(২) তরীকা সঠিক হওয়া :
ইবাদত কবুলের অন্যতম শর্ত হ’ল ইবাদত সম্পাদনের পদ্ধতি সঠিক হওয়া তথা আল্লাহ ও তদীয় রাসূল প্রদর্শিত পদ্ধতি অনুযায়ী হওয়া। অন্যথায় ইবাদত কবুল হয় না। আল্লাহ বলেন,قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا، الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا، أُولَئِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ وَلِقَائِهِ فَحَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَلَا نُقِيمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَزْنًا- ‘বলে দাও, আমরা কি তোমাদেরকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের সম্পর্কে জানিয়ে দেব? পার্থিব জীবনে যাদের সকল প্রচেষ্টা বিফলে গেছে। অথচ তারা ভেবেছে যে, তারা সৎকর্ম করছে। ওরা হ’ল তারাই, যারা তাদের প্রতিপালকের আয়াত সমূহকে এবং তার সাথে সাক্ষাতকে অস্বীকার করে। ফলে তাদের সকল কর্ম নিস্ফল হয়ে যায়। ক্বিয়ামতের দিন আমরা তাদের জন্য দাড়িপাল্লা দন্ডায়মান করব না’ (কাহফ ১৮/১০৩-১০৫)।
অর্থাৎ আল্লাহ স্বীয় রাসূলের মাধ্যমে ইবাদত করার যে পদ্ধতি মানুষকে জানিয়েছেন, সে পদ্ধতিতে ইবাদত না করলে তা কবুল হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ، ‘যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু প্রবর্তন করবে, তা প্রত্যাখ্যাত’।[1] তিনি আরো বলেন,مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا، فَهْوَ رَدٌّ، ‘যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল, যাতে আমাদের নির্দেশনা নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[2]
রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুসরণের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন,وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا، ‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত হও’ (হাশর ৫৯/৭)। তিনি আরো বলেন,قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ، ‘তুমি বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন ও তোমাদের গোনাহসমূহ মাফ করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আললাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আলে ইমরান ৩/৩১)।
রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং সুন্নাত অাঁকড়ে ধরার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّيْنَ الرَّاشِدِيْنَ تَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ، ‘অতএব তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত এবং আমার হিদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নাত অনুসরণ করবে ও তা শক্তভাবে আঁকড়ে ধরবে। আর তা মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে। সাবধান! (ধর্মে) নবাবিষ্কার থেকে বেঁচে থাকবে। কারণ প্রতিটি নবাবিষ্কার হ’ল বিদ‘আত এবং প্রতিটি বিদ‘আত হ’ল ভ্রষ্টতা’।[3] তিনি আরো বলেন,كُلُّ أُمَّتِى يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ، إِلاَّ مَنْ أَبَى. قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَمَنْ يَأْبَى، قَالَ مَنْ أَطَاعَنِى دَخَلَ الْجَنَّةَ، وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ أَبَى، ‘আমার সকল উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে, তবে ‘আবা’ ব্যতীত। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবা’ কে? তিনি বললেন, যে আমার অনুসরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে সে-ই ‘আবা’ বা অস্বীকারকারী’।[4] অতএব সকল ইবাদত রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত তথা তাঁর তরীকা মোতাবেক সম্পন্ন হ’তে হবে।
দ্বীনের মধ্যে কেউ বিদ‘আত করলে ঐ ব্যক্তির কোন আমল কবুল হয় না। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ أَحْدَثَ فِيهَا حَدَثًا، أَوْ آوَى مُحْدِثًا، فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللهِ وَالْمَلاَئِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ، لاَ يُقْبَلُ مِنْهُ صَرْفٌ وَلاَ عَدْلٌ. ‘যদি কেউ এতে (মদীনায়) বিদ‘আত করে অথবা বিদ‘আতীকে আশ্রয় দেয়, তাহ’লে তার উপর আল্লাহ, ফেরেশতা মন্ডলী ও সকল মানুষের অভিসম্পাত। ঐ ব্যক্তির কোন ফরয ও নফল ইবাদত কবুল হবে না’।[5]
সুন্নাত পরিপন্থী আমল করার কারণে পরকালে ঐ আমলকারী রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আত থেকেও বঞ্চিত হবে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم إِنِّى فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ، مَنْ مَرَّ عَلَىَّ شَرِبَ، وَمَنْ شَرِبَ لَمْ يَظْمَأْ أَبَدًا، لَيَرِدَنَّ عَلَىَّ أَقْوَامٌ أَعْرِفُهُمْ وَيَعْرِفُونِى، ثُمَّ يُحَالُ بَيْنِى وَبَيْنَهُمْ فَأَقُوْلُ إِنَّهُمْ مِنِّيْ. فَيُقَالُ: إِنَّكَ لاَ تَدْرِيْ مَا أَحْدَثُوْا بَعْدَكَ؟ فَأَقُوْلُ : سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيَّرَ بَعْدِيْ،
‘সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমি তোমাদের পূর্বেই হাওযে কাওছারের কাছে পেঁŠছে যাব। যে ব্যক্তি আমার কাছে পেঁŠছবে, সে পানি পান করবে। আর যে একবার পান করবে, সে আর কখনো পিপাসিত হবে না। এমন সময় আমার কাছে এমন কিছু লোক আসবে যাদেরকে আমি চিনতে পারব এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে। অতঃপর আমার ও তাদের মাঝে আড়াল করে দেয়া হবে। তখন আমি বলব, এরাতো আমার উম্মত। তখন আমাকে বলা হবে, আপনি জানেন না, আপনার অবর্তমানে তারা কি নতুন সৃষ্টি করেছিল। আমি তখন বলব, যারা আমার অবর্তমানে (আমার দ্বীনে) পরিবর্তন করেছ, তারা দূর হও, দূর হও’।[6] অর্থাৎ এ ধরনের লোক আমার শাফা‘আত ও আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে।
রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের বিপরীত আমল করলে পরিণতি হবে জাহান্নাম। তিনি বলেন,وَشَرَّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ وَكُلَّ ضَلاَلَةٍ فِى النَّارِ. ‘(দ্বীনের মধ্যে) প্রত্যেক নবাবিষ্কৃত বিষয়ই নিকৃষ্ট। আর প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদ‘আত এবং প্রত্যক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা। আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম হ’ল জাহান্নাম’।[7]
(৩) ইখলাছ বা একনিষ্ঠতা :
ইবাদত কবুলের আরেকটি শর্ত হচ্ছে ইখলাছ বা একনিষ্ঠতা। যেকোন আমল আল্লাহর জন্য খাছ করাকে ইখলাছ বলা হয়। ইখলাছ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীছে অনেক বর্ণনা এসেছে। তন্মধ্যে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হ’ল।-
আল্লাহ বলেন, وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّينَ، ‘তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁuঁট মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে’ (বাইয়েনাহ ৯৫/৫)।
আল্লাহ স্বীয় নবীকে সম্বোধন করে বলেন,قُلِ اللهَ أَعْبُدُ مُخْلِصًا لَهُ دِيْنِيْ، فَاعْبُدُوْا مَا شِئْتُمْ مِنْ دُوْنِهِ، ‘বল, আমি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদত করি। অতএব তোমরা তাঁর পরিবর্তে যার ইচ্ছা ইবাদত কর’ (যুমার ৩৯/১৪-১৫)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ فَاعْبُدِ اللهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ، أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ- ‘আমরা তোমার নিকট এই কিতাব যথার্থরূপে নাযিল করেছি। অতএব তুমি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত কর। জেনে রাখ, নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদত আল্লাহরই নিমিত্তে’ (যুমার ৩৯/২-৩)।
ইখলাছ বা নিয়তের যথার্থতার উপরে মানুষের কর্মফল নির্ভর করে। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّةِ، وَإِنَّمَا لاِمْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ، وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوِ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا، فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ. ‘নিঃসন্দেহে যাবতীয় আমলের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। প্রত্যেককে তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিদান দেয়া হবে। অতএব যার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হবে, সে হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি হিসাবেই গণ্য হবে। আর যার হিজরত দুনিয়া অর্জন অথবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হবে, তার হিজরত সে হিসাবেই গণ্য হবে’।[8] এ হাদীছের ব্যাখ্যায় ইবনু রজব হাম্বলী (রহঃ) বলেন,
وهذا الحديث أصل عظيم من أصول الإسلام كما أن حديث الأعمال بالنيات ميزان للأعمال في باطنها وهو ميزان للأعمال في ظاهرها فكما أن كل عمل لا يراد به وجه الله تعالى فليس لعامله فيه ثواب فكذلك كل عمل لا يكون عليه أمر الله ورسوله فهو مردود على عامله،
‘এই হাদীছটি ইসলামের মূলনীতি সমূহের একটি বড় মূলনীতি। যেমনভাবে এ নিয়তের হাদীছটি গোপন ও প্রকাশ্য আমলের মানদন্ড। অনুরূপভাবে প্রত্যেক আমল, যা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা হয় না, তাতে আমলকারীর জন্য কোন ছওয়াব নেই। তদ্রূপ প্রত্যেক ঐ আমল, যাতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ থাকে না, তা আমলকারীর প্রতি ফেরৎ দেওয়া হয়’।[9]
ইবাদতে ইখলাছ না থাকলে তা নিষ্ফল হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُورًا ‘আর আমরা সেদিন তাদের কৃতকর্ম সমূহের দিকে মনোনিবেশ করব। অতঃপর সেগুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব’ (ফুরক্বান ২৫/২৩)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,وذلك لأنها فقدت الشرط الشرعي، إما الإخلاص فيها، وإما المتابعة لشرع الله. فكل عمل لا يكون خالصا وعلى الشريعة المرضية، فهو باطل. ‘এটা এজন্য যে, এখানে শারঈ শর্ত অনুপস্থিত রয়েছে। তা হ’ল আমলে ইখলাছ বা একনিষ্ঠতা এবং আল্লাহর বিধানের অনুগামী হওয়া। সুতরাং প্রত্যেক আমল, যা একনিষ্ঠভাবে সম্পাদিত হয় না এবং শরী‘আত অনুযায়ী হয় না তা বাতিল।[10]
মহান আল্লাহ মানুষের অন্তরের প্রতি তথা তার নিয়তের প্রতি লক্ষ্য করেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوْبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ. ‘আল্লাহ তোমাদের আকৃতি এবং সম্পদের দিকে তাকান না। তবে তিনি তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে তাকান’।[11] আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,سُئِلَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ الرَّجُلِ يُقَاتِلُ شَجَاعَةً وَيُقَاتِلُ حَمِيَّةً وَيُقَاتِلُ رِيَاءً أَىُّ ذَلِكَ فِى سَبِيلِ اللهِ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ قَاتَلَ لِتَكُونَ كَلِمَةُ اللهِ هِىَ الْعُلْيَا فَهُوَ فِى سَبِيلِ اللهِ. ‘রাসূল (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ঐ সকল ব্যক্তি সর্ম্পকে, যারা লড়াই করে বীরত্ব প্রকাশের জন্য, লড়াই করে অহমিকা প্রদর্শনের জন্য ও লড়াই করে লোক দেখানো ভাবনা নিয়ে। তাদের মধ্যে কে আল্লাহর জন্য লড়াই করল? রাসূল (ছাঃ) বললেন, যে লড়াই করে আল্লাহর কালেমা (বাণী) উঁচু করার জন্য সেই আল্লাহর পথে লড়াই করে’।[12]
প্রকৃত ইখলাছ বা একনিষ্ঠতা হচ্ছে, আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পরকালীন শান্তি ও মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদত করা। যেমন আল্লাহ বলেন,وَمَا لِأَحَدٍ عِنْدَهُ مِنْ نِعْمَةٍ تُجْزَى، إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَى، ‘আর তার প্রতি কারও অনুগ্রহের প্রতিদান হিসাবে নয়, বরং শুধু তার মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশায়’ (লায়ল ৯২/১৯-২০)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلَاهَا مَذْمُومًا مَدْحُورًا، وَمَنْ أَرَادَ الْآَخِرَةَ وَسَعَى لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ كَانَ سَعْيُهُمْ مَشْكُورًا، ‘যে কেউ পার্থিব সুখ-সম্ভোগ কামনা করে, আমি তাকে যা ইচ্ছা সত্বর দিয়ে থাকি। পরে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করে দেই, তারা তাতে নিন্দিত-বিতাড়িত অবস্থায় প্রবেশ করবে। আর যারা (ঈমান নিয়ে) পরকাল কামনা করে এবং এর জন্য যথাযথ চেষ্টা-সাধনা করে, তাদের চেষ্টা স্বীকৃত হয়ে থাকে’ (বানী ইসরাঈল ১৭/১৮-১৯)।
বস্ত্ততঃ আমল বিশুদ্ধ হবার জন্য প্রয়োজন মনের সকল প্রকার রোগ হ’তে অন্তরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা। যেমন হিংসা-অহংকার, ধোঁকা-প্রতারণা, গীবত-তোহমত, চোগলখুরী, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি। তদ্রূপ মানুষের দোষ-ত্রুটির দিকে দৃষ্টি দেওয়া থেকেও নিজেকে দূরে রাখতে হবে। আর ইবাদতের মাধ্যমে মানুষের প্রশংসা অর্জন, অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়া, তাদের খেদমত বা ভালবাসা অর্জন করার উদ্দেশ্য পরিহার করতে হবে। কারণ এসবই হচ্ছে মাখলূকের নিকট মুখাপেক্ষী হওয়া। যা শিরকের নামান্তর। হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ বলেন,أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ مَنْ عَمِلَ عَمَلاً أَشْرَكَ فِيهِ مَعِى غَيْرِى تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ ‘আমি শিরককারীদের শিরক হ’তে সম্পূর্ণ মুক্ত। যে ব্যক্তি আমলে (ইবাদতে) আমার সাথে অন্যকে শরীক করে, আমি তাকে তার সেই শিরকসহ বর্জন করি’।[13]
তিনি আরো বলেন,أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ فَمَنْ عَمِلَ لِى عَمَلاً أَشْرَكَ فِيْهِ غَيْرِى فَأَنَا مِنْهُ بَرِىءٌ وَهُوَ لِلَّذِى أَشْرَكَ، ‘আমি শিরককারীদের শিরক থেকে মুক্ত। যে ব্যক্তি আমার জন্য কোন আমল করল এবং তাতে শরীক করল, আমি এ শিরক থেকে মুক্ত। আর তা হবে ঐ ব্যক্তির জন্য, যার সাথে সে শরীক করল’।[14] অন্য একটি হাদীছে এসেছে,
عَنْ مَحْمُودِ بْنِ لَبِيدٍ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ. قَالُوا وَمَا الشِّرْكُ الأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ الرِّيَاءُ يَقُولُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا جُزِىَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِى الدُّنْيَا فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً.
‘মাহমূদ ইবনু লাবীদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য যে ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা বেশী আশঙ্কা করছি তাহ’ল ছোট শিরক। লোকেরা (ছাহাবীগণ) প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ছোট শিরক কি? তিনি বললেন, লোক দেখানো আমল। আমলের বিনিময় প্রদানের দিন আল্লাহ ঐ সকল লোকেদেরকে বলবেন, তোমরা সেই সমস্ত লোকদের কাছে যাও, যাদেরকে দেখিয়ে দুনিয়াতে তোমরা আমল করেছিলে। আর লক্ষ্য করো তাদের নিকট থেকে কোন বিনিময় পাও কি-না’?[15]
ছোট শিরক বা গোপন শিরকের উদাহরণ হাদীছে এভাবে এসেছে,
عَنْ مَحْمُودِ بْنِ لَبِيدٍ، قَالَ خَرَجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ أَيُّهَا النَّاسُ إِيَّاكُمْ وَشِرْكَ السَّرَائِرِ قَالُوا : يَا رَسُولَ اللهِ، وَمَا شِرْكُ السَّرَائِرِ؟ قَالَ : يَقُومُ الرَّجُلُ فَيُصَلِّي فَيُزَيِّنُ صَلاَتَهُ جَاهِدًا لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ النَّاسِ إِلَيْهِ، فَذَلِكَ شِرْكُ السَّرَائِرِ.
‘মাহমূদ বিন লাবীদ (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) (একদা স্বগৃহ হ’তে) বের হয়ে বললেন, হে মানবমন্ডলী! তোমরা গুপ্ত শিরক হ’তে সাবধান হও। তারা (ছাহাবীগণ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! গুপ্ত শিরক কি? তিনি বললেন, মানুষ ছালাতে দাঁড়িয়ে তার ছালাতকে সুশোভিত করে, যাতে লোকেরা তার প্রতি লক্ষ্য করে দেখে। এটাই (লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় করা) হ’ল গুপ্ত শিরক’।[16]
পক্ষান্তরে ইখলাছ যথার্থ হ’লে আমল না করেও ছওয়াব বা প্রতিদান পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে হাদীছে এসেছে,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رضى الله عنهما عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فِيمَا يَرْوِى عَنْ رَبِّهِ عَزَّ وَجَلَّ قَالَ قَالَ إِنَّ اللهَ كَتَبَ الْحَسَنَاتِ وَالسَّيِّئَاتِ، ثُمَّ بَيَّنَ ذَلِكَ فَمَنْ هَمَّ بِحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللهُ لَهُ عِنْدَهُ حَسَنَةً كَامِلَةً، فَإِنْ هُوَ هَمَّ بِهَا فَعَمِلَهَا كَتَبَهَا اللهُ لَهُ عِنْدَهُ عَشْرَ حَسَنَاتٍ إِلَى سَبْعِمِائَةِ ضِعْفٍ إِلَى أَضْعَافٍ كَثِيرَةٍ، وَمَنْ هَمَّ بِسَيِّئَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللهُ لَهُ عِنْدَهُ حَسَنَةً كَامِلَةً، فَإِنْ هُوَ هَمَّ بِهَا فَعَمِلَهَا كَتَبَهَا اللهُ لَهُ سَيِّئَةً وَاحِدَةً.
‘ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) তাঁর প্রতিপালক হ’তে বর্ণনা করে বলেন (হাদীছে কুদসী), আল্লাহ নেকী ও গোনাহ লিখে দেন। এরপর সেগুলোর বর্ণনা দেন। সুতরাং যে ব্যক্তি কোন সৎ কাজের ইচ্ছা করল, কিন্তু তা বাস্তবায়ন করল না, আল্লাহ তার জন্য একটি পূর্ণ নেকী লিখবেন। আর যে ভাল কাজের ইচ্ছা করল এবং তা বাস্তবায়নও করল তবে আল্লাহ তার জন্য দশ গুণ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত এমনকি এর চেয়েও অধিক নেকী লিখে দেন। আর যে ব্যক্তি কোন মন্দ কাজের ইচ্ছা করল, কিন্তু তা বাস্তবায়ন করল না, আল্লাহ তাঁর কাছে তার জন্য পূর্ণ নেকী লিখবেন। আর যদি সে মন্দ কাজের ইচ্ছা করার পর তা বাস্তবায়ন করে, তবে তার জন্য আল্লাহ মাত্র একটা গুনাহ লিখেন’।[17]
ইখলাছের কারণে জিহাদ না করেও জিহাদের ছওয়াব পাওয়া যায়। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) বর্ণিত, তিনি বলেন,كُنَّا مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فِى غَزَاةٍ فَقَالَ إِنَّ بِالْمَدِينَةِ لَرِجَالاً مَا سِرْتُمْ مَسِيرًا وَلاَ قَطَعْتُمْ وَادِيًا إِلاَّ كَانُوا مَعَكُمْ حَبَسَهُمُ الْمَرَضُ. ‘আমরা নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে এক যুদ্ধে ছিলাম। তখন তিনি বললেন, মদীনাতে কিছু লোক এমন আছে যে, তোমরা যত সফর করছ এবং যে কোন উপত্যকা অতিক্রম করছ, তারা তোমাদের সঙ্গে আছেন। অসুস্থতা তাদেরকে অাঁটকে রেখেছে’।[18] আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ فِى غَزَاةٍ فَقَالَ إِنَّ أَقْوَامًا بِالْمَدِينَةِ خَلْفَنَا، مَا سَلَكْنَا شِعْبًا وَلاَ وَادِيًا إِلاَّ وَهُمْ مَعَنَا فِيهِ، حَبَسَهُمُ الْعُذْرُ. ‘নবী করীম (ছাঃ) এক যুদ্ধে ছিলেন, তখন তিনি বললেন, কিছু লোক মদীনায় আমাদের পেছনে রয়েছে। আমরা যে কোন ঘাঁটি বা উপত্যকা অতিক্রম করি না কেন তারা আমাদের সঙ্গেই আছেন। ওযরই তাদের অাঁটকে রেখেছে’।[19]
ইখলাছপূর্ণ ইবাদতের কারণে পরকালে মুক্তি পাওয়া যাবে। এ প্রসঙ্গে, আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,يَغْزُو جَيْشٌ الْكَعْبَةَ، فَإِذَا كَانُوا بِبَيْدَاءَ مِنَ الأَرْضِ يُخْسَفُ بِأَوَّلِهِمْ وَآخِرِهِمْ. قَالَتْ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ كَيْفَ يُخْسَفُ بِأَوَّلِهِمْ وَآخِرِهِمْ، وَفِيهِمْ أَسْوَاقُهُمْ وَمَنْ لَيْسَ مِنْهُمْ. قَالَ يُخْسَفُ بِأَوَّلِهِمْ وَآخِرِهِمْ، ثُمَّ يُبْعَثُونَ عَلَى نِيَّاتِهِمْ. ‘একদল সৈন্য কা‘বা (ধ্বংসের উদ্দেশ্যে) অভিযান চালাবে। যখন তারা বায়দা নামক স্থানে পৌঁছবে তখন তাদের আগের পিছের সকলকে যমীনে ধ্বসিয়ে দেয়া হবে। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তাদের অগ্রবাহিনী ও পশ্চাৎবাহিনী সকলকে কিভাবে ধ্বসিয়ে দেয়া হবে, অথচ সেনাবাহিনীতে তাদের বাযারের (পণ্য-সামগ্রী বহনকারী) লোকও থাকবে এবং এমন লোকও থাকবে যারা তাদের দলভুক্ত নয়। তিনি বললেন, তাদের আগের পিছের সকলকে ধ্বসিয়ে দেয়া হবে। তারপরে (ক্বিয়ামতের দিন) তাদের নিয়ত অনুযায়ী উঠানো হবে’।[20]
ইখলাছপূর্ণ আমলের কারণে দুনিয়াবী জীবনেও বড় বড় বিপদ-মুছীবত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তোমাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে তিন ব্যক্তি সফরে বের হয়ে তারা রাত কাটাবার জন্য একটি গুহায় আশ্রয় নেয়। হঠাৎ পাহাড় হ’তে এক খন্ড পাথর পড়ে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। তখন তারা নিজেদের মধ্যে বলতে লাগল, তোমাদের সৎকর্মের অসীলায় আল্লাহর কাছে দো‘আ করা ছাড়া আর কোন কিছুই এ পাথর হ’তে তোমাদেরকে মুক্ত করতে পারবে না। তখন তাদের মধ্যে একজন বলতে লাগল, হে আল্লাহ! আমার পিতা-মাতা খুব বৃদ্ধ ছিলেন। আমি কখনো তাদের আগে আমার পরিবার-পরিজনকে কিংবা দাস-দাসীকে দুধ পান করাতাম না। একদিন কোন একটি জিনিসের তালাশে আমাকে অনেক দূরে চলে যেতে হয়। কাজেই আমি তাঁদের ঘুমিয়ে পড়ার পূর্বে ফিরতে পারলাম না। আমি তাঁদের জন্য দুধ দোহন করে নিয়ে এলাম। কিন্তু তাঁদেরকে ঘুমন্ত পেলাম। তাদের আগে আমার পরিবার-পরিজন ও দাস-দাসীকে দুধ পান করতে দেওয়াটাও আমি পসন্দ করলাম না। তাই আমি তাঁদের জেগে উঠার অপেক্ষায় পেয়ালাটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এভাবে ভোরের আলো ফুটে উঠল। তারপর তাঁরা জাগলেন এবং দুধ পান করলেন। হে আল্লাহ! যদি আমি তোমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এ কাজ করে থাকি, তবে এ পাথরের কারণে আমরা যে বিপদে পড়েছি, তা আমাদের হ’তে দূর করে দাও। ফলে পাথর সামান্য সরে গেল, কিন্তু তাতে তারা বের হ’তে পারল না।
নবী করীম (ছাঃ) বলেন, তারপর দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমার এক চাচাতো বোন ছিল। সে আমার খুব প্রিয় ছিল। আমি তার সাথে সঙ্গত হ’তে চাইলাম। কিন্তু সে বাধা দিল। তারপর এক বছর ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সে আমার কাছে (সাহায্যের জন্য) এল। আমি তাকে একশ’ বিশ দীনার এ শর্তে দিলাম যে, সে আমার সাথে একান্তে মিলিত হবে। তাতে সে রাযী হ’ল। আমি যখন সম্পূর্ণ সুযোগ লাভ করলাম, তখন সে বলল, আমি তোমাকে অবৈধভাবে মোহর ভাঙ্গার অনুমতি দিতে পারি না। ফলে সে আমার সর্বাধিক প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও আমি তার সাথে সঙ্গত হওয়া পাপ মনে করে তার কাছ হ’তে ফিরে আসলাম এবং আমি তাকে যে স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছিলাম, তাও ছেড়ে দিলাম। হে আল্লাহ! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য করে থাকি, তবে আমরা যে বিপদে পড়ে আছি তা দূর কর। তখন সেই পাথরটি (আরো একটু) সরে পড়ল। কিন্তু তাতে তারা বের হ’তে পারছিল না।
নবী করীম (ছাঃ) বলেন, তারপর তৃতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমি কয়েকজন মজুর নিয়োগ করেছিলাম এবং আমি তাদেরকে তাদের মজুরীও দিয়েছিলাম। কিন্তু একজন লোক তার প্রাপ্য না নিয়ে চলে গেল। আমি তার মজুরীর টাকা কাজে খাটিয়ে তা বাড়াতে লাগলাম। তাতে প্রচুর ধন-সম্পদ অর্জিত হ’ল। কিন্তু কিছুকাল পর সে আমার নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আমাকে আমার মজুরী দিয়ে দাও। আমি তাকে বললাম, এসব উট, গরু, ছাগল ও গোলাম যা তুমি দেখতে পাচ্ছ, তা সবই তোমার মজুরী। সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! তুমি আমার সাথে বিদ্রূপ করো না। তখন আমি বললাম, আমি তোমার সাথে মোটেই বিদ্রূপ করছি না। তখন সে সবই গ্রহণ করল এবং নিয়ে চলে গেল। তা হ’তে একটাও ছেড়ে গেল না। হে আল্লাহ! আমি যদি তোমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য এ কাজ করে থাকি, তবে আমরা যে বিপদে পড়েছি, তা দূর কর। তখন সে পাথরটি সম্পূর্ণ সরে পড়ল। তারপর তারা বেরিয়ে এসে পথ চলতে লাগল’।[21]
পক্ষান্তরে ইবাদতে ইখলাছ না থাকলে পরকালে শাস্তি পেতে হবে ও জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হ’তে হবে। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘নিশ্চয়ই সর্বপ্রথম ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন যার ফায়ছালা করা হবে, সে ব্যক্তি যে শহীদ হয়েছিল। তাকে আনা হবে, অতঃপর তাকে তাঁর (আল্লাহর) নে‘মতরাজি জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে। তিনি বলবেন, তুমি এর বিনিময়ে কি আমল করেছ? সে বলবে, আপনার জন্য জিহাদ করে এমনকি শহীদ হয়েছি। তিনি বলবেন, মিথ্যা বলেছ, তবে তুমি এজন্য জিহাদ করেছ যেন তোমাকে বীর বলা হয়, অতএব তোমাকে তা বলা হয়েছে। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হবে, তাকে তার চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর। তাকে তাই করা হবে। আরও এক ব্যক্তি যে ইলম শিখেছে, শিক্ষা দিয়েছে ও কুরআন তিলাওয়াত করেছে। তাকে আনা হবে। অতঃপর তাকে তাঁর নে‘মতরাজি জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে। তিনি বলবেন, তুমি এর বিনিময়ে কি আমল করেছ? সে বলবে, আমি ইলম শিখেছি, শিক্ষা দিয়েছি ও আপনার জন্য কুরআন তিলাওয়াত করেছি। তিনি বলবেন, মিথ্যা বলেছ। তবে তুমি ইলম শিক্ষা করেছ যেন বলা হয়, সে আলেম; কুরআন তিলাওয়াত করেছ যেন বলা হয়, সে ক্বারী। অতএব তা বলা হয়েছে। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হবে যে, তাকে চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার, তাকে তাই করা হবে। আরও এক ব্যক্তি যাকে আল্লাহ সচ্ছলতা দিয়েছেন ও সকল প্রকার সম্পদ দান করেছেন, তাকে আনা হবে। তাকে তাঁর নে‘মতরাজি জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে। তিনি বলবেন, তুমি এর বিনিময়ে কি আমল করেছ? সে বলবে, এমন খাত নেই যেখানে খরচ করা আপনি পসন্দ করেন, আমি তাতে আপনার জন্য খরচ করিনি। তিনি বলবেন, মিথ্যা বলেছ। তুমি তো খরচ করেছ যেন বলা হয়, সে দানশীল। অতএব তা বলা হয়েছে। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হবে, তাকে তার চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[22]
অতএব উপরোক্ত তিনটি শর্ত ব্যতীত ইবাদত কবুল হবে না। আক্বীদা সঠিক হওয়া ইবাদতের অস্তিত্বের জন্য শর্ত। ইখলাছ বা নিয়ত সঠিক হওয়া এবং ইবাদত সুন্নাত অনুযায়ী সম্পন্ন হওয়া ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য আবশ্যিক পূর্বশর্ত। অতএব ইবাদত কবুল হওয়ার আশা করা যাবে, যদি ঐ তিনটি শর্ত একত্রে পাওয়া যায়। আর এসব ব্যতিরেকে ইবাদত কবুলের আশা করা নির্বুদ্ধিতা মাত্র। এমনকি নিয়তের বিশুদ্ধতা তথা ইখলাছের তারতম্যে ইবাদত ছোট অথবা বড় শিরকে পরিণত হয়ে যায়। ইবাদতের উদ্দেশ্য যদি গায়রুল্লাহ হয়, তাহ’লে তা হবে শিরক। ইবাদতে যদি রিয়া বা লোক দেখানো ভাবনা চলে আসে, তাহ’লে ঐ ইবাদত ছোট শিরকে পরিণত হয়ে যায়। আর নিয়তের বিশুদ্ধতা থাকার পরও যদি আমল সুন্নাত মোতাবিক না হয়, তাহ’লে তা হবে বিদ‘আত ও শরী‘আতে নবাবিষ্কৃত কাজ, যার পরিণাম ভ্রষ্টতা। এটা নিঃসন্দেহে প্রত্যাখ্যাত। আর কোন কাজ ইখলাছ এবং সুন্নাতে রাসূলের অনুসরণ ছাড়া কবুল হয় না।
এজন্য ফুযাইল ইবনু আয়ায আল্লাহর বাণী, لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا ‘তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য, কে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সুন্দর আমল করে’? (মুলক ৬৭/২) এর তাফসীরে বলেন, ‘সেটা হচ্ছে আমলে একনিষ্ঠতা ও যথার্থতা। তারা বলল, হে আবু আলী! আমলের একনিষ্ঠতা ও যথার্থতা কি? উত্তরে তিনি বলেন, যখন আমল ইখলাছপূর্ণ হবে কিন্তু সঠিকভাবে আদায় করা হয় না, তা কবুল হবে না। আবার সঠিকভাবে আদায় হ’লেও একনিষ্ঠ না হ’লে তাও কবুল হবে না যতক্ষণ তা ইখলাছপূর্ণ ও বিশুদ্ধ না হয়। ইখলাছ হচ্ছে কেবল মাত্র আল্লাহর জন্য ইবাদত হওয়া। আর বিশুদ্ধতা হচ্ছে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী ইবাদত সম্পন্ন হওয়া। অতঃপর তিনি আল্লাহর বাণী পাঠ করেন। (অর্থ) ‘যে তার প্রভুর সাথে সাক্ষাতের আশা করে সে যেন নেক আমল করে এবং তার প্রভুর ইবাদতে কাউকে শরীক না করে’ (কাহফ ১৮/১১০)।[23] (ক্রমশঃ)
[1]. বুখারী হা/২৬৯৭; মিশকাত হা/১৪০।
[2]. বুখারী তরজমাতুল বাব-২০; মুসলিম হা/১৭১৮।
[3]. আবূদাঊদ হা/৪৬০৭; মিশকাত হা/১৬৫; ছহীহুল জামে‘ হা/২৫৪৯।
[4]. বুখারী হা/৭২৮০; মিশকাত হা/১৪৩।
[5]. বুখারী হা/১৮৭০; মুসলিম হা/১৩৬৬।
[6]. বুখারী হা/৬৫৮৩; মুসলিম হা/২২৯৬; মিশকাত হা/৫৫৭১।
[7]. নাসাঈ হা/১৫৭৮; ইবনু মাজাহ হা/৪৫; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৭৮৫।
[8]. বুখারী হা/১, ৬৬৮৯; মুসলিম হা/১৯০৭; মিশকাত হা/১।
[9]. ইবনু রজব হাম্বলী, জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪০৮ হিঃ), পৃঃ ৫৯।
[10]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৬/১০৩ পৃঃ।
[11]. মুসলিম হা/৪৬৫১; মিশকাত হা/৫৩১৪।
[12]. মুসলিম হা/১৯০৪; ইবনু মাজাহ হা/২৭৮৩; তিরমিযী হা/১৬৪৬।
[13]. মুসলিম হা/২৯৫৮; মিশকাত হা/৫৩১৫।
[14]. ইবনু মাজাহ হা/৪২০২; ছহীহুত তারগীব হা/৩৪।
[15]. আহমাদ হা/২৩৬৮৬; মিশকাত হা/৫৩৩৪; ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৩২; ছহীহাহ হা/৯৫১।
[16]. বায়হাক্বী হা/৩৪০০; ইবনে খুযাইমা হা/৯৩৭; ছহীহুত তারগীব হা/৩১।
[17]. বুখারী হা/৬৪৯১; মুসলিম হা/১৩১; মিশকাত হা/২৩৭৪।
[18]. মুসলিম হা/১৯১১।
[19]. বুখারী হা/২৮৩৯; ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/১২।
[20]. বুখারী হা/২১১৮; মুসলিম হা/২৮৮৩।
[21]. বুখারী হা/২২১৫, ২২৭২; মুসলিম হা/২৭৪৩।
[22]. মুসলিম হা/১৯০৫; ছহীহুল জামে‘ হা/২০১৪।
[23]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন ২/৯৩; তাফসীরে বাগাভী ৫/১২৪।