আইএসের সহিংস তৎপরতার ফলে লাভ হচ্ছে কার? গুলশান হত্যাযজ্ঞে অংশ নিয়ে যে তরুণরা প্রাণ হারিয়েছে, তাদের মধ্যে দু’জন ছিল পলিগ্রামের সন্তান, একজন মাদ্রাসায় পড়েছিল। বাকি সবাই শহুরে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। পড়াশোনা করেছে রাজধানীর অভিজাত ও ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কেউ কেউ বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়েও।
বিজ্ঞ মহলে এতকাল বলা হয়েছে যে, উগ্রপন্থী রাজনৈতিক ভাবাদর্শের প্রতি সহজেই যাদের আকর্ষণ করা যায়, তারা দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত গ্রামাঞ্চলের তরুণ-যুবক। বিশেষতঃ যারা মাদ্রাসায় পড়ে, লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থাকে ইত্যাদি। উন্নয়নবিশারদ, সমাজবিজ্ঞানী, রাজনীতিক ব্যক্তিগণ বলে থাকেন, দারিদ্র্য দূর হলেই মৌলবাদ-উগ্রপন্থা-সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি দূর হবে। কিন্তু গুলশান ট্র্যাজেডির কুশীলবেরা এক নতুন কিংবা আমাদের কাছে এ যাবৎ অজ্ঞাত এক বাস্তবতা উন্মোচন করে দিয়ে গেল। তারা যেন বলে গেল, আর্থসামাজিক প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চেয়েও অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাদের বিবেচনায় আছে। সে বিষয়ের গুরুত্ব তাদের কাছে এতই বেশী যে, সে জন্য তারা অকাতরে আত্মবিসর্জনও দিতে পারে।
কী সেই বিষয়?
প্রথমতঃ বিদ্রোহ। তারুণ্য বিদ্রোহের বয়স। ভালো বা মন্দ অর্থে নয়; বিদ্রোহ শব্দটি দোষগুণ নিরপেক্ষভাবে ব্যবহার করছি। এই তীব্র আবেগ জাগে সাধারণত প্রতিক্রিয়া থেকে। অর্থাৎ বিদ্রোহ মৌলিক আবেগ নয়, কোনো কিছুর প্রতিক্রিয়ামূলক আবেগ। কিন্তু কিসের প্রতিক্রিয়া? কিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ? যার মনে বিদ্রোহ জাগে তার বিবেচনায় যা কিছু অন্যায়, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
রাজনৈতিক ইসলামের একশ্রেণীর তাত্ত্বিক মনে করেন, ইউরোপ-আমেরিকার শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর ভূ-রাজনৈতিক আচরণ, বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রিয়াকলাপ, প্রপাগান্ডা, সর্বোপরি সামরিক তৎপরতা সবকিছুর লক্ষ্যবস্ত্ত বা টার্গেট হ’ল মুসলিম বিশ্ব বা ইসলামী উম্মাহ। ইসলাম আর মুসলমানই তাদের প্রধান শত্রু। তাদের এই শত্রুতার সুনির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত ফিলিস্তীন, আফগানিস্তান, সোমালিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া। তাদের তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আসলে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, এটা তাদের ক্রুসেড। এই ক্রুসেডেরই প্রতিক্রিয়া হ’ল জিহাদ।
ইরাক যুদ্ধের পরিণতিতেই আইএস-এর জন্ম হয়েছে এ রকম স্বীকারোক্তিমূলক কথা এখন পাশ্চাত্যে উচ্চারিত হচ্ছে। ইরাক যুদ্ধেরও আগে থেকে আছে যে আল-কায়েদা, তারও জন্ম পাশ্চাত্যবিরোধী প্রতিক্রিয়া থেকে। সব প্রতিক্রিয়ার একটা আদি উৎস ফিলিস্তীন। আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় ইসরাঈল নামের যে কৃত্রিম রাষ্ট্রটি বিশাল ফিলিস্তীন ভূখন্ডকে দিনে দিনে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে, যে সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতন তারা এখনো ফিলিস্তীনী জনগোষ্ঠীর ওপর চালিয়ে যাচ্ছে, তা আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের মতো সংগঠনগুলোর তীব্র ক্রোধ ও ভয়ংকর জিঘাংসার এক অন্তহীন উৎস।
১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়া ও পরিণতিতে জন্ম হয়েছে তালেবান ও আল-কায়েদার মতো অনেক সশস্ত্র ইসলামী গোষ্ঠীর। সমগ্র আরব দুনিয়া থেকে হাযার হাযার তরুণ-যুবক ছুটে গিয়েছিল পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। সঊদী ধনকুবেরের পুত্র ওসামা বিন লাদেন, মিসরীয় চিকিৎসক আয়মান আল-জাওয়াহিরি, এমনকি জর্ডানের ছোট্ট শহর জারকার তরুণ আবু মুস‘আব আয-যারকাবীর (আজকের ইসলামিক স্টেট যাকে তাদের স্বপ্নদ্রষ্টা পথিকৃৎ হিসেবে মানে) জিহাদের দীক্ষালাভ ঘটেছে আফগানিস্তানের পাথুরে-পাহাড়ী রণাঙ্গনে। বাংলাদেশের আদি ইসলামী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সূতিকাগারও সেই আফগানিস্তান। স্নায়ুযুদ্ধের সেই কালে আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্রশক্তিগুলো প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সর্বতোভাবে মদদ জুগিয়েছিল ইসলামপন্থী যোদ্ধা বা মুজাহিদদের। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপ ও স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে ভূ-রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে বদলে গেল। আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করে নিল তালেবান। শুরু হ’ল দেশটির বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে তালেবানের পাশে দাঁড়াল ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদা। সেই সঙ্গে শুরু হ’ল বৈশ্বিক জিহাদ। বিস্ময়কর এক শত্রু সৃষ্টি করে নিল আমেরিকা ও তার মিত্ররা। তারা সেই শত্রুর নাম দিল ‘মিলিট্যান্ট ইসলাম’।
ইরাকের সাদ্দাম হোসেন সেই মিলিট্যান্ট ইসলামকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন, এমনকি তিনি নিজেই এক মহা সন্ত্রাসবাদী, তাঁর কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র আছে, এই মিথ্যা অজুহাতে আমেরিকা ও তার মিত্ররা ব্যাপক বিধ্বংসী আগ্রাসন চালাল ইরাকে। লাখ লাখ মানুষের প্রাণ গেল, দেশটা তো ধ্বংস হ’লই, ধ্বংস হ’ল মানুষে মানুষে শত বছরের সম্প্রীতি। শী‘আ-সুন্নী-কুর্দি-ইয়াযীদী বিরোধে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ইরাকী সমাজের বুনন। গড়ে উঠল কয়েক ডজন সশস্ত্র গোষ্ঠী। ইরাকের পর লিবিয়া, তথাকথিত আরব বসন্তের আগুনে বাতাস দিয়ে ও ইন্ধন জুগিয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে বানানো হ’ল এক বিশাল অগ্নিকুন্ড। সিরিয়ার প্রলম্বিত গৃহযুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জন্য দিগন্ত প্রসারিত করে দিল। বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে লড়াইরত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র ও অর্থ জুগিয়ে যে ব্যাপক বিধ্বংসী নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হ’ল, তারই মধ্যে অভ্যুদয় ঘটল ইসলামিক স্টেট নামের এক স্বঘোষিত খিলাফত রাষ্ট্রের। আল-কায়েদার ছোট ভাই, একদা লাদেন-অনুগত কিন্তু পরে অবাধ্য এই দুর্ধর্ষ সশস্ত্র গোষ্ঠী ইরাক ও সিরিয়ার বিরাট অঞ্চল দখল করে নিয়ে ওই দুই দেশের সীমান্তরেখা মুছে দিয়ে ঘোষণা করল পৃথিবীতে খিলাফতের পুনরুত্থান ঘটেছে; আবুবকর আল-হুসাইনী আল-কুরায়শী আল-বাগদাদী সেই রাষ্ট্রের আমীরুল মুমিনীন বা খলীফা।
সিরিয়ার রাক্কা শহরকে রাজধানী করে ঘোষিত সেই ইসলামিক স্টেট বা খিলাফতের আয়তন ২০১৪ সালের জুন মাসে ছিল গ্রেট ব্রিটেনের আয়তনের সমান।
যদিও গুলশান হামলার দায় আইএস স্বীকার করেছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সূত্রে বলা হয়েছে, তবু ওই হামলায় অংশগ্রহণকারী তরুণদের সিরিয়া-ইরাকভিত্তিক ওই সংগঠনটিই যে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরী করেছে এ ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত হতে পারিনি। কিন্তু এটা অন্তত বলা যায়, তারা প্রেরণা পেয়েছে আইএসের মতো সংগঠন থেকেই। যেটাকে ‘মগজ ধোলাই’ বলা হচ্ছে, তার জন্য সিরিয়ার আলেপ্পো বা রাক্কায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই; ইউরোপ-আমেরিকার মতো জিহাদী মন্ত্রে দীক্ষাদানের কাজ এই বাংলাদেশেও বেশ ভালোভাবে সম্ভব। অনেকে অনেকবার বলেছেন, আইএস শুধু একটি সংগঠনই নয়, একটা ভাবাদর্শও বটে। আমি বরং বলব, আইএস প্রধানতই একটা ভাবাদর্শ, যার কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা নেই এবং যার আকর্ষণ সারা পৃথিবীর মুসলমান তরুণদের মধ্যে ক্রমশ বেড়েছে।
সংবাদপত্রে পড়লাম, ভারতের কেরালা রাজ্য থেকে ১৫ জন মুসলমান তরুণ নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে, তারা আইএসে যোগ দিতে সিরিয়ায় গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই তরুণদের একজন ‘হোয়াটস অ্যাপ’-এ স্বজনদের কাছে বার্তা পাঠিয়েছে, ‘আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আমি সিরিয়ায় চলে গেলাম’। ‘আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এই তরুণদের কাছে এক আকর্ষণীয় রোমাঞ্চ। এই দুঃসাহসিক অভিযানে তার মৃত্যু হতে পারে, এটা সে জানে। কিন্তু এভাবে মৃত্যু হলে তার আফসোস থাকবে না। কারণ তাকে বোঝানো হয়েছে এই মৃত্যু মহান। এটাকে বলে শাহাদাত; যার পুরস্কার জান্নাত। ইহলৌকিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধের রোমাঞ্চের সঙ্গে পারলৌকিক পুরস্কারের আকর্ষণই এই তরুণদের কাছে ইসলামিক স্টেটের মূল আকর্ষণ।
এদের ‘মগজ ধোলাই’ বলতে যা বোঝানো হচ্ছে, তার মোদ্দাকথা এটাই। কিন্তু শুধু তো ইসলামিক স্টেটই এসব কথা বলে না, আল-কায়েদার বক্তব্যও একই। মধ্যপ্রাচ্যে আরও কয়েক ডজন ইসলামী সশস্ত্র গোষ্ঠী আছে, তাদের বক্তব্যও একই ধরনের। তাহ’লে এই তরুণেরা শুধু ইসলামিক স্টেটের পেছনে ছুটছে কেন?
কারণ, দু’বছর ধরে বৈশ্বিক জিহাদের ১ নম্বর ব্র্যান্ড হ’ল ইসলামিক স্টেট বা আইএস। আল-কায়েদাকে টপকে আইএস কী করে ১ নম্বর হ’ল?
প্রথমতঃ ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন জোটের বিভীষিকাপূর্ণ সামরিক আগ্রাসন এবং সাদ্দাম হোসেনের সেনাবাহিনী ভেঙ্গে দেওয়ার ফলে। সাদ্দাম- সেনারাই এখন আইএসের প্রধান সামরিক শক্তি। দ্বিতীয়তঃ আইএস ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেখানে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, যেটা সারা বিশ্ব থেকে ছুটে যাওয়া আইএস যোদ্ধাদের নিরাপদ ঘাঁটি বা ‘সেফ হেভেন’ হিসেবে কাজ করছে। তৃতীয়তঃ আইএসের আছে অত্যন্ত শক্তিশালী এক প্রপাগান্ডা মেশিন বা প্রচারযন্ত্র। চতুর্থতঃ আইএসের দর্শন নিরেট বিশুদ্ধতাবাদী; তারা তাদের ভাষায় আদি বিশুদ্ধ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়, ইসলামের বহু রূপ তারা বরদাশত করে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, শী‘আ ইসলাম মুসলিম জাহানে তাদের প্রধান শত্রু। পঞ্চমতঃ আইএসের কর্মপদ্ধতি তার যোদ্ধাদের কাছে দর্শনীয়ভাবে রোমাঞ্চকর, যাকে বলে ‘থ্রিলিং’। তাদের কাছে আইএস এক বিপ্লবী শিহরণের নাম।
এই সমস্ত কিছু মিলিয়ে জিহাদী তরুণের মনে ইসলামিক স্টেটের যে রূপ দাঁড়িয়ে গেছে, তা চূড়ান্ত অর্থে বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, প্রতিশোধের প্রতীক এবং সেই বিদ্রোহ পরকাল পর্যন্ত সম্প্রসারিত। কেননা পুরস্কারের আশ্বাসও সেখানে রয়েছে। কিন্তু এই ইউটোপিয়ায় আকৃষ্ট তরুণমন বিচারী দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে কোনো ধরনের জিজ্ঞাসা বোধ করে না। সে প্রশ্ন তোলে না, বৈশ্বিক রাজনীতির কোনো গোপন খেলার ঘুঁটি হিসেবে সে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না। সে প্রশ্ন তোলে না, আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সঙ্গে নারী-শিশুসহ নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের ওপর বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালানোর সম্পর্ক কী। এই প্রশ্নও তার মনে জাগে না, নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের ওপর বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালানোর ফলে তাদের সম্পর্কে সমাজে কি ধরনের মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। তারা জানতে চায় না, ইঙ্গ-মার্কিন গণতন্ত্র রফতানীকারকদের হাতে মধ্যপ্রাচ্যে যত মুসলমান প্রাণ হারিয়েছে, তার চেয়ে কত বেশী মুসলমান মারা গেছে নিজেদের মধ্যে সহিংসতায়। তারা জানতে চায় না, শী‘আ-সুন্নীসহ বিভিন্ন মুসলিম গোষ্ঠীর মধ্যে যে বিভক্তি ও বিরোধ জাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার ফলে ক্ষতি হচ্ছে কার। আমেরিকা ও তার মিত্রদের ‘ক্রুসেডী’ দুনিয়ার, নাকি ইসলামী উম্মাহর?
সর্বোপরি এই তরুণদের মনে এমন জিজ্ঞাসা জাগে না, আইএসের সহিংস তৎপরতার ফলে লাভ হচ্ছে কার? কে মূল বেনিফিশিয়ারী?
(সংকলিত)