মুসলমানদের
জন্য বছরে শরী‘আত সম্মত দু’টি ঈদ রয়েছে। তা হ’ল ঈদুল ফিৎর ও ঈদুল আযহা।
অনেক মানুষ অজ্ঞতা, অলসতা বা অবহেলা ও উদাসীনতা বশতঃ ঈদে নানা রকম
ভুল-ভ্রান্তি করে থাকে। আলোচ্য নিবন্ধে এসব ভুল-ত্রুটি উল্লেখ করার প্রয়াস
পাব ইনশাআল্লাহ।-
১. গোসল না করা :
কোন কোন
মানুষ ঈদের ছালাতের জন্য পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন ও গোসল করা থেকে বিরত
থাকে। এটা ঠিক নয়। বরং ঈদের জন্য গোসল করা মুস্তাহাব। যাযান হ’তে বর্ণিত,
তিনি বলেন,سَأَلَ رَجُلٌ عَلِيًّا رضي الله عنه عَنِ الْغُسْلِ قَالَ:
إغْتَسِلْ كُلَّ يَوْمٍ إِنْ شِئْتَ. فَقَالَ: لاَ، الغُسْلُ الَّذِيْ هُوَ
الْغُسْلُ. قَالَ يَوْمَ الْجُمْعَةِ وَيَوْمَ عَرَفَةَ وَيَوْمَ
النَّحْرِ وَيَوْمَ الْفِطْرِ. ‘জনৈক ব্যক্তি আলী (রাঃ)-কে গোসল সম্পর্কে
জিজ্ঞেস করল। তিনি বললেন, তুমি চাইলে প্রতিদিন গোসল করবে। সে বলল, না, এ
গোসল নয়। বরং ঐ গোসল, যা মুস্তাহাব। তিনি বললেন, জুম‘আর দিন, আরাফার দিন,
ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিৎরের দিন’।[1]
নাফে‘
(রহঃ) বলেন, أَنَّ عَبْدَ اللهِ بْنَ عُمَرَ كَانَ يَغْتَسِلُ يَوْمَ
الْفِطْرِ قَبْلَ أَنْ يَغْدُوَ إِلَى الْمُصَلَّى ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর
ঈদুল ফিৎরের দিন ঈদের মাঠে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন’।[2]
২. উত্তম পোশাক পরিধান না করা :
মুসলমানদের
মধ্যে কেউ কেউ ঈদের ছালাতের জন্য সুন্দর পোশাক পরিধান করে না; বরং ছালাতের
পরে সুন্দর পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে বের হয়। এটা ঠিক নয়। বরং ঈদের ছালাতের
জন্য যথাসম্ভব উত্তম পোশাক পরিধান করতে হবে। ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,
তিনি বলেন, كَانَ يَلْبِسُ يَوْمَ الْعِيْدِ بُرْدَةً حَمْرَاءَ
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদের দিনে লাল বর্ণের চাদর পরিধান করতেন’।[3]
৩. ঈদুল ফিৎরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে খেজুর না খাওয়া :
অধিকাংশ
মানুষ ঈদুল ফিৎরের দিনে শিরনি-সেমাই, ফিরনি-পায়েশ ইত্যাদি খেয়ে ছালাতের
জন্য ঈদগাহ অভিমুখে গমন করে। কেউবা কিছু না খেয়েই ছালাতের জন্য বের হয়ে
যায়। এটা সুন্নাত পরিপন্থী। বরং ঈদুল ফিৎরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে
বেজোড় সংখ্যক খেজুর খেয়ে বের হওয়া সুন্নাত। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি
বলেন, لاَ يَغْدُو يَوْمَ الْفِطْرِ حَتَّى يَأْكُلَ تَمَرَاتٍ
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদুল ফিৎরের দিন সকালে কয়েকটি খেজুর না খেয়ে (ঈদগাহে)
গমন করতেন না’।[4] অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَيَأْكُلُهُنَّ وِتْرًا ‘তিনি বেজোড় সংখ্যক খেজুর খেতেন’।[5]
ইবনু
আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, مِنَ السُّنَّةِ أنْ يَطْعَمَ [يومَ
الفِطْرِ] قَبْلَ أنْ يَخْرُجَ وَلَوْ بِتَمْرَةٍ. ‘ঈদুল ফিৎরের দিন (বাড়ী
থেকে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে) বের হওয়ার পূর্বে কিছু খাওয়া সুন্নাত। এমনকি একটা
খেজুর হ’লেও’।[6]
ইমাম তিরমিযী (রহঃ)
বলেন,وَقَدِ اسْتَحَبَّ قَوْمٌ مِنْ أَهْلِ الْعِلْمِ أَنْ لاَ يَخْرُجَ
يَوْمَ الْفِطْرِ حَتَّى يَطْعَمَ شَيْئًا وَيُسْتَحَبُّ لَهُ أَنْ
يُفْطِرَ عَلَى تَمْرٍ وَلاَ يَطْعَمَ يَوْمَ الأَضْحَى حَتَّى يَرْجِعَ.
‘বিদ্বানগণের একদল ঈদুল ফিৎরের দিন কোন কিছু খেয়ে বের হওয়া মুস্তাহাব
বলেছেন। আর খেজুর খেয়ে বের হওয়া মুস্তাহাব। ঈদুল আযহার দিন ছালাত আদায় করে
ফিরে না আসা পর্যন্ত কিছু খাবে না’।[7]
ইবনু
কুদামা (রহঃ) বলেন,لا نعلم في استحباب تعجيل الأكل يوم الفطر اختلافا ‘ঈদুল
ফিৎরের দিন প্রত্যুষে কিছু খাওয়া মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারে কোন মতভিন্নতা
আমরা অবগত নই’।[8]
৪. ঈদুল আযহার দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে খাওয়া :
কোন
কোন মানুষ ঈদুল আযহার দিন ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বে বাড়ী থেকে
কিছু খেয়ে বের হয়। এটাও ঠিক নয়। বরং উচিত হ’ল এ দিন ছালাত আদায়ের পূর্বে
কোন কিছু না খাওয়া। বুরাইদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,لاَ يَخْرُجُ
يَوْمَ الْفِطْرِ حَتَّى يَطْعَمَ وَلاَ يَطْعَمُ يَوْمَ الأَضْحَى حَتَّى
يُصَلِّىَ ‘নবী করীম (ছাঃ) ঈদুল ফিৎরের দিনে কোন কিছু না খেয়ে বের হ’তেন
না। আর ঈদুল আযহার দিনে ছালাত আদায় না করা পর্যন্ত কিছু খেতেন না’।[9] অন্য
বর্ণনায় এসেছে,كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا كَانَ يَوْمُ
الْفِطْرِ لَمْ يَخْرُجْ حَتَّى يَأْكُلَ وَإِذَا كَانَ يَوْمُ النَّحْرِ
لَمْ يَأْكُلْ حَتَّى يَذْبَحَ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদুল ফিৎরের দিন কিছু না
খেয়ে বের হ’তেন না। আর ঈদুল আযহার দিনে কুরবানী না করে কিছু খেতেন না’।[10] অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, فَيَأْكُلُ مِنْ أَضْحِيَّتِهِ ‘তিনি স্বীয় কুরবানীর গোশত হ’তে খেতেন’।[11] তবে কলিজা হ’তে খাওয়ার হাদীছ যঈফ।[12]
৫. একই রাস্তা দিয়ে প্রত্যাবর্তন :
অধিকাংশ
মানুষ যে রাস্তায় ঈদগাহে গমন করে ঐ রাস্তা দিয়েই প্রত্যাবর্তন করে থাকে।
এটা সুন্নাতী পদ্ধতি নয়। বরং সুন্নাত হচ্ছে এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে গমন করা
এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা। জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, إِذَا
كَانَ يَوْمُ عِيْدٍ خَالَفَ الطَّرِيْقَ ‘নবী করীম (ছাঃ) ঈদের দিনে
রাস্তা পরিবর্তন করতেন’।[13]
৬. ওযর ব্যতীত যানবাহনে চড়ে ঈদগাহে গমন করা :
বর্তমানে
বহু মানুষ বিনা কারণে যানবাহনে চড়ে ঈদগাহে যায়। অথচ উত্তম হ’ল পায়ে হেঁটে
ঈদগাহে যাওয়া। তবে দূরত্ব বা অন্য কোন কারণে যানবাহনে চড়ে যাওয়া যায়। আলী
ইবনু আবী তালেব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,مِنَ السُّنَّةِ أَنْ
تَخْرُجَ إِلَى الْعِيدِ مَاشِيًا وَأَنْ تَأْكُلَ شَيْئًا قَبْلَ أَنْ
تَخْرُجَ. ‘সুন্নাত হ’ল ঈদের মাঠে পায়ে হেঁটে যাওয়া এবং বাড়ী থেকে বের
হওয়ার পূর্বে কিছু খাওয়া’।[14] ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন, এ হাদীছটি হাসান
এবং এ হাদীছের উপরেই অধিকাংশ বিদ্বানের আমল। আর তাঁরা লোকদের ঈদের মাঠে
পায়ে হেঁটে যাওয়া এবং ঈদুল ফিৎরের ছালাতের পূর্বে খেয়ে বের হওয়া মুস্তাহাব
বলেছেন। ইমাম তিরমিযী আরো বলেন, কোন ওযর ব্যতীত যানবাহনে না চড়ে ঈদগাহে
যাওয়া মুস্তাহাব।[15]
৭. ঈদায়নের দিনে তাকবীর না পড়া :
ঈদের দিনে আনন্দের পাশাপাশি তাকবীর পাঠ করা মুসলমানদের জন্য যরূরী বিষয়। ঈদুল ফিৎর সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوْا اللهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ ‘যাতে তোমরা গণনা পূর্ণ কর এবং তোমাদের হেদায়াত দান করার জন্য তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব বর্ণনা কর। আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)। ঈদুল আযহা সম্পর্কে মহান আললাহ বলেন, وَاذْكُرُوا اللهَ فِيْ أَيَّامٍ مَعْدُوْدَاتٍ ‘আর তোমরা নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনে আল্লাহকে স্মরণ করবে’ (বাক্বারাহ ২/২০৩)।
ঈদুল আযহায় তাকবীর পাঠের সময় হচ্ছে আরাফার দিন
ফজর থেকে আইয়্যামে তাশরীকের শেষ দিন পর্যন্ত। অর্থাৎ ১৩ই যিলহজ্জ আছর
পর্যন্ত। যেমনভাবে আলী, ইবনু মাসঊদ ও ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে।[16]
আর ঈদুল ফিৎরে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পর থেকে ঈদের ছালাত পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতে হয়। ইবনু আবী শায়বা ছহীহ সনদে যুহরী থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,أنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَخْرُجُ يَوْمَ الْفِطْرِ فَيُكَبِّرُ حَتَّى يَأْتِيَ الْمُصَلَّى وَحَتَّى يَقْضِيَ الصَّلاَةَ فَإذَا قَضَى الصَّلاَةَ قَطَعَ التَّكْبِيْرَ- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদুল ফিৎরের দিন ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হয়ে তাকবীর পড়তে পড়তে ঈদগাহে আসতেন এবং ছালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবীর পড়তেন। ছালাত শেষ হ’লে তিনি তাকবীর পড়া বন্ধ করতেন’।[17] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে,
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَخْرُجُ فِي الْعِيْدَيْنِ مَعَ الْفَضْلِ بْنِ عَبَّاسٍ، وَعَبْدِ اللهِ بْنِ عَبَّاسٍ، وَالْعَبَّاسِ، وَعَلِيٍّ، وَجَعْفَرٍ، وَالْحَسَنِ، وَالْحُسَيْنِ، وَأُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ، وَزَيْدِ بْنِ حَارِثَةَ، وَأَيْمَنَ ابْنِ أُمِّ أَيْمَنَ، رَافِعًا صَوْتَهُ بِالتَّهْلِيْلِ وَالتَّكْبِيْرِ، فَيَأْخُذُ طَرِيْقَ الْحَدَّادِيْنَ حَتَّى يَأْتِيَ الْمُصَلَّى، فَإِذَا فَرَغَ رَجَعَ عَلَى الْحَذَّائِيْنَ حَتَّى يَأْتِيَ مَنْزِلَهُ-
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দুই ঈদের দিনে ফযল ইবনু আববাস,
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস, আববাস, আলী, জা‘ফর, হাসান, হুসাইন, উসামা বিন
যায়েদ, যায়েদ বিন হারেছাহ, আয়মান ইবনু উম্মে আয়মানকে সাথে নিয়ে (ঈদের
ছালাতের উদ্দেশ্যে) বের হ’তেন উচ্চৈঃস্বরে ‘তাহলীল’ (লা ইলাহা ইল্লাহ) ও
তাকবীর বলতে বলতে। তখন তিনি কর্মকারদের রাস্তা ধরে ঈদগাহে পৌঁছতেন এবং
ছালাত শেষে মুচিদের রাস্তা ধরে বাড়ী পৌঁছতেন’।[18]
৮. ঈদের রাতকে নফল ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা :
সারা
বছর রাত্রি জাগরণ করে ইবাদত করা সুন্নাত। বিশেষত রামাযান মাসের রাত্রিতে।
যেমনভাবে ছহীহাইনে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ صَامَ
رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ
ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি রামাযানে ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রাত্রি জাগরণ
করবে, তার সমস্ত (ছগীরা) গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে’।[19]
আর
রামাযানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর পাওয়ার আশায় রাত্রি জাগরণ করা অতীব
যরূরী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَمَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيْمَانًا
وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি
ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরে জাগরণ করে ইবাদত করবে, তার সমস্ত
(ছগীরা) গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’।[20]
এছাড়া ফযীলতের আশায় অন্য কোন রাত্রিকে শারঈ দলীল ব্যতীত ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা বিদ‘আত। যেমন কিছু মানুষ ফযীলতের আশায় ঈদায়নের রাত্রিকে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করে। এ ব্যাপারে তিনটি যঈফ ও জাল হাদীছ পেশ করা হয়। যথা :
(১) ওবাদাহ ইবনু ছামেত
(রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈদুল ফিৎর ও
ঈদুল আযহার রাত্রিতে জাগরণ করবে (ইবাদত করবে), তার অন্তর মরবে না যেদিন
অন্তর সমূহ (অর্থাৎ সকল মানুষ) মারা যাবে’ ।[21] এ বর্ণনাটি মাওযূ‘ বা জাল।
এর সনদে ওমর ইবনু হারূণ আল-বালখী রয়েছে। ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন ও ছালেহ জাযরাহ
বলেন, সে মিথ্যুক। এজন্য আল্লামা নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন, বর্ণনাটি
জাল।[22]
২. عَنْ أَبِى أُمَامَةَ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ قَامَ لَيْلَتَىِ الْعِيْدَيْنِ لِلَّهِ مُحْتَسِبًا لَمْ يَمُتْ قَلْبُهُ يَوْمَ تَمُوْتُ الْقُلُوْبُ.
(২)
আবু উমামা (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি
আল্লাহর ওয়াস্তে ছওয়াব লাভের আশায় দু’ঈদের রাত্রি জাগরণ করবে, তার অন্তর
মরবে না, যেদিন অন্তর সমূহ (অর্থাৎ সকল মানুষ) মারা যাবে’।[23] বর্ণনাটি
অত্যন্ত দুর্বল (যঈফ)। এর সনদে বাক্বিয়া ইবনুল ওয়ালীদ আছে, সে মুদাল্লাস
রাবী, অথচ সে আনআন পদ্ধতিতে বর্ণনা করেছে। এজন্য আলবানী বলেন, বর্ণনাটি
অত্যন্ত যঈফ।[24] ইরাকী বলেন, এর সনদ যঈফ। আল-বুছীরী বলেন, বাক্বিয়ার তাদলীস করার কারণে এ বর্ণনাটির সনদ যঈফ (দুর্বল)।[25]
(৩) মু‘আয (রাঃ) হ’তে মারফূ‘
সূত্রে বর্ণিত আছে, ‘যে ব্যক্তি চারটি রাত্রি জাগরণ করবে, তার জন্য
জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। সেগুলো হ’ল তারবিয়ার রাত (৮ই যিলহজ্জ), আরাফার
রাত, ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিৎরের রাত’।[26] এ বর্ণনাটি মাওযূ‘ বা জাল। এর সনদে
আব্দুর রহীম ইবনু যায়েদ আল-উময়া রয়েছে। ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন বলেন, সে
মিথ্যুক। এর সনদে সুওয়াইদ ইবনু সাঈদ রয়েছে, সে যঈফ (রাবী)। ইবনুল জাওযী
(রহঃ) বলেন, حديث لا يصح ‘হাদীছটি ছহীহ নয়’। আলবানী বলেন, এটি মাওযূ বা
জাল।[27]
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ঈদায়নের রাত্রিতে জাগরণের ফযীলত সম্পর্কে কোন ছহীহ হাদীছ বর্ণিত নেই। এ ব্যাপারে উদ্ধৃত সকল হাদীছই যঈফ ও মওযূ, যা দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যায় না। আর উক্ত বর্ণনাগুলি দ্বারা ঈদায়নের দু’রাত্রিতে ইবাদত করা মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারেও দলীল গ্রহণ করা যায় না।
সুতরাং অন্যান্য রাত্রির চেয়ে ঈদের রাত্রিতে জাগরণের ব্যাপারে বিশেষ কোন ফযীলত ও গুরুত্ব নেই। যদি কারো নিয়মিত রাত্রি জাগরণের অভ্যাস থাকে, সে এই রাত্রি জাগরণ করে নফল ছালাত আদায় করলে তার জন্য নেকী ও কল্যাণ রয়েছে। কিন্তু কেউ যদি অধিক ফযীলত লাভ করার বিশ্বাস ও ধারণায় এই দুই রাত্রি জাগরণ করে তাহ’লে সেটা ভুল ও বিদ‘আতী আমল হবে।
৯. নীরবে-নিঃশব্দে ঈদগাহে গমন করা :
কিছু মানুষ চুপ-চাপ ঈদগাহে গমন করে। কেউবা গল্প করতে করতে গিয়ে ঈদের মাঠে উপস্থিত হয়। তাকবীর পাঠ করে না। আর চুপচাপ বসে থেকেই ছালাত আদায় করে। এটা ঠিক নয়। বরং মুসলমানের জন্য কর্তব্য হ’ল বাড়ী থেকে বের হয়েই ঈদগাহে গমনের পথে তাকবীর পাঠ করতে থাকবে এবং ছালাত আদায়ের পূর্ব পর্যন্ত উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর পাঠ করবে ইসলামের এই মহান নিদর্শন প্রচারের জন্য। আল্লাহ বলেন, ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوْبِ ‘এটাই আল্লাহর বিধান এবং কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করলে এটাতো তার হৃদয়ের তাক্বওয়া সঞ্জাত’ (হজ্জ ২২/৩২)।
ইবনু আবী
শায়বা ছহীহ সনদে যুহরী থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (ছাঃ) ঈদুল ফিৎরের
দিন বের হ’তেন এবং ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন।[28]
ইবনু
আবী মূসা বলেন, يكبر الناس في خروجهم من منازلهم لصلاتي العيد جهرا-
‘মানুষ তাদের বাড়ি থেকে দু’ঈদের ছালাতের উদ্দেশ্যে বের হয়ে উচ্চৈঃস্বরে
তাকবীর বলত’।[29]
ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন, يكبر جهرا اذا خرج من بيته حتى يأتي المصلى ‘বাড়ী থেকে বের হয়েই উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর বলবে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত’।[30] ইবনু কুদামা (রহঃ) বলেন, এ বিষয়টি আলী, ইবনু ওমর, আবু উমামা, আবু রুহম এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনেক ছাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে।[31] এটা ওমর ইবনু আব্দুল আযীয, আবান ইবনু ওছমান এবং আবু বকর ইবনু মুহাম্মাদেরও অভিমত। নাখঈ, সাঈদ ইবনু জুবায়ের ও ইবনু আবী লাইলা উক্ত আমল করতেন। হাকাম, হাম্মাদ, মালেক, ইসহাক ও আবু ছাওরও অনুরূপই বলেছেন।
১১. তাকবীরের শব্দাবলী :
اَللهُ
أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ اللهُ
أَكْبَرُ وَلِلَّهِ الْحَمْدُ ‘আল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার, লা ইলা-হা
ইল্লাল্লা-হু, ওয়াল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার, ওয়া লিল্লা-হিল হাম্দ’।[32] অর্থ: আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই। আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য।[33]
অন্য বর্ণনায় এসেছে,الله أكبر كبيْرًا الله أكبر كبيْرًا الله أكبر وأجل
الله أكبر ولله الحمد ‘আল্লা-হু আকবার কাবীরা, আল্লা-হু আকবার কাবীরা,
আল্লা-হু আকবার ওয়া আজাল, আল্লা-হু আকবার, ওয়ালিল্লা-হিল হামদ’।[34]
অনেক
বিদ্বান পড়েছেন, الله أكبر كَبِيْرا، وَالْحَمْد لله كثيْرا، وَسُبْحَان
الله بكرَة وَأَصِيلا، ‘আল্লা-হু আকবার কাবীরা, ওয়াল হামদু লিল্লা-হি
কাছীরা, ওয়া সুবহা-নাল্লা-হি বুকরাতাওঁ ওয়া আছীলাহ’। অর্থ: আল্লাহ মহান,
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য। সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা
করছি’।[35] ইমাম শাফেঈ (রহঃ) এটাকে সুন্দর বলেছেন।[36]
১২. ঈদের ছালাত আদায়ে অবহেলা করা :
অনেকে
মনে করে ঈদের সুন্নাত। এ কারণে কোন কোন লোক ফজরের ছালাত আদায় করেই ঘুমিয়ে
যায় বা বৈষয়িক কোন কাজে ব্যস্ত থাকে এবং ঈদের ছালাত আদায় করা থেকে বিরত
থাকে। এটা ঠিক নয়। বরং সঠিক কথা হচ্ছে ঈদের ছালাত সুন্নাতে মুওয়াক্কাদা।
অবজ্ঞা ও অবহেলাবশতঃ এ ছালাত পরিত্যাগ করা উচিত নয়। কারণ ঈদের ছালাত আদায়ের
জন্য রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ দিতেন। উম্মু আতিয়া (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর
রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, يَخْرُجُ الْعَوَاتِقُ وَذَوَاتُ الْخُدُوْرِ،
أَوِ الْعَوَاتِقُ ذَوَاتُ الْخُدُورِ وَالْحُيَّضُ، وَلْيَشْهَدْنَ
الْخَيْرَ وَدَعْوَةَ الْمُؤْمِنِينَ، وَيَعْتَزِلُ الْحُيَّضُ
الْمُصَلَّى. قَالَتْ حَفْصَةُ فَقُلْتُ الْحُيَّضُ فَقَالَتْ أَلَيْسَ
تَشْهَدُ عَرَفَةَ وَكَذَا وَكَذَا- ‘যুবতী, পর্দানশীন, ঋতুবতী মহিলারা বের
হবে এবং ভাল কাজ (ঈদের খুৎবা) ও মুমিনদের দো‘আতে শরীক হবে। ঋতুবতী মহিলারা
ঈদগাহ হ’তে দূরে থাকবে। হাফছা (রাঃ) বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ঋতুবতীও কি
বের হবে? তিনি বললেন, সে কি আরাফাত ও অমুক অমুক স্থানে উপস্থিত হয় না?[37]
অন্য
হাদীছে এসেছে, كَانَ يَأْمُرُ بَنَاتَهُ وَنِسَائَهَ أَنْ يَّخْرُجْنَ فِي
الْعِيْدَيْنِ ‘তিনি (নবী করীম ছাঃ) স্বীয় কন্যা ও স্ত্রীগণকে দু’ঈদের
জন্য বের হওয়ার নির্দেশ দিতেন’।[38]
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, ঈদায়নের যেসব সুন্নাতী আমল ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তা পালন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য যরূরী। অবহেলা, অবজ্ঞা বা উদাসীনতায় এসব সুন্নাত ত্যাগ করলে গোনাহগার হ’তে হবে। ঈদের ছালাত আদায়ের সাথে সাথে ঐসব সুন্নাত পালনে আমরা সবাই সচেষ্ট হই। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন-আমীন!
[1]. বায়হাক্বী, ইরওয়াউল গালীল ১/১৭৭, হা/১৪৬-এর শেষে, সনদ ছহীহ; সিলসিলা আছার আছ-ছহীহাহ হা/৩৫৩, সনদ হাসান।
[2]. মুওয়াত্ত্বা মালেক হা/৬০৯, ২/২৪৮; সিলসিলা আছার আছ-ছহীহাহ আ/৩৫২, সনদ ছহীহ।
[3]. তাবারানী, মু‘জামুল আওসাত্ব ২/৫৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১২৭৯, ৩/২৭৪, সনদ ছহীহ।
[4]. বুখারী হা/৯৫৩।
[5]. বুখারী, হা/৯৫৩, ইবনু খুযায়মা, হা/১৪২৯; দারাকুৎনী হা/১৭৩৬।
[6]. বায্যার, ১/৩১২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩০৩৮, সনদ ছহীহ।
[7]. তিরমিযী, হা/৫৪২, ২/৪২।
[8]. ফাৎহুল বারী ২/৪৪৭; তুহফাতুল আহওয়াযী ৩/৮১; মির‘আত ৫/৩৮।
[9]. তিরমিযী হা/৫৪২; ইবনু মাজাহ হা/১৭৫৬; মিশকাত হা/১৪৪০, সনদ ছহীহ।
[10]. আহমাদ হা/২১৯৬৪, সনদ হাসান।
[11]. মুসনাদ আহমাদ হা/২৩০৩৪; নায়লুল আওত্বার ৪/২৪১।
[12]. সুবুলুস সালাম (তা‘লীক আলবানী), ২/২০০১।
[13]. বুখারী হা/৯৮৬; মিশকাত হা/১৪৩৪।
[14]. ইবনু মাজাহ হা/১২৯৪-৯৭; তিরমিযী হা/৫৩০, সনদ হাসান।
[15]. তিরমিযী ‘জুম‘আ’ অধ্যায়।
[16]. ইরওয়া ৩/১২৫।
[17]. বায়হাক্বী ৩/২৭৯; ইরওয়াউল গালীল ৩/১২৩, সনদ মুরসাল ছহীহ।
[18]. বায়হাক্বী ৩/২৭৯; ইরওয়াউল গালীল ৩/১২৩, সনদ ছহীহ।
[19]. বুখারী হা/৩৮; মুসলিম হা/৭৬০; মিশকাত হা/১৯৫৮।
[20]. বুখারী হা/২০১৪; মুসলিম হা/৭৬০; মিশকাত হা/১৯৫৮।
[21]. তাবারানী, মু‘জামুল কাবীর, মু‘জামুল আওসাত্ব; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, ২/১৯৮।
[22]. সিলসিলা যঈফা, হা/৫২০; যঈফুল জামে‘ হা/৫৩৬১; যঈফ আত-তারগীব হা/৬৬৮।
[23]. ইবনু মাজাহ হা/১৭৮২; যঈফ তারগীব হা/৬৬৬; যঈফুল জামে‘ হা/৫৭৪২।
[24]. সিলসিলা যঈফা হা/৫২১, ৫১৬৩।
[25]. সিলসিলা যঈফা ২/১১ পৃঃ।
[26]. নাছরুল মাকদেসী, জুয মিনাল আমালী ২/১৮৬; আল-ইলালুল মুতানাহিয়া হা/৯৩৪, ২/৫৬৮।
[27]. সিলসিলা যঈফা হা/৫২২।
[28]. বায়হাক্বী ৩/২৭৯; ইরওয়াউল গালীল ৩/১২৩, মুরসাল ছহীহ।
[29]. আল-মুগনী ২৫৬, ২৬২ পৃঃ।
[30]. আল-মুগনী, ২৫৬, ২৬২।
[31]. তদেব।
[32]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, বায়হাক্বী, সনদ ছহীহ, ইরওয়া ৩/১২৫ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৪৩ পৃঃ; আল-মুগনী ২/২৫৪-৫৬ পৃঃ।
[33]. ইবনু আবী শায়বাহ, ২/২; বায়হাক্বী ৩/৩১৫; ইরওয়া ৩/১২৫-২৬।
[34]. ইরওয়া ৩/১২৬, সনদ ছহীহ।
[35]. কুরতুবী ২/৩০৬-৭ পৃঃ; মাসায়েলে কুরবানী ও আক্বীক্বা, পৃঃ ২৮।
[36]. যাদুল মা‘আদ (বৈরূত : ১৪১৬হিঃ/১৯৯৬খ্রিঃ)), ২/৩৬১ পৃঃ; নায়লুলু আওত্বার ৪/২৫৭ পৃঃ
[37]. বুখারী হা/৩২৪, ৯৮০, ১৬৫২।
[38]. আহমাদ, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২১১৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৮৮৮।