সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এক ব্যক্তি ১০ লাখ টাকা পেয়েছিলেন পথে। ব্যাগসহ সেই টাকা পুলিশের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে বেশ বাহবাও কুড়িয়ে নেন তিনি। টানা দুই দিন দেশের গণমাধ্যম জুড়ে তার ‘সততা’র কীর্তি ফলাও করে প্রচার হয়। কিন্তু জাপানীদের যদি এমন ঘটনা বলা হয়, তারা বলবেন, এ আর এমন কি? যার সম্পদ তার কাছে ফিরিয়ে দেয়াই তো কর্তব্য!

মার্কিন ধনকুবের ওয়ারেন বাফেট বলেছেন, ‘সততা অমূল্য জিনিস। সস্তা লোকের কাছ থেকে এটি আশা করবেন না।’ কথাটি ধ্রুব সত্য ধরে নিলে জাপানীরা বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান এই জিনিসটি আয়ত্ব করতে সক্ষম হয়েছে। পরিসংখ্যান তো সেদিকেই ইঙ্গিত করে।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে জাপানের জনসাধারণের মাঝে সততার হার বিশ্বের যে কোন স্থানের চেয়ে বেশী। তাদের এই সততা বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করে। আর সেই সাথে প্রশ্নও জাগায়, কেন জাপানীরা এতটা সৎ?

মূলত সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় প্রভাব ও জনবান্ধব পুলিশ প্রশাসনের কারণেই জাপানে সততাভিত্তিক একটা সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবন থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সেই সততার ছাপ সুস্পষ্ট।

যে কারো জন্য হাতব্যাগ হারিয়ে যাওয়াটা ভীষণ বিব্রতকর। এতে মোবাইলের পাশাপাশি ট্রাভেল কার্ড, আইডি কার্ড, ব্যাংক কার্ড খোয়া যায়। নিরন্তর ঝামেলার সৃষ্টি হয়। হাতব্যাগটি ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত এই সমস্যার শেষ থাকে না। বিশ্বে এমন একটি স্থান আছে, যেখানে হারানো জিনিস ফেরত পাওয়ার প্রায় শতভাগ সম্ভাবনা আছে। জায়গাটি আর কোথাও নয়, টোকিও- জাপানের রাজধানী। শহরটিতে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষের বাস। এমন জনবহুল নগরে বছরে লাখ লাখ জিনিস হারিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। যায়ও। কিন্তু তার অধিকাংশই ফেরত পান মালিকেরা।

২০১৮ সালের একটা পরিসংখ্যান দেখলেই এর প্রমাণ মিলবে। সে বছর টোকিওতে ৫ লাখ ৪৫ হাযার হারিয়ে যাওয়া আইডি কার্ড মালিকদের হাতে তুলে দিয়েছে টোকিওর মেট্রোপলিটন পুলিশ। সংখ্যাটা হারিয়ে যাওয়া মোট আইডি কার্ডের ৭৩ শতাংশ।

ঠিক একইভাবে ২০১৮ সালে হারিয়ে যাওয়া ১ লাখ ৩০ হাযার স্মার্টফোন (৮৩ শতাংশ) এবং ২ লাখ ৪০ হাযার মানিব্যাগ (৬৫ শতাংশ) ফেরত পেয়েছেন এগুলোর মালিকেরা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনও ঘটেছে, হারিয়ে যাওয়ার দিনই প্রিয় বস্ত্তটি হাতের মুঠোয় পেয়েছেন তাঁরা। আর বাকী স্মার্টফোনগুলো যে হারিয়ে গেছে তা নয়। বরং বাকী ১৭ শতাংশ ফোনের মালিক পাওয়া যায়নি। তাই প্রশাসনিকভাবে সেগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি সান ফ্রান্সিসকোর একটি ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের এই শহরের এক বাসিন্দার একটি মানিব্যাগ খোয়া যায়। তবে কেউ একজন সেটা পেয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন। মনোবিদ কাজুকো বেহরেনস ঘটনাটির বর্ণনা দিয়ে বলছিলেন, হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফেরত পাওয়ার ঘটনা মার্কিন সমাজে প্রায় দুর্লভ। তাই ওয়ালেটটি যিনি পেয়ে পুলিশে দিয়েছিলেন, তিনি রীতিমতো নায়ক বনে গেলেন। স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তার সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করল। তাকে নিয়ে করা সংবাদের শিরোনাম দেওয়া হয় ‘সৎ মানুষ’।

কিন্তু বেহরেনসের মাতৃভূমি জাপানে এ ধরনের সততার ঘটনা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। বরং তাদের সমাজে কারও খোয়া যাওয়া কিছু ফেরত না পাওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক ঘটনা।

জাপানের যে শহরে যত পুলিশ স্টেশন, সেই শহরে তত নিরাপত্তা। টোকিওতে প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে যেখানে ৯৭টি পুলিশ স্টেশন, সেখানে লন্ডনে প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে মাত্র ১১টি পুলিশ স্টেশন।

কিয়োটো সাঙ্গিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ের অধ্যাপক মাসাহিরো তামুরা বলছিলেন, জাপানের পুলিশ কর্মকর্তারা খুবই জনবান্ধব। শিশুরা রাস্তায় কোন পুলিশ দেখলেই অভিবাদন জানায়। আবার পাশেই কোন বয়স্ক লোক থাকলে পুলিশ কর্মকর্তারা গিয়ে তাঁর খোঁজ নেন।

তামুরা বলেন, জাপানী সমাজে হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফেরত দেওয়ার ব্যাপারটি শিশু বয়সেই শেখানো হয়। অন্যের খোয়া যাওয়া জিনিস মাত্র ১০ ইয়েন (৮ টাকা) মূল্যের হ’লেও পুলিশ স্টেশনে জমা দেওয়ার বিষয়ে শিশুদের উৎসাহিত করা হয় পরিবার থেকেই। আর ১০ ইয়েনের একটি মুদ্রা জমা দিলেও পুলিশ কর্মকর্তারা তা আনুষ্ঠানিকভাবে লিখে রাখেন।

রিপোর্ট করে মুদ্রাটি কোষাগারে জমা রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে কেউ হারিয়ে যাওয়া মুদ্রার বিষয়ে দাবী না করলে তা সন্ধানদাতাকে পুরস্কার হিসাবে দিয়ে দেন পুলিশ কর্তারা।

নিউইয়র্ক ও টোকিওর ওপর চালানো একটি গবেষণায় দেখা যায় হারিয়ে যাওয়া ৮৮ শতাংশ মুঠোফোন ও ৮০ শতাংশ মানিব্যাগ টোকিওর পুলিশের কাছে জমা পড়েছে। অন্যদিকে নিউইয়র্কের চিত্রটা পুরোই বিপরীত। মাত্র ৬ শতাংশ মুঠোফোন এবং ১০ শতাংশ মানিব্যাগ জমা পড়েছে পুলিশ স্টেশনে। অন্যান্য কারণের মধ্যে শহরে পুলিশ স্টেশন বেশী থাকাটাও এর বড় একটা কারণ।

মনোবিদ বেহরেনসের মতে, কোন না কোনভাবে গোষ্ঠীগতভাবে টিকে থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওয়ালেট ফেরত দেওয়ার মতো ভালো একটা কিছু করলে আপনার মনে এই চিন্তাটা জাগবে যে, ভবিষ্যতে আপনার ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটতে পারে। অর্থাৎ আপনারও কিছু খোয়া গেলে তা ফেরত পাবেন।

তবে জাপানে কেউ যখন হারানো কিছু পেয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন, তখন তার মাঝে তা ফিরে পাওয়ার মানসিকতাও কাজ করে না। ব্যক্তিটি সমস্যায় থাকলে, সে দরিদ্র হ’লেও অথবা জিনিসটি প্রয়োজনীয় হ’লেও তা করেন না।

নিউইয়র্ক ও টোকিওতে ওয়ালেট চুরির ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান ল স্কুলের অধ্যাপক মার্ক ডি. ওয়েস্ট। জাপানের আইন ও আইনী ব্যবস্থা নিয়ে এই বিশেষজ্ঞের মত হ’ল, জাপানী সমাজের আইন-কানূন ও মূল্যবোধই দেশটির জনগণের মধ্যে সততা প্রতিষ্ঠা করেছে। সম্ভবত এ কারণেই জাপান এত উন্নত।

আসলে জাপানের অধিকাংশ মানুষ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদে নয়, বরং যৌথ সত্ত্বায় বিশ্বাসী। তারা শুধু নিজের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্য চিন্তার চর্চা করেন। ২০১১ সালে জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সুনামী আঘাত হানে। তখন অসংখ্য লোক গৃহহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু এ রকম একটা পরিস্থিতিতেও জাপানীরা আত্মসংযমের পরিচয় দেন। তাঁরা নিজের চেয়ে অন্যের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেন। সুনামীর সময় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় লুটপাটের ঘটনা ঘটেইনি প্রায়। অথচ এ রকম পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্য যেকোন দেশে ঘটে উল্টোটা।

একটি গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানী মায়েদের কাছে সন্তানদের নিয়ে তাদের প্রত্যাশার কথা জানতে চাওয়া হয়। জবাবে জাপানী মায়েদের ভাষ্য ছিল, সন্তান যেন একটি সাধারণ জীবন যাপন করে। খুব উচ্চাভিলাষী, সমাজবিচ্ছিন্ন জীবনে তারা অভ্যস্ত হোক, তারা এমনটা চান না। এর কারণ জাপানী মায়েরা মনে করেন, একসঙ্গে থাকার শক্তিই মানুষকে বড় করে। মানুষকে উদার আর দয়াশীল করে।






নতুন শিক্ষা কারিকুলাম : মুসলিম জাতিসত্তা ধ্বংসের নীল নকশা - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
মিয়ানমার ও ভারতের নাগরিকত্ব আইন বাংলাদেশের জন্য বড় হুমকি - জামালউদ্দীন বারী
রোহিঙ্গা ফেরৎ চুক্তি : তবে... - শামসুল আলম শিক্ষকআল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
মিয়ানমার এখন বাংলাদেশকে দূষছে - এ কে এম যাকারিয়া
পার্বত্য শান্তিচুক্তির হাল-অবস্থা - মেহেদী হাসান পলাশ
আত্মপীড়িত তারুণ্য ও জঙ্গীবাদ - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
আজারবাইজানের নাগর্নো-কারাবাখ বিজয় - মুহাম্মাদ ফেরদাউস
ফারাক্কা-রামপাল : বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্কের বাধা - আনু মুহাম্মদ, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ
কুরআন ও বাইবেলের আলোকে যাবীহুল্লাহ কে? - রূহুল হোসাইন, জলঙ্গী, মুর্শিদাবাদ, ভারত
ইতিহাসের ভয়াবহ সব মহামারীগুলো - -আত-তাহরীক ডেস্ক
রাষ্ট্রহীন করা হচ্ছে ৪০ লাখ মানুষকে - সি আর আবরার** অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শরণার্থী ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ।\ সংকলিত \
ভাস্কর্যে নয়, হৃদয়ে ধারণ করুন! - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
আরও
আরও
.