পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ ।

(২) توحيد الألوهية أو العبادة (তাওহীদুল উলূহিয়াহ বা তাওহীদুল ইবাদাহ) : এটা হ’ল, إفراد الله عز وجل بالعبادة ‘ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করা’।[1] অর্থাৎ এক আল্লাহর ইবাদত করা এবং এক্ষেত্রে তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক না করা। এই তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্যই আল্লাহ মানুষ ও জ্বিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন (যারিয়াত ৫১/৫৬)। এটা বাস্তবায়নের জন্যই মানুষকে করেছেন জ্ঞানসম্পন্ন। প্রেরণ করেছেন মানুষের নিকট নবী-রাসূলগণকে। নাযিল করেছেন আসমানী কিতাব সমূহ, যার মাধ্যমে নবী-রাসূলগণ মানুষকে হেদায়াতের নূরে আলোকিত করেছেন। প্রত্যেক নবী-রাসূলের দাওয়াতের বিষয়বস্ত্তই ছিল তাওহীদুল ইবাদত। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِيْ كُلِّ أُمَّةٍ رَسُوْلًا أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَ- ‘আল্লাহর ইবাদত করার ও ত্বাগূতকে বর্জন করার নির্দেশ দেবার জন্য আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি’ (নাহল ১৬/৩৬)। তিনি আরো বলেন,

وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُوْلٍ إِلَّا نُوْحِيْ إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُوْنِ-

‘আমরা তোমার পূর্বে কোন রাসূল প্রেরণ করিনি এই অহী ব্যতীত যে, আমি (আল্লাহ) ছাড়া কোন (সত্য) মা‘বূদ নেই। সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত কর’ (আম্বিয়া ২১/২৫)

উল্লিখিত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের নিকট নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করার মূল উদ্দেশ্য জানিয়ে দিয়েছেন। আর তা হ’ল ত্বাগূতকে বর্জন করতঃ এক আললাহর ইবাদত করার নির্দেশ প্রদান।

ইবাদতের পরিচয় : عبادة ‘ইবাদত’ শব্দটি عبد ‘আবদ’ শব্দ থেকে গৃহীত, যা দু’টি জিনিসের সমন্বিত নাম।

(১) التعبد (তা‘আববুদ) তথা ইবাদত করা : এর অর্থ হ’ল, التذلل لله عز وجل بفعل أوامره واجتناب نواهيه، محبة وتعظيما- ‘সম্মান ও মুহাববতের সাথে অবনতচিত্তে আল্লাহর আদেশ পালন ও তাঁর নিষেধ বর্জন করা’।[2]

(২) المتعبد به (মুতা‘আববাদু বিহি) তথা যে সকল কথা ও কর্মের মাধ্যমে ইবাদত করা হয় : এর অর্থ বর্ণনায় শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেছেন, أَنَّ الْعِبَادَةَ هِيَ اسْمٌ جَامِعٌ لِكُلِّ مَا يُحِبُّهُ اللهُ وَيَرْضَاهُ مِنْ الْأَقْوَالِ، وَالْأَعْمَالِ الظَّاهِرَة وَالْبَاطِنَةِ - ‘ইবাদত ঐ সকল প্রকাশ্য এবং গোপন কথা ও কাজের সমন্বিত নাম, যা আললাহ ভালবাসেন এবং যাতে তিনি সন্তুষ্ট হন’।[3]

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,  أن العبادة هي غاية الحب بغاية الذل والخضوع ‘ইবাদত হচ্ছে চরম বিনয় ও নম্রতার সাথে সীমাহীন ভালবাসা।[4]

যেমন- ছালাত, ছিয়াম, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি। এগুলো হ’ল المتعبد به (মুতা‘আববাদ বিহি)। কেননা এগুলোর মাধ্যমে ইবাদত করা হয়। আর এগুলো পালন করার নাম হ’ল التعبد (তা‘আববুদ) বা ইবাদত করা।

অতএব আল্লাহ ভালবাসেন এমন সকল প্রকাশ্য ও গোপন কথা ও কাজ আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠভাবে বিনম্রচিত্তে যথাযথভাবে সম্পাদন করার নাম হ’ল ইবাদত। হাদীছে জিব্রীলের মধ্যে রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ ‘আপনি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবেন যেন আপনি তাঁকে (আল্লাহ্কে) দেখছেন। আর যদি আপনি তাঁকে দেখতে না পান তাহ’লে (মনে করবেন) তিনি আপনাকে দেখছেন’।[5] আর আল্লাহ ঐ সকল কথা ও কর্মকে ভালবাসেন, যার বিধি-বিধান তিনি নাযিল করেছেন। ইবাদত হ’ল তাওক্বীফী। অর্থাৎ ইসলামী শরী‘আত যাকে ইবাদত হিসাবে সাব্যস্ত করেছে কেবল তাই ইবাদত হিসাবে গণ্য। আর যাকে ইবাদত হিসাবে গণ্য করেনি, কখনোই তা ইবাদত হিসাবে পরিগণিত নয়। মানুষের বিবেক যে কাজকে ভাল মনে করবে তাই যদি ইবাদত হিসাবে গণ্য হ’ত, তাহ’লে যুগে যুগে নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ এবং কিতাব নাযিলের কোন প্রয়োজন হ’ত না। অতএব কোন কথা ও কর্মকে ইবাদত হিসাবে গণ্য করতে হ’লে অবশ্যই তাকে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ স্বীকৃত হ’তে হবে। কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অস্বীকৃত কোন কিছু কখনোই ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে না; বরং তা হবে বিদ‘আত।

ত্বাগূত-এর পরিচয় : الطاغوت (তাগূত) শব্দটি আরবী الطغيان (তুগইয়ান) শব্দ থেকে নির্গত। যার অর্থ সীমালংঘন করা।

পারিভাষিক অর্থ বর্ণনায় যুজাজ (রহঃ) বলেন, كُلُّ مَا عُبِدَ مِنْ دُوْنِ اللهِ ‘আল্লাহ ব্যতীত যারই ইবাদত করা হয়, তাই ত্বাগূত’।[6]

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,الطاغوت كل ما تجاوز به العبد حده من معبود أو متبوع أو مُطَاعٍ ‘ত্বাগূত্ব হ’ল, বান্দার ঐ সকল সীমালংঘন, যা সে মা‘বূদ, অনুসরণীয় ব্যক্তি এবং আনুগত্যের অধিকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে করে থাকে’।[7]

অর্থাৎ বান্দা যখন এক আল্লাহর ইবাদত না করে মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয়, তখন সে ত্বাগূত্বের ইবাদত করে। আর বান্দা যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ বাদ দিয়ে বিভিন্ন গণক, যাদুকর, পীরপূজা, কবরপূজা এবং নির্দিষ্টভাবে কোন ব্যক্তির তাক্বলীদ বা অন্ধ অনুসরণে লিপ্ত হয়, তখন সে ত্বাগূত্বের অনুসরণ করে। আর বান্দা যখন আল্লাহর আনুগত্য প্রত্যাখ্যানকারী নেতা-নেত্রীর ইসলাম বিরোধী আইন প্রণয়নে সন্তুষ্ট হয়, তখন সে ত্বাগূতের আনুগত্য করে। আল্লাহ তা‘আলা এই ত্বাগূতকে বর্জন করার জন্যই কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। প্রকৃত মুসলিম হ’তে হ’লে অবশ্যই ত্বাগূতকে বর্জন করতে হবে। আগাছা দমন না করে জমিতে চারা রোপণ করা যেমন, ত্বাগূত বর্জন না করে আল্লাহর ইবাদত করাও তেমন। অনেক মূল্যবান খাদ্যে বিষ মিশিয়ে দিলে সেটা যেমন খাদ্য থাকে না, আল্লাহর ইবাদতের সাথে ত্বাগূতের ইবাদত মিশ্রিত হ’লে সেটাও ইবাদত থাকে না; বরং বাতিল হয়ে যায়। তাই যে কোন মূল্যে ত্বাগূতকে বর্জন করে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে। আল্লাহ বলেন,

لَا إِكْرَاهَ فِيْ الدِّيْنِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوْتِ وَيُؤْمِنْ بِاللهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ-

‘দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই। নিশ্চয়ই হিদায়াত স্পষ্ট হয়েছে ভ্রষ্টতা থেকে। অতএব যে ব্যক্তি ত্বাগূতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মযবূত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (বাক্বারাহ ২/২৫৬)। তিনি অন্যত্র বলেন, وَالَّذِيْنَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوْتَ أَنْ يَعْبُدُوْهَا وَأَنَابُوْا إِلَى اللهِ لَهُمُ الْبُشْرَى فَبَشِّرْ عِبَادِ- ‘আর যারা ত্বাগূতের উপাসনা পরিহার করে এবং আল্লাহ অভিমুখী হয় তাদের জন্য আছে সুসংবাদ। অতএব আমার বান্দাদেরকে সুসংবাদ দাও’ (যুমার ৩৯/১৭)

ইবাদত কবুলের শর্তাবলী : সম্মানিত পাঠক! যেহেতু আল্লাহই একমাত্র সত্য মা‘বূদ, যিনি আমাদেরকে তাঁর ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছেন; সেহেতু বিশুদ্ধভাবে ইবাদত সম্পাদনের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করাই আমাদের কর্তব্য। আর বিশুদ্ধভাবে ইবাদত করার মানদন্ড উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, بَلَى مَنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَلَهُ أَجْرُهُ عِنْدَ رَبِّهِ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ- ‘হ্যাঁ, যে কেউ আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে এবং সৎকর্মপরায়ণ হয় তার ফল তার প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/১১২)

অত্র আয়াতে বর্ণিত (مَنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّه) দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইবাদত করা এবং (وَهُوَ مُحْسِنٌ) দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী আমল করা।[8] আল্লাহ আরো বলেন, فَمَنْ كَانَ يَرْجُوْ لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا- ‘যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে’ (কাহ্ফ ১৮/১১০)

অত্র আয়াতে বর্ণিত (فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا) দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, সে যেন রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী আমল করে এবং (وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا) দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য শিরক মুক্ত আমল করে।[9]

উল্লিখিত আয়াত দু’টিতে আল্লাহ তা‘আলা ইবাদত কবুলের দু’টি শর্ত উল্লেখ করেছেন, যা অবশ্য পালনীয়। বীজগণিতের সূত্রে ভুল করলে যেমন ফলাফল সঠিক হয় না। ইবাদতের শর্ত ঠিক না থাকলে তেমন আল্লাহর নিকটে তা কবুল হয় না। শর্ত দু’টি হ’ল,

(১) একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইবাদত করা; যা ছোট ও বড় শিরক মুক্ত হবে। আল্লাহ বলেন, وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوْا إِلَّا إِيَّاهُ ‘তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না’ (বনী ইসরাইল ১৭/২৩)। তিনি আরো বলেন,وَاعْبُدُوْا اللهَ وَلَا تُشْرِكُوْا بِهِ شَيْئًا ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক কর না’ (নিসা ৪/৩৬)। তিনি অন্যত্র বলেন,قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلَّا تُشْرِكُوْا بِهِ شَيْئًا ‘(হে মুহাম্মাদ!) বল, তোমরা এসো! তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের প্রতি কি কি হারাম করেছেন, তা আমি তোমাদেরকে পাঠ করে শুনাব, আর তা এই যে, তোমরা তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না’ (আন‘আম ৬/১৫১)। রাসূল (ছাঃ) মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ)-কে বলেছিলেন,

يَا مُعَاذُ، هَلْ تَدْرِى حَقَّ اللهِ عَلَى عِبَادِهِ وَمَا حَقُّ الْعِبَادِ عَلَى اللهِ؟ قُلْتُ اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَعْلَمُ، قَالَ فَإِنَّ حَقَّ اللهِ عَلَى الْعِبَادِ أَنْ يَعْبُدُوْهُ وَلاَ يُشْرِكُوْا بِهِ شَيْئًا، وَحَقَّ الْعِبَادِ عَلَى اللهِ أَنْ لاَ يُعَذِّبَ مَنْ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا-

‘হে মু‘আয! তুমি কি জান বান্দার উপর আল্লাহর হক্ব কি এবং আল্লাহর উপর বান্দার হক্ব কি? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেন, বান্দার উপর আল্লাহর হক্ব হ’ল, বান্দা তাঁর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। আর আল্লাহর উপর বান্দার হক্ব হ’ল, তাঁর ইবাদতে কাউকে শরীক না করলে আল্লাহ তাকে শাস্তি দিবেন না’।[10] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ বলেন (হাদীছে কুদসী), يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَخْلِصُوْا أَعْمَالَكُمْ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ فَإِنَّ اللهَ لاَ يَقْبَلُ إِلاَّ مَا أُخْلِصَ لَهُ- ‘হে মানবমন্ডলী! তোমরা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইবাদত কর। কেননা আল্লাহ তাঁর সন্তুষ্টিচিত্তে পালিত ইবাদত ব্যতীত অন্য ইবাদত কবুল করেন না’।[11]

(২) রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী ইবাদত করা। আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হ’তে তোমাদের নিষেধ করেন তা হ’তে বিরত থাক’ (হাশর ৫৯/৭)। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ- ‘যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যাতে আমাদের নির্দেশনা নেই তা প্রত্যাখ্যাত’।[12] তিনি আরো বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِيْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার (শরী‘আতের) মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[13] সুফিয়ান ইবনু উয়াইনাহ (রহঃ) বলেন, إِنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم هُوَ المِيْزَانُ الْأَكْبَرُ، فَعَلَيْهِ تُعْرَضُ الْأَشْيَاءُ، عَلَى خُلُقِهِ وَسِيْرَتِهِ وَهَدْيِهِ، فَمَا وَافَقَهَا فَهُوَ الْحَقُّ، وَمَا خَالَفَهَا فَهُوَ الْبَاطِلُ- ‘নিশ্চয়ই রাসূল (ছাঃ) হ’লেন সবচেয়ে বড় মানদন্ড। অতএব সকল কিছুই রাসূল (ছাঃ)-এর চরিত্র, পথ-পদ্ধতি ও নীতিমালার উপর পেশ করতে হবে। যা তার সাথে মিলে যাবে তাই কেবল হক্ব বলে গণ্য হবে। আর যা তার বিপরীত হবে তা বাতিল বলে গণ্য হবে’।[14] হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) বলেন,

كُلُّ عِبَادَةٍ لَمْ يَتَعَبَّدْهَا أَصْحَابُ رَسُوْلِ الله صلى الله عليه وسلم فَلاَ تَعْبُدُوْهَا فَإِنَّ الأَوَّلَ لَمْ يَدَعْ لِلْآخِرِ مَقَالاً فَاتَّقُوْا اللهَ يَا مَعْشَرَ القُرَّاء وَخُذُوْا بِطَرِيْقِ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ-

‘যে সকল ইবাদত রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ করেননি, সে সকল ইবাদত তোমরাও কর না। কেননা পূর্ববর্তী লোকেরা (রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম) পরবর্তী লোকদের জন্য কোন অসম্পূর্ণতা রেখে যাননি। অতএব হে মুসলিম সমাজ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং পূর্ববর্তীদের রীতি-নীতি গ্রহণ কর’।[15]

ফুযাইল ইবনু ইয়ায (রহঃ) বলেন,

إنَّ الْعَمَلَ إذَا كَانَ خَالِصًا وَلَمْ يَكُنْ صَوَابًا لَمْ يُقْبَلْ، وَإِذَا كَانَ صَوَابًا وَلَمْ يَكُنْ خَالِصًا لَمْ يُقْبَلْ، حَتَّى يَكُونَ خَالِصًا صَوَابًا، وَالْخَالِصُ أَنْ يَكُونَ لِلَّهِ، وَالصَّوَابُ أَنْ يَكُونَ عَلَى السُّنَّةِ-

‘আমল খালেছ হ’লেও যদি তা সঠিক না হয়, তাহ’লে তা (আল্লাহর নিকট) কবুল হবে না। আর আমল সঠিক হ’লেও যদি তা খালেছ না হয়, তাহ’লেও তা কবুল হবে না; যতক্ষণ পর্যন্ত আমলটি খালেছ ও সঠিক না হয়। খালেছ হ’ল, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই ইবাদত করা আর আমলের শুদ্ধতা হ’ল, রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী আমল করা’।[16]

সম্মানিত পাঠক! উল্লিখিত দলীল সমূহ ছাড়াও আরো বহু সংখ্যক দলীলের আলোকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, তাওহীদুল ইবাদত কায়েম করতে হ’লে দু’টি মৌলিক বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে। (১) আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন কিছুর ইবাদত না করা। অর্থাৎ শিরক মুক্ত ইবাদত করা। (২) কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অস্বীকৃত কোন ইবাদত না করা। অর্থাৎ বিদ‘আত মুক্ত ইবাদত করা। আর এটাই ইসলামের প্রথম ও প্রধান স্তম্ভ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কোন (সত্য) মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল-এই সাক্ষ্য প্রদান করার মৌলিক উদ্দেশ্য।

لا إله إلا الله (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)-এর অর্থ ও তাৎপর্য : ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর বিশুদ্ধ অর্থ হ’ল,  لا معبود بحق إلا الله অর্থাৎ ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন (সত্য) মা‘বূদ নেই’। কেননা দুনিয়াতে অনেক মিথ্যা মা‘বূদ রয়েছে, মানুষ যাদের ইবাদত করে থাকে। যেমন- খৃষ্টানরা মারিয়ামকে আল্লাহর স্ত্রী ও ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্র বলে দাবী করে থাকে। ফলে তারা তিন মা‘বূদে বিশ্বাসী। আর ইহুদীরা উযাইর (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্র বলে বিশ্বাস করে থাকে। ফলে তারা দুই মা‘বূদে বিশ্বাসী। মক্কার কুরাইশরা পবিত্র কা‘বা গৃহে স্থাপিত ৩৬০টি মূর্তিকে তাদের মা‘বূদ বলে বিশ্বাস করত। আর তাইতো যখন রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদত করার আহবান জানালেন, তখন তারা তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল, أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهًا وَاحِدًا إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ ‘সে কি বহু মা‘বূদের (পরিবর্তে) এক মা‘বূদ বানিয়ে নিয়েছে? এতো এক আশ্চর্য ব্যাপার!’ (ছোয়াদ ৩৮/৫)

অনুরূপভাবে বর্তমানে বহু মানুষ নিজেদেরকে মুসলিম দাবী করেও তারা নবী, পীর, অলী-আওলিয়াকে আল্লাহর মত ক্ষমতাবান বলে বিশ্বাস করে এবং তাদের নিকট সাহায্য চায়, তাদের নিকট মনের আশা পূরণার্থে দো‘আ করে, তাদের উদ্দেশ্যে মানত করে, তাদের নৈকট্য হাছিলের উদ্দেশ্যে রুকূ-সিজদা করে এবং পশু যবেহ করে ইত্যাদি। এদের দৃষ্টিতে শুধুমাত্র আল্লাহই ইবাদতের জন্য যথেষ্ট নন; বরং প্রয়োজনে পীর-দরবেশ, অলী-আওলিয়ার নিকটও দো‘আ করা, সিজদাহ করা, বিপদে-আপদে সাহায্য চাওয়া যাবে (নাঊযুবিল্লাহ)। এক্ষেত্রে এরাও এ সকল পীর, অলী-আওলিয়াকে মা‘বূদ হিসাবে বিশ্বাস করে। অথচ এরা সকলেই বাতিল। আল্লাহ বলেন, ذَلِكَ بِأَنَّ اللهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ هُوَ الْبَاطِلُ وَأَنَّ اللهَ هُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيْرُ- ‘এটা এজন্য যে, আল্লাহ, তিনিই সত্য এবং তারা তাঁর পরিবর্তে যাকে ডাকে তা তো বাতিল বা অসত্য এবং আল্লাহ, তিনিই তো সমুচ্চ, মহান’ (হজ্জ ২২/৬২)। তিনি অন্যত্র বলেন,

وَلَا تَدْعُ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِيْنَ-

‘আর আল্লাহকে ছেড়ে এমন কিছুকে আহবান (ইবাদত) করো না, যা না তোমার কোন উপকার করতে পারে, আর না কোন ক্ষতি করতে পারে। বস্ত্ততঃ যদি এরূপ কর, তবে তুমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (ইউনুস ১০/১০৬)। তিনি অন্যত্র বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ عِبَادٌ أَمْثَالُكُمْ فَادْعُوْهُمْ فَلْيَسْتَجِيْبُوْا لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِيْنَ- ‘আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদেরকে ডাকো, তারা তো তোমাদেরই ন্যায় বান্দা। সুতরাং তোমরা তাদেরকে ডাকতে থাক, যদি তোমরা সত্যবাদী হও, তবে তারা তোমাদের ডাকে সাড়া দিবে’ (আ‘রাফ ৭/১৯৪)। তিনি অন্যত্র বলেন,

أَأَرْبَابٌ مُتَفَرِّقُوْنَ خَيْرٌ أَمِ اللهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ- مَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوْهَا أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمْ مَا أَنْزَلَ اللهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوْا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّيْنُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُوْنَ-

‘ভিন্ন ভিন্ন বহু প্রতিপালক শ্রেয়, না পরাক্রমশালী এক আল্লাহ? তাঁকে ছাড়া তোমরা কেবল কতগুলি নামের ইবাদত করছ, যে নামগুলি তোমাদের পিতৃপুরুষ ও তোমরা রেখেছ; এগুলির কোন প্রমাণ আল্লাহ পাঠাননি। বিধান দেবার অধিকার কেবল আল্লাহরই। তিনি আদেশ দিয়েছেন কেবল তাঁর ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করতে। এটাই সঠিক দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না’ (ইউসুফ ১২/৩৯-৪০)। তিনি অন্যত্র বলেন,

قُلِ ادْعُوْا الَّذِيْنَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُوْنِ اللهِ لَا يَمْلِكُوْنَ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ فِيْ السَّمَاوَاتِ وَلَا فِيْ الْأَرْضِ وَمَا لَهُمْ فِيْهِمَا مِنْ شِرْكٍ وَمَا لَهُ مِنْهُمْ مِنْ ظَهِيْرٍ- وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ-

‘তুমি বল, তোমরা আহবান কর তাদেরকে যাদেরকে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে (মা‘বূদ) মনে করতে। তারা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে অণু পরিমাণ কিছুর মালিক নয় এবং এতদুভয়ে তাদের কোন অংশও নেই। আর তাদের কেউ তার সহায়কও নয়। যাকে অনুমতি দেওয়া হয় সে ছাড়া আল্লাহর নিকট কারো সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না’ (সাবা ৩৪/২২-২৩)। তিনি অন্যত্র বলেন, أَيُشْرِكُوْنَ مَا لَا يَخْلُقُ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُوْنَ- وَلَا يَسْتَطِيْعُوْنَ لَهُمْ نَصْرًا وَلَا أَنْفُسَهُمْ يَنْصُرُوْنَ- ‘তারা কি এমন বস্ত্তকে (আল্লাহর সাথে) শরীক করে থাকে যারা কোন বস্ত্তই সৃষ্টি করতে পারে না; বরং তারা নিজেরাই (আল্লাহ কর্তৃক) সৃজিত? এই শরীককৃত বস্ত্তসমূহ তাদের কোন সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে না এবং তারা নিজেদেরকেও কোন সাহায্য করতে পারে না’ (আ‘রাফ ৭/১৯১-১৯২)

أركان لا إله إلا الله  তথা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর রুকন সমূহ : ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর রুকন হ’ল দু’টি।

(১) النفي  তথা না সূচক : আর তা হ’ল, لا إله (লা ইলাহা) কোন (সত্য) ইলাহ নেই। অর্থাৎ ‘লা ইলাহা’ অংশীদারিত্বের সকল প্রকারকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে দেয়। আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদত করা হয়, তাদের সবগুলিকে বর্জন করা অপরিহার্য করে দেয়।

(২) الإثبات তথা হ্যাঁ সূচক : আর তা হ’ল, إلا الله (ইল্লাল্লাহ) আল্লাহ ব্যতীত। অর্থাৎ ‘ইল্লাল্লাহ’ বান্দার ইবাদতকে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করে। অথবা ইবাদতের যোগ্য যে কেবলমাত্র আল্লাহ তা অপরিহার্য করে দেয়। আল্লাহ বলেন, فَمَنْ يَّكْفُرْ بِالطَّاغُوْتِ وَيُؤْمِنْ بِاللهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ- ‘যে ব্যক্তি ত্বাগূতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মযবূত হাতল আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (বাক্বারাহ ২/২৫৬)

অত্র আয়াতে বর্ণিত فَمَنْ يَّكْفُرْ بِالطَّاغُوْتِ ‘যে ব্যক্তি ত্বাগূতকে অস্বীকার করে’। এটা প্রথম রুকন। অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত যারই ইবাদত করা হোক না কেন তার সবগুলিই বাতিল; যা অবশ্য বর্জনীয়। আর وَيُؤْمِنْ بِاللهِ ‘আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে’। এটা দ্বিতীয় রুকন। অর্থাৎ মা‘বূদ একমাত্র আল্লাহই। তাই উপরেই ঈমান আনতে হবে এবং তারই ইবাদত করতে হবে।

উল্লেখ্য যে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর দু’টি রুকনের কোনটিকে বাদ দিয়ে যিকির জায়েয নয়। অর্থাৎ শুধু ‘লা ইলাহা’ বলে যিকির করা যেমন জায়েয নয়; তেমনি শুধু ‘ইল্লাল্লাহ’ বলে যিকির করাও জায়েয নয়।

شروط لا إله إلا الله তথা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর শর্তাবলী : ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর ৭টি শর্ত রয়েছে, যা জানা ও মানা প্রত্যেক মুসলমানের উপর অবশ্য কর্তব্য। কেননা এই সাতটি শর্ত পূরণ না করে শুধুমাত্র মৌখিভাবে তা পাঠ করে কোন লাভ হবে না। নিম্নে শর্তগুলি দলীলসহ উপস্থাপন করা হ’ল।

(১) العلم (ইলম) বা জ্ঞান থাকা : অর্থাৎ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর হ্যাঁ সূচক ও না সূচক দু’টি অংশের অর্থ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখা। আর তা হচ্ছে, বান্দা বিশুদ্ধচিত্তে শুধুমাত্র আল্লাহরই দাসত্ব করবে। আল্লাহ ব্যতীত যার ইবাদত করা হয় তা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করবে। এই অর্থ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান না রেখে শুধুমাত্র মৌখিভাবে কালিমা পাঠ করে কোন লাভ হবে না। বান্দা যখন এই কালেমার অর্থ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখবে, তখনই সে কেবল আল্লাহকে বিধানদাতা, রিযিকদাতা, সন্তানদাতা, জীবন-মৃত্যুর মালিক, পাপ মোচনকারী, বিপদ-আপদে রক্ষাকারী ইত্যাদি হিসাবে গ্রহণ করতে সক্ষম হবে। আল্লাহ বলেন,فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ ‘জেনে রাখ! আল্লাহ ব্যতীত কোন (সত্য) ইলাহ নেই’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৯)। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ مَاتَ وَهُوَ يَعْلَمُ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘যে ব্যক্তি (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) আল্লাহ ব্যতীত কোন (হক্ব) ইলাহ নেই, এটা জেনে মৃত্যুবরণ করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[17]

(২) اليقين (ইয়াক্বীন) তথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা : অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য মা‘বূদ নেই-এর উপর দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে। এ ব্যাপারে কোনরূপ সন্দেহ থাকলে কালিমা পড়ে কোন লাভ হবে না। আল্লাহ বলেন,

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوْا وَجَاهَدُوْا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ أُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُوْنَ-

‘তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং জীবন ও সম্পদ দ্বারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, তারাই সত্যনিষ্ঠ’ (হুজুরাত ৪৯/১৫)। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,  أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ لاَ يَلْقَى اللهَ بِهِمَا عَبْدٌ غَيْرَ شَاكٍّ فِيْهِمَا إِلاَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ- ‘যে ব্যক্তি বিনা সন্দেহে (দৃঢ়ভাবে) এ সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন (সত্য) মা‘বূদ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল; আর ঐ অবস্থায় সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[18]

(৩) الإخلاص (ইখলাছ) তথা ইখলাছের সাথে কালেমা পাঠ করা : ইখলাছ হ’ল, যাবতীয় শিরকমুক্ত হওয়া। যখনই বান্দা ইখলাছের সাথে কালিমা পাঠ করবে, তখন সে আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না। সুতরাং ইখলাছবিহীন কালিমা পাঠ করলে কোন ফায়েদা হবে না। আল্লাহ বলেন,  وَمَا أُمِرُوْا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ- ‘তাদেরকে আদেশ দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র ইখলাছপূর্ণভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে’ (বায়্যিনাহ ৯৮/৫)। রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِيْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ- ‘ঐ ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন আমার শাফা‘আত লাভে ধন্য হবে, যে ব্যক্তি অন্তর থেকে ইখলাছের সথে বলবে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কোন (সত্য) মা‘বূদ নেই’।[19]

(৪) الصدق (আছ-ছিদক) তথা সত্যবাদী হওয়া : অর্থাৎ সত্যনিষ্ঠার সাথে কালিমা পাঠ করা, যাতে কোন মুনাফিক্বী থাকবে না। মুখ ও অন্তরের সম মিল রেখে কালিমা পাঠ করবে। কেননা মুনাফিক্বরা মৌখিকভাবে কালিমা পাঠ করে, কিন্তু আন্তরিকভাবে অবিশ্বাস করে। তাই তারা ঈমানের দাবীতে মিথ্যাবাদী। আল্লাহ মুনাফিক্বদের সম্পর্কে বলেন, يَقُوْلُوْنَ بِأَلْسِنَتِهِمْ مَا لَيْسَ فِيْ قُلُوْبِهِمْ ‘তারা মুখে এমন কথা বলে, যা তাদের অন্তরে নেই’ (ফাতহ্ ৪৮/১১)। তিনি অন্যত্র বলেন,أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوْا أَنْ يَقُوْلُوْا آمَنَّا وَهُمْ لاَ يُفْتَنُوْنَ- وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْنَ- ‘মানুষ কি মনে করেছে যে, আমরা ঈমান এনেছি- এ কথা বললেই তাদেরকে অব্যাহতি দেয়া হবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমরাতো তাদের পূর্ববর্তীদেরকেও পরীক্ষা করেছিলাম। আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দিবেন কারা সত্যবাদী ও কারা মিথ্যাবাদী’ (আনকাবূত ২৯/২-৩)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَا مِنْ أَحَدٍ يَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ صِدْقًا مِنْ قَلْبِهِ إِلاَّ حَرَّمَهُ اللهُ عَلَى النَّارِ-  ‘যে কোন বান্দা অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে এ সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন (সত্য) মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল- তার জন্য আল্লাহ জাহান্নামকে হারাম করে দিবেন’।[20]

(৫) القبول তথা গ্রহণ করা : অর্থাৎ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করলে তার উপর যে অহি-র বিধানের অনুসরণ ফরয হয়ে যায়, তা পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হবে। বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে এর কোন কিছুই প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। আল্লাহ বলেন, وَإِذَا قِيْلَ لَهُمُ اتَّبِعُوْا مَا أَنْزَلَ اللهُ قَالُوْا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْقِلُوْنَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُوْنَ- ‘যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার অনুসরণ কর। তখন তারা বলে, বরং আমরা এরই অনুসরণ করব, যা আমাদের পিতৃ-পুরুষগণ হ’তে প্রাপ্ত হয়েছি; যদিও তাদের পিতৃ-পুরুষদের কোনই জ্ঞান ছিল না এবং তারা সুপথগামীও ছিল না’ (বাক্বারাহ ২/১৭০)। তিনি অন্যত্র বলেন, وَكَذَلِكَ مَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ فِيْ قَرْيَةٍ مِنْ نَذِيْرٍ إِلَّا قَالَ مُتْرَفُوْهَا إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِمْ مُقْتَدُوْنَ، قَالَ أَوَلَوْ جِئْتُكُمْ بِأَهْدَى مِمَّا وَجَدْتُمْ عَلَيْهِ آبَاءَكُمْ قَالُوْا إِنَّا بِمَا أُرْسِلْتُمْ بِهِ كَافِرُوْنَ- ‘এভাবে তোমার পূর্বে কোন জনপদে যখনই আমরা কোন সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখন ওর সমৃদ্ধশালী ব্যক্তিরা বলত, আমরাতো আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পেয়েছি এক মতাদর্শের অনুসারী এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি। তখন সতর্ককারী বলত, তোমরা তোমাদের পূর্ব-পুরুষদেরকে যে পথে পেয়েছ, আমি যদি তোমাদের জন্য তদপেক্ষা উৎকৃষ্ট পথ-নির্দেশ আনয়ন করি (তাহ’লেও কি তোমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে?) তারা বলত, তোমরা যা সহ প্রেরিত হয়েছ আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি’ (যুখরুফ ৪৩/২৩-২৪)

(৬) الإنقياد (ইনক্বিয়াদ) তথা আনুগত্য করা : অর্থাৎ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বললেই তাকে আল্লাহর সকল আদেশ যথাযথভাবে মেনে চলার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে এবং তাঁর প্রত্যেকটি নিষেধ নিঃশর্তভাবে বর্জন করতে হবে। আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يُسْلِمْ وَجْهَهُ إِلَى اللهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى وَإِلَى اللهِ عَاقِبَةُ الْأُمُوْرِ- ‘যদি কেউ সৎ কর্মপরায়ণ হয়ে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে তাহ’লে সেতো দৃঢ়ভাবে ধারণ করে এক মযবূত হাতল। আর যাবতীয় কার্যের পরিণাম আল্লাহর দিকে’ (লুকমান ৩১/২২)

(৭) المحبة (মুহাববত) তথা ভালবাসা : অর্থাৎ কালিমাকে মুহাববতের সাথে পাঠ করতে হবে। বিনা মুহাববতে শুধুমাত্র মৌখিক সাক্ষ্যদানে কোন লাভ হবে না। আর কোন ক্রমেই কাউকে আল্লাহর সমতুল্য ভালবাসা যাবে না। আল্লাহ বলেন, وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُوْنِ اللهِ أَنْدَادًا يُحِبُّوْنَهُمْ كَحُبِّ اللهِ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ- ‘আর মানুষের মধ্যে এমনও ব্যক্তি আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালবাসার মত ভালবাসে। আর যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহর জন্য ভালবাসায় দৃঢ়তর’ (বাক্বারাহ ২/১৬৫)                               (চলবে)

* লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব; প্রধান দাঈ, বাংলা বিভাগ, আল-ফুরক্বান সেন্টার, হূরা, বাহরাইন।


[1]. মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, আল-ক্বাওলুল মুফীদ ১/১৪ পৃঃ।

[2]. ঐ।

[3]. শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া, আল-‘উবূদিয়াহ ২/৪৫৪ পৃঃ।

[4]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন ১/৮৫ পৃঃ।

[5]. বুখারী হা/৫০; মুসলিম হা/৮; মিশকাত হা/২।

[6]. তাজুল আরূস মিন জাওয়াহিরিল কামূস ৩৮/৪৯৬ পৃঃ।

[7]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন ১/৯২ পৃঃ।

[8]. তাফসীর ইবনু কাছীর, সূরা বাক্বারাহ ১১২নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

[9]. তাফসীর ইবনু কাছীর, সূরা কাহফ ১১২নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

[10]. বুখারী হা/২৮৫৬; মুসলিম হা/৩০; মিশকাত হা/২৪।

[11]. দারাকুতনী হা/১৩৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭৬৪; ছহীহ আত-তারগীব হা/৭।

[12]. মুসলিম হা/১৭১৮।

[13]. বুখারী হা/২৬৯৭; মুসলিম হা/১৭১৮; মিশকাত হা/১৪০।

[14]. খতীব বাগদাদী, আল-জামে‘ লি আখলাকির রাবী ওয়া আদাবিস সামে‘ হা/৮।

[15]. আবু ইসহাক আশ-শাতেবী, আল-ই‘তিছাম ২/১৩২; নাছিরুদ্দীন আলবানী, আত-তাওয়াস্সুল, ১/১৬ পৃঃ।

[16]. শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া, আল-‘উবূদিয়াহ ২/৪৭৬ পৃঃ; ড. সাইয়েদ আব্দুল গনী, আল-আক্বীদাতুছ ছাফিয়া লিল ফিরক্বাতিন নাজিয়াহ, পৃঃ ২৫৯।

[17]. মুসলিম হা/২৬; মিশকাত হা/৩৭।

[18]. মুসলিম হা/২৭; মিশকাত হা/৫৯১২।

[19]. বুখারী হা/৯৯; মিশকাত হা/৫৫৭৪।

[20]. বুখারী হা/১২৮; মিশকাত হা/২৫।






ঈছালে ছওয়াব : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (১ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আল্লাহর প্রতি ঈমানের স্বরূপ (তৃতীয় কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ভারতীয় উপমহাদেশের আহলেহাদীছ আলেমগণের অগ্রণী ভূমিকা - ড. নূরুল ইসলাম
মাসিক আত-তাহরীক : ফেলে আসা দিনগুলি - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
আল-কুরআনের আলোকে জাহান্নামের বিবরণ (২য় কিস্তি) - বযলুর রশীদ
ইসলাম ও জঙ্গীবাদ - মুজাহিদুল ইসলাম স্বাধীন - সরকারী কে.সি. কলেজ, ঝিনাইদহ
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
১৬ মাসের মর্মান্তিক কারা স্মৃতি (৩য় কিস্তি) - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
উত্তম মৃত্যুর কিছু নিদর্শন ও আমাদের করণীয় - ইহসান ইলাহী যহীর
বৃদ্ধাশ্রম : মানবতার কলঙ্কিত কারাগার (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম
হাদীছ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পরিক্রমা - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ইবাদতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আরও
আরও
.