জন : সমাজে তালাক প্রবণতা বৃদ্ধির আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে হারাম উপার্জন। এতে একদিকে যেমন আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হ’তে হয়। অপরদিকে হারাম উপার্জন দ্বারা পরিপুষ্ট ব্যক্তির কোন ইবাদতও কবুল হয় না। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لاَ يَقْبَلُ إِلاَّ طَيِّبًا وَإِنَّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ فَقَالَ يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ وَقَالَ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ،.
‘আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র, তিনি পবিত্র বস্ত্ত ছাড়া গ্রহণ করেন না। আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলদের যে হুকুম দিয়েছেন মুমিনদেরকেও সে হুকুম দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্ত্ত হ’তে ভক্ষণ কর এবং সৎকর্ম কর। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর, সব বিষয়ে আমি অবগত’ (মুমিনূন ২৩/৫১)। তিনি আরো বলেছেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমরা তোমাদের যে রূযী দান করেছি, সেখান থেকে পবিত্র বস্ত্ত সমূহ ভক্ষণ কর’ (বাক্বারাহ ২/১৭২)। অতঃপর তিনি এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত দীর্ঘ সফর করে। ফলে সে ধুলি ধূসরিত রুক্ষ কেশধারী হয়ে পড়ে। অতঃপর সে আকাশের দিকে হাত তুলে বলে, ‘হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং সে হারাম খেয়ে থাকে। কাজেই তার দো‘আ কি করে কবুল হ’তে পারে?[7] আল্লাহ আরো বলেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِنَ اللهِ وَرَسُولِهِ وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوسُ أَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُونَ وَلَا تُظْلَمُونَ
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সূদের পাওনা যা বাকী রয়েছে, তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা সত্যিকারের মুমিন হয়ে থাক। যদি তোমরা তা না কর, তাহ’লে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে যাও। আর যদি তোমরা তওবা কর, তাহ’লে তোমাদের মূলধনটুকু পাবে। তোমরা অত্যাচার করো না এবং অত্যাচারিত হয়ো না’ (বাক্বারাহ ২/২৭৮-২৭৯)।
এমন বিধান থাকতেও অনেকে তোয়াক্কা করে না। ফলে শুরু হয় আল্লাহর গযব। অর্থের অহংকারে স্বামী অথবা স্ত্রী হয়ে উঠে বেপরোয়া। শুরু হয় তাদের মধ্যে অশান্তি, অনৈক্য। যার সর্বশেষ পরিণতি হয় তালাক।
৭. পর্দাহীনতা : অনেক মুসলিম পরিবারের নারী-পুরুষ বেহায়াপনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত। নির্লজ্জদের মত এরা রাস্তা ঘাটে চলাচল করে। মূলতঃ এটাও কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। মুসলিম যিন্দেগীকে সংকীর্ণ করে দেয়। আল্লাহ বলেন,
وَقَرْنَ فِيْ بُيُوْتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّتِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاتَ وَآتِيْنَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيْدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيْرًا-
‘আর তোমরা নিজ নিজ গৃহে অবস্থান কর। পূর্বতন জাহেলী যুগের নারীদের ন্যায় সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়িয়ো না। তোমরা ছালাত কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো। হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে কালিমা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র করতে’ (আহযাব ৩৩/৩৩)।
তিনি আরো বলেন, يَاأَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِيْنَ يُدْنِيْنَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَى أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيْمًا- ‘হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মুমিনদের স্ত্রীদের বলে দাও তারা যেন তাদের বড় চাদরের কিছু অংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আহযাব ৩৩/৫৯)। তিনি আরো বলেন,
وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوْجَهُنَّ وَلَا يُبْدِيْنَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوْبِهِنَّ وَلَا يُبْدِيْنَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ بُعُوْلَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُوْلَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِيْنَ غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِيْنَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَى عَوْرَاتِ النِّسَاءِ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِيْنَ مِنْ زِينَتِهِنَّ وَتُوْبُوْا إِلَى اللهِ جَمِيْعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُوْنَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ-
‘আর তুমি মুমিন নারীদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাযত করে। আর তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে কেবল যেটুকু প্রকাশ পায় সেটুকু ব্যতীত। তারা যেন তাদের মাথার কাপড় বক্ষদেশের উপরে রাখে। আর তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজ পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগিনীপুত্র, নিজেদের বিশ্বস্ত নারী, অধিকারভুক্ত দাসী, কামনামুক্ত পুরুষ এবং শিশু, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অবহিত নয় তারা ব্যতীত। আর তারা যেন এমনভাবে চলাফেরা না করে যাতে তাদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ হয়ে পড়ে। আর হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর দিকে ফিরে যাও, যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (নূর ২৪/৩১)।
বর্তমান সময়ে অধিকাংশ নারীরা তাদের পোষাক-পরিচ্ছদে, চাল-চলনে, উলঙ্গ, নির্লজ্জ, বেহায়া নারীদের মত। সুগন্ধি মেখে সাজসজ্জা করে বাইরে ঘোরাফিরা করে। তারা নিজেরা পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হয় এবং পুরুষদেরকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُوْنَ بِهَا النَّاسَ وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيْلَاتٌ مَائِلَاتٌ رُءُوْسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ لَا يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلَا يَجِدْنَ رِيْحَهَا وَإِنَّ رِيْحَهَا لَيُوْجَدُ مِنْ مَسِيْرَةِ كَذَا وَكَذَا-
‘দুই শ্রেণীর লোক জাহান্নামী, যাদেরকে এখনও আমি দেখিনি। ১. এমন সম্প্রদায় যাদের হাতে গরুর লেজের ন্যায় দীর্ঘ লাঠি থাকবে, যা দ্বারা তারা মানুষকে প্রহার করবে। ২. নগ্ন পোষাক পরিধানকারী নারী, যারা পুরুষদেরকে নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করবে এবং নিজেরাও পুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথা বক্র উঁচু কাঁধ বিশিষ্ট উটের ন্যায় হবে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এমনকি তারা জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধি এত এত দূর হ’তে পাওয়া যায়।[8]
৮. মাহরাম ব্যতীত সফর করা : অনেক মুসলিম পরিবার রয়েছে যারা গায়ের মাহরাম ব্যতীত তাদের নারীদের সফর করিয়ে থাকে। বিশেষ করে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদেরকে মাহরাম ব্যতীত যাতায়াত করার সুযোগ দেওয়া অথবা আবাসিকে স্থান করে দেওয়া পাপের দিকে ঠেলে দেওয়ারই নামান্তর। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,لَا يَحِلُّ لِامْرَأَةٍ أَنْ تُسَافِرَ ثَلَاثًا إِلَّا وَمَعَهَا ذُو مَحْرَمٍ مِنْهَا ‘কোন মহিলার সাথে কোন মাহরাম পুরুষ না থাকলে, সে যেন তিন দিনের পথ সফর না করে’ (বুখারী হা/২৩৮৯)।
ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,
لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا وَمَعَهَا ذُو مَحْرَمٍ وَلَا تُسَافِرْ الْمَرْأَةُ إِلَّا مَعَ ذِي مَحْرَمٍ فَقَامَ رَجُلٌ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّ امْرَأَتِي خَرَجَتْ حَاجَّةً وَإِنِّي اكْتُتِبْتُ فِي غَزْوَةِ كَذَا وَكَذَا قَالَ انْطَلِقْ فَحُجَّ مَعَ امْرَأَتِكَ-
‘মাহরাম পুরুষ ব্যতীত কোন পুরুষ যেন কোন মহিলার সাথে একান্তে সাক্ষাৎ না করে। কোন স্ত্রীলোক যেন সাথে কোন মাহরাম পুরুষ ছাড়া একাকী সফর না করে। এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার স্ত্রী হজ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে এবং আমি সৈন্য বাহিনীতে তালিকাভুক্ত হয়েছি অমুক অমুক যুদ্ধে যাবে। তিনি বললেন, তুমি চলে যাও এবং তোমার স্ত্রীর সাথে হজ্জ কর’।[9]
বিষয়টি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, একা হজ্জ পর্যন্ত করার অনুমতি রাসূল (ছাঃ) দেননি। বিভিন্ন সময় পত্র-পত্রিকায় বা গণমাধ্যমে সংবাদ পাওয়া যায় শিক্ষর্থীরা এমন সুযোগে কোন না কোন ভাবে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। অথবা দীর্ঘ সফরে পরপুরুষ সঙ্গী হ’লে একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজ স্বামীকে ত্যাগ করে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়। এভাবে এক পর্যায়ে বৈধ পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। পর্দাহীনতাই এক্ষেত্রে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে।
৯. হারাম প্রদর্শনী : আধুনিককালে নাটক, সিনেমা খুবই সহজ লভ্য। কি করে স্বামীকে ঘায়েল করতে হয়, শাশুড়িকে দমিয়ে রাখতে হয়, ননদদেরকে কিভাবে দূরে সরাতে হয়, বন্ধুকে কিভাবে পটাতে হয়, সর্বোপরি সংসারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির সকল কলাকৌশল শিক্ষায় সহযোগিতা করে বর্তমান প্রচারমাধ্যম। এমনকি পোষাক প্রদর্শনীর নামে শরীর প্রদর্শন, বিজ্ঞাপনের নামে নারীর দেহ প্রদর্শন মহামারীর আকার ধারণ করেছে। এব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-এর সতর্ক বাণী রয়েছে। জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
سَأَلْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ نَظْرَةِ الْفُجَاءَةِ فَأَمَرَنِي أَنْ أَصْرِفَ بَصَرِي-
‘আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে হঠাৎ দৃষ্টি পড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন, আমি যেন আমার চোখ ফিরিয়ে নিই’।[10]
সহশিক্ষার কারণে নৈতিক চরিত্রের যে অবনতি ও অবক্ষয় হয়েছে তা বর্ণনাতীত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েরা অবাধ মেলামেশার সুযোগ পায়। ফলে তারা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে। সহশিক্ষার কারণে একই সময়ে একজন যুবক কিংবা যুবতী অনেকের সাথে সম্পর্ক গড়ার সুযোগ পায়। এর ফলে শুরু হয় রেষারেষি, এসিড নিক্ষেপ, খুন-খারাবী ইত্যাদি।
সহশিক্ষার কুফল হ’ল দাম্পত্য জীবনে অশান্তি। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রত্যেক ছেলে ও মেয়ে বহু ছেলেমেয়ের সাথে অবাধে মেলামেশার সুযোগ পায়। এদের মধ্যে যার সাথে তথাকথিত প্রেম জমে ওঠে, তার সাথে বিয়ে না হ’লে, বিবাহিত জীবনে স্বামী স্ত্রীকে এবং স্ত্রী স্বামীকে মেনে নিতে পারে না। সারা জীবন চলে পরস্পরের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি। কেউ কাউকে বরদাশত করতে পারে না। আবার প্রেমের বিয়ে হ’লে পরস্পরের মধ্যে আকর্ষণের চেয়ে বিকর্ষণই ঘটে বেশী। বিবাহ পূর্ব কুকর্ম স্বামীকে অবিশ্বাসী করে তোলে। এভাবেই সৃষ্টি হয় ভুল বুঝাবুঝি আর পরিণামে ঘটে তালাক।
১০. যৌথ কর্মসংস্থান : নারী পুরুষ একই কর্মস্থলে কাজের সুবাদে পরপুরুষের সাথে ঘনিষ্টতা বৃদ্ধি পায়। নিজের স্বামীর তুলনায় সহকর্মীদের সাথে বেশীরভাগ সময় ব্যয় হয়ে থাকে। আত্মীয়-অনাত্মীয়, নারী-পুরুষের মধ্যে ব্যাপক সংমিশ্রণ ও মেলামেশা চলে যৌথ কর্ম সংস্থানে। এটা বড় ধরনের ফিতনা ও মুসলিম পরিবারের চরম ক্ষতির কারণ। অথচ শরী‘আতে এ ব্যাপারে কঠিনভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এমনকি রাস্তায় বের হ’লে রাস্তার কিনারা দিয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছেন রাসূল (ছাঃ)। যেমন আবূ উসায়দ আনছারী (রাঃ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, যখন তিনি মসজিদ থেকে বেরিয়ে দেখতে পান যে, রাস্তার মাঝে পুরুষরা মহিলাদের সাথে মিশে যাচ্ছে তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মহিলাদের উদ্দেশ্যে বলেন,
اسْتَأْخِرْنَ فَإِنَّهُ لَيْسَ لَكُنَّ أَنْ تَحْقُقْنَ الطَّرِيْقَ عَلَيْكُنَّ بِحَافَّاتِ الطَّرِيقِ فَكَانَتْ الْمَرْأَةُ تَلْتَصِقُ بِالْجِدَارِ حَتَّى إِنَّ ثَوْبَهَا لَيَتَعَلَّقُ بِالْجِدَارِ مِنْ لُصُوقِهَا بِهِ-
‘তোমরা অপেক্ষা কর! তোমাদের রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলাচল করা উচিত নয়, বরং তোমরা রাস্তার এক পাশ দিয়ে যাবে। এরপর মহিলারা দেয়াল ঘেষে চলাচল করার ফলে অধিকাংশ সময় তাদের কাপড় দেয়ালের সাথে আটকে যেত’।[11]
অনেকে খোলামেলাভাবে ও রাস্তার মাঝে পুরুষের সাথে মিলেমিশে চলে। অনেক সময় মহিলারা পুরুষকে টপকে যায়। যা অনেক ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনে। এ রকম ড্যামকেয়ার চলাফেরায় নারী অনেক সময় উচ্ছৃঙ্খল যুবকের লালসার শিকারে পরিণত হয়। ফলে নিজের ইয্যত-আব্রু নষ্ট হয় এবং সংসার ভেঙ্গে যায়।
১১. আত্মীয়-স্বজনের সাথে ব্যাপক সংমিশ্রণ : ইসলামী পর্দা না থাকায় নিকটাত্মীয় ও দূরবর্তী আত্মীয়দের সাথে অবাধ মেলামেশা চলে। চাচাত, খালাতো, মামাতো, ফুফাতো ভাই-বোন, সমবয়সী শিক্ষার্থী অথবা সিনিয়ার ভাই, প্রতিবেশী ভাই-বোনদের মাঝে নির্দ্বিধায় দেখা-সাক্ষাৎ হয়ে থাকে। মহান আল্লাহ স্বয়ং রাসূলের স্ত্রীদেরকে কঠিনভাবে হুঁশিয়ার করেছেন অথচ তারা ছিলেন উম্মুল মুমিনীন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا تَدْخُلُوْا بُيُوْتَ النَّبِيِّ إِلَّا أَنْ يُؤْذَنَ لَكُمْ إِلَى طَعَامٍ غَيْرَ نَاظِرِيْنَ إِنَاهُ وَلَكِنْ إِذَا دُعِيْتُمْ فَادْخُلُوْا فَإِذَا طَعِمْتُمْ فَانْتَشِرُوْا وَلَا مُسْتَأْنِسِيْنَ لِحَدِيْثٍ إِنَّ ذَلِكُمْ كَانَ يُؤْذِي النَّبِيَّ فَيَسْتَحْيِي مِنْكُمْ وَاللهُ لَا يَسْتَحْيِيْ مِنَ الْحَقِّ وَإِذَا سَأَلْتُمُوْهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوْبِهِنَّ وَمَا كَانَ لَكُمْ أَنْ تُؤْذُوْا رَسُوْلَ اللهِ وَلَا أَنْ تَنْكِحُوْا أَزْوَاجَهُ مِنْ بَعْدِهِ أَبَدًا إِنَّ ذَلِكُمْ كَانَ عِنْدَ اللهِ عَظِيْمًا-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত তোমরা নবীর গৃহ সমূহে প্রবেশ করো না তোমাদের খাওয়ার জন্য আহার্য প্রস্ত্ততির অপেক্ষা না করে। তবে যখন তোমাদের ডাকা হবে, তখন প্রবেশ করো। অতঃপর খাওয়া শেষে বেরিয়ে পড়ো। অহেতুক গল্প-গুজবে রত হয়ো না। এটি নবীকে কষ্ট দেয়। কিন্তু তিনি তোমাদের কিছু বলতে লজ্জা পান। অথচ আল্লাহ সত্য বলায় লজ্জা পান না। আর তোমরা তাঁর স্ত্রীদের নিকট কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এটা তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিক পবিত্রতার কারণ। আর আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেওয়া এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীদের বিবাহ করা তোমাদের উপর চিরদিনের জন্য অবৈধ। নিশ্চয়ই এটি আল্লাহর নিকটে মহা পাপ’ (আহযাব ৩৩/৫৩)।
অনেকেই পর্দার বিষয়ে কোন তোয়াক্কা করে না। ফলে চাচাত, মামাত, খালাত, ফুফাত ভাই-বোনদের সাথে তাদের থাকে না কোন ব্যবধান। গোপনে চলে এদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক। বিবাহ পরবর্তী জীবনে খাপ খাওয়াতে না পেরে পূর্বের সম্পর্কে ফিরে যাওয়ার রাস্তা তালাশ করে। অবশেষে তালাক বা ডিভোর্সের মাধ্যমে ঘটে পরিসমাপ্তি।
১২. মাতা-পিতার অবাধ্যতা : স্ত্রী নিয়ে সুখী হবার আশায় পিতা-মাতার উপর স্ত্রীকে প্রাধান্য দিয়ে পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করে অনেকেই। ফলে দেখা যায় বৌ-শাশুড়ীর মধ্যে মনোমালিন্য। তখন পিতা-মাতাকে ছেড়ে সংসার আলাদা করে নেয়। ফলে পিতা-মাতার অভিশাপে তাদের নিজেদের মাঝেও একসময় অশান্তি সৃষ্টি হয়। অবশেষে তালাক অথবা ডিভোর্সের মাধ্যমে ফায়ছালা হয়। মাতা-পিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে সে কি করে আল্লাহর রহমত পেতে পারে? আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا ‘আর তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারু উপাসনা করো না এবং তোমরা পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহ’লে তুমি তাদের প্রতি উহ্ শব্দটিও উচ্চারণ করো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। তুমি তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বল’ (বনী ইসরাঈল ১৭/২৩)।
‘আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে এসে বলল, جِئْتُ أُبَايِعُكَ عَلَى الْهِجْرَةِ وَتَرَكْتُ أَبَوَيَّ يَبْكِيَانِ فَقَالَ ارْجِعْ عَلَيْهِمَا فَأَضْحِكْهُمَا كَمَا أَبْكَيْتَهُمَا، ‘আমি আপনার কাছে হিজরতের
বায়‘আত নিতে এসেছি এবং আমার মাতা-পিতাকে কান্নারত অবস্থায় রেখে এসেছি। তিনি বললেন, তুমি ফিরে যাও। তাদেরকে যেভাবে কাঁদিয়েছ ঐভাবে তাদেরকে হাসাও’।[12]
[চলবে]
মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম
ভেরামতলী, শ্রীপুর, গাযীপুর।
[1]. মুসলিম হা/২৮১৩, ই.ফা.বা হা/৬৮৪৬।
[2]. মুসলিম হা/২৬৩৭।
[3]. তিরমিযী হা/২৬১৬; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭৩, হাসান ছহীহ।
[4]. মুসলিম হা/৮২, ই.ফা.বা হা/১৪৯।
[5]. ইবনে কাছীর ৮/৪৯৫।
[6]. বুখারী হা/৬৪৪; মুসলিম হা/৬৫১; আহমাদ হা/৭৩৩২।
[7]. মুসলিম হা/১০১৫; মিশকাত হা/২৭৬০।
[8]. মুসলিম হা/২১২৮; মিশকাত হা/৩৫২৪।
[9]. বুখারী হা/১৮৬২; মুসলিম হা/১৩৪১।
[10]. মুসলিম হা/২১৫৯; তিরমিযী হা/২৭০।
[11]. আবূদাউদ হা/৫২৭২; মিশকাত হা/৪৭২৭।
[12]. আবূদাউদ হা/২৫২৮।