রাসূল (ছাঃ)-কে আল্লাহ রাববুল আলামীন মানবজাতির জন্য ‘উসওয়াহ হাসানাহ’ বা সর্বোত্তম আদর্শ হিসাবে প্রেরণ করেছিলেন (আহযাব ৩৩/২১)। মানবজীবনের এমন কোন দিক ও বিভাগ নেই যে সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ)-এর দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায় না। মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে সুস্পষ্ট পথ দেখিয়েছেন রাসূল (ছাঃ)। এজন্য তাঁর জীবনাদর্শ সর্বকালে সর্বদেশে অনুসরণীয়। তাঁর আনীত কুরআন যেমন আমাদের জন্য হেদায়াতের ধ্রুবতারা, তেমনি তাঁর কথা, কাজ ও সমর্থনের সমন্বয়ে গঠিত সুন্নাহ এক চির দেদীপ্যমান আলোকবর্তিকা। তাই হাদীছ ব্যতীত ইসলামী জীবনব্যবস্থা অকল্পনীয়।

মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় ও সামাজিক বিকাশের মৌলিক সূত্র হ’ল দু’টি। (ক) আল-কুরআন। (খ) রাসূল (ছাঃ)-এর ব্যক্তিত্ব, জীবনী ও আচার-ব্যবহার এবং তাঁর শিক্ষা, পথনির্দেশিকা ও কর্মপদ্ধতি। যাকে সমন্বিতভাবে সুন্নাহ বলা হয় এবং তা সংরক্ষিত হয়েছে হাদীছে। এগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় আল্লাহ রাববুল আলামীন এই উৎসদ্বয়ের মাধ্যমে মানবজাতির জন্য সুচারুরূপে পার্থিব জীবন পরিচালনার যাবতীয় পথনির্দেশনা দিয়েছেন। যা কুরআনের মাধ্যমে এসেছে সংক্ষিপ্তাকারে এবং সুন্নাহর মাধ্যমে এসেছে বিস্তারিত ও ব্যবহারিক আকারে। নিম্নে মানুষের সামগ্রিক জীবনে হাদীছের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হ’ল।-

(১) মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণে হাদীছ :

ইসলামী শরী‘আতের সকল বিধি-বিধান মানবজীবনের নানাবিধ প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে প্রণীত হয়েছে। বিদ্বানগণ এগুলোকে কিছু ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন -

ক. আবশ্যিক প্রয়োজন (الضروريات) : যা ব্যতীত মানুষের জীবনধারণ অসম্ভব। যেমন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি।

খ. সাধারণ প্রয়োজন (الحاجيات) : যা ব্যতীত জীবন ধারণ কষ্টকর। যেমন চলার বাহন, জীবিকার জন্য পেশা গ্রহণ ইত্যাদি।

গ. কল্যাণসাধন (التحسينيات) : যা জীবন ধারণের জন্য আবশ্যকীয় নয়, তবে জীবনকে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যময় ও উপভোগ্য করে তোলে। যেমন ভালো খানাপিনা করা, মূল্যবান কাপড় পরিধান করা ইত্যাদি।

সাধারণভাবে যদি আমরা হাদীছ তথা সুন্নাহর প্রতি লক্ষ্য করি, তাহ’লে দেখব মানবজীবনের এ সকল মৌলিক প্রয়োজনের দিকসমূহে গভীরভাবে আলোকপাত করেছে। কুরআনে এ বিষয়গুলি মূলনীতি আকারে এসেছে আর তা সুন্নায় এসেছে বিস্তারিতভাবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা সহকারে। মানবজীবন সুরক্ষায় আবশ্যিক যে পাঁচটি প্রয়োজন (দ্বীনের হেফাযত, জীবনের হেফাযত, সম্মানের হেফাযত, সম্পদের হেফাযত এবং জ্ঞান-বিবেকের হেফাযত) ইসলামী শরী‘আতে নির্ধারিত হয়েছে, তা যেমন কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, তেমনি হাদীছেও বিস্তারিত এসেছে। যেমন :

ক. দ্বীনের হেফাযত : এটি তিনভাবে তথা ইসলাম, ঈমান এবং ইহসানের হেফাযতের মাধ্যমে অর্জিত হয়। অর্থাৎ মানুষের আক্বীদা-বিশ্বাস কি হবে, জীবনের মৌলিক লক্ষ্য কি হবে, কিভাবে আমলের মাধ্যমে সে লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন করবে সে ব্যাপারে কুরআনে যেমন সুস্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে, তেমনি হাদীছেও তার প্রকৃতি ও স্বরূপ সবিস্তার বর্ণিত হয়েছে।

খ. জীবনের হেফাযত : এরও তিনটি অর্থ রয়েছে। যেমন পরিবার পরিচালনা, মানববংশ বিস্তারের জন্য জৈবিক প্রয়োজনের স্বীকৃতি; জীবনধারণের জন্য খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র প্রভৃতির সংস্থান এবং জীবনকে অপরের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ব্যবস্থাগ্রহণ। এ সকল অধিকার হেফাযতের লক্ষ্যে কুরআনে যেমন দিকনির্দেশনা এসেছে, তেমনি হাদীছে বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। যেমন মানুষকে যেনার হারাম পদক্ষেপ থেকে বাঁচাতে বিবাহের হালাল বিধান প্রদান করেছে এবং বিবাহসংক্রান্ত অতিরিক্ত বিধি-বিধান যেমন তালাক, খোলা‘, লি‘আন প্রভৃতি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। অনুরূপ হালাল ও পবিত্র খাবার গ্রহণ করা এবং তা সংগ্রহের জন্য চাষাবাদ, যবেহ ও শিকারের নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। তেমনিভাবে মানুষের জীবন অন্যায়ভাবে হরণ করা থেকে বিরত রাখতে হদ ও ক্বিছাছের বিধান রেখেছে, জিহাদের বিধান রেখেছে।

অনুরূপভাবে মানুষের ধন-সম্পদ কিভাবে সংরক্ষিত হবে, কিভাবে আয়-ব্যয় করতে হবে, কিভাবে অন্যায় পথে সম্পদ উপার্জনকারীকে প্রতিরোধ করতে হবে এবং কিভাবে মানুষের সম্মান-মর্যাদা ও জ্ঞান-বিবেককে সংরক্ষণ করতে হবে সে সকল বিধানও হাদীছে বিস্তারিত এবং পুংখানুপুংখভাবে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং কুরআনের সাথে সাথে হাদীছেও যদি এ সকল বিধান বিস্তারিতভাবে বর্ণিত না হ’ত, তাহ’লে আমরা এ সকল বিষয়ে মহান আল্লাহর দিক-নির্দেশনা সঠিকভাবে জানতে পারতাম না এবং তা বাস্তবায়ন পদ্ধতিও খুঁজে পেতাম না।[1]

(২) সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনে হাদীছ :

ইসলামী শরী‘আতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হ’ল রাষ্ট্রপরিচালনা নীতি। ইবনুল ক্বাইয়িম (৭৫১হি.) বলেন, ‘ইসলামী শরী‘আত সর্বোচ্চ ন্যায়বিচারের প্রতিভূ। এই ন্যায়বিচারের ঊর্ধ্বে আর কোন ন্যায়বিচার নেই। এতে অন্তর্নিহিত কল্যাণের চেয়ে বড় কল্যাণ আর নেই। আর ন্যায়বিচারপূর্ণ রাজনীতি এর একটি অংশ এবং শাখা। রাজনীতিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। অত্যাচারমূলক রাজনীতি, যা ইসলামী শরী‘আত হারাম করেছে এবং ন্যায়বিচারপূর্ণ রাজনীতি, যা নিজেই হ’ল ইসলামী শরী‘আত’।[2]

ইসলাম কেবল কিছুমাত্র ইবাদত ও আচারসমষ্টির নাম নয়; বরং তা মানবজীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নে‘মতরাজি পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে মনোনীত করে সন্তুষ্ট হ’লাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। এর মধ্যে রাষ্ট্রনীতিও অন্তর্ভুক্ত।

এজন্য কুরআনে যেমন আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করা হয়েছে, তেমনি রাসূল (ছাঃ) থেকে এই সার্বভৌমত্বের স্বরূপ ও তা প্রতিষ্ঠার উপায়, কিভাবে রাষ্ট্রের দু’টি প্রধান অঙ্গ আইন ও বিচার ব্যবস্থা পরিচালিত হবে, কে নেতা হবে ও তার পদ্ধতি কি হবে, কিভাবে রাজা ও প্রজা পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে ইত্যাদি রাষ্ট্র পরিচালনার খুঁটিনাটি নীতিমালা সম্পর্কে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (ছাঃ) নিজেই ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক, সেনাপতি ও বিচারক।[3] হাদীছ গ্রন্থসমূহে ‘কিতাবুল ইমারাত (নেতৃত্ব), কিতাবুল আহকাম (আইন-কানূন), কিতাবুল হুদূদ (দন্ডবিধি) প্রভৃতি স্বতন্ত্র অধ্যায়ই রচিত হয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনা, আইন ও বিচার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। এ সকল দিক-নির্দেশনা না জানলে ফক্বীহদের নিকট একজন শাসক ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য উপযুক্তই গণ্য হন না।[4] সুতরাং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং মানুষে মানুষে পরস্পরের অধিকার ও দায়িত্ব-কর্তব্যের স্বরূপ জানার জন্য কুরআনের সাথে সাথে হাদীছ বা সুন্নাহর শরণাপণ্ণ হওয়া অত্যাবশ্যক।

ইবনুল ক্বাইয়িম (৭৫১হি.) বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর কিতাব প্রেরণ করেছেন এবং তাঁর রাসূলদের প্রেরণ করেছেন মানুষের উপর ন্যায়বিচার কায়েম করার জন্য। এই ন্যায়বিচার দন্ডের উপর দাঁড়িয়ে আছে সমগ্র আসমান ও যমীন। কোথাও ন্যায়বিচারের নিদর্শন ফুটে উঠলে এবং যে কোন উপায়ে তার অবয়ব পরিস্ফুট হ’লে, সেটাই আল্লাহর শরী‘আত, সেটাই আল্লাহর দ্বীনের নিদর্শন। বরং আল্লাহ তাঁর বিভিন্ন উপায়ে তাঁর শারঈ নির্দেশনার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন যে, এর মাধ্যমে তাঁর উদ্দেশ্য হ’ল- তাঁর বান্দাদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করা এবং মানুষকে ন্যায়নিষ্ঠ করা। সুতরাং যে পথেই ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন, তা দ্বীনেরই অংশবিশেষ, দ্বীনের বিরোধী নয়। সুতরাং এটা বলা যাবে না যে, ন্যায়বিচারপূর্ণ রাজনীতি শরী‘আতের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক; বরং তা শরী‘আতের আনীত বিধান কর্তৃক অনুমোদিত কিংবা স্বয়ং শরী‘আতেরই অংশ। আমরা সেটাকে আমাদের পরিভাষায় বলি রাজনীতি। তবে সেটা মূলতঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল প্রতিষ্ঠিত ন্যায়বিচার ব্যবস্থার নাম’।[5]

(৩) জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশে হাদীছ :

সুন্নাহ হ’ল মানবজাতির বিশুদ্ধতম জ্ঞানের দ্বিতীয় প্রধান উৎস। কেবল শারঈ জ্ঞানই নয়, বরং মানবিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা দিক ও বিভাগ সম্পর্কে রয়েছে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহর বিশাল ভান্ডার।[6] সুন্নাহ আমাদের জানিয়ে দিয়েছে কোন জ্ঞান উপকারী আর কোন জ্ঞান উপকারী নয়। সর্বোপরি জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে যেমন উৎসাহিত করেছে এবং জ্ঞানার্জনের পথ ও পদ্ধতিও বর্ণনা করে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ :

ক. শারঈ জ্ঞান : যেহেতু ইসলামী শরী‘আতের দ্বিতীয় উৎস হ’ল হাদীছ, সেহেতু শারঈ যে কোন ইলম অর্জন করা হাদীছ ব্যতীত সম্ভব নয়। যেমন ইলমুল আক্বীদাহ, উলূমুল কুরআন, ফিক্বহ ও উছূলুল ফিক্বহ প্রভৃতি। সুতরাং কুরআনকে যদি ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের হৃদপিন্ড হিসাবে তুলনা করা হয়, তবে হাদীছ তার চলমান ধমনী। এ ধমনী ইসলামী জ্ঞানের সুবিশাল পরিমন্ডলে তপ্ত তাজা শোণিতধারা প্রবাহিত করে এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সতেজ, সক্রিয় ও সচল রেখেছে।[7]

খ. মানবিক জ্ঞান : মানুষের দুনিয়াবী জীবন পরিচালনার জন্য যে সকল জ্ঞান অপরিহার্য সে সম্পর্কে সাযুজ্যপূর্ণ ও সুসমন্বিত জ্ঞানের পথ প্রদর্শন করেছে সুন্নাহ। যেমন :

নৈতিক শিক্ষা : যার মাধ্যমে একজন মানুষকে কিভাবে ছোট থেকে নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হয় এবং জীবনের বিভিন্ন স্তরে নৈতিকতার চর্চা করতে হয়, তা সবিস্তারে বিবৃত হয়েছে সুন্নাহর মধ্যে। হাদীছের গ্রন্থগুলোতে ‘আদব-আখলাক’ অধ্যায়টি প্রায় অপরিহার্য অংশ। এছাড়া ‘রিয়াযুছ ছালেহীন’সহ বিভিন্ন বিখ্যাত হাদীছগ্রন্থ সংকলিত হয়েছে কেবল আদব-আখলাকের উপরই।

ইতিহাস : ঐতিহাসিক বর্ণনাতেও সুন্নাহর গুরুত্ব অপরিসীম, যা আরবজাতির প্রাচীন ইতিহাস এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সমসাময়িক সমস্ত ঘটনাবলীর এক অতি মূল্যবান দলীল।

অর্থনীতি : মানুষের অর্থনৈতিক কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হবে, কিভাবে উৎপাদন ও বাজারজাত করতে হবে, কিভাবে সম্পদের বণ্টন হবে এবং অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়নে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে - প্রভৃতি বিষয়ে আনুপুংখ বিবরণ পাই আমরা সুন্নাহর মধ্যে। হাদীছ গ্রন্থ সমূহে ‘যাকাত’, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য’ ও ‘উত্তরাধিকার সম্পত্তি’ প্রভৃতি শিরোনামে পৃথক পৃথক অধ্যায় রচিত হয়েছে।

গ. বস্ত্তবিজ্ঞান : সুন্নাহ বস্ত্তবিজ্ঞান সম্পর্কেও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছে। বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে এত বেশী সংখ্যক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে যে হাদীছ গ্রন্থসমূহে ‘কিতাবুব তিবব’ বা চিকিৎসা অধ্যায় রচিত হয়েছে। এছাড়া ‘আত-তিববুন নববী’ বা রাসূল (ছাঃ)-এর চিকিৎসা শিরোনামেও অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে।[8] এতে যেমন প্রতিষেধক ও ভেষজ চিকিৎসা রয়েছে তেমনি রয়েছে মানসিক চিকিৎসাও। এছাড়াও হাদীছে পদার্থ, মহাকাশবিদ্যা, ভূতত্ত্ববিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, জিনতত্ত্ব প্রভৃতি সম্পর্কেও দিক- নির্দেশনা পাওয়া যায়। রাবেতা আলমে ইসলামীর অধীনস্ত সংস্থা الهيئة التأسيسية للإعجاز العلمي في القران والسنة[9] অন্ততঃ ১৭৪৪টি হাদীছ একত্রিত করেছে, যা বিভিন্নভাবে সৃষ্টিসংক্রান্ত এবং চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত তথ্য বহন করে।[10]

(৪)মুসলিমসভ্যতা বিকাশে হাদীছ :

রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শ যে বিগত প্রায় পনের শত বছর পরও মানব সমাজে অদ্যাবধি জীবন্ত রয়েছে। তার পেছনে অন্যতম বড় অবদান হ’ল হাদীছের। যদি হাদীছ সংরক্ষিত না থাকত, রাসূল (ছাঃ)-এর চলার পথ আমাদের সামনে সমুজ্জ্বল না থাকত, তাহ’লে শত শত বছর ধরে ইসলামী সভ্যতার যে মহান চিত্তাকর্ষক ঐতিহ্য নির্মিত হয়েছে, তা কখনই অস্তিত্ববান হ’তে পারত না। যদি হাদীছ না থাকত তবে মুসলিম সমাজ একটি আদর্শ ও নিয়ন্ত্রিত জীবনব্যবস্থার অধীনস্ত হ’তে পারত না। যদি হাদীছ না থাকত তাহ’লে প্রত্যেক যুগে, প্রত্যেক শহরে এত এত বিদ্বান ও সংস্কারকের জন্ম হ’ত না। সমাজকে সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করার জন্য সংস্কারধর্মী মানদন্ডের অস্তিত্ব থাকত না। হক্ব-বাতিল, ভাল-মন্দকে পৃথক করার কোন স্থায়ী নীতিমালা থাকত না। হাদীছের কারণে মুসলিম উম্মাহ পুরোপুরি আদর্শের ভিত্তিতে মানব সমাজ গড়ে তোলার প্রেরণা লাভ করেছে। এ পৃথিবীকে তারা উপহার দিতে সক্ষম হয়েছে উত্তম চরিত্র এবং মানবতাবোধের অসংখ্য হিরণ্ময় নযীর। কুরআন যদি হয় তাত্ত্বিক প্রেরণা, হাদীছ হ’ল তার ব্যবহারিক প্রেরণা। এই দ্বিবিধ প্রেরণার সমন্বয়েই সম্ভব হয়েছে এক নতুন সভ্যতার বিনির্মাণ, যার তুলনীয় নযীর পৃথিবীর ইতিহাসে কখনও ছিল না এবং আগামীতেও হবে না। আল্লাহ বলেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (আহযাব ৩৩/২১)

আবুল হাসান আলী আন-নাদভী (১৯৯৯খ্রি.) বলেন, ‘হাদীছের গ্রন্থসমূহ মুসলিম উম্মাহর সংস্কার, রেনেসাঁ এবং সেই সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক শুদ্ধতার অন্যতম উৎস হয়ে রয়েছে। যুগে যুগে সংস্কারকরা এই উৎস থেকে দ্বীনের শুদ্ধ ও স্বচ্ছ জ্ঞান আহরণ করেছেন। তাঁরা এ সকল হাদীছকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করেছেন। একে দ্বীনের পথে ও সংস্কারের ময়দানে মানুষকে আহবানের সূত্র হিসাবে ধারণ করেছেন এবং তাঁরা যাবতীয় অনাচার-দুরাচার ও নবসৃষ্ট বিষয়াদির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন এর মাধ্যমে। প্রত্যেক যুগে যারা মুসলিম সমাজকে পরিপূর্ণ ইসলামের দিকে এবং সঠিক দ্বীনের দিকে আহবান করতে চায়, যারা নিজেদের মধ্যে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর পরিপূর্ণ আদর্শ জীবনের মধ্যে যোগসূত্র গড়ে তুলতে চায় এবং যারা যুগের প্রেক্ষিতে নতুন নতুন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রয়োজন অনুভব করে, তাদের জন্য হাদীছের বিকল্প কিছু নেই’।[11]

হাদীছ যে ইসলামী সভ্যতার প্রাণ তার বড় প্রমাণ হ’ল যখনই মুসলমানদের সাথে হাদীছের যোগসূত্র ছিন্ন হয়েছে বা দুর্বল হয়েছে, তখনই মুসলিম উম্মাহ হয় চিন্তা ও দর্শনের দিক থেকে, না হয় রাজনৈতিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে গেছে, হোক না সে সময় দাঈদের সংখ্যা অনেক বেশী কিংবা যুক্তিবাদ ও ছূফীবাদ চর্চাকারীদের জয়জয়কার। হাদীছের সাথে যখনই তাদের সম্পর্কচ্ছেদ ঘটেছে তখনই তাদের মধ্যে সংস্কারের আওয়াজ দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং জ্ঞানের বাতিও নিভতে শুরু করেছে। এ এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা।

উদাহরণস্বরূপ ভারত উপমহাদেশের কথা বলা যায়। দশম হিজরী শতক থেকে উপমহাদেশের ধর্মীয় অঙ্গনে হাদীছের উপস্থিতি প্রায় বিরল হয়ে ওঠে। হাদীছের পঠন-পাঠন বন্ধ হয়ে সেখানে স্থান করে নেয় বিভিন্ন মাযহাবের ফিক্বহগ্রন্থ ও তার ব্যাখ্যাসমূহ। স্থান করে নেয় উছূল এবং যুক্তিবিদ্যার গ্রন্থসমূহ। যার ফলাফল এই দাঁড়ায় যে, এই উপমহাদেশে বিদ‘আতের ছড়াছড়ি সৃষ্টি হয়। ধর্মের নামে হাজারো রসম-রেওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে। মানুষেরা ইবাদতের জন্য নানা পথ ও পদ্ধতি আবিষ্কার করে। নানা ধর্মীয় উৎসবের আবির্ভাব ঘটায়। নেককার লোকদের কবর ঘিরে মুসলমানদের আনাগোনা বাড়ে। সেখানে খানকাহ বানিয়ে তাদের কবরে সিজদা দেয়া শুরু করে। কবরে বাতি জ্বালিয়ে ফয়েয হাছিলের প্রতিযোগিতায় মানুষ লিপ্ত হয়। এভাবে ইসলামের বিশুদ্ধ রূপ প্রায় বিতাড়িত হয়ে যায় উপমহাদেশ থেকে।

অবশেষে ‘মুজাদ্দিদ আলফে ছানী’ খ্যাত আহমাদ ইবনু আব্দুল আহাদ আস-সারহিন্দী (১০৩৪ খ্রি.) রুখে দাঁড়ালেন এসবের বিরুদ্ধে। তিনি মানুষকে আহবান করলেন সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার দিকে। ময়দানে নামলেন বিদ‘আতের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট দাওয়াত নিয়ে।[12] ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’ তথা গ্রহণযোগ্য বিদ‘আত নামে যে ধারণা প্রচলিত ছিল তা তিনি পুরোপুরিভাবে অগ্রাহ্য ঘোষণা করলেন। ছূফীদের মধ্যে প্রচলিত ‘ওয়াহদাতুল উজূদ’ তথা আল্লাহ সত্তাগতভাবে সর্বত্র বিরাজমান- এই আক্বীদার বিরুদ্ধে তিনি গ্রহণ করেন কঠোর অবস্থান। তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, نحن في حاجة الي كلام محمد العربي صلي الله عليه وسلم، لسنا في حاجة إلي كلام الشيخ محي الدين ابن عربي، أو صدر الدين القونوي والشيخ عبد الرزاق الكاشي وإلى "النصوص" لا إلى "الفصوص"، إن الفتوحات المدنية أغنتنا عن "الفتوحات المكية" ‘আমরা আরবের মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মুখনিঃসৃত বাণীর মুখাপেক্ষী, কোন শায়খ মুহিউদ্দীন ইবনুল আরাবী বা ছাদরুদ্দীন কুনুভী বা শায়খ আব্দুর রায্যাক আল-কাশীর মুখাপেক্ষী নই। আমরা মুখাপেক্ষী নুছূছ (কুরআন ও হাদীছ)-এর, কোন ‘ফুছূছ’ (ইবনুল আরাবী রচিত ফুছূছুল হিকাম)-এর নয়; মাদানী বিজয়গাঁথাসমূহই আমাদের জন্য যথেষ্ট, মাক্কী বিজয়গাঁথা (ইবনুল আরাবী রাচিত আল-ফুতুহাতুল মাক্কিয়াহ)-এর কোন প্রয়োজন নেই’।[13]

একই পদাংক অনুসরণ করে আগমন করলেন আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিছ দেহলভী (১০৫২খ্রি.) এবং হাদীছের প্রচার-প্রসার ও পাঠদানে নিজেকে উৎসর্গ করলেন। তারপর এলেন শায়খুল ইসলাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দিহলভী (১১৭৬খ্রি.) এবং তাঁর সন্তানগণ ও শিষ্যরা। তাঁরাও একইভাবে হাদীছে প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করলেন। কিতাব ও সুন্নাহর এই মিশনে তাঁরা এমনভাবে সফল হ’লেন যে, ইসলামের প্রাণকেন্দ্র থেকে শতসহস্র মাইল দূরে ভারতের বুকে জ্বলে উঠল সুন্নাহর এক মহান প্রদীপ, গড়ে উঠল হাদীছের এক প্রতাপশালী সাম্রাজ্য। আর একে কেন্দ্র করে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু হ’ল তা-ই ভারত উপমহাদেশে ইসলামের নতুন জীবন দান করল। ধারাবাহিকভাবে সাইয়িদ আহমাদ ব্রেলভী, শাহ ইসমাঈল শহীদের মত মহান সংস্কারকদের জন্ম হ’ল, যাদের কর্মতৎপরতায় মানুষ আবার সঠিক দ্বীনের সন্ধান পেল এবং শত শত বছরের বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ পরিত্যাগ করতে লাগল। এটা যে ছিল হাদীছ ও সুন্নাহর পুনরুজ্জীবনের বাস্তব ফলাফল, তাতে কোন সন্দেহ নেই । কেবল ভারতের বুকেই নয় বরং সঊদী আরব, ইরাক, সিরিয়া, মিসর, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, আফগানিস্তান, তুর্কিস্তান সব জায়গাতেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। আবুল হাসান আলী নাদভী দৃঢ়তার সাথে বলেন, وإنني واثق بأنه إذا لم يكن وجود لكتب السنة ودواوين الحديث ولم يكن سبيل إلى معرفة السنن والتمييز بينها وبين البدع، لم يكن وجود لهؤلاء المصلحين الكبار والأئمة الأعلام الذين يتجمل بهم تاريخ الإسلام ‘আমি সুনিশ্চিত যে, যদি সুন্নাহর কিতাব ও হাদীছের পান্ডুলিপিসমূহের অস্তিত্ব না থাকত; যদি সুন্নাহসমূহ জানার কোন ব্যবস্থা না থাকত; যদি সুন্নাহ এবং বিদআ‘তসমূহ পৃথক করার সুযোগ না থাকত, তাহ’লে সে সকল মহান সংস্কারক এবং বিজ্ঞ ইমামগণের আবির্ভাব কখনই ঘটত না, যাদেরকে নিয়ে ইসলামের ইতিহাস গৌরবমন্ডিত হয়েছে’।[14] সুতরাং নিঃসন্দেহে হাদীছ ইসলামী সভ্যতার বিকাশে অতি আবশ্যকীয় উপাদান।

(১) হাদীছ মুসলিম জাতির আদর্শিক রক্ষাকবচ :

ইসলাম যে চিরস্থায়ী ইলাহী ধর্ম এবং তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে সমহিমায় টিকে থাকবে, তার একটি বৃহত্তম নিদর্শন হ’ল হাদীছ। পৃথিবীতে একমাত্র মুসলিম জাতিরই রয়েছে সুশৃংখল বুদ্ধিবৃত্তিক ও আদর্শিক কাঠামো, যা অন্য কোন জাতির মধ্যে দেখা যায় না। কেননা অন্য কোন জাতির কাছে বিশুদ্ধ ধর্মীয় দলীল নেই, নেই সুনির্দিষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ, নেই সামনে এগিয়ে চলার স্থায়ী রূপরেখা। কিন্তু মুসলমানদের জন্য রয়েছে হাদীছের অমূল্য সম্পদ, যা তাদের জন্য রচনা করেছে সেই একই ঈমানী এবং আধ্যাত্মিক পরিমন্ডল, যার ছায়াতলে প্রতিপালিত হয়েছিলেন ছাহাবীগণ। হাদীছের কারণেই ছাহাবীদের পর যত প্রজন্মই এসেছে এবং আগামীতে আসবে তারা সকলেই এক লমহায় সেই ঈমানী পরিমন্ডলে আশ্রয় নেয়ার সুযোগ পেয়েছে এবং পাবে, যা কিনা স্বয়ং রাসূল (ছাঃ)-এর নিজস্ব পরিচর্যায় আলোকিত। ফলে রাসূল (ছাঃ)-এর অনুপিস্থিতিতেও মানুষ ঈমানে, আমলে, আধ্যাত্মিকতায় সেই একই পবিত্র অনুভূতির স্বাদ আস্বাদন করতে পারে যা কিনা ছাহাবীগণ রাসূল (ছাঃ)-এর সরাসরি পরিচর্যার অধীনে লাভ করেছিলেন। ইমাম তিরমিযীর আবেগমাখা ভাষ্যে তা-ই যেন প্রকটিত হয়েছে- من كان في بيته هذا الكتاب يعني الجامع فكأنما في بيته نبي يتكلم ‘যে বাড়ীতে এই কিতাব (সুনান তিরমিযী) রয়েছে, সে বাড়ীতে যেন স্বয়ং রাসূল (ছাঃ) কথা বলেন’।[15]

ফলে ইসলাম পরিণত হয়েছে একটি জীবন্ত জীবনব্যবস্থায়। একজন মানুষ ঈমানের বলে বলীয়ান হ’লে তার কর্মকান্ড এবং আচার-আচরণ কোন ধরনের হয়, আখেরাতে বিশ্বাসী জীবনের রূপরেখা কেমন হয়, তার বাস্তব ও সর্বোচ্চ নমুনা উপস্থাপন করেছে হাদীছ। হাদীছ এমন এক বৃহৎ জানালা যা দিয়ে মুসলমানরা রাসূল (ছাঃ)-এর পারিবারিক জীবন, তাঁর দৈনন্দিন কর্মকান্ড, তাঁর সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতি, তাঁর ২৩ বছরের নবুঅতী যিন্দেগীর হাযারো ঘটনা স্বচক্ষে যেন দেখতে পায়। পৃথিবীতে আর কোন মানুষের জীবনী এত নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত হয়নি, যেমনটি রাসূল (ছাঃ)-এর ক্ষেত্রে ঘটেছে হাদীছের মাধ্যমে। শুধু তা-ই নয়, রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে সরাসরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রায় লক্ষাধিক ছাহাবীর দৈনন্দিন কর্মকান্ডও প্রতিভাত হয় হাদীছের এই মহা আয়নায়। রাতের বেলার ইবাদতগুজার এবং দিনের বেলার ঘোড়সওয়ার এই মহান ছাহাবীগণের জীবনী রেখাপাত করে যায় প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষের হৃদয়ে। কিভাবে একটি জনগোষ্ঠী রাসূল (ছাঃ)-এর পবিত্র ছোঁয়ায় এবং ইসলামের মহান পরশে সামান্য গ্রামীণ মেষপালক কিংবা অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবে থাকা মরুবাসী মাত্র ২৩ বছরের ব্যবধানে সমগ্র আরব বিজেতায় পরিণত হয়ে সারা বিশ্বকে নাড়া দিতে সক্ষম হ’ল, তার প্রতিটি ধাপ সুচারুরূপে সংরক্ষিত হয়েছে হাদীছ শাস্ত্রে। এজন্য হাদীছ শাস্ত্র হ’ল মুসলিম জাতির জন্য এমন এক শক্তিশালী দলীল, যা তাদের আদর্শিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্থায়িত্বকে সুনিশ্চিত করেছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে টিকে থাকার বলিষ্ঠ ভিত্তি দান করেছে।[16] 

ইবনুল ক্বাইয়িম (৭৫১হি.) বলেন,والمقصود أن بحسب متابعة الرسول تكون العزة والكفاية والنصرة، كما أن بحسب متابعته تكون الهداية والفلاح والنجاة، فالله سبحانه علق سعادة الدارين بمتابعته، وجعل شقاوة الدارين في مخالفته ‘মূল বিষয় হ’ল, রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণের উপরই নির্ভর করে (মুসলিম জাতির) ইয্যত, উপযুক্ততা এবং বিজয়; যেমনভাবে তাঁর অনুসরণের উপরই নির্ভরশীল সঠিক পথ, কল্যাণ এবং মুক্তি লাভ করা। নিশ্চয়ই আল্লাহ উভয় জগতের যাবতীয় সৌভাগ্য রেখেছেন তাঁর রাসূলের অনুসরণের মাঝে এবং যাবতীয় দুর্ভাগ্য রেখেছেন তার বিরুদ্ধাচরণে’।[17] 

হাদীছ কুরআনের ব্যাখ্যা হিসাবে সংরক্ষিত হওয়ায় ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত হয়েছে। কেননা মানুষ জন্মগতভাবে যুক্তিবাদী ও আত্মপূজারী। ফলে কুরআনকে যদি স্ব স্ব বিবেক মোতাবেক ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেয়া হ’ত, তাহ’লে সহজেই মানুষ নানা মতে বিভক্ত হয়ে যেত। সেজন্য আল্লাহ তাঁর রাসূল (ছাঃ)-কে তাঁর কুরআনের একক ব্যাখ্যাকার হিসাবে প্রেরণ করেছিলেন[18] এবং সেই ব্যাখ্যার অনুসরণ করাকে মানবজাতির জন্য আবশ্যক ঘোষণা করেছেন।[19] ফলে ইসলাম নানা মত ও নানা ব্যাখ্যার জটিলতা থেকে মুক্ত থেকে একটি স্থিতিশীল মানদন্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং ইসলামী জীবনব্যবস্থায় হাদীছ এমন একটি অপরিহার্য স্থান দখল করে আছে যে, হাদীছকে অনুসরণ করার অর্থ ইসলামকে অনুসরণ করা এবং হাদীছকে পরিত্যাগ করার অর্থ ইসলামকেই পরিত্যাগ করা।

অপরদিকে হাদীছের কারণে কুরআন অপব্যাখ্যারও সমস্ত পথ রুদ্ধ করা সম্ভব হয়েছে। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর পবিত্র কুরআনকে নানাভাবে অপব্যাখ্যা করার হাযারো চেষ্টা করা হয়েছিল এবং অদ্যাবধি চলে আসছে। কিন্তু হাদীছের শক্ত দেয়ালের কারণে সেসব অপব্যাখ্যা কর্পুরের মত উবে গেছে। যদি হাদীছ ব্যতীত কুরআন বোঝার সুযোগ থাকত, তাহ’লে মানুষ কুরআনকে শব্দে শব্দে ঠিক রেখেও নিজের ভাসাভাসা জ্ঞান দিয়ে ইচ্ছামত কুরআনের ব্যাখ্যা সাজিয়ে নিত। কিন্তু সে সুযোগ রুদ্ধ করে দিয়েছে হাদীছ। যার ফলশ্রুতিতে কুরআনের অর্থকে বিকৃত করার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে ইসলামের মধ্যে বহু বিজাতীয় কৃষ্টি-কালচার, রসম-রেওয়াজ, সভ্যতা-সংস্কৃতি অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করেছে। এমনকি ইসলামের নামেই ইসলামের মধ্যে বহু নতুন নতুন বিধান তথা ‘বিদ‘আত’-এর অনুপ্রবেশ ঘটানোর চেষ্টা করেছে একশ্রেণীর সুযোগসন্ধানী। কিন্তু একমাত্র হাদীছের শক্তিশালী প্রতিরোধব্যুহ থাকার কারণে তার কোনটিই স্থায়িত্ব লাভ করেনি। আর এভাবেই ইসলামী সভ্যতার চিরস্থায়ী নিরাপদ ভিত্তি রচিত হয়েছে এবং সকল বিজাতীয় মতবাদের আক্রমণ থেকে তা চিরন্তনভাবে সুরক্ষিত থেকেছে।

এজন্যই যারা দ্বীনের জ্ঞান এবং হাদীছের সংরক্ষণে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন তাদের উদ্দেশ্যে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لا تزال طائفة من أمتي ظاهرين على الحق، لا يضرهم من خذلهم، حتى يأتي أمر الله وهم كذلك ‘আমার উম্মতের একটি দল সবসময় হক্বের উপর বিজয়ী থাকবে। যারা তাদেরকে পরাজিত ও লাঞ্ছিত করতে চাইবে, তারা তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। অতঃপর আল্লাহর নির্দেশ (ক্বিয়ামত) এসে যাবে), কিন্তু তারা অনুরূপই বিজয়ী অবস্থায় থাকবে’।[20] আলী ইবনুল মাদীনী (২০৪হি.) এই দলটি সম্পর্কে বলেছেন, তারা হ’লেন আছহাবুল হাদীছ’।[21] অনুরূপভাবে ইয়াযীদ ইবনু হারূন (২০৬হি.), ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (২৪১হি.) এই হাদীছের বর্ণিত দলটি সম্পর্কে বলেছেন, إن لم يكن هم أصحاب الحديث فما أدري من هم ‘তারা যদি আছহাবুল হাদীছ না হন তাহ’লে আমি জানি না তারা কারা’।[22] এখানে ‘আছহাবুল হাদীছ’ অর্থ কেবল মুহাদ্দিছ বা হাদীছের পন্ডিতগণই নন, বরং সাধারণভাবে প্রত্যেক যুগে যারা হাদীছের সংরক্ষণ করেন এবং হাদীছের প্রচার ও প্রসার করেন তাদেরকেও বুঝানো হয়েছে। যেমন ইবনু তায়মিয়া (৭২৮হি.) বলেন, ونحن لا نعني بأهل الحديث المقتصرين على سماعه، أو كتابته أو روايته، بل نعني بهم: كل من كان أحق بحفظه ومعرفته وفهمه ظاهراً وباطناً، واتباعه باطناً وظاهراً، ‘আমরা আহলুল হাদীছ বলতে কেবল মুহাদ্দিছদেরকেই বুঝাই না, যারা কি না হাদীছ শ্রবণ, লিখন এবং বর্ণনায় ব্যস্ত থাকেন; বরং প্রত্যেক সে সকল ব্যক্তিকেও বুঝিয়ে থাকি যারা প্রাগ্রসরভাবে প্রকাশ্যে-গোপনে হাদীছ সংরক্ষণ, হাদীছের জ্ঞান ও বুঝ অর্জন এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে তা অনুসরণ করে থাকেন’।[23]

(২) হাদীছ মুসলিম উম্মাহর সাংস্কৃতিক ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু :

পৃথিবীতে দেশ-সমাজ-কাল নির্বিশেষে, জগতের সকল কোণায়-ক্রান্তিতে যত মুসলমান বসবাস করে, তাদের জীবনযাত্রা, সাংস্কৃতিক নিদর্শন, আচার-ব্যবহার, পারস্পরিক ভাববিনিময়, দৈনন্দিন কর্মকান্ড, চিন্তা-চেতনা সবকিছুতেই এক মহাকাব্যিক ঐক্যের বিস্ময়কর চিত্র পরিস্ফূট হয়। এই ঐকতানের পিছনে মূল যে জিনিসটি ক্রিয়াশীল তা হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহর অনুসরণ। রাসূল (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া জীবনাদর্শই মুসলমানদের মাঝে এই পারস্পরিক ঐক্যের মহাবন্ধন তৈরী করে দিয়েছে, যার ভিত্তিতে পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম গোলার্ধ পর্যন্ত, উত্তর থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ পর্যন্ত সর্বত্র মুসলিম একই রাসূলের অনুসারী হিসাবে, একই আদর্শ ও সংস্কৃতির সুবিস্তৃত ছাতার নীচে বসবাস করছে। হাদীছ অস্বীকারকারী হওয়া সত্ত্বেও জামাল বান্না (১৯২০-২০১৩খ্রি.) যথার্থই বলেছেন,فقد أوجدت السنة رباطا و"كومنولث" أقوي من أي كومونولث آخر ‘সুন্নাহ (মুসলমানের মাঝে) এমন বন্ধন এবং কমনওয়েলথ তৈরী করেছে, যা (পৃথিবীর) অন্য যে কোন কমনওয়েলথের চেয়ে শক্তিশালী’।[24]

ডাচ প্রাচ্যবিদ Arent Jan Wensinck (১৮৮২-১৯৩৯খ্রি.) তাঁর অগ্রজ ডাচ প্রাচ্যবিদ Snouch Hurgronje (১৮৫৭-১৯৩৬খ্রি.) (ইগনাজ গোল্ডজিহেরের পর প্রাচ্যবিদদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে দেখা হয়) সম্পর্কে লিখেছেন যে, তিনি ১৭ বছর ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ উপনিবেশের একজন কর্মকর্তা হিসাবে অবস্থান করেন। অতঃপর মুসলমানদেরকে আরো নিকট থেকে দেখার উদ্দেশ্যে আব্দুল গাফ্ফার নাম ধারণ করে গোপনে মক্কায় ছয় মাস অবস্থান করেন। এসময় যে বিষয়টি তাঁর দৃষ্টি সবচেয়ে আকর্ষণ করে তা হ’ল, মক্কা ও মদীনার মুসলমানদের সাথে ইন্দোনেশিয়া, জাভা এবং আচেহের মুসলমানদের বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির সুগভীর ঐক্য। শুধু বিশ্বাসে এবং প্রার্থনার নিয়মেই নয়; বরং খাওয়া, পান করা, পোষাক-পরিচ্ছদ, আদব-কায়দা, কুশলাদি বিনিময় সবকিছুর মধ্যে এই ঐকতান তাকে অভিভূত করে। শুধু তিনিই নন, আরও দু’জন ডাচ প্রাচ্যবিদ Van Nieuwenhuijze এবং Hendrik Kraemer একই ধরনের বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, যারা তার মত ইন্দোনেশিয়ায় অনুরূপ গবেষণা অব্যাহত রেখেছিলেন। তারা মন্তব্য করেছিলেন যে, হাদীছ সম্পর্কে না জানা ব্যতীত মধ্যপ্রাচ্যের সমাজ ব্যবস্থা এবং মুসলমানদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করা সম্ভব নয়।[25]

অনুরূপই মন্তব্য করেছেন জার্মান প্রাচ্যবিদ Johann Fück (১৮৯৪-১৯৭৪খ্রি.)। তিনি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন যে, কালের ভিন্নতা, ভৌগলিক দূরত্ব সবকিছু অতিক্রম করে একই ধরনের ইসলামী সংস্কৃতি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে কিভাবে এতটা প্রভাবিত করল? বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন উপায়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের মাঝে একই ইসলামী সংস্কৃতির বিনিসুতোয় গাঁথা জীবনাচার গড়ে উঠল কিভাবে? এর উত্তরে তিনি বলেন, মানুষের মাঝে সার্বজনীন সংস্কৃতির বিস্তার, মানসিক যুথবদ্ধতা তৈরী এবং একইরূপ জীবনধারা গড়ে তোলার সক্ষমতা ইসলাম কেবল কুরআন থেকে লাভ করেনি; বরং এর পিছনে রয়েছে নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সুন্নাহ। ইসলামের শিকড় লুকিয়ে রয়েছে রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনীর মাঝে। মুহাম্মাদ (ছাঃ) কেবল আইন ও বিধান দিয়ে নয়, বরং তাঁর আদর্শ জীবনাচারে এই ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। সুতরাং ইসলামের এই অভূতপূর্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহর উপরই অধিক ভিত্তিশীল।[26]

সারকথা :

হাদীছ যেমন কুরআনের ব্যাখ্যা হিসাবে ইসলামী শরী‘আতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তেমনি ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রতিটি দিক ও বিভাগের সাথে সুগভীরভাবে যুক্ত। পবিত্র কুরআন নাযিলের সাথে সাথে তার বাস্তব রূপরেখা উপস্থাপনের জন্য আল্লাহ রাববুল আলামীন রাসূল (ছাঃ)-কে সর্বোত্তম নমুনাস্বরূপ প্রেরণ করেছিলেন। আর সেই নমুনাই সংরক্ষিত হয়েছে হাদীছ বা সুন্নাহে। আর সে কারণেই হাদীছ ব্যতীত ইসলামী জীবনব্যবস্থার অস্তিত্ব অকল্পনীয়। খ্যাতনামা পন্ডিত মুহাম্মাদ আসাদ (১৯০০-১৯৯২খ্রি.) বলেন, We therefore need a guide whose mind possesses something more than the normal reasoning qualities and the subjective rationalism common to all of us; we need someone who is inspired - in a word, a Prophet. If we believe that the Qur'an is the Word of God, and that Muhammad was God's Apostle, we are not only morally but also intellectually bound to follow his guidance implicitly. ‘সুতরাং আমাদের প্রয়োজন এমন একজন পথনির্দেশকের, যার হৃদয় সব মানুষের মধ্যে ক্রিয়াশীল স্বাভাবিক চিন্তাশীলতা এবং যুক্তিবাদী গুণাবলীর ঊর্ধ্বে আরও কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আমাদের প্রয়োজন এমন একজনের যিনি প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত বা এক কথায় নবী বা রাসূল। যদি আমরা বিশ্বাস করি যে,

কুরআন হ’ল আল্লাহর কালাম এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) হ’লেন আল্লাহর রাসূল, তাহ’লে আমরা কেবল নৈতিকভাবেই নয়, বরং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেও তাঁর নির্দেশনা অনুসরণ করতে বাধ্য’।[27]

তিনি যর্থার্থই বলেন, To follow him in all that he commanded is to follow Islam; to discard his Sunnah is to discard the reality of Islam. ‘তিনি (মুহাম্মাদ (ছাঃ)) যা কিছু বিধিবদ্ধ করেছেন তার অনুসরণের অর্থ হ’ল ইসলামকে অনুসরণ করা এবং সুন্নাহকে প্রত্যাখ্যান করার অর্থ হ’ল ইসলামের বাস্তবতাকে প্রত্যাখ্যান করা’।[28]


[1]. ড. রঊফ শালাবী, আস-সুন্নাতু বাইনা ইছবাতিল ফাহিমীন ওয়া রাফযিল জাহিলীন (কুয়েত : দারুল কলম, ১৯৮২খ্রি.), পৃ. ৬১-৬৮।

[2]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আত-ত্বুরুকুল হুকমিয়াহ (কুয়েত : মাকতাবাতু দারিল বায়ান, তাবি), পৃ. ৪।

[3]. ড. সাঈদ ইসমাঈল আলী, আস-সুন্নাহ আন-নববিইয়াহ রু’ইয়া তারবাবিয়াহ (কায়রো : দারুল ফিকর, ২০০২খ্রি.), পৃ. ১৮৭-২১৬।

[4]. আবুল হাসান আল-মাওয়ার্দী, আল-আহকামুস সুলতানিয়াহ (কায়রো : দারুল হাদীছ, তাবি), পৃ. ১৯।

[5]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আত-ত্বুরুকুল হুকমিয়াহ , পৃ. ১২-১৩।

[6]. ইউসুফ আল-কারযাভী, আস-সুন্নাতু মাছদারান লিল মা‘রিফাতি ওয়াল হাযারাহ (কায়রো : দারুশ শুরূক্ব, ৩য় প্রকাশ, ২০০২খ্রি.), পৃ.৮৪-১৮০; আন-নববিইয়াহ রু’ইয়া তারবাবিয়াহ, ২৩১-৩২৬।

[7]. মাওলানা আব্দুর রহীম, হাদীস সংকলনের ইতিহাস, পৃ. ১৯।

[8]. আবূ নাঈম আস্ফাহানী, আত-তিববুন নববী (বৈরূত : দারু ইবনু হাযম, ২০০৬ খ্রি.); ইবনুল ক্বাইয়িম, আত-তিববুন নববী (বৈরূত : দারু এহইয়াইল কুতুব আল-আরাবিয়া, ১৯৫৭খ্রি.); শামসুদ্দীন যাহাবী, আত-তিববুন নববী (বৈরূত : দারু এহইয়াইল উলূম, ১৯৯০ খ্রি.) প্রভৃতি।

[9]. https://www.eajaz.org.

[10]. ড. খলীল ইবরাহীম মোল্লা খাত্বির, মুখতাছারুস সুন্নাহ আন-নাবাবিয়াহ ওয়াহইয়ুন, পৃ. ১৭৫-২১৪।

[11]. আব্দুর রহমান আল-ফিরইয়াঈ, জুহূদ মুখলিছাহ ফী খিদমাতিস সুন্নাহ আল-মুতাহ্হারাহ (বানারাস : জামি‘আহ সালাফিয়াহ, ১৯৮০খ্রি.), পৃ. ৩৫-৩৭।

[12]. আবুল হাসান আলী নদভী, মুহাযারাতুন ইসলামিয়াতুন ফিল ফিকরে ওয়াদ দাওয়াহ, তাহকীক : আব্দুল মাজেদ আল-গাওরী (বৈরূত : দারু ইবনু কাছীর, ২০০১খ্রি.), ৩/৫৭৫।

[13]. তদেব, ৩/৫৭৬।

[14]. তদেব, ৩/৫৭৭।

[15]. শামসুদ্দীন যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফ্ফায, ২/১৫৪।

[16]. H.A.R. Gibb বলেন, The study of the hadith is not confined to determining how far it represents the authentic teaching and practice of Mohammed and the primitive Medinian community. It serves also as a mirror in which the growth and development of Islam as a way of life and of the larger Islamic community are most truly reflected (Muhammadanism : A Historical Survey (Newyork : Oxford University Press, 1962), p. 86).

[17]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ (বৈরূত : মুআস্সাসাতুর রিসালাহ, ২৭শ প্রকাশ : ১৯৯৪খ্রি.), ১/৩৯।

[18]. আল্লাহ বলেন, وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ إِلَّا لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي اخْتَلَفُوا فِيهِ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَআমরা তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করেছি কেবল এজন্য যে, তুমি তাদেরকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে দিবে যেসব বিষয়ে তারা মতভেদ করে এবং (এটি নাযিল করেছি) মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত স্বরূপ(নাহল ১৬/৬৪)। তিনি আরও বলেন, وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَআর আমরা তোমার নিকটে কুরআন নাযিল করেছি, যাতে তুমি লোকদের নিকট বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে দাও যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে’(নাহল ১৬/৪৪)। একই মর্মার্থের অনেক আয়াত কুরআনে নাযিল হয়েছে, যাতে স্পষ্ট হয় যে, মানুষ কুরআনের নির্দেশনা থেকে তখনই উপকৃত হবে যখন রাসূল (ছা.) তাদের ব্যাখ্যা করে শোনাবেন। অন্যদিকে ‘মানুষকে’ শব্দ দ্বারা এটা প্রতীয়মান হয় যে, রাসূল (ছা.)-এর এই ব্যাখ্যার মুখাপেক্ষী প্রতিটি মানুষ। সুতরাং প্রতিটি মানুষই যদি এই ব্যাখ্যার মুখাপেক্ষী হয়, তাহ’লে কুরআন সংরক্ষণের সাথে সাথে এর ব্যাখ্যা সংরক্ষণও অবধারিত হয়ে যায়। নতুবা নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা মত কুরআনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মানুষ কুরআনের অর্থই পরিবর্তন করে ফেলবে এবং কুরআন বিকৃত হয়ে যাবে (Muhammad Taqi Usmani, The Authority of Sunnah, p. 77)

[19]. আল্লাহ বলেন, مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে, সে আল্লাহর আনুগত্য করে। আর যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের উপর আমরা তোমাকে তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠাইনি’(নিসা ৪/৮০)

[20]. মুসলিম, হা/১৯২০। হাদীছটি বিভিন্ন ইবারতে বহু সংখ্যক ছাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে।

[21]. ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী, ১৩/২৯৩।

[22]. তদেব।

[23]. ইবনু তায়মিয়া, মাজমু‘উল ফাতাওয়া, ৪/৯৫।

[24]. জামাল বান্না, আস-সুন্নাহ ওয়া দুয়ারুহা ফিল ফিকহিল জাদীদ, পৃ. ২০।

[25]. Mehmet Görmez, "What Directed The Classic Orientalism Into Hadith Research" (The Muslim World, U.S.A, 2006), p. 17.

[26]. Johann Fück, "The Role of Traditionalism in Islam", Studies on Islam,p. 99-101, See in: Mehmet Görmez, "What Directed The Classic Orientalism Into Hadith Research", p. 19

[27] .Muhammad Asad, Islam at the crossroad (Gibraltar : Darul Andalus, 1980), p. 95.

[28]. Ibid, p. 97.






নেতার প্রতি আনুগত্যের স্বরূপ - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
ইবাদতে অলসতা দূর করার উপায় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ইবাদতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ ভেঙ্গে দিচ্ছে ভারত - আহমদ সালাহউদ্দীন
মানবাধিকার ও ইসলাম (৪র্থ কিস্তি) - শামসুল আলম
ঈদের ছয় তাকবীরের পক্ষে উপস্থাপিত দলীল সমূহ পর্যালোচনা - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
প্রসঙ্গ : মাসিক আত-তাহরীক - মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম প্রধান
সংগঠনের গতিশীলতা বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা ও তা উত্তরণের উপায় - শেখ মুহাম্মাদ রফীকুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক, পাইকগাছা সরকারী কলেজ, খুলনা
দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকার (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ঈদায়ন সম্পর্কিত কতিপয় ত্রুটি-বিচ্যুতি - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ভূমিকম্পের টাইম বোমার ওপর ঢাকা : এখনই সচেতন হ’তে হবে - কামরুল হাসান দর্পণ
আরও
আরও
.