মোদী একজন শক্তিমান বক্তা। গত কয়েক মাসে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছেন, এমনকি তিনি পূজনীয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদে যারা বিশ্বাস করেন না, তারাও মোদীর প্রশংসা করতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ হচ্ছে, তাঁর কর্মসূচীতে ভারতের ৩০০ মিলিয়ন মধ্যবিত্ত মানুষের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে। তা হ’ল দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন। তাঁর নেতৃত্বে গুজরাটের অর্থনীতি ২০০১ সালের পর আকারে তিন গুণ বেড়েছে। সে কারণেই ২০০১ সালের পর থেকে তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অপরিসীম। কাজ করিয়ে নিতে ও বিনিয়োগ আনতে তিনি পারঙ্গম। দুর্নীতিও নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা তাঁর আছে, আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারেন তিনি। অচল ও ঝামেলাপূর্ণ নিয়মকে ঝেড়ে ফেলার ক্ষমতা রাখেন তিনি।

ভারতের মানুষ আরো পাঁচ বছর কংগ্রেস শাসনে থাকতে চায় না কেন, সেটা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিষয়ে মোদীর অবস্থান ও পুরনো রেকর্ড জানার পরও মানুষ তাঁকে নিয়ে এত উচ্ছ্বসিত কেন, তা বোঝা অতটা সহজ নয়।

২০০২ সালে মোদী যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী, সে সময় প্রায় দুই হাযার মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মৃত্যুবরণ করে। আরো প্রায় দুই লাখ মুসলিম ঘরছাড়া হয়। অনেক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়, পুরুষদের কেটে টুকরো টুকরো করা হয় এবং কেরোসিন দিয়ে বা জ্বলন্ত টায়ারে পুড়িয়ে মারা হয়। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের পেট চিরে তাঁদের চোখের সামনে ভ্রূণ হত্যা করা হয়। মোদী নিজের ব্যবহারিক প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে গর্ব করলেও তাঁর বিরুদ্ধে ২০০২ সালের দাঙ্গা সংঘটিত হতে দেওয়ার অভিযোগ আছে। এমনকি দাঙ্গাবাজদের গ্রেপ্তার না করার জন্যও নাকি তিনি পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যদিও এ অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি প্রতিবেদনে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, মোদীর প্রশাসন এই হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করেছে। ‘এটা ছিল পরিকল্পিত আক্রমণ’। ঐ প্রতিষ্ঠানের একজন জ্যেষ্ঠ গবেষক বলেছেন, ‘এটা সংঘটিত হয়েছে পুলিশ ও রাজ্য সরকারের কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ সহায়তায়’।

মোদী বেশ কয়েকটি আনুষ্ঠানিক তদন্তের মুখোমুখি হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোন রায় হয়নি। এমনকি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাদানে তাঁর সরকার ব্যর্থ হলেও তিনি কখনোই ক্ষমা প্রার্থনা করেননি বা তাঁর মধ্যে কোন অনুশোচনাও দেখা যায়নি। দাঙ্গাবিষয়ক প্রশ্ন করা হলেও তিনি এর উত্তর দিতে অস্বীকার করেছেন। এ বিষয়ে গত বছর তিনি মন্তব্য করেন, ‘একটি কুকুরছানা গাড়িচাপা পড়লে’ আমি যেমন দুঃখিত হতাম, দাঙ্গায় মুসলমানদের দুর্দশায় ঠিক তেমন কষ্ট পেয়েছি। একবার তিনি দাঙ্গাবাজদের কর্মকান্ডকে আংশিকভাবে যৌক্তিকও বলেছিলেন। যেমন বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘নয়-এগারো পরবর্তীকালে নিরপরাধ শিখ নিহত হয়েছিল, কেন? কারণ সে দেখতে সন্ত্রাসীদের মতো ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষিত মানুষদের যদি উসকানি দিয়ে এ কাজ করানো সম্ভব হয়, তাহলে গুজরাটের মানুষদের ক্ষেত্রে কেন ভিন্ন মাপকাঠি ব্যবহার করা হবে?’ আরও একবার এর চেয়েও শীতল কণ্ঠে তিনি ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছিলেন, ‘কেন ২০০২ সাল নিয়ে এত কথা হচ্ছে?... এটা অতীত, এর কী তাৎপর্য আছে?’ নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেছিলেন, তাঁর একমাত্র আক্ষেপ হচ্ছে, তিনি মিডিয়াকে সামলাতে পারেননি।

এসব বক্তব্যে ভারতীয় মুসলমানরা আশ্বস্ত হননি, উদার হিন্দুদেরও তা আশ্বস্ত করতে পারেনি। এই ঘরানার মানুষ ভারতের বহুত্ববাদী সমাজকাঠামোর ওপর ভরসা রাখে। মোদীর দলের মুসলমানবিরোধিতাও কমেনি: সেই দাঙ্গার শিকার ৫০ হাযার মানুষ এখনো অতিদারিদ্রে্যর মধ্যে বসবাস করছে, উদ্বাস্ত্ত হয়ে তারা ৮৩টি ‘শরণার্থী শিবিরে’ পচে মরছে। মোদী একবার এসব শিবির পরিদর্শন করলেও তিনি তাচ্ছিল্যভরে এসব শিবিরকে মুসলিম ‘শিশু উৎপাদন শিবির’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। নির্বাচনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় তিনি বারবার মুসলিম টুপি পরতে অস্বীকার করেন। তাঁর ভাষায়, ‘এর মানে হবে সংখ্যালঘুদের তোয়াজ করা’।

১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ভাঙার সঙ্গেও মোদীর সম্পর্ক আছে। তার আগে ১৯৯০ সালে সোমনাথ মন্দির থেকে রথযাত্রা আয়োজনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। এই রথযাত্রায় যে প্রচারণা চালানো হয়, সেটাই পরবর্তীকালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসে প্ররোচনা দেয় বলে অভিযোগ আছে। মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন ২০০১ সালের সাত অক্টোবর। চার মাস পরেই গোধরা স্টেশনে ৫৯ জন তীর্থযাত্রী ট্রেনে আগুন লেগে পুড়ে মারা যান। কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই মোদী বলে বসেন, এটা পাকিস্তানের মুসলমানদের ষড়যন্ত্র। তিনি রাজ্যব্যাপী হরতাল ডেকে বসেন। আর আগুনে পোড়া তীর্থযাত্রীদের মরদেহ নিয়ে মিছিল করেন। উত্তেজক বক্তৃতাও দেন তিনি।

তার পরের দিন জঙ্গী হিন্দুদের একটি বিশাল দল নানা রকম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গুজরাটের অভিজাত মুসলিম আবাসিক এলাকা গুলবার্গের সামনে জড়ো হয়। সেখানে থাকতেন কংগ্রেসের সাবেক সাংসদ এহসান জাফরী। পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা দেখে জাফরী আতঙ্কিত হয়ে সাহায্যের জন্য বিভিন্ন স্থানে ফোন করতে শুরু করেন। এঁদের মধ্যে মোদীও ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জাফরী নিরাশ হয়ে পড়েন। সে সময় জাফরীর বাড়িতে ইমতিয়ায পাঠান নামের একজন বিদ্যুৎমিস্ত্রি আশ্রয় নেন।

ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় তিনি বলেন, ‘আমি যখন জাফরী সাহেবকে বলি, কী হয়েছে; ‘তিনি বলেন, কোন পুলিশ মোতায়েন করা হবে না।’ জাফরীর বিধবা স্ত্রী যাকিয়ার ভাষ্য অনুসারে, মোদী তাঁর স্বামীকে বিদ্রূপ করে বলেন, জাফরী এখনো বেঁচে আছেন শুনে তিনি বিস্মিত।

এর কিছুক্ষণ পরেই জাফরীর স্ত্রী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আতঙ্ক নিয়ে দেখেন, দাঙ্গাবাজরা তাঁর স্বামীকে দিগম্বর করে টেনে রাস্তায় নিয়ে যাচ্ছে। তার চোখের সামনেই তারা জাফরীকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে একে একে তাঁর আঙুল, হাত, পা, মাথা কেটে টুকরো টুকরো করছে। তারপর জাফরীর মৃতদেহকে তারা একটি উন্মুক্ত চিতায় স্থাপন করে। পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেও কিছু করেনি। এমনকি জাফরীকে পুলিশ বলে, ‘আপনাকে বাঁচানোর ব্যাপারে আমাদের ওপর কোন নির্দেশ নেই’। পরবর্তীকালে একটি ম্যাগাজিনের তদন্তে কয়েকজন দাঙ্গাবাজকে ক্যামেরার সামনে বলতে শোনা গেছে, মুখ্যমন্ত্রী এই আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছেন। মোদী আমাদের তিন দিন সময় দিয়ে বলেছেন, ‘এর মধ্যে যা পার করো’, দাঙ্গাবাজদের একজন গর্বভরে বলেন।

মোদীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে গুরুতর। কিন্তু তিনি যথারীতি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন, এমনকি এও বলেন, সেদিন রাত সাড়ে আটটার আগে তিনি এ ঘটনা জানতেনই না। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমও (এসআইটি) তাঁর এই ভাষ্য সত্য বলে ধরে নিয়েছে।

 তবে এই এসআইটির প্রতিবেদনে অনেক অসংগতি আছে। ফলে এটা গ্রহণ করা কঠিন। যেমন, ঘটনার দিন দাঙ্গা শুরু হলে গুলবার্গে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বহুবার যোগাযোগ হয়েছে, সে রেকর্ড আছে।

এই প্রতিবদনে মোদীর প্রশংসা করে বলা হয়েছে, সেদিন তিনি বারবার পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেটাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে তিনি কী করে জাফরীকে খুনের ঘটনাটি রাতে জানলেন? ফলে প্রতিবেদনটি নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে।

বিশেষত মোদীর একজন সাবেক সহকারী যখন একটি এফিডেভিটের বরাত দিয়ে বলেন, গুজরাটের আইনজীবীদের কাছে ঐ প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়েছিল। তাঁরা এটা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে খতিয়ে দেখেন, এমনকি এর সম্পাদনাও করেন।

ভারতের জনগণ একটি মারাত্মক জুয়া খেলায় মেতে উঠেছে। তারা মোদীর মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতাবিষয়ক অবস্থানকে পাশ কাটিয়ে তাঁর মধ্যে একজন শক্তিশালী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম ব্যক্তিকে নির্বাচিত করেছেন। যিনি হয়তো কিছু কঠিন সংস্কার করতে পারবেন, সুশাসনও কিছুটা নিশ্চিত করতে পারবেন। এতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও হয়তো আসবে। কিন্তু তার বদলে ভারতীয়রা কী হারাল, সেটা তাদের ভেবে দেখা দরকার।                               \ সংকলিত\

উইলিয়াম ডালরিম্পল

‘নিউ স্টেটসম্যান’ পত্রিকার ভারতীয় প্রতিনিধি।






বাংলা ভাষা ও বাংলা একাডেমী নিয়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ​র অগ্রন্থিত বক্তৃতা
কুরআন ও বাইবেলের আলোকে যাবীহুল্লাহ কে? - রূহুল হোসাইন, জলঙ্গী, মুর্শিদাবাদ, ভারত
রেল দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার - মুহাম্মাদ আব্দুছ ছবূর মিয়া, ঝিনাইদহ
রক্তাক্ত পেশোয়ার : চরমপন্থার ভয়াল রূপ - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
সভ্যতার সঙ্কট ও ধর্মনিরপেক্ষ জঙ্গীবাদ
ফ্রান্স ও স্পেনে হিজাব নিষিদ্ধ
গ্লোবাল টাইগার সামিট
অ্যান্টি সিক্রেট ওয়েবসাইট : উইকিলিকস - শরীফা বিনতে আব্দুল মতীন
রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা - সুকান্ত পার্থিব
ইতিহাসের ভয়াবহ সব মহামারীগুলো - -আত-তাহরীক ডেস্ক
হিজাব ও ঔপনিবেশিকতা : প্রেক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় - মুহাম্মাদ আবূ হুরায়রা ছিফাত
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ - জামালুদ্দীন বারী
আরও
আরও
.