ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রেল দুর্ঘটনা সমগ্র জাতিকে আবারো কাঁদালো। হৃদয় বিদারক এ ঘটনা বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে দেখল সমগ্র জাতি। ঘটে যাওয়া রেল দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে যথাযথ হিসাব পাওয়া না গেলেও সব মিলিয়ে ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৮ কোটি টাকার। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে রেলের যে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে সেই তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে। আমরা যদি বাস্তবতা একটু চিন্তা করি তাহ’লে দেখব, রেল দুর্ঘটনা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিংবা অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশী সংঘটিত হয়। এক একটি দুর্ঘটনায় একটি পরিবারের সারা জীবনের কান্না। এমনকি এমন নযীরও আছে পুরো পরিবার শেষ হয়েছে শুধুমাত্র একটি ভুলের জন্য। সেই একজন বা দুইজন মানুষের ভুলের মাশুল গুনতে হয় হাযারো মানুষকে।

ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ :

ট্রেন দুর্ঘটনার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হ’ল।-

১. জনবল সংকট : রেলে দক্ষ জনবলের সংকট রয়েছে বহুদিন থেকে। ১৯৭৩ সালে রেলে জনবল ছিল ৬৮ হাযার। তখন দেশের মানুষ ছিল ৭ কোটি। অথচ এখন প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে রেলের জনবল ২৭ হাযার। আবার ট্রেনের চালকের সংকট থাকায় তাদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। তাই বাড়তি চাপে কাজ করতে গিয়ে শরীর ক্লান্ত হয়ে তন্দ্রা বা ঘুম আসা স্বাভাবিক। এতে দুর্ঘটনা ঘটে।  

২. ডবল লাইন না থাকা : দেশে সিঙ্গেল লাইনে ট্রেন চলে, ফলে কোথাও দুর্ঘটনা ঘটলে পুরো এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এটা যতদিন না ডাবল লাইন করা যাচ্ছে, ততদিন এই সমস্যা বিদ্যমান থাকবে। ত্রুটিপূর্ণ লাইন মেরামতের সময় লুপ লাইনে যেতে গিয়ে অনেক সময় ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে।

৩. মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন ও জরাজীর্ণ লাইন : দেশের রেল ওয়েতে শতবর্ষী মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন-কোচ দিয়ে জরাজীর্ণ লাইনে চলছে যাত্রী পরিবহন। সেই সঙ্গে রেল পার্টিতে নেই পাথর, নেই ফিসপ্লেট, নাট-বল্টু খোলা ইত্যাদিও রেল দুর্ঘটনার কারণ।

৪. অসতর্কতা ও অবহেলা : রেল দুর্ঘটনার ৮০ শতাংশের বেশি ঘটছে কর্মীদের ভুলে ও অবহেলায়। গত পাঁচ বছরের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনার দু’টি কারণ পাওয়া যায়। ১. মানবিক ভুল ২. কারিগরি ত্রুটি। গড়ে ৮০% ভুলের মধ্যে রয়েছে লাইন পরিবর্তনের জোড়া ভুলভাবে স্থাপন করা ও ভুল সংকেত দেওয়া। সংকেত ও গতিনির্দেশিকা না মেনে ট্রেন চালান চালক ও সহকারী চালকেরা।

৫. সিগনাল সমস্যা : ত্রুটিপূর্ণ সিগন্যালিং ব্যবস্থার কারণে রেল দুর্ঘটনা ঘটছে। সিগন্যালের লাইট অনেক সময় হয়তো সঠিকভাবে জ্বলে না। আবার কোনটা হালকা থাকে এবং কোনটা উজ্জ্বল থাকে। উজ্জ্বল থাকলে সমস্যা থাকে না। যেটায় আলো কম থাকে, সেটা চোখে পড়ে না। এ কারণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

৬. অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং : অবৈধ লেভেল ক্রসিং দিয়ে রেললাইনে অন্যান্য যানবাহন উঠে যাওয়ার কারণে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটছে।

ট্রেন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় :

দক্ষ জনবল বৃদ্ধি করা, নতুন ইঞ্জিন-কোচ ক্রয় করা, রেল লাইনের সংস্কার ও ডবল লাইনের ব্যবস্থা করা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের নিয়মিত তদারকি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, আধুনিক সিগনালের ব্যবস্থা করা এবং অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা। সেই সাথে রেল পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের ‘রানিং স্টাফ’ বলা হয়। এর মধ্যে চালক, সহকারী চালক, পরিচালক (গার্ড), স্টেশনমাস্টার রয়েছেন। এদের প্রত্যেককে বাধ্যতামূলক ডোপ টেস্ট (মাদক পরীক্ষা) করার নিয়ম বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব বিষয়ে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিয়ে রেলের দুর্ঘটনা এড়ানো এবং সেবার মান বাড়ানো যেতে পারে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে রেল দুর্ঘটনা :

বাংলাদেশ রেল বিভাগ বলছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারী থেকে ২০১৯-এর জুন পর্যন্ত গত ৫ বছর দুর্ঘটনা হয়েছে ৮৬৮টা। এই দুর্ঘটনাগুলোতে ১১১ জন নিহত এবং আহত হয়েছে ২৯৮ জন। তবে সম্প্রতি দু’টি দুর্ঘটনা ধরলে এই সংখ্যা হবে ৮৭০টা। এই দুর্ঘটনাগুলোতে ১২৭ জন নিহত এবং আহত হয়েছে তিন শতাধিক।

দেশে ঘটে যাওয়া কিছু রেল দুর্ঘটনার বিবরণ নিম্নরূপ-

১৯৮৩ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামের কাছাকাছি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে ১৩ জন নিহত হয় ও ২০০ জন আহত হয়। ১৯৮৩ সালের ২২শে মার্চ ঈশ্বরদীর কাছে সেতু পার হওয়ার সময় কয়েকটি স্প্যান ভেঙে পড়ে। নিচে শুকনো জায়গায় পড়ে ট্রেনের কয়েকটি বগি। এতে ৬০ জন যাত্রী নিহত হয়।

১৯৮৫ সালের ১৩ই জানুয়ারী খুলনা থেকে পার্বতীপুরগামী সীমান্ত এক্সপ্রেসের কোচে আগুন ধরে যায়। এতে ২৭ জন যাত্রী নিহত হয় এবং ২৭ জন আহত হয়।

১৯৮৬ সালের ১৫ই মার্চ সর্বহারা পার্টির নাশকতায় ভেড়ামারার কাছে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে নদীতে পড়ে যায়। এতে ২৫ জন যাত্রী নিহত এবং ৪৫ জন আহত হয়।

বাংলাদেশের ইতিহাসে দেশে সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৯ সালের ১৫ জানুয়ারী টঙ্গীর মাজুখানে। সেদিন দু’টি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৭০ জন যাত্রী নিহত হয় এবং ৪০০ যাত্রী আহত হয়।

১৯৯৫ সালের ১৩ই জানুয়ারী রাত সোয়া ৯-টায় হিলি স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা গোয়ালন্দ থেকে পার্বতীপুরগামী লোকাল ট্রেনকে ধাক্কা দেয় সৈয়দপুর থেকে খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস। এতে দু’টি ট্রেনের ৫০ জনের বেশী যাত্রী নিহত এবং আহত হয় দুই শতাধিক যাত্রী।

২০১০ সালে নরসিংদীতে চট্টগ্রামগামী মহানগর গোধূলি এবং ঢাকাগামী চট্টলা এক্সপ্রেসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে চালকসহ মোট ১২ জন নিহত হয়।

২০১৬ সালে নরসিংদীর আরশীনগর এলাকায় ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়াগামী তিতাস কমিউটার ট্রেনের ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়। দুর্ঘটনার কারণ ছিল ভুল সিগন্যাল। এতে দুইজন নিহত ও অন্তত ১০ আহত হয়।

২০১৮ সালের ১৫ই এপ্রিল টঙ্গীতে ঢাকা-জয়দেবপুর রেললাইনে একটি ট্রেনের ৫টি বগি লাইনচ্যুত হ’লে ৫ জন নিহত ও ৫০ জন আহত হয়।

২০১৯ সালের ২৩শে জুন কুলাউড়ার বরমচাল রেলক্রসিং এলাকায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেসের ৪টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে খালে ছিটকে পড়ে। এতে ৬ জন যাত্রী নিহত হয়।

২০১৯ সালের ১২ই নভেম্বর ভোররাত পেŠনে ৩-টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দবাগ রেল স্টেশনে সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেসের পেছনের কয়েকটি বগিকে ধাক্কা দেয় চট্টগ্রাম থেকে আসা তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস। এতে ১৬ জন নিহত ও আহত হয়েছে শতাধিক যাত্রী।

সর্বশেষ গত ১৪ই নভেম্বর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয় এবং ৩টি বগিতে আগুন ধরে যায়। এতে ট্রেনের চালকসহ অন্তত ২৫ জন আহত হন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কোটি টাকার উপরে।

বিশ্বের উল্লেখযোগ্য কিছু রেল দুর্ঘটনা :

১৯১৭ সালে রোমানিয়ার সিউরেয়া স্টেশনের নিকটবর্তী এলাকায় একটি ট্রেনে আগুন ধরে গেলে অন্তত ছয় শত যাত্রী নিহত হয়।

১৯১৭ সালের ১২ই ডিসেম্বর। প্রচন্ড গতির কারণে আল্পস পর্বতের পাশ দিয়ে যাওয়া ফ্রান্সের সেইনট মিশেল-ডে-মাউরিএনে রেল দুর্ঘটনায় সৈন্যবাহী একটি ট্রেনের ব্রেকে আগুন ধরে যায়। ধারণা করা হয় এ দুর্ঘটনায় যাত্রীদের সবাই নিহত হয়।

১৯৪৪ সালের ৩রা জানুয়ারী স্পেনের টরে ডেল বিয়েরজু গ্রামে অবস্থিত ২০ নাম্বার টানেলে একটি মেইল ট্রেইন প্রবেশ করে। এসময় বিপরীত দিক থেকে কয়লাবাহী আরেকটি ট্রেনের সাথে মুখোমুখি ধাক্কা লাগে। ট্রেন দু’টিতে বেশ কিছু যাত্রী থাকলেও তারা টিকেট ছাড়াই ভ্রমণ করছিল। ফলে হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। ট্রেন দু’টিতে টানা দু’দিন ধরে আগুন জ্বলেছিল।

১৯৮১ সালের প্রায় ১০০০ যাত্রী নিয়ে ভারতের বিহারের বাঘমতি নদীতে পড়ে যায় একটি ট্রেন। টেনটি যখন সেতুর কাছে এসেছিল ঠিক সেই মুহূর্তে একটি গরু ট্রেনলাইন পার হচ্ছিল। গরুটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গেলে রেলের নিয়ন্ত্রণ হারায় চালক। পাঁচ শতের অধিক যাত্রী নিহত হয়েছিল এ দুর্ঘটনায়।

ইথিওপিয়ার আওয়াশ শহরের নিকটে ১৯৮৫ সালের ১৪ই জানুয়ারী ট্রেন দুর্ঘটনাটি আফ্রিকার ভয়াবহতম দুর্ঘটনা হিসাবেই প্রসিদ্ধ। আওয়াশ গিরিখাতের পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়ে খাদে পড়ে গেলে ৪২৮ জন নিহত হয়।

২০০২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারী মিশরের কায়রো থেকে লুক্সরগামী ট্রেনের একটি বগিতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। আগুন ছড়িয়ে পড়ে ট্রেনের অন্যান্য বগিতে এবং ট্রেনটির সাতটি বগি পুড়ে নিহত হয় কমপক্ষে ৪০০ জন মানুষ।

২০০৪ সালের সুনামির দিনে প্রায় ১৫ শত যাত্রী নিয়ে সমুদ্র থেকে মাত্র ২১৭ গজ দূরে অবস্থান করছিল একটি ট্রেন। সুনামির প্রথম ঢেউটি আসার সময়ে স্টেশনের আরো অনেক যাত্রী ট্রেনটিকে নিরাপদ ভেবে আশ্রয় নেয়। ১৭০০ জনের অধিক মানুষ এ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত হয়।

উপসংহার :

রেল দুর্ঘটনা নতুন কিছু নয়। মাঝে মধ্যেই এ রকম মর্মান্তিক খবর জাতির বিবেককে নাড়া দেয়। কিন্তু কিছু দিন পর আমরা ভুলে যাই। দুর্ঘটনা থেকে যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ করি না। প্রতিকারেরও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। ফলে যা হবার তাই হয়। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে ভাবা উচিত। শুধু ট্রেন বৃদ্ধি নয় বরং লাইন বৃদ্ধি করা উচিত। এতে দুর্ঘটনা যেমন কমবে, তেমনি সিডিউল বিপর্যয়ের অভিশাপ থেকে জাতি মুক্তি পাবে। পরিশেষে বলব, সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে রেল হ’তে পারে আমাদের অন্যতম একটি যোগাযোগ মাধ্যম ও সরকারী আয়ের অন্যতম উৎস।

 

 

 

 

 






ফারাক্কা-রামপাল : বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্কের বাধা - আনু মুহাম্মদ, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ
জাপান : সততাই যার মূল শক্তি - \ সংকলিত \
আত্মহত্যা ও সামাজিক দায় - মুহাম্মাদ ফেরদাঊস
মৃদু ভূকম্পন বড় ভূমিকম্পের এলাহী হুঁশিয়ারি - আবু ছালেহ
শূকরের চর্বিজাত খাবার ও প্রসাধনী নিয়ে সতর্কতা - ড. আ ফ ম খালিদ হাসান
কোথায় মিলবে চিকিৎসা? - মুহাম্মাদ আবু নোমান
ইতিহাসের ভয়াবহ সব মহামারীগুলো - -আত-তাহরীক ডেস্ক
তাবলীগ জামাতে সংঘর্ষ
সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে - \ সংকলিত \
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক : একটি প্রাসঙ্গিক আলোচনা - লিলবর আল-বারাদী - যশপুর, তানোর, রাজশাহী
পহেলা বৈশাখ ও সাংস্কৃতিক রাজনীতি - মুহাম্মাদ আবু হুরায়রা ছিফাত
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা : আমাদের করণীয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আব্দুর রব
আরও
আরও
.