আরবী শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে সাধারণভাবে ‘শবেবরাত’ বা ‘লায়লাতুল বারাআত’(ليلة البراءة) বলা হয়। ‘শবেবরাত’ শব্দটি ফারসী। এর অর্থ হিস্সা বা নির্দেশ পাওয়ার রাত্রি। দ্বিতীয় শব্দটি আরবী। যার অর্থ বিচ্ছেদ বা মুক্তির রাত্রি। এদেশে শবেবরাত ‘সৌভাগ্য রজনী’ হিসাবেই পালিত হয়। এজন্য সরকারী ছুটি ঘোষিত হয়। লোকেরা ধারণা করে যে, এ রাতে বান্দাহর গুনাহ মাফ হয়। আয়ু ও রূযী বৃদ্ধি করা হয়। সারা বছরের ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয়। এই রাতে রূহগুলো সব আত্মীয়-স্বজনের সাথে মুলাক্বাতের জন্য পৃথিবীতে নেমে আসে। বিশেষ করে বিধবারা মনে করেন যে, তাদের স্বামীদের রূহ ঐ রাতে ঘরে ফেরে। এজন্য ঘরের মধ্যে আলো জ্বেলে বিধবাগণ সারা রাত মৃত স্বামীর রূহের আগমনের আশায় বুক বেঁধে বসে থাকেন। বাসগৃহ ধুপ-ধুনা, আগরবাতি, মোমবাতি ইত্যাদি দিয়ে আলোকিত করা হয়। অগণিত বাল্ব জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়। আত্মীয়-স্বজন সব দলে দলে গোরস্থানে ছুটে যায়। হালুয়া-রুটির হিড়িক পড়ে যায়। ছেলেরা পটকা ফাটিয়ে আতশবাজি করে হৈ-হুল্লে­াড়ে রাত কাটিয়ে দেয়। যারা কখনো ছালাতে অভ্যস্ত নয়, তারাও ঐ রাতে মসজিদে গিয়ে ‘ছালাতে আল্ফিয়াহ’ (الصلاة الألفية) বা ১০০ রাক‘আত ছালাত আদায়ে রত হয়। যেখানে প্রতি রাক‘আতে ১০ বার করে সূরা ইখলাছ পাঠ করা হয়। সংক্ষেপে এই হ’ল এদেশে শবেবরাতের নামে প্রচলিত ইসলামী পর্বের বাস্তব চিত্র।

ধর্মীয় ভিত্তি : মোটামুটি দু’টি ধর্মীয় আক্বীদাই এর ভিত্তি হিসাবে কাজ করে থাকে। ১. ঐ রাতে বান্দাদের গুনাহ মাফ হয়। আগামী এক বছরের জন্য ভাল-মন্দ তাক্বদীর নির্ধারিত হয় এবং এই রাতে কুরআন নাযিল হয়। ২. ঐ রাতে রূহগুলি ছাড়া পেয়ে মর্ত্যে নেমে আসে। হালুয়া-রুটি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, ঐদিন ওহোদ যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-এর দান্দান মুবারক শহীদ হয়েছিল। ব্যথার জন্য তিনি নরম খাদ্য হিসাবে হালুয়া-রুটি খেয়েছিলেন বিধায় আমাদেরও সেই ব্যথায় সমবেদনা প্রকাশ করার জন্য হালুয়া-রুটি খেতে হয়। অথচ ওহোদের যুদ্ধ হয়েছিল ৩য় হিজরীর শাওয়াল মাসের ৭ তারিখ শনিবার সকালে।[1] আর আমরা ব্যথা অনুভব করছি তার প্রায় দু’মাস পূর্বে শা‘বানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রে...!

এক্ষণে আমরা উপরোক্ত বিষয়গুলির ধর্মীয় ভিত্তি কতটুকু তা খুঁজে দেখব। প্রথমটির সপক্ষে যেসব আয়াত ও হাদীছ পেশ করা হয়, তা নিম্নরূপ: ১. সূরা দুখান-এর ৩ ও ৪ আয়াত-إِنَّا اَنْزَلْنَاهُ فِىْ لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِيْنَ، فِيْهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍحَكِيْمٍ- অর্থ : ‘আমরা তো এটি অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে; আমরা তো সতর্ককারী’। ‘এ রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়’ (দুখান ৪৪/৩-৪)।

হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেন, ‘এখানে মুবারক রজনী অর্থ লায়লাতুল ক্বদর’। যেমন সূরা ক্বদর ১ম আয়াতে আল্লাহ বলেন, إِنَّا اَنْزَلْنَاهُ فِىْ لَيْلَةٍ الْقَدْرِ ‘নিশ্চয়ই আমরা এটা নাযিল করেছি ক্বদরের রাত্রিতে’। আর সেটি হ’ল রামাযান মাসে। যেমন সূরা বাক্বারাহ ১৮৫ আয়াতে আল্লাহ বলেন,شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِىْ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْانُ ‘এই সেই রামাযান মাস, যে মাসে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে’। তিনি বলেন, এ রাতে এক শা‘বান হ’তে আরেক শা‘বান পর্যন্ত বান্দার রূযী, বিয়ে-শাদী, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি লিপিবদ্ধ হয় বলে যে হাদীছ প্রচারিত আছে, তা ‘মুরসাল’ ও যঈফ এবং কুরআন ও ছহীহ হাদীছ সমূহের বিরোধী হওয়ার কারণে অগ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন, ক্বদর রজনীতেই লওহে মাহফূযে সংরক্ষিত ভাগ্যলিপি হ’তে পৃথক করে আগামী এক বছরের নির্দেশাবলী তথা মৃত্যু, রিযিক ও অন্যান্য ঘটনাবলী যা সংঘটিত হবে, সেগুলি লেখক ফেরেশতাগণের নিকটে প্রদান করা হয়। এরূপভাবেই বর্ণিত হয়েছে আব্দুল্লাহ বিন ওমর, মুজাহিদ, আবু মালিক, যাহ্হাক প্রমুখ সালাফে ছালেহীনের নিকট হ’তে।

অতঃপর ‘তাক্বদীর’ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য হ’ল,وَكُلُّ شَيْءٍ فَعَلُوْهُ فِى الزُّبْرِ، وكُلُّ صَغِيْرٍ وَّكَبِيْرٍ مُسْتَطَرٌ- ‘তাদের সমস্ত কার্যকলাপ আছে আমলনামায়, আছে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সমস্ত কিছুই লিপিবদ্ধ’ (ক্বামার ৫৪/৫২-৫৩)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, كَتَبَ اللهُ مَقَادِيْرَ الخَلاَئِقِ قَبْلَ أنْ يَّخْلُقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأرْضَ بِخَمْسِيْنَ أَلْفَ سَنَةٍ. ‘আসমান সমূহ ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বৎসর পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় মাখলূক্বাতের তাক্বদীর লিপিবদ্ধ করেছেন’।[2] আবু হুরায়রাহ (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমার ভাগ্যে যা আছে তা ঘটবে; এ বিষয়ে কলম শুকিয়ে গেছে’ (পুনরায় তাক্বদীর লিখিত হবে না)।[3]

এক্ষণে শবেবরাতে প্রতিবছর ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয় বলে যে ধারণা প্রচলিত আছে, তার কোন ছহীহ ভিত্তি নেই। বরং ‘লায়লাতুল বারাআত’ বা ভাগ্যরজনী নামটিই সম্পূর্ণ বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ইসলামী শরী‘আতে এই নামের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

বাকী রইল এই রাতে গুনাহ মাফ হওয়ার বিষয়। সেজন্য দিনে ছিয়াম পালন ও রাতে ইবাদত করতে হয়। অন্ততঃ ১০০ রাক‘আত ছালাত আদায় করতে হয়। প্রতি রাক‘আতে সূরা ফাতিহা ও ১০ বার করে সূরা ইখলাছ (কুল হুওয়াল্লা-হু আহাদ) পড়তে হয়। এই ছালাতটি গোসল করে আদায় করলে গোসলের প্রতি ফোঁটা পানিতে ৭০০ রাক‘আত নফল ছালাতের ছওয়াব পাওয়া যায় ইত্যাদি।

এ সম্পর্কে প্রধান যে দলীলগুলি পেশ করা হয়ে থাকে, তা নিম্নরূপ :

১. আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِذَا كَانَتْ لَيْلَةٌ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَقُوْمُوْا لَيْلَهَا وَصُوْمُوْا نَهَارَهَا الخ- ‘মধ্য শা‘বান এলে তোমরা রাত্রিতে ইবাদত কর ও দিনে ছিয়াম পালন কর। কেননা আল্লাহ ঐদিন সূর্যাস্তের পর দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন ও বলেন, আছ কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। আছ কি কেউ রূযী প্রার্থী আমি তাকে রূযী দেব। আছ কি কোন রোগী, আমি তাকে আরোগ্য দান করব’?[4]

আলবানী বলেন, হাদীছটি মওযূ‘ অথবা অত্যন্ত যঈফ। হাদীছটির সনদ ‘অত্যন্ত বাজে’ (واه جدا)। তিনি বলেন, এর সনদে আবুবকর ইবনু আবী সাব্রাহ নামে একজন রাবী আছেন, যিনি হাদীছ জালকারী।[5]

দ্বিতীয়তঃ হাদীছটি ছহীহ হাদীছের বিরোধী হওয়ায় অগ্রহণযোগ্য। কেননা একই মর্মে প্রসিদ্ধ ‘হাদীছে নুযূল’ ইবনু মাজাহর ৯৮ পৃষ্ঠায় মা আয়েশা (রাঃ) হ’তে (হা/১৩৬৬) এবং বুখারী শরীফের (মীরাট ছাপা ১৩২৮ হিঃ) ১৫৩, ৯৩৬ ও ১১১৬ পৃষ্ঠায় এবং ‘কুতুবে সিত্তাহ’ সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে সর্বমোট ৩০ জন ছাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। সেখানে ‘মধ্য শা‘বান’ না বলে ‘প্রতি রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশ’ বলা হয়েছে। অতএব ছহীহ হাদীছ সমূহের বর্ণনানুযায়ী আল্লাহ প্রতি রাত্রির তৃতীয় প্রহরে নিম্ন আকাশে অবতরণ করে বান্দাকে ফজরের সময় পর্যন্ত উপরোক্ত আহবান জানিয়ে থাকেন; শুধুমাত্র নির্দিষ্টভাবে মধ্য শা‘বানের একটি রাত্রিতে নয়।

২. মা আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা রাত্রিতে একাকী মদীনার বাকবী‘ গোরস্থানে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি এক পর্যায়ে আয়েশাকে লক্ষ্য করে বলেন, মধ্য শা‘বানের দিবাগত রাতে আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং ‘কল্ব’ গোত্রের ছাগল সমূহের লোম সংখ্যার চাইতে অধিক সংখ্যক লোককে মাফ করে থাকেন’।[6]

হাদীছটি যঈফ। কারণ এর সনদ মুনকাত্বি‘ বা ছিন্নসূত্র এবং সনদে হাজ্জাজ বিন আরত্বাত নামক একজন দুর্বল রাবী আছেন।[7]

৩. ইমরান বিন হুছাইন (রাঃ) বলেন যে, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে বলেন, তুমি কি ‘সিরারে শা‘বানের’ ছিয়াম রেখেছ? লোকটি বলল, ‘না’। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে রামাযানের পর ছিয়াম দু’টির ক্বাযা আদায় করতে বললেন’।[8]

ইমাম বুখারী সহ জমহূর বিদ্বানগণের নিকট ‘সিরার’ অর্থ মাসের শেষ।[9] উক্ত ব্যক্তি শা‘বানের শেষাবধি নির্ধারিত ছিয়াম পালনে অভ্যস্ত ছিলেন অথবা ঐটা তার মানতের ছিয়াম ছিল। রামাযানের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার নিষেধাজ্ঞা লংঘনের ভয়ে তিনি শা‘বানের শেষের ছিয়াম দু’টি বাদ দেন। সেকারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ঐ ছিয়ামের ক্বাযা আদায় করতে বলেন। বুঝা গেল যে, এই হাদীছটির সঙ্গে প্রচলিত শবেবরাতের কোন সম্পর্ক নেই।

৪. আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘পাঁচ রাতে দো‘আ ফেরত দেওয়া হয় না। রজব মাসের প্রথম রাতে, মধ্য শা‘বানে, জুম‘আর রাত, ঈদুল ফিতর এবং কুরবানীর রাতের দো‘আ। হাদীছটি জাল।[10]

৫. আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুললাহ (ছাঃ) বলেছেন, আললাহ তা‘আলা শা‘বান মাসের পনের তারিখ রাতে সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দান করে এবং সকলকে ক্ষমা করে দেন, কেবল মুশরিক ও পরস্পরে শত্রু ব্যতীত’।[11] আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, পরস্পরে শত্রু ও আত্মঘাতি ব্যতীত’।[12]

৮টি যঈফ সূত্র উল্লেখ করে সেগুলি হাদীছটিকে শক্তিশালী করেছে মন্তব্য করে শায়খ আলবানী হাদীছটিকে ‘নিঃসন্দেহে ছহীহ’ (صحيح بلا ريب) বলেছেন।[13] ভাষ্যকার শু‘আয়েব আরনাঊত্ব হাদীছটির সনদ যঈফ বলেছেন। অতঃপর বিভিন্ন শাওয়াহেদ-এর কারণে ‘ছহীহ লেগায়রিহি’ বলেছেন (আহমাদ হা/৬৬৪২)। ভাষ্যকার আহমাদ শাকের একইরূপ বলেছেন (১০/১২৭)। কিন্তু ‘ছহীহ’ বলা সত্ত্বেও এ রাত্রি উপলক্ষ্যে বিশেষ কোন আমল করাকে শায়খ আলবানী কঠোরভাবে বিদ‘আত বলেছেন।[14]

এক্ষণে এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য : (১) হাদীছটি বুখারী-মুসলিম সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত ছহীহ হাদীছ সমূহের বিরোধী। (২) সকল ছহীহ হাদীছে এসেছে যে, আল্লাহ প্রতি রাতের তৃতীয় প্রহরে নিম্ন আকাশে অবতরণ করেন এবং ফজর পর্যন্ত বান্দাদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, আছ কি কোন আহবানকারী, আমি তার আহবানে সাড়া দেব...।[15] অথচ অত্র হাদীছে এটি ১৫ই শা‘বানের রাতের জন্য খাছ করা হয়েছে। যদিও এরূপ ক্ষমা প্রদানের কথা অন্য ছহীহ হাদীছ সমূহে এসেছে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবারে জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেওয়া হয়। অতঃপর আল্লাহর সাথে শিরক করেনি এমন সকল ব্যক্তিকে ক্ষমা করা হয়। কেবল ঐ দুই ব্যক্তি ছাড়া যাদের মধ্যে পরস্পরে শত্রুতা রয়েছে। বলা হয় যে, এই দু’জনকে ছাড় যতক্ষণ না ওরা পরস্পরে সন্ধি করে’।[16] অথচ ঐ দু’রাতে কেউ বিশেষভাবে কোন ইবাদত বা অনুষ্ঠানাদি করেনা এবং করার বিধানও নেই। (৩) এই রাতে বা দিনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম কোনরূপ বাড়তি আমল বা ইবাদত করেননি। (৪) মতভেদের সময় রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে তাঁর ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত কঠিনভাবে অাঁকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন।[17] তিনি বলেন, যে ব্যক্তি এমন কাজ করবে, যাতে আমাদের নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[18] অতএব ১৫ই শা‘বান উপলক্ষ্যে প্রচলিত সকল প্রকার ইবাদত ও অনুষ্ঠানাদি নিঃসন্দেহে বিদ‘আত। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।

শবেবরাতের ছালাত : এই রাত্রির ১০০ রাক‘আত ছালাত সম্পর্কে যেসব হাদীছ বলা হয়ে থাকে তা ‘মওযূ’ বা জাল।[19] এই ছালাত ৪৪৮ হিজরীতে সর্বপ্রথম বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদে আবিষ্কৃত হয়। যেমন মিশকাতুল মাছাবীহ-এর খ্যাতনামা আরবী ভাষ্যকার মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (মৃঃ ১০১৪ হিঃ) ‘আল-লা‘আলী’ কেতাবের বরাতে বলেন, ‘জুম‘আ ও ঈদায়নের ছালাতের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে ‘ছালাতে আল্ফিয়াহ’ নামে এই রাতে যে ছালাত আদায় করা হয় এবং এর সপক্ষে যেসব হাদীছ ও আছার বলা হয়, তার সবই জাল অথবা যঈফ। এব্যাপারে (ইমাম গাযালীর) ‘এহ্ইয়াউল উলূম’ ও (ইবনুল আরাবীর) ‘কূতুল ক্বুলূব’ দেখে যেন কেউ ধোঁকা না খায়।... এই বিদ‘আত ৪৪৮ হিজরীতে সর্বপ্রথম জেরুযালেমের বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদে প্রবর্তিত হয়। মসজিদের মূর্খ ইমামগণ অন্যান্য ছালাতের সঙ্গে যুক্ত করে এই ছালাত চালু করেন। এর মাধ্যমে তারা জনসাধারণকে একত্রিত করার এবং নেতৃত্ব করা ও পেট পুর্তি করার একটা ফন্দি এঁটেছিল মাত্র। এই বিদ‘আতী ছালাতের ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে নেক্কার-পরহেযগার ব্যক্তিগণ আল্লাহর গযবে যমীন ধ্বসে যাওয়ার ভয়ে শহর ছেড়ে জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিলেন’।[20]

এই রাতে মসজিদে গিয়ে একাকী বা জামা‘আতবদ্ধভাবে ছালাত আদায় করা, যিকর-আযকারে লিপ্ত হওয়া সম্পর্কে জানা যায় যে, শামের কিছু বিদ্বান এটা প্রথমে শুরু করেন। তারা এই রাতে সুন্দর পোষাক পরে, আতর-সুরমা লাগিয়ে মসজিদে গিয়ে রাত্রি জাগরণ করতে থাকেন। পরে বিষয়টি লোকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। মক্কা-মদীনার আলেমগণ এর তীব্র বিরোধিতা করেন। কিন্তু শামের বিদ্বানদের দেখাদেখি কিছু লোক এগুলো করতে শুরু করে। এইভাবে এটি জনসাধারণ্যে ব্যপ্তি লাভ করে।[21]

রূহের আগমন : এই রাত্রিতে মদীনার ‘বাক্বী‘উল গারক্বাদ’ কবরস্থানে রাতের বেলায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিঃসঙ্গ অবস্থায় যিয়ারত করতে যাওয়ার হাদীছটি[22] যে যঈফ ও মুনক্বাত্বি‘ তা আমরা ইতিপূর্বে দেখে এসেছি। এখন প্রশ্ন হ’ল, এই রাতে সত্যি সত্যিই রূহগুলো ইল্লীন বা সিজ্জীন হ’তে সাময়িকভাবে ছাড়া পেয়ে পৃথিবীতে নেমে আসে কি-না। যাদের মাগফেরাত কামনার জন্য আমরা দলে দলে কবরস্থানের দিকে ছুটে যাই। এমনকি মহিলাদেরকেও এ রাতে কবরস্থানে দেখা যায়। এ সম্পর্কে সাধারণতঃ সূরা ক্বদর-এর ৪ ও ৫ আয়াত দু’টি পেশ করা হয়ে থাকে। যেখানে বলা হয়েছে, تَنَزَّلُ الْمَلآئِكَةُ وَالرَّوْحُ فِيْهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ سَلاَمٌ، هِىَ حَتَّى مَطْلِعِ الْفَجْرِ- ‘সে রাত্রিতে ফিরিশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। সকল বিষয়ে কেবল শান্তি; ফজরের উদয়কাল পর্যন্ত’। এখানে ‘সে রাত্রি’ বলতে লায়লাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদরকে বুঝানো হয়েছে- যা এই সূরার ১ম, ২য় ও ৩য় আয়াতে বলা হয়েছে।

অত্র সূরায় ‘রূহ’ অবতীর্ণ হয় কথাটি রয়েছে বিধায় হয়তবা অনেকে ধারণা করে নিয়েছেন যে, মৃত ব্যক্তিদের রূহগুলি সব দুনিয়ায় নেমে আসে। অথচ এই অর্থ কোন বিদ্বান করেননি। ‘রূহ’ শব্দটি একবচন। এ সম্পর্কে হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেন, ‘এখানে রূহ বলতে ফিরিশতাগণের সরদার জিবরাঈলকে বুঝানো হয়েছে’।

শা‘বান মাসের করণীয় : রামাযানের আগের মাস হিসাবে শা‘বান মাসের প্রধান করণীয় হ’ল অধিকহারে ছিয়াম পালন করা। আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আমি রাসূলু্ল্লাহ (ছাঃ)-কে রামাযান ব্যতীত অন্য কোন মাসে শা’বানের ন্যায় এত অধিক ছিয়াম পালন করতে দেখিনি। শেষের দিকে তিনি মাত্র কয়েক দিন ছিয়াম ত্যাগ করতেন’।[23]

যারা শা‘বানের প্রথম থেকে নিয়মিত ছিয়াম পালন করেন, তাদের জন্য শেষের পনের দিন ছিয়াম পালন করা উচিত নয়। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যখন শা‘বানের অর্ধেক হবে, তখন তোমরা ছিয়াম রেখো না’।[24] অবশ্য যদি কেউ অভ্যস্ত হন বা মানত করে থাকেন, তারা শেষের দিকেও ছিয়াম পালন করবেন।

মোটকথা শা‘বান মাসে অধিক হারে নফল ছিয়াম পালন করা সুন্নাত। ছহীহ দলীল ব্যতীত কোন দিন বা রাতকে ছিয়াম ও ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা সুন্নাতের বরখেলাফ। অবশ্য যারা ‘আইয়ামে বীয’-এর তিন দিন নফল ছিয়ামে অভ্যস্ত, তারা ১৩, ১৪ ও ১৫ই শা‘বানে উক্ত নিয়তেই ছিয়াম পালন করবেন, শবেবরাতের নিয়তে নয়। নিয়তের গোলমাল হ’লে কেবল কষ্ট করাই সার হবে। কেননা বিদ‘আতী কোন আমল আল্লাহ পাক কবুল করেন না এবং সকল প্রকার বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা ও প্রত্যাখ্যাত।[25] আল্লাহ আমাদের সবাইকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে নিজ নিজ আমল সমূহ পরিশুদ্ধ করে নেওয়ার তাওফীক দান করুন- আমীন! (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : হাফাবা প্রকাশিত ‘শবেবরাত’ বই)।


[1]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ৩৪৮ পৃঃ।

[2]. মুসলিম হা/২৬৫৩; মিশকাত হা/৭৯।

[3]. বুখারী হা/৫০৭৬; মিশকাত হা/৮৮।

[4]. ইবনু মাজাহ হা/১৩৮৮; আলবানী, মিশকাত হা/১৩০৮।

[5]. বিস্তারিত দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ হা/২১৩২)

[6]. ইবনু মাজাহ হা/১৩৮৯, মিশকাত হা/১২৯৯

[7]. আলবানী, যঈফুল জামে‘ হা/১৭৬১; শু‘আইব আরনাঊত্ব, তাহকীক মুসনাদে আহমাদ হা/২৬০৬০

[8]. বুখারী হা/১৯৮৩; মুসলিম হা/১১৬১; মিশকাত হা/২০৩৮

[9]. মুবারকপুরী, মির‘আত হা/১৩১৬-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ

[10]. আলবানী, সিলসিলা যঈফাহ হা/১৪৫২

[11]. ইবনু মাজাহ হা/১৩৯০; মিশকাত হা/১৩০৬ ‘রামাযানে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ

[12]. আহমাদ হা/৬৬৪২; মিশকাত হা/১৩০৭; যঈফ আত-তারগীব হা/৬২১

[13]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/১১৪৪, ৩/১৩৮, ১৫৬৩, ৪/১৩৭

[14]. ফাতাওয়া আলবানী (অডিও) ক্লিপ নং ১৮৬/৬

[15]. বুখারহিা/১১৪৫; মুসলিম হা/৭৫৮; মিশকাত হা/১২২৩

[16]. মুসলিম হা/২৫৬৫; মিশকাত হা/৫০২৯-৩০

[17]. আবুদাঊদ হা/৪৬০৭; ইবনু মাজাহ হা/৪২; মিশকাত হা/১৬৫

[18]. মুসলিম হা/১৭১৮

[19]. ইবনুল জাওযী, আল-মওযূ‘আত ২/১২৭-২৯; সৈয়ূতী, আল-লাআলী আল-মাছনূ‘ ফীল আহাদীছিল মাওযূ‘আহ ২/৪৯-৫০

[20]. মিরক্বাত শরহ মিশকাত হা/১৩০৮-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ ৪/৪৪৬-৪৭ পৃ.।

[21]. আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায, ‘আত-তাহযীরু মিনাল বিদ‘আ’ পৃঃ ১২-১৩

[22]. ইবনু মাজাহ হা/১৩৮৯; মিশকাত হা/১২৯৯; যঈফুল জামে‘ হা/১৭৬১।

[23]. বুখারী হা/১৯৬৯, মুসলিম হা/১১৫৬, মিশকাত হা/২০৩৬

[24]. আবুদাঊদ হা/২৩৩৭; তিরমিযী হা/৭৩৮; মিশকাত হা/১৯৭৪

[25]. নাসাঈ হা/১৫৭৮, মিশকাত হা/১৬৫





বিষয়সমূহ: আমল
দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকার (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ছালাত পরিত্যাগকারীর ভয়াবহ পরিণতি (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আল্লামা আলবানী সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব আরনাঊত্বের সমালোচনার জবাব (৩য় কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
সমাজ সংস্কারে ইমামগণের ভূমিকা - ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
নিয়মের রাজত্ব - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
ইবাদতে অলসতা দূর করার উপায় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মুহাসাবা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
বিদ‘আত ও তার পরিণতি (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
হাদীছ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পরিক্রমা (২য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মুহাম্মাদ (ছাঃ)-ই সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল (পূর্বে প্রকাশিতের পর) - আব্দুল্লাহ বিন আবদুর রাযযাক
পলাশীর মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি ও আমাদের শিক্ষা - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
মানবাধিকার ও ইসলাম (৩য় কিস্তি) - শামসুল আলম
আরও
আরও
.