একটি সমাজ ও সভ্যতার মূল্যবোধ প্রজন্মের পর প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষাব্যবস্থাই নির্ধারণ করে ভবিষ্যতে দেশে কি ধরনের নাগরিক তৈরি হবে। রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য কেবল কর্মদক্ষ নাগরিক তৈরি নয়। কেননা রাষ্ট্রের কল্যাণ কেবল বস্ত্তগত উন্নতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা রক্ষা ও মানবিকতার বিকাশে নৈতিকতার বিষয়টিও যরূরী। কোন দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাক্রম হ’ল একটি আয়নাস্বরূপ, যার মধ্যে সেদেশের মানুষ তাদের নিজেদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। দেশের ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতীয় মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি বিনির্মাণে অত্যন্ত যরূরী। এজন্য একটি নিখুঁত শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নের কাজটি সে দেশের নাগরিকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট ৯টি শিক্ষা কমিশন গঠিত হ’লেও কোনটির সুপারিশকৃত শিক্ষানীতিতেই গণমানুষের কৃষ্টি-কালচার, জীবনবোধ ও দর্শনের প্রতিফলন ঘটেনি। গত বছর থেকে নতুন যে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হয়েছে তা নিয়ে নানা মহল থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়েছে। কুদরত-ই-খুদা শিক্ষানীতিকে ভিত্তি ধরে সাজানো হয়েছে এ শিক্ষাক্রম। ৯০ শতাংশের অধিক মুসলিম জনগোষ্ঠীর এ দেশে যে ধরনের শিক্ষানীতি বা শিক্ষাক্রম হওয়ার কথা ছিল ব্রিটিশ ভারত থেকেই তা চরম অবহেলার শিকার। ১৯৭১ সালের পর প্রণীত বাংলাদেশের সব শিক্ষানীতিতে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত নামকাওয়াস্তে কিছু ধর্মীয় পাঠ্যবই রাখা হ’লেও অবহেলা ছিল সেখানেও। উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোতে ধর্মীয় শিক্ষার কোন কাঠামো না থাকায় দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত ও কর্মদক্ষ জনগণের মধ্যে দেখা দিয়েছে নৈতিকতার চরম সঙ্কট। যুগের পর যুগ পার হচ্ছে কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষার কোন পরিমার্জন হচ্ছে না। বরং আধুনিকায়নের নামে মাদ্রাসা শিক্ষার মৌলিকত্ব নষ্ট করে স্কুলের সিলেবাস মাদ্রাসার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যত সময় যাচ্ছে শিক্ষিতের হার এবং মাথা পিছু আয় বাড়ছে; বাড়ছে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা; কিন্তু এর সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে যাবতীয় অনৈতিক কর্মকান্ডও। অথচ শিক্ষার উন্নয়নের সাথে সাথে তা নিমণগামী হওয়ার কথা ছিল। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার গোড়ায় সঙ্কট রয়েছে। এ সঙ্কটের স্বরূপ উদঘাটন ও তার নিরসন করা প্রয়োজন।
শিক্ষাব্যবস্থা : তত্ত্ব ও ইতিহাস
শিক্ষাব্যবস্থা বলতে শিক্ষা সংস্থানকে সুসংগঠিত করার প্যাটার্ন বোঝায়, যা সাধারণত জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত হয়। মূলতঃ জাতীয় পর্যায়ই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আর শিক্ষানীতি বলতে সেসব নীতিমালার সমষ্টি বোঝায়, যার উপর ভিত্তি করে এই সংগঠনের কাজ করা যায়, যার মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষাসংক্রান্ত নির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্য হাছিল করার প্রত্যাশা করা হয়। কোন রাষ্ট্র কি ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি নির্ধারণ করবে তা নির্ভর করে ঐ রাষ্ট্রের শিক্ষাসম্পর্কিত ধারণার উপর। এ ধারণাগুলোর মধ্যে আছে শিক্ষার প্রকৃতি, শিক্ষার উৎস, শিক্ষাদানের পদ্ধতি, শিক্ষার উদ্দেশ্য ইত্যাদি।
প্রাচীন মিসরীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতায় শিক্ষা মূলতঃ ধর্মীয় যাজকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হ’ত। বিজ্ঞান, চিকিৎসা, গণিত ও জ্যামিতির মতো ব্যবহারিক বিষয়গুলো যাজকরাই আনুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দিতেন। অন্যদিকে স্থাপত্যবিদ্যা, প্রকৌশলবিদ্যা ও ভাস্কর্যশিল্পের মতো পেশামূলক বিষয়গুলো আনুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে শিক্ষা দেয়া হ’ত। শিক্ষা মূলতঃ সমাজের প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানদের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল। পুনরাবৃত্তি ও মুখস্থকরণ ছিল শিক্ষার প্রাথমিক পদ্ধতি। তবে গ্রীক সভ্যতায় ছেলেরা ৭ বছর বয়সে বিদ্যালয়ে যেত যেখানে তারা পড়া, লেখা, গণিতের পাশাপাশি কাব্য ও সঙ্গীতও শিখত। মেয়েরা ঘরে পড়তে ও লিখতে শিখত। এছাড়াও মায়েদের থেকে সেলাই, রন্ধন ইত্যাদি ব্যবহারিক বিদ্যা শিখত। ছেলেদের সাত বছর বয়সেই সামরিক ব্যারাকে পাঠিয়ে দেয়া হ’ত যুদ্ধবিদ্যা শেখানোর জন্য। শারীরিক কসরত ছিল শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। রোমান সভ্যতায় ধনী পরিবারের সন্তানদের ঘরে শিক্ষক রেখে শিক্ষাদান করা হ’ত। অন্যান্য ছেলে-মেয়েরা সাত বছর বয়সে বিদ্যালয়ে যেত, যেখানে তারা প্রাথমিক শিক্ষা হিসাবে পড়তে, লিখতে ও সাধারণ হিসাব করতে শিখত। ছেলেরা আরো উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করত যে পর্যায়ে তাদের জ্যামিতি, ইতিহাস, সাহিত্য এবং বক্তৃতা শেখানো হ’ত। গ্রীক ও রোমান শিক্ষাব্যবস্থায় জনপরিসরে অংশগ্রহণ এবং নাগরিক দায়িত্বের ওপর জোর দেয়া হ’ত।
খ্রিষ্টীয় ইউরোপে মধ্যযুগে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল ক্যাথলিক চার্চের সাথে সংশ্লিষ্ট। এসব প্রতিষ্ঠানে খ্রিষ্টধর্মীয় শাস্ত্র ছাড়াও ব্যাপক পরিসরে ত্রয়ী বিষয় (trivium) তথা ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র ও যুক্তিবিদ্যা এবং ক্ষুদ্র পরিসরে চতুষ্টয়ী বিষয় (quadrivium) তথা গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও সঙ্গীত শেখানো হ’ত। শিক্ষার মাধ্যম ছিল ল্যাটিন ভাষা। এনলাইটেনমেন্ট যুগের পর থেকে পাশ্চাত্যে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর খ্রিষ্টধর্মীয় প্রভাব দুর্বল হ’তে থাকে। বাইবেলের প্রামাণিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। ফলে খ্রিষ্টধর্মীয়ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে মূলধারা থেকে প্রতিস্থাপিত হয় সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারা। সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা ধর্মের প্রভাবমুক্ত মানব যুক্তি ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানভিত্তিক বলে দাবী করা হ’ত। মূলতঃ ক্যাথলিক ও প্রটেস্টট্যান্ট খ্রিষ্টানদের মধ্যে চলা রক্তক্ষয়ী ৩০ বছরব্যাপী (১৬১০-১৬৪৮) যুদ্ধের পর ক্যাথলিক চার্চের প্রভাব হ্রাস পায় এবং জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটতে থাকে। এ সময়কালে বিশেষ করে সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রচলিত গণশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রমিত ভাষায় শিক্ষাদানের মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্রের সীমানাভুক্ত বিভিন্ন সংস্কৃতি ও নৃতাত্ত্বিক জাতির মানুষকে আত্মীকরণ (assimilation) এবং একজাতকরণ (homogenization) করে জাতিরাষ্ট্রের অনুগত সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলা। এনলাইটেনমেন্ট চিন্তাবিদ জন লক এবং থমাস হবস এ সময়কালেই ক্যাথলিক চার্চের প্রতি আনুগত্যের বদলে জাতিরাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের আনুগত্যের উপর ভিত্তি করে সেক্যুলার রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলেন। আধুনিক স্কুলশিক্ষা মূলতঃ জাতিরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক উন্নয়নের দায়িত্ব নেয়। শিল্প বিপ্লবের সময় পাশ্চাত্যে শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন।
ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা : কুরআন নাযিলের মাধ্যমেই ইসলামী সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়। কুরআনের প্রথম নির্দেশ ছিল পড়! কুরআনের এই নির্দেশনায় অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলমানরা জ্ঞানভিত্তিক এক অতুলনীয় সভ্যতা গড়ে তোলে। ইসলামের পরিভাষায়, ইলম তথা জ্ঞান কেবল তথ্য-উপাত্তের নাম নয়, যা কেবল সমাজ ও মানুষের উপযোগিতায় ব্যবহারযোগ্য। বরং জ্ঞান হচ্ছে এমন জিনিস যা মানুষকে তার অস্তিত্বের উৎস ও উদ্দেশ্যের সাথে যুক্ত করে এবং বাকী সৃষ্টিজগতের সাথে তাকে ঐকতানে নিয়ে আসে। ইসলামের শিক্ষাব্যবস্থার মূলে রয়েছে তিনটি ধারণা : তা‘লীম যার অর্থ হচ্ছে কোন কিছু জানানো, শেখানো এবং সে ব্যাপারে অবগত করে তোলা। তারবিয়াহ যার অর্থ হচ্ছে কোন কিছুকে বৃদ্ধি বা বিকশিত করা এবং তা’দীব যার অর্থ হচ্ছে কাউকে মার্জিত ও আচারনিষ্ঠ করে তোলা। মুসলিম সভ্যতায় প্রথমে মসজিদ এবং এরপর মাদ্রাসার মাধ্যমে গণপরিসরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিম শাসনাধীন স্পেনের কর্ডোভায় ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৭০টি পাবলিক লাইব্রেরী ছিল। ১৪শ’ এবং ১৫শ’ শতাব্দীর মুসলিম শাসনাধীন দিল্লিতে প্রায় এক হাযারের মতো মাদ্রাসা ছিল এবং সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত ছিল। ১৮শ’ শতাব্দীতে ইউরোপীয় ভ্রমণকারীরা কায়রোতে শিক্ষার উচ্চ হার দেখে অবাক হয়ে যায়। আলজেরিয়া দখলকারী ফ্রেঞ্চ ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট ফ্রেঞ্চ গবেষকগণ লক্ষ্য করেন যে, ফ্রেঞ্চ দখলদারিত্বের শুরুর দিকে আলজেরিয়ায় শিক্ষার হার ফ্রান্সের শিক্ষার হারের চেয়েও বেশী। সে সময় মাদ্রাসাগুলোতে দুই ধরনের জ্ঞান শিক্ষা দেয়া হ’ত। (১) উলূমুল মাকূল (মানবীয় বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান) এবং উলূমুল মানকূল (ধর্মশাস্ত্র সংক্রান্ত জ্ঞান)। উলূমুল মাকূল-এর উদাহরণ ছিল গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, স্থাপত্যবিদ্যা, প্রকৌশলবিদ্যা ইত্যাদি। আর উলূমুল মানকূল-এর উদাহরণ হচ্ছে উলূমুল কুরআন, উলূমুল হাদীছ, ফিক্বহ, উছূলে ফিক্বহ ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, এই বিভাজন ধর্মীয় সেক্যুলারভিত্তিক বিভাজন ছিল না।
পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার দুর্গতি :
পশ্চিমা সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা মানবীয় বুদ্ধিবৃত্তিক ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে নিজেকে নিরপেক্ষ ও সার্বজনীন দাবী করলেও তা বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদ যেমন দৃষ্টবাদ (positivism), খন্ডবাদ (reductionism), আপেক্ষিকতাবাদ (relativism) কিংবা ঐতিহাসিকতাবাদ (historicism)-এর উপর ভিত্তি করে রচিত। মূলতঃ জ্ঞানমাত্রই কোন না কোন বিশ্বদর্শনের আলোকেই বিশ্লেষণ করতে হয়। মূলতঃ জ্ঞানের সাথে আল্লাহ ও অহি-র সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে একে প্রকৃতিবাদের উপর স্থাপন করার ফলে পশ্চিমা জ্ঞান-বিজ্ঞান হয়ে পড়েছে খন্ডবাদী (reductionist), যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হ’ল ইন্দ্রীয়বোধ্যতা (perceptibility), পরিমাপযোগ্যতা (quantifiability) ও বস্ত্তগতকে (materialism)-কে অতিন্দ্রীয়তা (imperceptibility), গুণ (quality) ও অপরিমাপযোগ্যতার (immeasurability) ওপর ব্যাপকভাবে প্রাধান্য দেয়া।
প্রচলিত পশ্চিমা ধাঁচের সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটি বড় দিক হ’ল সামাজিক প্রকোষ্ঠকরণ (social compartmentalization) তৈরি করা। দার্শনিক এলাসডেয়ার ম্যাকইন্টায়ারের ভাষায়, সামাজিক প্রকোষ্ঠকরণ হচ্ছে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র স্ব স্ব যুক্তিসিদ্ধতা, নিয়ম ও বিহিত ভূমিকা দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়ে পড়া। তাই একজন মানুষ যখন ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন আলাদা আলাদা স্বতন্ত্র যৌক্তিক ও নৈতিক নমুনার মধ্যে কাজ করে। এর ফলে একক মানবিক সত্তা হিসাবে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে তার ভাবনা ব্যাহত ও বাধাগ্রস্ত হয়, তার মধ্যে তৈরি হয় মানসিক টানাপোড়েন ও অস্থিরতা।
ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ফলে পশ্চিমা মানুষের মধ্যে নৈতিকতার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে অন্য সেক্যুলার দর্শনের উপর। হাল-যামানার এই সেক্যুলার দর্শন হচ্ছে লিবারেলিজম বা উদারতাবাদ। লিবারেলিজমের প্রধান দিক হচ্ছে সামষ্টিকতার উপর ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদকে প্রাধান্য দেয়া। লিবারেল নৈতিকতার মূলে রয়েছে Harm principle বা ‘ক্ষতির নীতি’ যা এর প্রবক্তা লিবারেলিজমের অন্যতম প্রবক্তা জন স্টুয়ার্ট মিল এভাবে সংজ্ঞায়িত করেন : ‘the only purpose for which power can rightfully be exercised over any member of a civilised community against his will is to prevent harm to others.’ অর্থাৎ কোন সভ্য সমাজের একজন সদস্যের উপর (রাষ্ট্রীয়) ক্ষমতাকে কেবল তখনই ন্যায্যভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে, যখন তা দ্বারা তাকে সমাজের অন্য সদস্যকে ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখা হয়। ধর্মীয় শিক্ষা না থাকার ফলে মানুষ পরিবার ও সমাজের বাঁধন থেকে নিজেকে ছুটিয়ে নিচ্ছে। ফলে বাড়ছে আত্মকেন্দ্রিকতা। এই আত্মকেন্দ্রিকতার পরিপূরক হিসাবে দেখা দিচ্ছে ভোগবাদিতা। মূলতঃ এ দু’টো পরস্পরের পরিপূরক। ধর্মীয় বাধা দূর হয়ে যাওয়ার কারণে যৌনতার উপর বিধি-নিষেধও উঠে যাচ্ছে। এর ফলে বিয়ে নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে যৌন বিশৃঙ্খলা। বিয়ে বহির্ভূত অবাধ যৌন সম্পর্ককে এখন পাশ্চাত্যে খুবই স্বাভাবিক হিসাবে দেখা হয়। ফলে বিয়ের কাঠামোর বাইরে জন্ম নিচ্ছে বহু শিশু, যারা পিতার সাহচর্য ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে এসব শিশু বড় হয় ড্রাগ এডিকশন ও রাহাজানির মতো অপরাধ ও আইনবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ছে।
দীর্ঘসময় এই সেক্যুলার পশ্চিমা শক্তি নিজেদের জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মাতাল হয়ে পরিবেশকে স্রেফ নিজেদের উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করেছে। অন্য ধর্মকেন্দ্রিক ঐতিহ্যবাদী সভ্যতাগুলোতে বিশেষ করে ইব্রাহীমীয় ধর্মগুলোতে (ইহুদীবাদ, খ্রিষ্টবাদ ও ইসলাম) প্রকৃতিকে কেবল ব্যবহারযোগ্য জিনিস নয় বরং আল্লাহর নিদর্শন হিসাবে গণ্য করা হ’ত। তাই প্রকৃতির সংরক্ষণ ও বিকাশ ছিল সব ঐতিহ্যবাদী সভ্যতার নৈতিকতার একটি বড় অংশ। কিন্তু সেক্যুলার পশ্চিমা বিশ্ব প্রকৃতিকে কেবল নিজেদের প্রয়োজন মাফিক ছাঁচ ও ব্যবহারযোগ্য ভেবেছে। সেই সাথে যোগ হয়েছে পশ্চিমাদের অসীম অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণা। এর ফলে দেখা দিয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতার (global warming) মতো ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়।
পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের উপনিবেশগুলোতে নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার ফলে ক্ষতি হয় আরো গভীরে। মূলতঃ ঔপনিবেশিক প্রশাসন ব্যবস্থার কেরানী তৈরির জন্য এবং পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতিতে প্রশিক্ষিত জনশক্তি তৈরি করাই ছিল এই পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো তাদের উপনিবেশগুলো ছেড়ে যাওয়ার সময় ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত এই অভিজাত শ্রেণীর কাছেই ক্ষমতা অর্পণ করে যায়। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোর শাসকগোষ্ঠী মোটা দাগে ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রচলিত প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও অভিজাত সাংস্কৃতিক কাঠামোই বজায় রাখে, যা মূলতঃ নিও-কলোনিয়ালিজম নামে একটি নতুন ফেনোমেনোনের জন্ম দেয়।
ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত :
বাংলাদেশে ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন শুরু হয় কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে, পরবর্তীতে কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশন ধর্মহীনতা ও ইসলামবিরোধী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নে আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। সাম্প্রতিককালে সেক্যুলার শিক্ষা বিস্তারে প্রয়াস অব্যাহত আছে। বর্তমান সরকার প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ধর্মশিক্ষা বাদ দিয়ে সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। প্রকৃতপক্ষে ধর্মহীন শিক্ষা মানুষকে ধীরে ধীরে নৈতিকতা বিবর্জিত অন্যায়ের দিকে নিয়ে যায়।
জীবনপদ্ধতি ও দর্শনবর্জিত শিক্ষা : বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার মূল ধারা আল্লাহ বিমুখ ও ঈমান, আক্বীদা বিবর্জিত দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আদর্শিক জীবন ও দর্শন লাভ করার দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় না। মহান আল্লাহ অহী ও নবুঅতের মাধ্যমে মানুষের জন্য যে হেদায়াত ও জীবন-যাপন পদ্ধতি পাঠিয়েছেন, এ শিক্ষাব্যবস্থা সে সম্পর্কে শুধু নীরবই নয়, বরং বিরূপ। এভাবে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ইসলামী জীবন ও দর্শনবিমুখ একটি প্রজন্ম গড়ে তোলার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করছে সরকার ও ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলো।
প্রকৃত লক্ষ্য বিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থা : ইসলামী শিক্ষার মূল লক্ষ্য হ’ল মানুষের মাঝে এক আল্লাহর আনুগত্য করার প্রবণতা সৃষ্টি করা, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালে মুক্তিলাভের প্রেরণা সৃষ্টি করা, আল্লাহপ্রদত্ত সত্যের সাক্ষ্য হিসাবে নিজেদের পেশ করার যোগ্যতা অর্জন এবং খিলাফত পরিচালনা এবং মানবতার সেবা করার দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করা। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার ভাবধারা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শিক্ষা লাভকারীরা জীবনের কোন মহৎ লক্ষ্য অর্জনের শিক্ষা লাভ করে না এবং শ্রেষ্ঠ গুণাবলী ও যোগ্যতাও অর্জন করতে পারে না।
নৈতিক মূল্যবোধ বিবর্জিত জাতি তৈরি : একটি জাতি যখন নৈতিক মূল্যবোধ বিবর্জিত হবে তখন সেই জাতি তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে। ইসলামবিরোধী ও সেক্যুলার গোষ্ঠী এটাই চায়। সেজন্য তারা এমন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে যা বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের নৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ দেউলিয়া করে ফেলেছে। এরূপ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নৈতিক অবক্ষয় ছাড়া আর কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়।
ঈমানী দর্শন ও সৃষ্টিকর্তা-বিমুখ জাতি তৈরি : ঈমানী দর্শনে উজ্জীবিত আদর্শবাদী প্রজন্ম ও জাতি ইসলাম বিদ্বেষী সেক্যুলারদের জন্য ভীতির কারণ। তাই আল্লাহ, আল্লাহর একত্ববাদ, রিসালাত, হেদায়াত, পরকাল, আল্লাহর নিকট জবাবদিহি, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি ঈমানী দর্শনের ধারণা বিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে জাতির ঘাড়ে। এ শিক্ষাব্যবস্থা পরকালবিমুখ দুনিয়াপূজারী মানুষ তৈরি করে। মানুষের প্রকৃত কল্যাণ-অকল্যাণ, জীবনের আসল ব্যর্থতা ও সার্থকতা জানানোর ব্যবস্থা এখানে নেই।
মানসিক দাস ও সেবক তৈরি : এ শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের মানসিক দাস আর অনুগত সেবক তৈরি করার জন্য। এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে স্বাধীন দেশ ও জাতিকে পরিচালনা করার যোগ্য নেতৃত্ব ও দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবার আশা করা যায় না। নিজ দেশের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য আত্মত্যাগী শিক্ষিত মানুষ এখান থেকে বের হওয়ার আশা করা যায় না।
নামে মাত্র ধর্মীয় শিক্ষা : শিক্ষাব্যবস্থার সেক্যুলার ভাবধারার সাথে নামে মাত্র ধর্ম শিক্ষা রাখা হয়েছে। ইসলাম ধর্ম শিক্ষাকে নীচের শ্রেণীগুলোতে অনেকটা পরগাছার মতো রাখা হয়েছে। ছাত্রদের অন্য সব জ্ঞান বিজ্ঞান এমনভাবে শিক্ষা দেয়া হয়, যার ফলে গোটা বিশ্বজগৎ আল্লাহ ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে এবং সফলভাবে পরিচালিত বলে তারা অনুভব করে। আল্লাহ, রাসূল ও পরকালের প্রয়োজনীয়তাই তারা অনুভব করে না। ছাত্রদের গোটা চিন্তাধারাই এ দৃষ্টিভঙ্গিতে গড়ে তোলা হয়। অতঃপর ধর্ম ক্লাসে শিক্ষক আল্লাহ, রাসূল, কিতাব ও পরকাল আছে বলে শিক্ষা দেন। এভাবেই প্রবল আল্লাহবিমুখ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলে তার উপর আল্লাহমুখী হালকা ধারণা পেশ করে ছাত্রদের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দেয়া হয়।
উপরের শ্রেণীগুলোতে ইসলামিয়াত ও ইসলামের ইতিহাস ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে রাখা হয়। ইসলামের ইতিহাস নামে এমন ইতিহাস ছাত্রদের পড়ানো হয়, যাতে ইসলামকে বিকৃত এবং ইসলামের ইতিহাসকে স্বার্থপরতা ও যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। ফলে অনেকেই পুরোপুরি ইসলামবিদ্বেষী হয়ে বের হয়।
ভুলে ভরা নিমণমানের পাঠ্যবই :
প্রতি বছর পাঠ্যপুস্তকের ভুল, চুরি, গুগল ট্রান্সলেটরের ব্যবহার হামেশাই চোখে পড়ার পরও তা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলে। এসব মানহীন পাঠ্যপুস্তক তৈরির উদ্দেশ্যই হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে একটি মেরুদন্ডহীন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়া, যারা অন্যায় ও যুলুম দেখে মুখ গুঁজে থাকবে। নতুন কারিকুলামে সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের একটি অধ্যায় নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন অনেকে। বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খন্ডকালীন শিক্ষক একটি অনুষ্ঠানে এ নিয়ে বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলার পর। ঐ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বলছে, এটি কেবল মানুষের লিঙ্গ বিচিত্রতা বোঝাতে যুক্ত করা হয়েছে। যাতে করে ছেলেমেয়েরা বিষয়গুলো বুঝে তাদের সহপাঠীর প্রতি সহনশীল হ’তে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছে, যেকোন কিছু পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করার আগে আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাসকে আমলে নিয়ে সচেতনতার সঙ্গে যুক্ত করা উচিত। তা না হ’লে এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে শরীফার গল্পের উপস্থাপনা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন।
মানুষ জন্মগতভাবে যে লিঙ্গ নিয়ে জন্মায় সেই লৈঙ্গিক পরিচয়ে যখন শনাক্ত হয় তখন তাকে সিস-জেন্ডার বলে। অন্যদিকে, একজন ব্যক্তি যে লিঙ্গ নিয়ে জন্মায় পরবর্তীতে যদি তার বিপরীত লৈঙ্গিক পরিচয়ে শনাক্ত হয় তবে তাকে ট্রান্সজেন্ডার বলে। এক্ষেত্রে নারী থেকে কেউ পুরুষে রূপান্তরিত হ’লে তাকে ট্রান্সম্যান আবার পুরুষ থেকে কেউ নারীতে রূপান্তরিত হ’লে তাকে ট্রান্সউইম্যান বলা হয়। এই জেন্ডার ট্রান্সফরমেশনের বিষয়টি প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম দু’ভাবেই হ’তে পারে। ‘শরীফার গল্প’তে শরীফা জন্মগতভাবে পুরুষ হ’লেও সে নিজেকে নারী বলে দাবী করে। অন্যদিকে শরীফার পরিচিত ব্যক্তি শারীরিক দিক দিয়ে নারী হ’লেও মানসিকভাবে নিজেকে পুরুষ বলে দাবী করে। যা সামাজিক ও ধর্মীয় নীতিবোধের বিরোধী।
এনজিওর স্বার্থান্বেষী কার্যক্রমের প্রভাব :
শুরু থেকেই বাংলাদেশে এলজিবিটিকিউ আন্দোলন আমদানী করা হয়েছিল বিদেশী এনজিও, বিশেষ করে পশ্চিমা শক্তিগুলোর মদদে। সাথে ছিল ভারতীয় কানেকশন। বাংলাদেশী বিভিন্ন এনজিও ও সমকামী গ্রুপ (ব্র্যাক, বন্ধু, বয়েজ অফ বাংলাদেশ) ফান্ডিং পায় ইউএসএইড, ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স হেলথ কোয়ালিশন (যুক্তরাষ্ট্রের এই এনজিওটি জাতিসঙ্ঘের পপুলেশন ফান্ড (UNFPA) এবং বিশ্বব্যাংকের সাথে কাজ করে দীর্ঘদিন ধরে, এ প্রতিষ্ঠানের গভীর সম্পর্ক আছে অ্যামেরিকার রকাফেলার এবং ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সাথে), নেদারল্যান্ডসের দূতাবাস এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ বা ব্রিটেনের Department of International Development (DFID) থেকে। সমকামিতাসহ অন্যান্য বিকৃত যৌনতা নিয়ে (তাদের ভাষায় যৌন বৈচিত্র্য নিয়ে) সমাজে আলাপ তোলার জন্য ২০০৭ থেকে ব্র্যাক বিভিন্ন মিটিং, ওয়ার্কশপ এবং মতবিনিময় সভার আয়োজন করতে শুরু করে। বিষয়টাকে তারা উপস্থাপন করে মানবাধিকারের কাঠামোতে ফেলে। সমকামিতার সামাজিকীকরণের প্রচেষ্টাকে বলা হয় যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার (Sexual and Reproductive Health & Rights - SRHR) নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা।
২০০৭ সালের কনফারেন্সের আলোচনার নির্যাস বুকলেট আকারে ছাপিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় সারা বাংলাদেশের ১৫০ জন স্টেকহোল্ডারের কাছে। যৌন অধিকার নিয়ে কোন ধরনের গবেষণাকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনার জন্য ২০০৮ সালে অ্যাকাডেমিক, এলজিবিটি সমর্থক এবং বিভিন্ন স্থানীয় সংস্থার সদস্যদের নিয়ে একটি মিটিং করে ব্র্যাকের গবেষকরা। এরই ধারাবাহিকতায় এলজিবিটি ইস্যু নিয়ে আরো গোছানো এবং সমন্বিতভাবে কাজ করার জন্য ২০০৮ সালে ব্র্যাকের জেইমস পি গ্রান্ট পাবলিক হেলথ স্কুল আলাদা একটি সেন্টার বা কেন্দ্র তৈরি করে, যার নাম Centre of Excellence for Gender, Sexual and Reproductive Health Rights. এই কেন্দ্র তৈরির ফান্ডিং আসে জাতিসঙ্ঘের একটি সংস্থার কাছ থেকে।
ব্র্যাকের কার্যক্রম এবং নেটওয়ার্কিংয়ের প্রভাব ছড়িয়ে যেতে থাকে সারা বাংলাদেশ জুড়ে। ২০০৭-এর কনফারেন্স এবং ২০০৯-এর কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে ঢাকার বাইরের দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমকামিতা ও অন্যান্য বিকৃত যৌনাচারের অধিকার নিয়ে সংক্ষিপ্ত কোর্স বা মডিউল চালু করার প্রতিশ্রুতি দেন তারা। আগ্রহ দেখান নিজ নিজ অঞ্চলে যৌন বিকৃতির অধিকার নিয়ে আলাদা কনফারেন্স আয়োজনেরও। অ্যাকাডেমিকদের মাধ্যমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের, বিশেষ করে ঢাকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-গুলোর কিছু শিক্ষার্থী এলজিবিটি সামাজিকীকরণ সংক্রান্ত কার্যক্রমের এই নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়ে পড়ে। ব্র্যাকের উদ্যোগ বাংলাদেশের এলজিবিটি আন্দোলনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এর আগে সমকামী তথা এলজিবিটি আন্দোলনের কার্যক্রম চলছিল এইডস প্রতিরোধ আর সচেতনতা সংক্রান্ত কার্যক্রমের আড়ালে। কাজ হচ্ছিল যৌন স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যানারে। ব্র্যাক এসে কাজ শুরু করে মানবাধিকারের কাঠামোকে সামনে রেখে। সরাসরি সমকামী শব্দটা ব্যবহার না করে যোর দেয় যৌন অধিকার, যৌন বৈচিত্র্য, যৌন শিক্ষা’ এবং জেন্ডার আইডেন্টিটির মতো পরিভাষার উপর। যদিও ঘুরেফিরে এই সব বুলির পেছনে মূল বক্তব্য এক যৌন বিকৃতির সামাজিকীকরণ ও বৈধতা। ব্র্যাকের কর্মপদ্ধতি এলজিবিটি এজেন্ডা প্রতিষ্ঠা নিয়ে জনপরিসরে আলাপ তোলার কাজটা এগিয়ে নিয়ে যায় অনেক দূর।
এক্ষেত্রে ঢাল হিসাবে কাজ করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও হিসাবে ব্র্যাকের পরিচয় ও প্রভাব। পাশাপাশি পুরো ব্যাপারটাকে মুনশিয়ানার সাথে দেখানো হয়েছে নিরীহ গবেষণা হিসাবে। সমকামিতার বৈধতা চাই বলা হ’লে যেভাবে বাধা তৈরি হ’ত গবেষণার ক্ষেত্রে তা হয়নি, বরং এভাবে তুলে ধরার ফলে অনেকের কাছে বিষয়টা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এই অবদানের স্বীকৃতিও পায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৩ সালে বিলিয়নেয়ার জর্জ সরোসের ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন এক বিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল তৈরি করে। এই তহবিলের জন্য পৃথিবীর ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়কে মনোনীত করা হয় যার মধ্যে একটি ছিল ব্র্যাক। এরপর থেকে যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার নিয়ে ব্র্যাকের কার্যক্রম আরো বিস্তৃত হয়েছে।
আমাদের করণীয় :
স্বল্প মেয়াদে করণীয় : শিক্ষাব্যবস্থায় যেন ধর্ম, নৈতিকতাকে গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ইসলাম বিরোধী মতাদর্শ অন্তর্ভুক্ত করতে না পারে সেজন্য সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
মধ্য-মেয়াদে করণীয় : ইসলামী আদর্শ ও নৈতিকতাকে ভিত্তি করে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে।
রাজনৈতিক/সরকারি পরিকল্পনা : রাজনৈতিক দল এবং সরকারী উদ্যোগে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তাচেতনা, মূল্যবোধ ও আদর্শকে সমুন্নত রেখে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে পরিকল্পনা নিতে হবে।
দীর্ঘ-মেয়াদে করণীয় : জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশজ শিক্ষানীতির বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন: জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে দেশের জনসাধারণের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, ধর্ম ও আদর্শকে ভিত্তি করে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরি করা এবং তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করা। এছাড়াও প্রাইভেট প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের মাধ্যমে Grass Root এ নতুন প্রজন্মের মধ্যে দ্বীনি, নৈতিক ও দেশপ্রেম- মানবতাধর্মী চিন্তা-চেতনা সঞ্চারিত করার প্রচেষ্টা চালানো। বাড়িঘর, মসজিদ-ধর্মালয় ও পরিবারে নৈতিক শিক্ষার দৃঢ় বুনিয়াদি শিক্ষা চালু করতে হবে। এর সাথে মক্তব ব্যবস্থার পুনঃপ্রচলন করা। Youtube Channel, Television, Facebook সহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নৈতিক, ধর্মীয় ও দেশপ্রেমভিত্তিক আদর্শ শিক্ষা প্রচার করা।
জাতীয় ও যেলাভিত্তিক ব্যাপক শিক্ষা প্রচারের জন্য ইসলামী শিক্ষা, ইসলামী সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যভিত্তিক অলিম্পিয়াড আয়োজন করা। টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, বই-পুস্তকে আদর্শভিত্তিক দ্বীনি ও নৈতিক শিক্ষা সম্বলিত শিক্ষা চালু করা। পার্থিব জীবনের প্রয়োজনে যত প্রকার বিদ্যা শিক্ষা করতে হয় সেসবকে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষা দিতে হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে ইসলামের সাথে মানবরচিত বিধানের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে ইসলামের যৌক্তিকতা ও শ্রেষ্ঠত্ব শিক্ষার্থীদের মনে বদ্ধমূল করতে হবে।
\ সংকলিত \
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আব্দুর রব
শিক্ষক, ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।