পরাক্রমশালীর
আভিধানিক অর্থ-পরাক্রান্ত, প্রবল প্ররাক্রান্ত, শক্তিমান, বলশালী,
বীর্যবান, প্রতাপশালী প্রভৃতি। আল্লাহ পরাক্রমশালী এর অর্থ স্বতন্ত্র। কারণ
ফেরাউন, নমরূদ, আবরাহার মত সীমালংঘনকারীদেরকে প্রতাপশালী বলা হ’লেও
আল্লাহর ক্ষমতার কাছে এরা কিছুই নয়। অনুরূপভাবে আলেকজান্ডার, হিটলার,
নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, জুলিয়ান সীজার প্রমুখ ক্ষমতাশালী হলেও তারাও কিছুই
নয়।
আল্লাহ পরাক্রমশালী শব্দের মধ্যে যে আভিধানিক অর্থ লুক্কায়িত আছে, আসলে তা আমাদের জানা নেই। সামান্য বোধশক্তি আছে মাত্র। আমরা শুধু তাঁর অগণনীয় সৃষ্ট বস্ত্তগুলি দেখে তাঁর মহাজ্ঞানের বিপুল পরিসরের চিন্তা করি এবং অসীম শক্তিমত্তার কল্পনা করি। এগুলি পৃথিবীর কোন প্রতাপশালীর পক্ষেই সম্ভব নয়। যেমন ভূমিকম্প, সুনামী, হ্যারিকেন, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি সঞ্চালন ও নিয়ন্ত্রণ মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ ব্যতীত কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর অসীম শক্তির আরও কত রূপ আছে তা আমাদের জানা নেই। সেগুলোর খবর আল্লাহই ভাল জানেন। অবশ্য মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে এসবের কিছু বর্ণনা রয়েছে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রবল পরাক্রমশালীর বর্ণনা দিয়েছেন। যেমন মূসা (আঃ)-এর প্রতি এক প্রত্যাদেশে মহান আল্লাহ বলেন, يَا مُوْسَى إِنَّهُ أَنَا اللهُ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ ‘হে মূসা! আমি আল্লাহ! প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (নামল ২৭/৯)।
পবিত্র কুরআন আল্লাহর বাণী এবং তিনিই তাঁর পক্ষ হ’তে তা আমাদের জন্য অবতীর্ণ করেছেন। তিনি বলেন, تَنْزِيْلَ الْعَزِيْزِ الرَّحِيْمِ ‘কুরআন পরাক্রমশালী পরম দয়ালু আল্লাহর তরফ থেকে অবতীর্ণ’ (ইয়াসীন ৩৬/৫)।
একই বিষয়ে অন্য আয়াতে প্রত্যাদেশ এসেছে, تَنْزِيْلُ الْكِتَابِ مِنَ اللهِ الْعَزِيْزِ الْحَكِيْمِ ‘কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে’ (যুমার ৩৯/১)। অন্য এক প্রত্যাদেশে বর্ণিত হয়েছে, حم، تَنْزِيْلُ الْكِتَابِ مِنَ اللهِ الْعَزِيْزِ الْعَلِيْمِ ‘হা-মীম, কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে, যিনি পরাক্রমশালী সুবিজ্ঞ’ (মুমিন ৪০/১-২)।
বস্ত্ততঃ এ মহাগ্রন্থ পৃথিবীর শেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে জগদ্বাসীর জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
الر
كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ
إِلَى النُّوْرِ بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَى صِرَاطِ الْعَزِيْزِ
الْحَمِيْدِ، اللهِ الَّذِيْ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي
الْأَرْضِ وَوَيْلٌ لِلْكَافِرِيْنَ مِنْ عَذَابٍ شَدِيْدٍ-
‘আলিফ-লাম-রা, এটি একটি গ্রন্থ, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আন, পরাক্রান্ত, প্রশংসার যোগ্য পালনকর্তার নির্দেশে তাঁরই পথের দিকে’ (ইবরাহীম ১৪/১-২)।
পবিত্র কুরআনের আলোচনায় মহাজ্ঞানী আল্লাহ তা‘আলা যাবতীয় বিষয়ের প্রতি তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনিই একমাত্র স্রষ্টা ও উপাস্য, একমাত্র শক্তিধর, পরাক্রমশালী অসীম ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর এই বিপুল ক্ষমতা দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতের সর্বত্র সমানভাবে বিরাজমান। মহান আল্লাহ বলেন, ذَلِكَ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ الْعَزِيْزُ الرَّحِيْمُ ‘তিনিই দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞানী, পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু (সাজদাহ ৩২/৬)। অপর এক প্রত্যাদেশে এসেছে, فَلِلَّهِ الْحَمْدُ رَبِّ السَّمَاوَاتِ وَرَبِّ الْأَرْضِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، وَلَهُ الْكِبْرِيَاءُ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ- ‘বিশ্বজগতের পালনকর্তা, ভূমন্ডলের পালনকর্তা ও নভোমন্ডলের পালনকর্তা আল্লাহরই প্রশংসা। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে তাঁরই গৌরব তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (জাছিয়া ৪৫/৩৬-৩৭)।
একই মর্মার্থে অন্য আয়াতে ঘোষিত হয়েছে,وَلِلَّهِ جُنُوْدُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَكَانَ اللهُ عَزِيْزًا حَكِيْمًا- ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের বাহিনীসমূহ আল্লাহরই। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (ফাতাহ ৪৮/৭)।
তিনিই বিশ্বজগতের বাদশাহ এবং সবাই তাঁর কাছে প্রার্থী এই মর্মে ঘোষিত হয়েছে, يُسَبِّحُ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ الْمَلِكِ الْقُدُّوْسِ الْعَزِيْزِ الْحَكِيْمِ- ‘রাজ্যাধিপতি, পবিত্র, পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে যা কিছু আছে নভোমন্ডলে ও যা কিছু আছে ভূমন্ডলে’ (জুম‘আ ৬২/১)।
আল্লাহ তা‘আলা একক বাদশাহ, স্রষ্টা, সর্বশক্তিমান, পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী ও যাবতীয় বিষয়ের মালিক ও নিয়ন্ত্রক। তাঁর এ শ্রেষ্ঠত্বে হস্তক্ষেপ করার কেউ নেই এবং এ বিষয়ে কেউ যেন ভুল পথে না যায়, সে জন্যেই উপরের আয়াতগুলোতে তিনি তাঁর অমিয় বাণীগুলো বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন কারণে, মানুষকে জ্ঞান দানের লক্ষ্যে কুরআনে উল্লেখ করেছেন। মানব জাতির মধ্যে অসংখ্য দোষ ও গুণের সমাবেশ ঘটেছে, যেগুলো আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী-বিজ্ঞানী, পন্ডিত, দার্শনিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, মনীষী, নবী-রাসূল কেউ জানে না। এখানেই আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মানুষের দাসত্বের নিদর্শন নিবিড়ভাবে লুক্কায়িত আছে।
মানুষের সকল কাজ-কর্ম তা প্রকাশ্যে হোক বা যত গোপনেই হোক না কেন সে সম্পর্কে মহান আল্লাহ সবিশেষ অবহিত। অনুরূপভাবে মানুষের চাল-চলন, আচার-আচরণ সম্পর্কে মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলা ভাল করেই জানেন এবং মানুষের যাবতীয় খবরও রাখেন। অতঃপর তাঁর প্রতি আনুগত্য ও ইবাদত-বন্দেগীর ব্যাপারেও তিনি অবহিত আছেন। তারপরও তিনি মানুষকে বার বার তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা, তাঁর মহাক্ষমতার কথা এবং একক উপাস্যের কথা স্মরণ করিয়ে প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, شَهِدَ اللهُ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ وَالْمَلاَئِكَةُ وَأُوْلُوْ الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ- ‘আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া কোন উপাস্য নেই, ফেরেশতাগণ এবং ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগণ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (আলে ইমরান ৩/১৮)।
একই অর্থে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْقَصَصُ الْحَقُّ وَمَا مِنْ إِلَهٍ إِلاَّ اللهُ وَإِنَّ اللهَ لَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ- ‘নিঃসন্দেহে এটাই হ’ল সত্য ভাষণ। আর এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই। আর আল্লাহ তিনিই হ’লেন পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়’ (আলে ইমরান ৩/৬২)।
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই আল্লাহ তা‘আলা, তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনিই একমাত্র মালিক, পবিত্র, শান্তি ও নিরাপত্তাদাতা, আশ্রয়দাতা, পরাক্রান্ত, প্রতাপান্বিত। তারা যাকে অংশীদার করে, আল্লাহ তা‘আলা তা থেকে পবিত্র। তিনিই আল্লাহ তা‘আলা, স্রষ্টা, উদ্ভাবক, রূপদাতা, উত্তম নামসমূহ তাঁরই। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবাই তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (হাশর ৫৯/২২-২৪)।
আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় পরাক্রমশালী, তাঁকেই উপাস্যরূপে আনুগত্য করার জন্যে তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন এবং এ বিষয় মান্য করার জন্যে পুনঃ পুনঃ আদেশ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ‘পরাক্রমশালী’ শব্দের অর্থ শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিজয়ী হওয়ার কথাই বোঝান হয়। কিন্তু আল্লাহ পরাক্রমশালী অর্থের দ্বারা তাঁর শক্তি প্রয়োগের কোন বাস্তব দৃশ্যের প্রয়োজন হয় না। তবুও তাঁর এই পরাক্রমশালী রূপের বা জ্ঞানের কিছু কিছু নমুনা মানব জাতির সম্মুখেই প্রকাশ ঘটেছে। যেমন প্রাগৈতিহাসিক যুগে বিশ্বের অমিত শক্তিধর, অত্যাচারী ও নিপীড়ক বাদশাহ ফেরাউন, তার অবাধ্য প্রজা বা দেশবাসী হযরত মূসা (আঃ) ও তাঁর দলবলকে দেশ ত্যাগের সময় পিছন হ’তে সসৈন্যে তাড়া করেছিল বা ধরার জন্য অগ্রসর হচ্ছিল। এ সময় আত্মরক্ষার জন্য মূসা (আঃ)-এর পক্ষে নীল নদ অতিক্রম করা ছাড়া আর কোন বিকল্প ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় রাসূল ও বান্দার এ দুর্দিনে তাঁর সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। এ সময় তিনি তাঁর অসীম শক্তি দ্বারা প্রবাহিত নদের স্রোতকে থামিয়ে দিয়ে এক পথ সৃষ্টি করেন। মূসা (আঃ) তাঁর দলবল নিয়ে এ পথ দিয়ে আল্লাহর রহমতে নীল নদের ওপারে চলে যান।
মূসা (আঃ)-এর পশ্চাদ্ধাবনকারী ফেরাউন দূর হ’তে সে দৃশ্য অবলোকন করল। অতঃপর নিকটবর্তী হয়ে সে পথেই পার হয়ে মূসা (আঃ)-কে ধরার সিদ্ধান্ত নিল। ফেরাউন ও তার সেনাবাহিনী যখন পথে প্রবেশ করল, তখন মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর হুকুমে নীল নদ তার পথ বন্ধ করে দিল এবং যথানিয়মে প্রবাহ শুরু করে দিল। নির্বোধ ও সীমালংঘনকারী ফেরাউন দলবল সহ ডুবে মারা গেল। ঐতিহাসিক এ কাহিনী জগদ্বাসীকে জানানোর জনই পবিত্র কুরআনে সবিস্তার লিপিবদ্ধ আছে।
ফেরাউন যে শক্তিধর ছিল তা আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে অবহিত করেছেন। আল্লাহ বলেন, مِنْ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ كَانَ عَالِيًا مِنَ الْمُسْرِفِيْنَ ‘ফেরাউন ছিল সীমালংঘণকারীদের মধ্যে প্রবল পরাক্রান্ত’ (দুখান ৪৪/৩১)।
আসলেই কি ফেরাউন প্রবল প্রতাপশালী ছিল? হ্যাঁ বিশ্ববাসীর জন্য সে ছিল প্রবল পরাক্রান্ত। কিন্তু আল্লাহর শক্তির সামনে সে একটা পিপীলিকার চাইতেও শক্তিহীন ছিল। শুধু বিশ্ববাসীকে জানানো ও দেখানোর জন্যই তার শক্তিকে প্রবল পরাক্রান্ত বলা হয়েছে। অতঃপর তার এই শক্তিকে কিভাবে ধূলিস্যাৎ করা হয়েছে, তাও পবিত্র কুরআনে অবতীর্ণ হয়েছে।
ফেরাউনের অত্যাচার ও পরিণতির এক সংক্ষিপ্ত কাহিনীতে উল্লিখিত হয়েছে, ‘ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের নির্যাতনের ভয়ে মূসার সম্প্রদায়ের একদল ছাড়া আর কেউ তাদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করল না। নিশ্চয়ই ফেরাউন দেশে স্বেচ্ছাচারী ও উচ্ছৃঙ্খল ছিল। মূসা বলেছিলেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! যদি তোমরা আল্লাহকে বিশ্বাস করে থাক, যদি তোমরা মুসলমান (আত্মসমর্পণকারী) হও, তবে তোমরা তাঁরই উপর নির্ভর কর। তারপর তারা বলল, আমরা আল্লাহর উপর নির্ভর করলাম। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে অত্যাচারী সম্প্রদায়ের উৎপীড়নের পাত্র করবেন না। আর আপনার অনুগ্রহে আমাদেরকে অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের হাত হ’তে রক্ষা করুন। আমি মূসা ও তাঁর ভাইকে প্রত্যাদেশ পাঠালাম, মিশরে তোমাদের সম্প্রদায়ের জন্য বাড়ী বানাও, আর তোমাদের বাড়ীগুলোকে কিবলামুখী করো, ছালাত আদায় কর ও বিশ্বাসীদের সুসংবাদ দাও। মূসা বললেন, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি ফেরআউন ও তার পরিষদবর্গকে পার্থিব জীবনে যে শানশওকত ও ধনদৌলত দান করেছেন তা দিয়ে ওরা মানুষকে আপনার পথ থেকে বিপথে চালিত করে। হে আমাদের প্রতিপালক! ওদের ধন-সম্পদ নষ্ট করে দিন, ওদের হৃদয়ে মোহর করে দিন, ওরা তো কঠিন শাস্তি না দেখা পর্যন্ত বিশ্বাস করবে না। আল্লাহ বললেন, তোমাদের দু’জনের প্রার্থনা গ্রহণ করা হ’ল। সুতরাং তোমরা শক্ত হও, আর যারা জানে না, তোমরা কখনও তাদের পথ অনুসরণ করবে না। আমি বনী ইসরাঈলকে সাগর পার করালাম। আর ফেরাউন ও তার সৈন্য-বাহিনী শত্রুতা করে ও ন্যায়ের সীমালংঘন করে তাদের পিছে ধাওয়া করল। অবশেষে পানিতে যখন সে ডুবে যাচ্ছে তখন বলল, আমি বিশ্বাস করলাম বণী ইসরাঈল যাঁর উপর বিশ্বাস করে, তিনি ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, আর তাঁর কাছে যারা আত্মসমর্পণ করে আমি তাদের একজন। আল্লাহ বললেন, এখন! এর আগে তুমি তো অমান্য করেছ, আর তুমি ছিলে এক ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী। আজ আমি তোমার দেহকে সংরক্ষণ করব যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের নিদর্শন হয়ে থাক। অবশ্য মানুষের মধ্যে অনেকেই আমার নিদর্শন সম্বন্ধে খেয়াল করে না’ (ইউনুস ১০/৮৩-৯২)।
এই ফেরাউনের লাশ আবিষ্কার সম্পর্কে ফরাসীর চিন্তাবিদ ড. মুরিস বুকাইলী তাঁর ‘দি বাইবেল দি কুরআন এ্যান্ড সায়েন্স’ পুস্তকে লিখেছেন, ‘ফেরাউনের দেহটি আবিষ্কার করেন, মিঃ লরেট ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে থেবেসের রাজকীয় উপত্যকা থেকে। সেখান থেকে মমিটিকে কায়রো নিয়ে আসা হয়। ১৯০৭ সালের ৮ই জুলাই এলিয়ট স্মীথ এই মমিটির আবরণ উন্মোচন এবং মমিটির দেহ পরীক্ষার বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। এই বিবরণ থেকে জানা যায়, কয়েকটি জায়গায় কিছু কিছু বিকৃতি ঘটলেও লাশটি মোটামুটিভাবে সংরক্ষিত ছিল। সেই থেকে কায়রোর যাদুঘরে পর্যটকদের দর্শনের জন্য মমিটিকে রেখে দেওয়া হয়েছে। মাথা ও ঘাড়টি খোলা, বাদবাকী দেহটা কাপড়ে ঢাকা। প্রদর্শনের এই ব্যবস্থা সত্ত্বেও মমিটিকে এমন কঠোরভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে যে, কাউকে ঐ মমিটির ছবি পর্যন্ত তুলতে দেওয়া হয় না। সেই ১৯১২ সালে স্মীথের তোলা ছবিগুলি ছাড়া আর কোন ছবি যাদুঘর কর্তৃপক্ষের নিকটেও নেই।
১৯৭৫ সালের জুন মাসে মিসরীয় কর্তৃপক্ষ লেখক ড. মুরিস বুকাইলিকে মমিটির শরীরের বিভিন্ন অংশ পরীক্ষা করে দেখার অনুমতি দেন। সেই সময় তাঁর পরামর্শক্রমে মমিটিকে নিরাপদভাবে সংরক্ষণের আরও উন্নত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
ইতিহাসের নিদর্শনাবলী সংরক্ষণ সবারই কাম্য। কিন্তু এখানে যে মমিটির সংরক্ষণের কথা বলা হচ্ছে, এটি নিছক কোন ঐতিহাসিক নিদর্শন নয়। এ মমিটির গুরুত্ব অনেক বেশী। এটা এমন একজন ব্যক্তির মরদেহ হযরত মূসার সাথে যার পরিচয় হয়েছিল। যে হযরত মূসার ধর্মীয় প্রচার প্রতিহত করতে চেয়েছিল এবং হযরত মূসা (আঃ) যখন বণী ইসরাঈলদের নিয়ে মিসর থেকে অন্যত্র হিজরত করছিলেন, তখন এই লোকটিই সসৈন্যে তাদের পিছনে ধাওয়া করেছিল। আর ধাওয়া করতে গিয়েই মারা পড়েছিল সমুদ্রের পানিতে ডুবে। আল্লাহর ইচ্ছায় তার মরদেহ ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে এবং কুরআনের বাণী অনুসারেই ভবিষ্যত মানব জাতির জন্য তা নিদর্শন হিসাবে সংরক্ষিত আছে।
এ যুগের অনেকেই আধুনিক তথ্য প্রমাণের আলোকে ধর্মীয় গ্রন্থের বিভিন্ন বর্ণনার সত্যাসত্য যাচাই করে নিতে চান। তাদের কাছে অনুরোধ, তারা যেন দয়া করে কায়রো গমন করেন এবং তথাকার মিসরীয় যাদুঘরের ‘রয়ালমামিজ’ কক্ষে সংরক্ষিত ফেরাউনের এই মমিটি দর্শন করে আসেন। আর তাহ’লেই তাঁরা বুঝতে পারবেন, কুরআনের আয়াতে ফেরাউনের মরদেহ সংরক্ষণ সম্পর্কে যে বর্ণনা রয়েছে, বাস্তব সত্য।
শুধু ফেরাউনই নয়, এরূপ আরও বহু অত্যাচারী রাজা-বাদশাহ, সম্রাট, শাসক তাদের পরাক্রান্ত রূপ নিয়ে পৃথিবী হ’তে লাঞ্ছিত অবস্থায় বিদায় হয়ে গেছে। আল্লাহ তো দৃশ্য-অদৃশ্য, জানা-অজানা সব জগতেরই মালিক। তিনি তাঁর ইচ্ছায় ফেরাউনের নির্মম পরিণতির বাস্তব চিত্রটি বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন।
উপরোক্ত কাহিনীর সারমর্মে আরও দেখা যায়, হযরত মূসা (আঃ) ও তাঁর দলবল যখন বিপদাপন্ন হয়ে পড়ল, তখন আল্লাহর ইচ্ছায় মূসা (আঃ)-এর হাতের লাঠির আঘাতে স্রোতস্বিণী নীল নদের স্রোত বন্ধ হয়ে গিয়ে নিরাপদ রাস্তা তৈরী হয়ে গেল। অতঃপর স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী ফেরাউন যখন সে রাস্তায় পার হচ্ছিল তখন আল্লাহর হুকুমে রাস্তা বিলীন হয়ে গেল এবং নীল নদের পানি প্রবাহ শুরু হয়ে গেল। এখানে দৃশ্যশক্তি নীল নদ এবং অদৃশ্য শক্তি আল্লাহর আদেশ। অদৃশ্য শক্তির প্রভাবেই দৃশ্য শক্তির বিকাশ ঘটে। সুতরাং আমরা দৃশ্য ও অদৃশ্য উভয় শক্তিরই প্রভাব-পতিপত্তি কিছু কিছু দেখতে পাই।
মহান আল্লাহ বলেন, فَالِقُ الْإِصْبَاحِ وَجَعَلَ اللَّيْلَ سَكَنًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ حُسْبَانًا ذَلِكَ تَقْدِيْرُ الْعَزِيْزِ الْعَلِيْمِ- ‘তিনি প্রভাত রশ্মির উন্মেষক! তিনি রাত্রিকে আরামদায়ক করেছেন এবং সূর্য ও চন্দ্রকে হিসাবের জন্য রেখেছেন। এটি পরাক্রান্ত মহাজ্ঞানীর নির্ধারণ’ (আন‘আম ৬/৯৬)। অন্য আয়াতে এসেছে, عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ ‘তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞানী, পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (তাগাবুন ৬৪/১৮)। আরও এক আয়াতে এসেছে, عَالِمُ الْغَيْبِ فَلاَ يُظْهِرُ عَلَى غَيْبِهِ أَحَدًا ‘তিনি গায়েব জানেন, কারো কাছে গায়েব প্রকাশ করেন না’ (জিন ৭২/২৬)।
এ বিষয়ে মহান আল্লাহ আরও বলেন, وَلِلَّهِ غَيْبُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا أَمْرُ السَّاعَةِ إِلاَّ كَلَمْحِ الْبَصَرِ أَوْ هُوَ أَقْرَبُ إِنَّ اللهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ- ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের গোপণ রহস্য আল্লাহর কাছেই রয়েছে। ক্বিয়ামতের ব্যাপারটি তো এমন, যেমন চোখের পলক অথবা তার চাইতেও নিকটবর্তী। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছুর উপর শক্তিমান’ (নাহল ১৬/৭৭)।
উপরের আয়াত সমূহ দ্বারা মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অসীম শক্তির কিছু নমুনা প্রকাশ করেছেন। যেমন সকালের সূর্য রশ্মি বা সূর্যের প্রাথমিক সৌন্দর্যপূর্ণ আলো আল্লাহর আদেশে প্রকাশিত হয়। অতঃপর দিনের কর্মব্যস্ততা ও রাত্রির আরামদায়ক শান্তির সুসংবাদ এবং তাদের দ্বারা দিন-রাত্রি, মাস, বৎসর প্রভৃতির হিসাবের কথাও প্রত্যাদেশ হয়েছে। এতদ্ব্যতীত তিনি তাঁর প্রবল পরাক্রান্তগায়েবী শক্তির কথাও বলেন। তিনি গায়েবের সবকিছুই জানেন। কিন্তু কারও কাছে তা প্রকাশ করেন না। অর্থাৎ উক্ত গায়েবী বিষয়টির নির্ধারিত দিন, তারিখ, সময় প্রকাশ করেন না। যেমন ক্বিয়ামতের ব্যাপারটি, চোখের পলক ফেলা সময়ের মধ্যে সংঘটিত হবে বলে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু দিন, কাল বা সময়ের কোন উল্লেখ নেই। অবশ্য এ বিষয়ে সন্দেহেরও কোন অবকাশ নেই। কারণ ক্বিয়ামতের যৎসামান্য নমুনা ভূমিকম্প, টর্নেডো, ঘূর্ণিঝড়, হ্যারিকেন, সিডর, সুনামী প্রভৃতি শক্তিগুলির বিকাশ তো মুহূর্তের মধ্যেই ঘটে থাকে। আর তা কত প্রলয়ংকরী এবং কত ভয়াবহ পৃথিবীর কিয়দাংশ ভুক্তভোগী লোকের ধারণায় এসেছে, আর অধিকাংশ লোকই এ বিষয়ে অজ্ঞ।
এ জগতে কত ছোট-বড় গায়েবী শক্তি আছে- যেমন অসুখ-বিসুখ, দুর্ঘটনা, ঝড়-তুফান প্রভৃতি, যা মানুষের জানা নেই। এমনকি ছোট ছোট সামান্য শক্তির কথাও মানুষ জানে না। তাই ছোট-খাট অসুখে, বিপদ-আপদে প্রাণ হরাচ্ছে বহু মানুষ। বাড়ী হ’তে বের হয়ে প্রতিদিন যানবাহনের দুর্ঘটনায়, ঝড়-তুফান, বন্যা-জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানি ঘটছে শত শত মানুষের। অদৃশ্যের এ লীলাখেলা অতীত ও বর্তমানে বিরামহীনভাবেই চলছে। সুতরাং এ জগতের অদৃশ্য শক্তির কাছে মানুষ কত অসহায়। অথচ এ অদৃশ্য শক্তির প্রকৃত মালিক মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলাকে মানুষ কত অবমূল্যায়ন করছে তা ভাবতেও অবাক লাগে।
বর্তমান বিশ্বে অনেক পরাশক্তির উদ্ভব ঘটেছে। কিন্তু তারা নিজেও এ শক্তি হ’তে নিরাপদ নয়। মানুষ এখন তাদের নিজ হাতে তৈরী মারণাস্ত্র দ্বারা হঠাৎ আক্রমণের মাধ্যমে তার প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিকে বা শত্রুকে জব্দ করার চেষ্টা করছে।
বিগত ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনা তন্মধ্যে অন্যতম। অবশ্য এর প্রতিশোধ হিসাবে যে ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে, তা নিরূপণ করা অসম্ভব। বর্তমানে যে কোন শক্তিধর দেশের কাছে প্রচুর পরিমাণে উন্নত মারণাস্ত্র মওজুদ রয়েছে। ফলে এক দেশ আরেক দেশকে ভয় করেই নিজের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
কিন্তু মহাপরাক্রমশালী বাদশাহ আল্লাহর অসীম রাজত্বের কোন শরীক নেই, প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, নেই কোন আদেশ লংঘনকারী জীব ও জড়। আছে শুধু বিতাড়িত ও ঘৃণিত শয়তানের কিছু চেলাচামুন্ডা, যারা পৃথিবীর স্বার্থ, শোভা ও আনন্দ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। তারা চলতি ঘটনা প্রবাহেরও মূল্যায়ন করে না।
আল্লাহ তা‘আলা যে মহাপরাক্রমশালী এটা তাঁর বিশাল আসমান-যমীন সৃষ্টিতেই প্রমাণ করে। মহান আল্লাহ বলেন, بَدِيْعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَإِذَا قَضَى أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُوْلُ لَهُ كُنْ فَيَكُوْنُ- ‘তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের স্রষ্টা। যখন তিনি কোন কার্যসম্পাদনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তার জন্য একথাই বলেন, ‘হয়ে যাও’ তৎক্ষণাৎ হয়ে যায়’ (বাক্বারাহ ২/১১৭)।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّمَا قَوْلُنَا لِشَيْءٍ إِذَا أَرَدْنَاهُ أَنْ نَقُوْلَ لَهُ كُنْ فَيَكُوْنُ ‘আমরা যখন কোন কিছু করার ইচ্ছা করি, তখন তাকে কেবল এতটুকুই বলি যে, ‘হয়ে যাও’ সুতরাং তা হয়ে যায়’ (নাহল ১৬/৪০)।
অপর এক আয়াতে প্রত্যাদেশ হয়েছে, إِنَّ اللهَ لاَ يَخْفَى عَلَيْهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاءِ، هُوَ الَّذِيْ يُصَوِّرُكُمْ فِي الْأَرْحَامِ كَيْفَ يَشَاءُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ- ‘আল্লাহর নিকট আসমান ও যমীনের কোন বিষয়ই গোপন নেই। তিনিই সেই আল্লাহ, যিনি তোমাদের আকৃতি গঠন করেন মায়ের গর্ভে, যেমন তিনি চেয়েছেন। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়’ (আলে ইমরান ৩/৫-৬)।
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘পুণ্যময় তিনি যাঁর হাতে রাজত্ব। তিনি সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান। তিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন যাতে তোমাদের পরীক্ষা করেন কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল’ (মুলক ৬৭/১-২)।
পরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলা মানব সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুও সৃষ্টি করেছেন। আবার মানুষ সৃষ্টির ব্যাপারে যেমন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈচিত্র্য এনে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা চেহারা বিশিষ্ট করে মিশ্রিত করে দিয়েছেন। মৃত্যুকেও অনুরূপভাবে আরও বৈচিত্র্যময় করে প্রত্যেকের মৃত্যু দৃশ্যকেও আলাদা আলাদা করে দিয়েছেন। এসব সৃষ্টি কর্মে যে জ্ঞান বা প্রযুক্তির দরকার পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহরই কেবল তা রয়েছে।
আল্লাহর অসীম জ্ঞানের প্রতি মানব জাতির জ্ঞানের গভীর দৃষ্টি আকর্ষণ করাই এসব বর্ণনার মূখ্য উদ্দেশ্য। বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয়ের ব্যাপক উন্নয়নে এসব জ্ঞানগর্ভ আয়াতগুলো তাৎপর্যপূর্ণভাবে ঘুরে ফিরে বর্ণিত হয়েছে। কাজেই এগুলো হ’তে মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কোন অবকাশ নেই। কারণ পরাক্রমশালী আল্লাহর বিপুল জ্ঞান ভান্ডারের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁর অবতীর্ণ আদেশ-প্রত্যাদেশের প্রতি আত্মসমর্পণ করে, একমাত্র তাঁর ইবাদতেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে মানব জাতিকে। এর অন্যথা হ’লে পরিণতি হবে ভয়াবহ। মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর জ্ঞানের দ্বারা বিশ্বজগতকে আবৃত করে রেখেছেন এবং নিয়ন্ত্রণ করছেন মানুষ সহ সকল বস্ত্তর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলিও। এ সম্পর্কিত ঘোষণায় প্রত্যাদেশ এসেছে, وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ وَهُوَ الْحَكِيْمُ الْخَبِيْر ‘তিনিই পরাক্রমশালী স্বীয় বান্দাদের উপর, তিনিই জ্ঞানময়, সর্বজ্ঞ’ (আন‘আম ৬/১৮)। অপর এক ঘোষণায় মহান আল্লাহ বলেন, سَبَّحَ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ ‘নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবাই আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (ছফ ৬১/১)।
আল্লাহর ক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার নির্দেশ দিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে, ‘বস্ত্ততঃ যে কোন অবস্থাতেই তুমি থাক এবং কুরআনের যে কোন অংশ থেকেই পাঠ কর, কিংবা যে কোন কাজই তোমরা কর অথচ আমি তোমাদের নিকট উপস্থিত থাকি, যখন তোমরা তাতে আত্মনিয়োগ কর। আর তোমার পরওয়ারদেগার থেকে গোপন থাকে না একটি কণাও, যমীনের না আসমানের, না এর চেয়ে ক্ষুদ্র কোন কিছু আছে, না বড়, যা এই প্রকৃষ্ট কিতাবে নেই’ (ইউনুস ১০/৬১)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘আর আমার বান্দারা যখন আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে বস্ত্ততঃ আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য, যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৬)।
তিনি আরও বলেন, ‘মনে রেখো, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা আছে, তা আল্লাহর। তোমরা যে অবস্থায় আছ তা তিনি জানেন। যেদিন তারা তাঁর কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে, সেদিন তিনি বলে দিবেন তারা যা করেছে। আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ই জানেন’ (নূর ২৪/৬৪)।
আমাদের অটুট বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আকাশ ও পৃথিবী এবং এর মাঝে যা কিছু আছে, এর প্রতিটি বিন্দুকণা আল্লাহ পাকের অসীম জ্ঞানের আওতাধীন এবং সবকিছুর উপর তাঁর পূর্ণ ক্ষমতা ও আধিপত্য রয়েছে। কোন বস্ত্ত যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, যা সাধারণ দৃষ্টিতে দেখতে পাওয়া যায় না, অনুরূপভাবে কোন বস্ত্ত যত দূরেই অবস্থিত থাক না কেন, অথবা কোন বস্ত্ত যত গভীর অাঁধার বা যবনিকার অন্তরালেই থাক না কেন মহান আল্লাহর জ্ঞান ও দৃষ্টির আড়ালে থাকতে পারে না এবং তিনি যে কোন বস্ত্তকে যখন ও যেখানে ইচ্ছা উপস্থিত করতে পারেন। এ বিষয়েও লোকমান তার সন্তানকে উপদেশ স্বরূপ বলেন, يَا بُنَيَّ إِنَّهَا إِنْ تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ فَتَكُنْ فِيْ صَخْرَةٍ أَوْ فِي السَّمَاوَاتِ أَوْ فِي الْأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللهُ إِنَّ اللهَ لَطِيْفٌ خَبِيْرٌ- ‘হে বৎস! কোন বস্ত্ত যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তর গর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ গোপনভেদ জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন’ (লুকমান ৩১/১৬)।
নভোমন্ডল, ভূমন্ডল, দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতের যাবতীয় বস্ত্ত পরাক্রমশালী আল্লাহর জ্ঞান ক্ষমতার আওতাভুক্ত থাকা ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস এবং একত্ববাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ জ্ঞানসমুদ্রে পাড়ি দেয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। এজন্যে প্রয়োজন শুধু সবিনয়ে তাঁর সম্মুখে নিঃশর্ত ও কলুষমুক্ত আত্মসমর্পণ। এ আত্মসমর্পণের প্রতি পরাক্রমশালী আল্লাহর সমর্থন ও সন্তুষ্টিই বান্দার ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের জন্যে সার্থকতা বয়ে আনবে। আর এ আত্মসমর্পণের স্বরূপ হবে পরাক্রমশালী আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ। এখানে যে কোন প্রকারের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কৃত্রিমতাও ধরা পড়ে যাবে মহাজ্ঞানী আল্লাহর সম্মুখে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল (ছাঃ)-কে বলেন, قُلْ لَوْ كَانَ الْبَحْرُ مِدَادًا لِكَلِمَاتِ رَبِّي لَنَفِدَ الْبَحْرُ قَبْلَ أَنْ تَنْفَدَ كَلِمَاتُ رَبِّي وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهِ مَدَدًا- ‘বলুন, আমার পালনকর্তার কথা লিখার জন্য যদি সমুদ্রের পানি কালি হয়, তবে আমার পালনকর্তার কথা শেষ হওয়ার আগেই সে সমুদ্র নিঃশেষিত হয়ে যাবে। সাহায্যার্থে অনুরূপ আরেকটি সমুদ্র এনে দিলেও’ (কাহাফ ১৮/১০৯)।
অনুরূপ আরও এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু রয়েছে সবই আল্লাহর। আল্লাহ অভাবমুক্ত প্রশংসার্হ। পৃথিবীতে যত বৃক্ষ আছে, সবই যদি কলম হয় এবং সমুদ্রের সাথেও সাত সমুদ্র যুক্ত হয়ে কালি হয়, তবুও তাঁর বাক্যাবলী বা জ্ঞানের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (লোকমান ৩১/২৬, ২৭)।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন হ’ল মহান আল্লাহর বাণী সমূহের সমন্বয়ে লিপিবদ্ধ, অতঃপর ঊর্ধ্বজগত হ’তে অবতীর্ণ মানবজাতির জন্য এক অদ্বিতীয় কিতাব। এ কিতাবে রয়েছে অসীম সত্তার অমূল্য জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বাণী। এ কিতাবের অভ্যন্তরস্ত মহাজ্ঞানের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা আদৌ সম্ভব নয়। কারণ তিনি উপরের আয়াতে বলেছেন যে, ভূ-পৃষ্ঠে যত বৃক্ষ আছে, যদি সেগুলো সমস্ত কেটে কলম বানানো হয় এবং বিশ্বের সমুদ্র সমূহের পানি দ্বারা কালি তৈরী করা হয় এবং এসব কালি-কলম দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার প্রজ্ঞা ও জ্ঞানগরিমা এবং তাঁর ক্ষমতার বিবরণ লিখতে আরম্ভ করা হয়, তবে সমুদ্রের পানি নিঃশেষ হয়ে যাবে, তবুও তাঁর অফুরন্ত প্রজ্ঞা ও মহিমার বর্ণনা শেষ হবে না।
মোটকথা মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর গুণাবলী অবর্ণনীয়। পক্ষান্তরে সমস্ত মানুষের গুণাবলী ও ক্ষমতা অপরিমিত নয়, বরং তা হিসাবযোগ্য এবং খুবই নগণ্য। কিন্তু আল্লাহর জ্ঞানভান্ডারের বাক্যাবলী অসীম ও অনন্ত। কোন সসীম বস্ত্ত অসীম বস্ত্তর নাগাল পেতে পারে না; অসীম বস্ত্তকে সীমাবদ্ধও করতে পারে না। সুতরাং অসীম ও অনন্ত জ্ঞানভান্ডারের মালিক মহামহিমাময় আল্লাহ তা‘আলার আহবানে একাত্মতা পোষণ করা মানব জীবনের একান্ত ব্রত হওয়া উচিত। দয়াশীল আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সেই তওফীক্ব দান করুন-আমীন!
রফীক আহমাদ
শিক্ষক (অবঃ), বিরামপুর, দিনাজপুর।