এটা
শুনে অনেকেই বিস্মিত হন, জম্মু ও কাশ্মীরের একটা নিজস্ব সংবিধান আছে, পৃথক
পতাকা আছে, একটা জাতীয় সংগীতও আছে। ভারতের অন্য রাজ্যে যাঁদের
মুখ্যমন্ত্রী বলা হয়, কাশ্মীরে সেই পদাধিকারী একদা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে
অভিহিত হতেন। এসবই ছিল জম্মু-কাশ্মীর-লাদাখের ‘বিশেষ মর্যাদা’র প্রতীক;
যদিও তারা ভারতের অন্তর্ভুক্ত।
এসব অতীত স্বাতন্ত্র্যের ওপর দাঁড়িয়েই হারানো রাষ্ট্রীয় মর্যাদার পুনর্জীবন চায় কাশ্মীরীরা। কিন্তু ক্রমে তারা কেবল অধিক কোণঠাসা অবস্থাতেই পড়ছে। সেই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কাশ্মীরের মর্যাদা আরেক দফা ছেঁটে দিতে চাইছে নয়াদিলী। তেমন ‘গুজব’-এ ভাসছে ভ্যালি।
কাশ্মীরের রাষ্ট্রনৈতিক স্বাতন্ত্র্যের প্রতীক ভারতীয় সংবিধানের দু’টি অনুচ্ছেদ। এর মাঝে অনুচ্ছেদ ৩৫-ক বাদ দিতে নয়াদিলীতে কথা হচ্ছে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীরে স্থায়ী বাসিন্দাদের বিশেষ মর্যাদা ও অধিকার বিষয়ে সিদ্ধান্তের এখতিয়ার রয়েছে রাজ্যের আইনসভার। ৩৫-ক অনুযায়ী কাশ্মীরের বাসিন্দা নয়, এমন ভারতীয়দের সম্পদের মালিক হওয়া ও চাকরি পাওয়ায় বাধা আছে। ১৯৫৪ সালের ১৪ই মে রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ অধ্যাদেশের মাধ্যমে কাশ্মীরের এই মর্যাদা নির্ধারণ করেছিলেন, যা অন্য কোন ভারতীয় রাজ্যকে দেওয়া হয়নি। কাশ্মীরীরা যাতে সার্বভৌমত্বের বোধ নিয়ে ভারত ইউনিয়নে থেকে যায়, সেই লক্ষ্যে নেহরু সরকারের সুপারিশে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশটি জারী করেন সে সময়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর আলোকে অধ্যাদেশটি জারি হয়।
৩৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীরের এমন এক স্বায়ত্ত্বশাসন রয়েছে, যা ১৯৪৭ সালের পর দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো ‘দেশীয় রাজ্য’ (প্রিন্সলি স্টেট) পায়নি। সবচেয়ে বড় দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদও নয়। ৩৭০ ও ৩৫-ক অনুচ্ছেদ কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধান মেনে চলার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দিয়েছিল বলে মনে করা হত প্রথম দিকে। সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে বা ভুল প্রমাণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক কাগুজে বিষয় হয়ে গেছে রাষ্ট্রনৈতিক ওই স্বাতন্ত্র্য। অনুচ্ছেদ ৩৫-ক বাতিল হওয়া তাই কফিনে পেরেকের শব্দের মতোই হবে। এতে কাশ্মীরের জনপ্রতিনিধি সভা ভারতীয় অন্য সব রাজ্যের মতোই চরিত্র নেবে। কাশ্মীরীরা তাই চাইছে, এটা যেন সত্য না হয়, এ যেন ‘গুজব’ হয়েই থাকে।
কিন্তু বিজেপি-আরএসএস এ ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তারা জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার অবসান ঘটাবে। তাদের ভাবাদর্শিক গুরু শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর বিরোধিতা করতে গিয়েই ১৯৫৩ সালে কাশ্মীরে মারা গেছেন বলে বিশ্বাস করে সংঘ পরিবার। সে কারণেই নতুন সরকারের দুই মাস না যেতেই প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের কাশ্মীর যাওয়ার পরপরই সেখানে নতুন করে বিপুল সেনা মোতায়েন করা হ’ল। এরপরই ভারতজুড়ে লেখালেখি শুরু হয়ে গেছে, ৩৫-ক অনুচ্ছেদ বাদ দিতে চলেছে সরকার। বিষয়টি অস্বাভাবিকও নয়; যেহেতু ৩৫-ক ও ৩৭০ অনুচ্ছেদের বাতিল মোদি-অমিত শাহ জুটির নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল এবং শেষোক্তজনই আছেন এখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। তবে ৩৫-ক অনুচ্ছেদ নিয়ে দেশটির সর্বোচ্চ আদালতে সাতটি মামলা রয়েছে। এ অবস্থায় কীভাবে এখনই তা বাদ দেওয়া যায়, তার আইনগত সুযোগ খুঁজে বের করতে হবে সরকারকে আগে। আদৌ তা সম্ভব কি না, সেটাও বড় প্রশ্ন হয়ে আছে।
আরো ১০ হাযার সৈনিক গেল কাশ্মীরে :
কাশ্মীর বিষয়ে বিপজ্জনক এই গুজব ছড়িয়েছে দু’টি ঘটনায়। বিশেষ করে সেখানে নতুনভাবে ১০ হাযার সৈনিক পাঠানো হয়েছে। এছাড়া গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়া একটা চিঠিতে দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় রেলওয়ে প্রোটেকশন ফোর্সের সদস্যদের কর্তৃপক্ষ চার মাসের খাবার মওজুদ রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
৩৫-ক অনুচ্ছেদ বাতিলের কারণে ‘কাশ্মীরীরা ক্ষুব্ধ হয়ে বিক্ষোভ করতে পারে’ এই অনুমানকে ব্যবহার করে নতুন করে সেখানে সামরিকায়ন শুরু হয়েছে বলে ভাষ্যকারদের ধারণা। কাশ্মীর বিশ্বের অন্যতম প্রধান সামরিকায়িত এলাকা। বিভিন্ন গবেষণায় দাবী করা হয়, ভ্যালিতে প্রতি ১০ জন বেসামরিক ব্যক্তির বিপরীতে একজন নিরাপত্তা সদস্য আছে। ভারতের অন্যত্র যা ৮০০ : ১।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনও নতুন করে চাইছে কাশ্মীর বিষয়ে আলাপ-আলোচনা ও মধ্যস্থতা। নয়াদিলী ঠিক এ সময়ই সেখানে নতুন করে বিপুল সেনা পাঠিয়ে ভিন্ন অবস্থান জানিয়ে দিল। জম্মু-কাশ্মীর-লাদাখ প্রশ্নে ভারত কোন মধ্যস্থতায় রাযী নেই।
তবে পাকিস্তান অনেক দিন ধরে কাশ্মীর বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপ চাইছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সর্বশেষ মনোভাব তার অবস্থানকে শক্তিশালী করছে। কিন্তু ‘অনুচ্ছেদ ৩৫’-এ বাদ দেওয়ার দৃশ্য অসহায়ের মতো দেখা ছাড়া ইমরান খানের কিছু করার নেই এ মুহূর্তে। অর্থনৈতিকভাবে দেশটি নাজুক অবস্থায় আছে। নয়াদিলী কোন উত্তেজক নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলেও পাকিস্তানী সৈনিকদের ছাউনিতে বসেই খবরটি শুনতে হবে।
ভারতের কাশ্মীর কৌশল পাল্টাচ্ছে :
৩৫-ক অনুচ্ছেদ বাতিলের সম্ভাব্য ভারতীয় উদ্যোগের মূল তাৎপর্য কাশ্মীর আর আগের মতো মুসলমানপ্রধান থাকবে না। জম্মুতেও অমুসলমানদের হিস্যা বাড়ানো হবে। মূলতঃ জনমিতি পাল্টে কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নতুন এক নিরীক্ষা হিসাবেই দোভাল-অমিত শাহ জুটি উদ্যোগটি নিচ্ছেন।
আরএসএসের অনেকেই মনে করেন, হিন্দুপ্রধান জম্মু এবং বৌদ্ধপ্রধান লাদাখকে পাশে রেখে কাশ্মীরকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, যদি কাশ্মীরে অমুসলমান হিস্যা বাড়ানো যায়। কাশ্মীরী অমুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির আইনগত প্রতিবন্ধকতা অপসারিত হলে ধীরলয়ে এটা একসময় পূর্ণ ভারতীয় রূপ নিয়ে নেবে। এছাড়া ৩৫-ক-এর অনুপস্থিতিতে কাশ্মীরের ভারতীয় কর্পোরেটদের সম্পদ ক্রয় ও বিনিয়োগেও বিশেষ সুবিধা হবে।
ভারতে এ মুহূর্তে যে আটটি প্রদেশে হিন্দুরা সংখ্যালঘু, তার একটি জম্মু ও কাশ্মীর। প্রদেশের জম্মুতে হিন্দু রয়েছে ৬৩ শতাংশ, লাদাখে ১২ এবং কাশ্মীরে ২ শতাংশ। গড়ে পুরো রাজ্যে ৩৬ শতাংশ। বিজেপি এ অবস্থারই পরিবর্তন ঘটাতে চায় ৩৫-ক পাল্টে। অর্থাৎ ভ্যালিতে জনমিতিক পরিবর্তন ঘটিয়ে।
রাজ্যের সর্বশেষ মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতী নয়াদিলীর পরিকল্পনাকে আগুনে বারুদের গুঁড়া ছিটানোর মতো ভুল হিসেবে হুঁশিয়ার করেছেন। তাঁর মতে, এতে পরিস্থিতির ওপর কারোরই নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। মেহবুবার দ্বিতীয় বাক্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। ৩৫-ক কিংবা ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল হওয়া মানে কাশ্মীরী তরুণ-তরুণীদের কাছে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাওয়া। নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ৩৫-ক অনুচ্ছেদ না থাকলে কাশ্মীরীদের ভূসম্পদ দ্রুত হাতবদল হতে থাকবে, এ শঙ্কায় ভীত কাশ্মীর।
কাশ্মীরীদের পাশে কেউ নেই :
বড় একটা গ্যারিসনের মতো কাশ্মীরের পরিবেশে এ মুহূর্তে স্বাধীন মতামত বা ভিন্নমত প্রকাশের কার্যত কোন নিয়মতান্ত্রিক উপায় নেই। এক বছর হ’ল রাজ্যটিতে প্রথমে গভর্ণরের শাসন এবং পরে রাষ্ট্রপতির শাসন চলছে। ২২ বছর পর সেখানে আবার নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির এরূপ দুর্দিন চলছে।
বিজেপি ছাড়া অন্যান্য দলের রাজনৈতিক তৎপরতা প্রায় বন্ধ। জনভিত্তিসম্পন্ন রাজনীতিবিদেরা অনেকেই গৃহবন্দী বা কারাগারে। জনরোষ স্তব্ধ রাখতে প্রায়ই ভ্যালিতে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রাখা হয়। ৩৫-ক অনুচ্ছেদের অপমৃত্যু ঘটলে এই খারাপ সময় আরো প্রলম্বিতই হবে। বলা যায়, কাশ্মীরের সামগ্রিক অবস্থাটি সেখানকার কবি আগা শহীদ আলীর সেই বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য কান্ট্রি উইদাউট এ পোস্ট অফিস’-এর মতো এখন। বন্ধ পোস্ট অফিসে বিলিবণ্টন না হওয়া চিঠির স্তূপকে উপজীব্য করে লেখা ওই দীর্ঘ কবিতার ৯১তম লাইনে কবি লিখছেন : প্রেমিকাকে লেখা এক কারাবন্দীর চিঠি দেখছি। যার শুরু হয়েছে এই বাক্য দিয়ে, ‘এই শব্দগুলো হয়তো তোমার কাছে কখনোই পৌঁছাবে না’।
কবিরা অনেক সময়ই চরম সত্যের বার্তাবাহক হয়ে ওঠেন। আগা শহীদ আলীর রূপক মিথ্যা নয় যে কাশ্মীরীদের নিপীড়িত বাস্তবতার সামান্যই জানে বিশ্ব এ মুহূর্তে। কিন্তু এই সচেতন উদাসীনতা সত্ত্বেও সেখানকার রক্তপাতের দায় সভ্য দুনিয়ার ওপরও অনেকখানি বর্তায়।
\ সংকলিত \