পর্ব ১ । পর্ব ২ ।

দরূদের বিশুদ্ধ শব্দাবলী :

রাসূলের (ছাঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ ও সালাম প্রদান দু’টি সময়ে হয়ে থাকে। 

(১) ছালাতের ভিতরে : ছালাতের ভিতরে ঐ সকল সালাম ও দরূদ পাঠ করতে হবে যা রাসূল (ছাঃ) নিজে পাঠ করেছেন ও ছাহাবায়ে কেরামকে শিক্ষা দিয়েছেন। যেটা তাশাহহুদ ও দরূদে ইব্রাহীমী হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। অনুরূপভাবে জানাযার ছালাতের দ্বিতীয় তাকবীরের পরে রাসূলের শিখানো দরূদে ইব্রাহীমী পড়তে হবে। ছালাতের ভিতরের দরূদ ও সালাম শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত, যাতে কম-বেশী করার অধিকার কারো নেই।

(২) ছালাতের বাইরে : ছালাতের বাইরে নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রতি অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি বিহীন যে কোন শব্দে দরূদ ও সালাম পাঠ করা ওলামাগণ জায়েয বলেছেন। যেমন ত্বাঊস (রহঃ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, ইবনে আববাস (রাঃ) বলেছেন,اَللَّهُمَّ تَقَبَّلْ شَفَاعَةَ مُحَمَّدٍ الْكُبْرَى، وَارْفَعْ دَرَجَتَهُ الْعُلْيَا، وَأَعْطِهِ سُؤْلَهُ فِي الْآَخِرَةِ وَالْأُوْلَى، كَمَا آَتَيْتَ إِبْرَاهِيْمَ وَمُوْسَى، ‘হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর বড় শাফা‘আত আমার জন্য কবুল কর। তাঁকে উচ্চ মর্যাদায় সম্মুন্নত কর এবং আপনি মূসা (আঃ) ও ইবরাহীম (আঃ)-কে যেভাবে দান করেছেন তেমনি তাকেও দুনিয়া ও আখিরাতে চাহিদা প্রদান করুন’।[1]

ছালাতের বাইরে ছাহাবীগণ রাসূল (ছাঃ)-এর নাম মুখে উচ্চারণ করলে অথবা শুনলে صلى الله عليه وسلم অথবা عليه الصلاة والسلام শব্দ ব্যবহার করেছেন। আবু মূসা আল-আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,

قُلْتُ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ مَا هَذَا الَّذِي أَحْدَثْتَ فِي شَأْنِ النُّسُكِ قَالَ إِنْ نَأْخُذْ بِكِتَابِ اللهِ فَإِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ قَالَ ‏وَأَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلَّهِ‏‏ وَإِنْ نَأْخُذْ بِسُنَّةِ نَبِيِّنَا عَلَيْهِ الصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ فَإِنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم لَمْ يَحِلَّ حَتَّى نَحَرَ الْهَدْىَ-

‘আমি বললাম, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি হজ্জের ব্যাপরে নতুন কি বিধান দিচ্ছেন? তিনি বললেন, আমরা যদি আল্লাহর কিতাব আঁকড়ে ধরি, তবে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ ও ‘ওমরাহ পূর্ণ কর’ (বাক্বারাহ ২/১৯৬)। আর আমরা যদি আমাদের নবী (ছাঃ)-এর সুন্নাতের অনুসরণ করি তাহ’লে নবী করীম (ছাঃ) সাথে করে নিয়ে আসা পশু যবাহ না করা পর্যন্ত ইহরাম খুলতেন না’।[2]

ছাহাবীগণের পরবর্তী তাবেঈগণ ইমাম ও মুহাদ্দিছগণ তাদের কথা-বার্তা ও হাদীছ লেখনিতে যখনি রাসূল (ছাঃ)-এর নাম এসেছে তখনি সংক্ষিপ্ত দরূদ হিসাবে صلى الله عليه وسلم লিখেছেন, হাদীছ শিক্ষা দেওয়ার সময়ও বলতেন।

রাসূল (ছাঃ) তাঁর উপরে দরূদ পঠের জন্য ছাহাবীদেরকে যে সকল দরূদ শিক্ষা দিয়েছেন তা প্রায় একই। আর তা হ’ল দরূদে ইবরাহীমী, যা প্রত্যেক মুছল্লী ছালাতে তাশাহুদের পরে পাঠ করে থাকে। আল্লামা আলবানী (রহঃ) তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘নাবী (ছাঃ)-এর ছালাত সম্পাদনের পদ্ধতি’ বইয়ে ‘নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রতি ছালাত পাঠ এবং তার স্থান ও শব্দাবলী’ অধ্যায়ে ৭টি উল্লেখ করেছেন। নিম্নে তার কয়েকটি উল্লেখ করা হ’ল।-

১. আবদুর রহমান ইবনু আবূ লায়লা (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কা‘ব ইবনু উজরাহ (রাঃ)-এর সাথে আমার দেখা হ’লে তিনি বললেন, হে আবদুর রহমান! আমি কি তোমাকে একটি কথা উপহার দিব যা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে শুনেছি? উত্তরে আমি বললাম, হ্যাঁ আমাকে তা উপহার দিন। তিনি বললেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার প্রতি আমরা সালাম কিভাবে পাঠ করব তা আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। আমারা আপনার ও আপনার পরিবারের প্রতি দরূদ কিভাবে পাঠ করব? রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমরা বল,

اللّهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ وَعَلى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلى إِبْرَاهِيمَ وَعَلى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدٌ، اَللّهُمَّ بَارِكْ عَلى مُحَمَّدٍ وَّعَلى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدٌ،

‘হে আল্লাহ! মুহাম্মাদের উপর এবং মুহাম্মাদের পরিবারবর্গের রহম করুন, যেমন রহম করেছেন ইব্রাহীম ও ইব্রাহীমের পরিবারবর্গের উপর। নিঃসন্দেহে আপনি প্রশংসিত ও সম্মানিত। হে আল্লাহ! বরকত দান করুন মুহাম্মাদের উপর ও মুহাম্মাদের পরিবার বর্গের উপর যেমন আপনি বরকত দান করেছেন ইব্রাহীম ও ইব্রাহীমের পরিবার বর্গের উপর। নিঃসন্দেহে আপনি প্রশংসিত ও সম্মানিত’।[3]

২. আবু মুহাম্মাদ কা‘ব ইবনু উজরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) একদিন আমাদের কাছে এলেন। আমরা তাকে বললাম, ইয়া রাসূলল্লাহ! আপনার উপর সালাম কিভাবে পাঠাতে হয় তা তো আমরা জানি। কিন্তু আপনার উপর দরূদ কিভাবে পড়তে হবে? তিনি বললেন, তোমরা বল,

اللهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدٌ اللهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدٌ-

‘হে আল্লাহ! রহম করুন মুহাম্মাদের উপর এবং মুহাম্মাদের পরিবারবর্গের উপর যেমন রহম করেছেন ইব্রাহীমের বংশধরের উপরে। নিঃসন্দেহে আপনি প্রশংসিত ও সম্মানিত। হে আল্লাহ! বরকত দান করুন মুহাম্মাদের উপর ও মুহাম্মাদের পরিবারবর্গের উপর যেমন আপনি বরকত দান করেছেন ইব্রাহীমের বংশধরের উপর। নিঃসন্দেহে আপনি প্রশংসিত ও সম্মানিত’।

৩. অন্য হাদীছে ছাহাবীদের প্রশ্নের জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা বল,

اَللهم صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إبْرَاهِيمَ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْت عَلَى آلِ إبْرَاهِيمَ، إنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ،

‘হে আল্লাহ! রহম করুন মুহাম্মাদের উপর এবং মুহাম্মাদের পরিবারবর্গের উপর যেমন রহম করেছেন ইব্রাহীমের পরিবারবর্গের উপর। হে আল্লাহ! বরকত দান করুন মুহাম্মাদের উপর ও মুহাম্মাদের পরিবার বর্গের উপর যেমন আপনি বরকত দান করেছেন ইব্রাহীমের পরিবারবর্গের উপর। নিঃসন্দেহে আপনি প্রশংসিত ও সম্মানিত’।[4]

৪. আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, ছাহাবীদের প্রশ্নের জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা বল,

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ عَبْدِكَ وَرَسُوْلِكَ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ وَآلِ إِبْرَاهِيْمَ،

‘হে আল্লাহ! আপনি আপনার বান্দা ও আপনার রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর রহমত বর্ষণ করুন। যেমন করে আপনি ইবরাহীম (আঃ)-এর উপর রহমত অবতীর্ণ করেছেন। আর আপনি মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর পরিবারবর্গের উপর বরকত নাযিল করুন, যে রকম আপনি ইবরাহীম (আঃ)-এর পরিবারবর্গের উপর বরকত অবতীর্ণ করেছেন’।[5]

৫. আবু হুমায়দ সা‘ঈদ (রহঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তোমরা বল, ছাহাবীদের প্রশ্নের জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَأَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَأَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ،

‘হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদ ও তাঁর স্ত্রী এবং সন্তান-সন্ততির উপর রহমত অবতীর্ণ করুন যেভাবে আপনি ইবরাহীম (আঃ)-এর পরিবারবর্গের উপর রহমত অবতীর্ণ করেছেন। আর আপনি মুহাম্মাদ ও তাঁর স্ত্রী এবং সন্তান-সন্ততির উপর বরকত অবতীর্ণ করুন যেরূপ আপনি ইবরাহীম (আঃ)-এর পরিবারবর্গের উপর বরকত অবতীর্ণ করেছেন। আপনি অতি প্রশংসিত, উচ্চ মর্যাদাশীল’।[6]

এখানে উল্লেখ্য যে, হাদীছে বর্ণিত দরূদের শব্দাবলীর কোথাও সাইয়িদিনা, মাওলানা, শাফীইনা অথবা হাবীবিনা ইত্যাদি শব্দ উল্লেখ নেই। রাসূল (ছাঃ)-এর অনেক গুণবাচক শব্দ রয়েছে। তন্মধ্যে উপরোক্ত শব্দাবলীও রাসূল (ছাঃ)-এর গুণবাচক শব্দ। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) যেহেতু দরূদে উক্ত শব্দ ব্যবহার করেননি। তাই সুন্নাত হ’ল উক্ত শব্দবলীকে দরূদের শব্দাবলী হিসাবে ব্যবহার না করা।

শরী‘আতের মানদন্ডে সমাজে প্রচলিত কিছু দরূদ

দরূদ পাঠ একটি ফযীলতপূণ ইবাদত। আর যে কোন ইবাদত আল্লাহর নিকট কবুল হওয়ার জন্য অন্যতম শর্ত হ’ল- রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণে ইবাদত করা। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে রাসূল (ছাঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ ও সালাম প্রদানের আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু তার পদ্ধতি কুরআনের বর্ণানা করা হয়নি। দরূদের পদ্ধতি, দরূদের শব্দাবলী রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদের মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা ছহীহ হাদীছ গ্রন্থ সমূহে বর্ণিত হয়েছে। তা হ‘ল দরূদে ইব্রাহীম যা প্রত্যেক মুছল্লী ছালাতের শেষ বৈঠকে তাশাহহুদের পরে পাঠ করে থাকেন। এছাড়া রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদেরকে অন্য কোন দরূদ শিক্ষা দিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই।

আর একথা সর্বজন বিদিত যে, আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ছাঃ)-কে প্রেরণ করেছেন তাঁর সঠিক দ্বীন মানুষের নিকট পৌঁছে দেওয়ার জন্য। আর রাসূল (ছাঃ) যথাযথভাবে স্বীয় দায়িত্ব পৌঁছে দিয়েছেন। এই বিশ^াস রাখা প্রত্যেক মু‘মিনের ঈমানী দায়িত্ব। সুতরাং দরূদের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের শব্দাবলীও রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। আর ছওয়াবের আশায় আমাদেরকে তাঁর অনুসরণ করাই ঈমানের দাবী।

কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, আজকাল রাসূল (ছাঃ)-এর মহবতের নামে, দরূদের নামে অনেক দরূদ প্রচলিত আছে যার অস্তিত্ব কুরআন-হাদীছে তো নেই, এমনকি নির্ভরযোগ্য কোন গ্রন্থেই এর উল্লেখ নেই। আর যে সকল ইমামদের নামে মাযহাব চালু করে অন্ধ তাক্বলীদ করা হচ্ছে তাঁরাও বলে জাননি। নিম্নে সমাজে প্রচলিত কিছু দরূদ ও শরী‘আতে তার অস্তিত্ব বিষয়ে আলোচনা করছি।

সমাজে বহুল প্রচলিত, বিশেষ করে বক্তাদের মুখে মুখে ব্যাপকভাবে পঠিত একটি প্রচলিত দরূদ (?) হ’ল-

بلغ العلى بكماله، كشف الدجى بجماله،

حسنت جميع خصاله، صلوا عليه وآله.

অর্থ : তিনি (মুহাম্মাদ ছাঃ) তাঁর পরিপূর্ণতার দ্বার উচ্চ আসনে পৌঁছেছেন। তাঁর সৌন্দর্যের কারণে অন্ধকার দূরবর্তী হয়েছে। তাঁর সমস্ত স্বভাব/চরিত্র সুন্দর। তোমরা তাঁর উপর ও তাঁর পরিবারের উপর দরূদ পাঠ কর।

বিশ্লেষণ : প্রথমত: সমাজে প্রচলিত উক্ত দরূদটি আসলে কোন দরূদ নয়, বরং এটি পারস্য কবি শেখ সা‘দী (৫৮৫ অথবা ৬০৬-৬৯১ হিঃ)-এর একটি কবিতার অংশ। তিনি রাসূলের প্রশংসায় এটি রচনা করেছেন।

দ্বিতীয়ত: এখানে শিরকের মিশ্রণ রয়েছে। কারণ এখানে বলা হয়েছে, রাসূল (ছাঃ) নিজের পরিপূর্ণতা দ্বারা উচ্চ আসনে পৌঁছেন। আসলে রাসূল (ছাঃ) নিজের যোগ্যতায় উচ্চ আসনে পৌঁছেননি, বরং আল্লাহ তাঁকে উচ্চ আসনে পৌঁছিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ ‘আর আমরা তোমার (মর্যাদার) জন্য তোমার স্মরণকে সমুন্নত করেছি’ (ইনশিরাহ/৪)। সুতরাং রাসূল (ছাঃ)-এর দুনিয়ায় ও আখেরাতে যত সম্মান, যত মর্যাদা সব আল্লাহ তাকে দিয়েছেন। এটা আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ। সুতরাং কেউ যদি বিশ^াস করে যে, আল্লাহর রাসূল নিজের যোগ্যতায় এত বড় মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন, তাহ’লে তা আল্লাহর ক্ষমতায় শিরক করা হবে। অনুরূপভাবে কেউ যদি বিশ^াস করে যে, রাসূল (ছাঃ)-এর কারণে (জাহিলিয়াতের) অন্ধকার দূরীভূত হয়ে (ইসলামের) আলোয় আলোকিত হয়েছে এটাও রাসূল (ছাঃ)-এর মর্যাদায় অতিরঞ্জিত করা হবে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحاً مِّنْ أَمْرِنَا مَا كُنتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيْمَانُ وَلَكِن جَعَلْنَاهُ نُوْراً نَّهْدِي بِهِ مَنْ نَّشَاء مِنْ عِبَادِنَا وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ،

‘অনুরূপভাবে আমরা তোমার কাছে আমাদের নির্দেশ থেকে ‘রূহ’কে ওহী যোগে প্রেরণ করেছি। তুমি জানতে না কিতাব কী এবং ঈমান কী। কিন্তু আমরা একে আলো বানিয়েছি, যার মাধ্যমে আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করি। আর নিশ্চয়ই তুমি সরল পথের দিক নির্দেশনা দাও’ (শূরা/৫২)

তৃতীয়ত: কবি নিজে একে দরূদ বলেননি। বরং তিনি বলেছেন, ‘তোমরা তাঁর ও তাঁর পরিবারের উপর দরূদ পাঠ কর’।

সতরাং এটাকে দরূদ হিসাবে মনে করে ছওয়াবের আশায় পাঠ করলে রাসূলের সুন্নাতের অবমাননা করা হবে এবং এটা নিশ্চয়ই বিদ‘আত হবে। আর কেউ যদি মনে করে এটা দরূদ হিসাবে নয় বরং কবিতা হিসাবে পড়া হয়, তাহ’লেও শব্দগত ও অর্থগত ক্রটির কারণেও এটা পরিতাজ্য।

এছাড়া রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি সম্মান জানাতে ও দরূদ পাঠ করতে বলা হয় যে,

يا نبي سلام عليك، يا رسول سلام عليك، يا حبيب سلام عليك صلوات الله عليك.

‘হে নবী! আপনার প্রতি সালাম। হে রাসূল! আপনার প্রতি সালাম। হে হাবীব! আপনার প্রতি সালাম। আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার উপর রহমত’।

উল্লেখ্য যে, প্রচলিত কথাগুলো আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) থেকে প্রমাণিত কোন দরূদ নয়। বরং এগুলো মানুষের বানানো দরূদের নামে জালিয়াতী।

আর আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ীও ভুল। কারণ সম্মানিত কাউকে ডাকার জন্য সম্মান দিয়ে ডাকতে হয়। অথচ এখানে সমস্ত নবীদের সর্দার, দুনিয়া-আখেরাতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ তাকে অনির্দিষ্টবাক্যে ডাকা হচ্ছে যা আদবের খেলাপ। আর আল্লাহ রাববুল আলামীন কুরআনের যত জায়গায় রাসূলকে সম্বোধন করেছেন সেখানে  يا نبي বা يا رسول  না বলে يا ايها رسول বা  يا ايها نبي বলেছেন।  যেমন আল্লাহ বলেন, يا أَيُّهَا النَّبِيُّ حَسْبُكَ اللَّهُ وَمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِين- ‘হে নবী! তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং যেসব মুমিন তোমার অনুসরণ করেছে তাদের জন্যও’ (আনফাল ৮/৬৪)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, يَاأَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ ‘হে রাসূল! তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে, তা পৌঁছে দাও’ (মায়েদা ৫/৬৭)। সুতরাং রাসূল (ছাঃ)-এর সম্মানের জন্য, ছওয়াবের আশায় দরূদ পাঠ করতে হ’লে রাসূল (ছাঃ)-এর শিখানো পদ্ধতি অনুযায়ীই করতে হবে। অন্যথা রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের অবজ্ঞার করণে ছওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হবে।

অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, আমাদের সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন বইয়ে মানুষের মুখে মুখে অনেক দরূদের নাম শুনা যায়। যার কোন সূত্র উল্লেখ নেই। যেমন দরূদে আকবার, দরূদে হাযারী, দরূদে লাখী, দরূদে নাজিয়া, দরূদে তাজ, দরূদে নারিয়া, দরূদে সাইফুল্লাহ, দরূদে যিয়ারাত, দরূদে শিফা, দরূদে মাহী, দরূদে খায়ের, দরূদে ফতুহাত, দরূদে কালিমাহ, দরূদে মোবারক, দরূদে মুহাম্মাদী, দরূদে বীর, দরূদে শাফেঈ, দরূদে গাওছিয়া, দরূদে একছিরে আযম, দরূদে যাজুলী, দরূদে নাজাত, দরূদে শাফিয়ুল আমরায, দরূদে বরকত, দরূদে কামেল, দরূদে তাম্মা, দরূদে মুত্তাকীন, দরূদে নূরুল আবছার, দরূদে মুকাররম, দরূদে মিফতাহুন নাযিরা, দরূদে আল-বাইয়াতিহি দরূদে অসীলা, দরূদে মুকাদ্দাস, দরূদে তুনাজ্জিনা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

আবার কিছু কিছু দরূদের আশ্চর্যজনক ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। যেহেতু উক্ত নামে কোন দরূদ রাসূল (ছাঃ) শিক্ষা দেননি। সুতরাং এই দরূদেরও কোন ফযীলত রাসূল (ছাঃ) বর্ণনা করেননি। সুতরাং কেউ যদি এসব বানানো দরূদের নামে জালিয়াতী কথাগুলো রাসূল বলেছেন বলে বিশ^াস করে তবে সে যেন নিজের স্থান জাহান্নামে বানিয়ে নিল।[7]

আর ফযীলত একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) বলার অধিকার রাখেন। কোন কাজ করলে, কোন যিকির করলে, কোন দরূদ পাঠ করলে কী পরিমাণ ছওয়াব হবে তা শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত হ’তে হবে। কোন মানুষ অনুমান করে কোন কিছু বললে সেটা শরী‘আতে অতিরিক্ত হিসাবে বিবেচিত হবে। যা শরী‘আতের ভাষায় বিদ‘আত হিসাবে পরিচিত, যার পরিণাম জাহান্নাম।[8]

নিম্নে প্রচলিত কিছু দরূদের মিথ্যা ও বানোয়াট ফযীলত তুলে ধরছি-

দরূদে হাযারীর ফযীলতে লেখা আছে, কোন পাপী লোকের কবরের নিকট হাযির হয়ে এ দরূদ তিনবার পাঠ করলে ঐ লোকের ৮০ বছরের কবরের আযাব আল্লাহ মাফ করে দিবেন। এ দরূদ ২১ বার পাঠ করে মৃত পিতা-মাতার জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করলে তাদেরকে আল্লাহ শান্তি দান করবেন এবং এক হাযার ফেরেশতা ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাদের কবরের নিকট এসে আল্লাহর নিকট গুনাহ মাফের জন্য দো‘আ করতে থাকবেন।

দরূদে লাখীতে বলা হয়েছে, ‘গজনীর সুলতান মাহমূদ মহানবী (ছাঃ)-এর ইশক ও মহবতে দৈনিক এক লক্ষ বার এ দরূদ পাঠ করতেন। একবার তিনি স্বপ্ন যোগে আদিষ্ট হ’লেন, হে মাহমূদ! তুমি প্রত্যেহ ফজর ছালাতের পর এ দরূদ পাঠ কর। এতে তুমি এক লক্ষ বার দরূদ পাঠ করার ছওয়াব লাভ করবে এবং তার বদৌলতে তুমি আমার ইশক ও মহবতের কামালিয়াতে পৌঁছতে সক্ষম হবে।

দরূদে নাজিয়ার ফযীলতে বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি চাকুরী হারানো বা কঠিন রোগে আক্রান্ত হ’লে বা মোকাদ্দামায় জয়ী হবার আশা না থাকলে খাছ নিয়তে এব হাযার বার দরূদে নাজিয়া পাঠ করে দো‘আ করলে আল্লাহ তা‘আলা তার দো‘আ কবুল করবেন।

দরূদে তাজের ফযীলতে বলা হয়েছে, ‘প্রতিদিন ফজর ছালাতের পর ৭ বার, আছরের ছালাতের পর ৩ তার এবং এশার ছালাতের পরে ৩ বার দরূদে তাজ পাঠ করলে অন্তরে প্রশান্তি আসে। শয়তানের ধোঁকা ও সকল প্রকার বালা-মুছীবত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। রূযী-রোযগারে বরকত হয় এবং সকলের কাছে সম্মান পাওয়া যায়।

দরূদে নারিয়ার ফযীলতে বলা হয়েছে, ‘কোন লোক বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে তাহাজ্জুদ ছালাতের পর নির্জন স্থানে বসে একাগ্রতার সাথে দরূদে নাজিয়া ২৭ বার পাঠ করে আল্লাহর দরবারে দো‘আ করলে, তার দো‘আ আল্লাহ কবুল করেন ও তার মনের বাসনা পূরণ করেন। আরো বলা হয়েছে, ‘কোন মারাত্মক রোগাক্রান্ত হ’লে কিছু পরহেযগার আলেম একত্রিত করে এ দরূদ ৪৪৪৪ বার পাঠ করে আল্লাহর কাছে দো‘আ করলে উক্ত দো‘আ কবুল হয় ও রোগ ভাল হয়। আরো বলা হয়েছে, ‘প্রত্যহ ফজর ও আছর ছালাতের পর ১১ বার এ দরূদ পাঠ করলে আল্লাহর ইচ্ছায় সকল কাজ মঙ্গলজনক হয়।

দরূদে শিফার ফযীলতে বলা হয়েছে, ‘নিয়মিত এ দরূদ পাঠ করলে আল্লাহর ইচ্ছায় মৃত্যু রোগ ছাড়া জীবনে আর অন্য কোন রোগে আক্রান্ত হবে না।

দরূদে মুকাদ্দাসের ফযীলতে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি দরূদে মুকাদ্দাস নিয়মিত পড়বেন আল্লাহ তার সব গুনাহ মাফ করে দিবেন, জানাযায় ফেরেশতা হাযির হবেন, কবর আলোকিত হবে, হাশরের মাঠে আল্লাহর মেহমানদের সাথে উপবিষ্ট থাকবেন।

দরূদে নূরের ফযীলতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি জুম‘আবারে আছরের ছালাতের পর ৮০ বার এই দরূদ পাঠ করবেন আল্লাহ তার ৮০ বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।

দরূদে দীদারে মুছতফার ফযীলতে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে এই দরূদ পাঠ করলে মৃত্যুর মুহূর্তে নবী করীম (ছাঃ)-এর দর্শন লাভ হবে ও কবরে প্রবেশ করতেই দেখতে পাবে নবী করীম (ছাঃ) রহমত সহকারে অবতরণ করছেন।

এছাড়াও বিভিন্ন দরূদের ফযীলতে বলা হয়েছে, যে এত বার পাঠ করলে রাসূল (ছাঃ) স্বপ্নে দেখা যাবে, সকাল-বিকাল পাঠ করলে এলাকা থেকে মহামারী বা বসন্ত দূর হবে, এতবার পাঠ করলে ব্যবসায়, চাকুরিতে বা ক্ষেত-খামারের কোন ক্ষতি হবে না, এক বার পড়লে ৭০ জন ফেরেশতা ১০০০ দিন পর্যন্ত ছওয়াব লিখতে থাকবেন, কাউছারের পানি পান করতে এই দরূদ পাঠ করতে হবে ইত্যাদি... ইত্যাদি।

ঐসব প্রচলিত দরূদগুলোর সবগুলো মানুষের বানানো এবং ফযীলতগুলো তাদের ইচ্ছামত তৈরী করা। আমরা যদি ছহীহ হাদীছ বাদ দিয়ে মানুষের কথাগুলোকে মেনে নেই তাহ’লে ইসলামের বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট হবে। আল্লাহ তা‘আলার কথা মিথ্যা প্রমাণিত হবে। কারণ আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে পসন্দ করলাম ইসলামকে’ (মায়েদাহ ৫/৩)

দরূদের সাথে সংশ্লিষ্ট সমাজে প্রচলিত কিছু বিদ‘আত

রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ একটি গুরুত্বপূণ ইবাদত হ’লেও বর্তমান নামধারী মুসলিমগণ দরূদের নামে বিভিন্ন ধরনের বিদ‘আত চালু করেছে। তারা ছওয়াবের আশায়, রাসূল (ছাঃ)-এর মহবতের নামে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান তৈরী করেছে, যার কোন ভিত্তি শরী‘আতে নেই। এ রকম কিছু বিদ‘আতের কথা নিমেণ উল্লেখ করছি।

১. মীলাদের আয়োজন করা :

আমাদের সমাজে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, কোন শুভ কাজে এমনকি নতুন বাড়ী ও দোকান উদ্বোধন উপলক্ষে মীলাদের আয়োজন করা হয়। যেখানে রাসূল (ছাঃ)-এর নামে বিভিন্ন ভাষায় প্রশংসামূলক অনেক কবিতা সুরে সুরে গেয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে সালাম জানানো হয় এবং তাঁর নামে দরূদ পাঠ করা হয়। এগুলো বিদ‘আতী আমল। মীলাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ জন্মসময়। যে কোন ব্যক্তির জন্মকালকে আরবীতে মীলাদ বলা হয়। আর সমাজে মীলাদ বলতে রাসূল (ছাঃ)-এর নামে বিভিন্ন ভাষায় তাঁর প্রশংসামূলক কবিতা পাঠ করাকে বুঝায়। এ মীলাদ অনুষ্ঠান শুধু রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম দিনে পালন হয় না; বরং সারা বছর পালন করা হয়।

হাদীছে রাসূল (ছাঃ)-এর জন্মবার উল্লেখ আছে, তা হ’ল সোমবার।[9] জন্মের বছর উল্লেখ আছে, তা হ’ল হাতির বছর।[10] কিন্তু রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম মাস ও জন্ম তারিখ উল্লেখ নেই। এজন্য ওলামায়ে কেরাম ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম মাস ও জন্ম তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। সুতরাং যেহেতু রাসূল (ছাঃ)-এর সঠিক জন্ম তারিখই জানা যায়নি তাহ’লে কিভাবে জন্ম দিবস পালন করা হবে। আর এমনকি ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীতে কেউ মীলাদ পালন করেননি।[11] বরং ৪র্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শী‘আদের উদ্যোগে মীলাদুন্নবী উদযাপন আরম্ভ হয়।[12] কারো কারো মতে, ইরাকের ‘এরবল’ এলাকার গভর্ণর আবু সাঈদ মুযাফ্ফরুদ্দীন কুকুবুরী (৫৮৬-৬৩০ হিঃ) সর্বপ্রথম কারো মতে ৬০৪ হিঃ মতান্তরে, ৬২৫ হিজরীতে মীলাদের প্রচলন ঘটান বলে কথিত আছে।[13]

একথা সম্পষ্ট যে, রাসূল (ছাঃ) কখনো তাঁর জন্ম দিবস পালন করেননি। ছাহাবায়ে কিয়াম, তাবেঈগণ এবং পরবর্তী সালাফে ছালেহীন না তার জন্ম দিবসে কোন অনুষ্ঠান করেছেন না বছরের অন্য কোন দিন মীলাদের নামে কোন অনুষ্ঠান করেছেন। বরং তারা সব সময় রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের যথাযথ অনুসরণ করেছেন। সুতরাং যারা রাসূল (ছাঃ)-কে জীবন দিয়ে ভালবাসেন, তারা যদি প্রচলিত পদ্ধতিতে মীলাদ পালন না করে থাকেন, তাহ’লে আমরা কেন এ বিদ‘আতী মীলাদ পালন করব?

২. মীলাদের অনুষ্ঠানে রাসূল (ছাঃ) হাযির হন বলে বিশ^াস করা :

সমাজে মীলাদ পালনকারী অনেকেই মনে বিশ^াস করেন যে, কোন মুসলিম যখন রাসূল (ছাঃ)-এর নামে মীলাদ পড়েন, দরূদ পাঠ করেন তখন রাসূল (ছাঃ) সেখানে উপস্থিত হন। এমনকি অনেকে মঞ্চে একটি খালি চেয়ার সাজিয়ে রাখেন, যাতে এই খালি চেয়ারে রাসূল (ছাঃ) এসে বসতে পারেন। এটা শিরকী আক্বীদা। রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে সঠিক আক্বীদা হ’ল তিনি ১১ হিজরীর ১২ই রবীউল আওয়াল মাসের ১২ তারিখ মৃত্যুবরণ করেছেন (যুমার-৩০-৩১; আলে ইমরান ১৪৪)। সকল ছাহাবীগণ জানাযা ছালাত আদায় করে তাঁকে কবরস্থ করেছেন। তিনি আর কখনো দুনিয়াতে আসবেন না। রাসূল (ছাঃ) সহ যেকোন মানুষ ইচ্ছা করলে দুনিয়াতে আসতে পারবেন না, বরাং ক্বিয়ামত পর্যন্ত বারযাখী জীবনে থাকবেন (মুমিনূন ৯০-১০০)। সুতরাং রাসূল (ছাঃ) মীলাদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া তাঁর কাজ নয়। বরং কোন মুসলিম তার উপর দরূদ পাঠ করলে বা সালাম প্রদান করলে ফেরেশতাগণ তাঁর নিকটে পৌঁছে দেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ لِلهِ عَزَّ وَجَلَّ مَلَائِكَةً سَيَّاحِيْنَ فِي الْأَرْضِ يُبَلِّغُوْنِي مِنْ أُمَّتِيْ السَّلَامَ ‘পৃথিবীতে মহান আল্লাহর ভ্রমণরত বহু ফেরেশতা রয়েছেন, যাঁরা আমার উম্মতের নিকট হ’তে আমাকে সালাম পৌঁছে দেন’।[14]

এছাড়াও পৃথিবীতে একই সময়ে অনেক স্থানে এই মীলাদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কোন স্থানে কখন মীলাদ হচ্ছে তা রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষে জানার কথা নয়। কারণ এটা গায়েবের বিষয়। আর রাসূল (ছাঃ) গায়েব জানতেন না (নামল ৬৫; বুখারী হা/৭৩৮০)। সব সময় সব জায়গায় উপস্থিত থাকা, সব কিছুর খবর রাখা আল্লাহ রাববুুল আলামীনের কাজ ও গুণ। আল্লাহ ব্যতীত কেউ যদি এ দাবী করে অথবা কাউকে যদি এ গুণে গুণাম্বিত করা হয় তাহ’লে সেটা শিরক হবে।

৩. ক্বিয়াম করা :

রাসূল (ছাঃ)-এর মহবতের নামে প্রচলিত মীলাদকারীদের মধ্যে অনেকে আবার মীলাদের এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে যান এবং কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দরূদ ও সালাম পাঠ করার পর বসে যান। তাদের ধারণা যখন রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করা হয়, তখন তিনি দরূদ পাঠের মজলিসে এসে উপস্থিত হন। আর রাসূল (ছাঃ) সম্মানে সবাই দাঁড়িয়ে যায়।

মীলাদ মাহফিলে রাসূল (ছাঃ) উপস্থিত হন এ বিশ^াস একটি কুফরী বিশ^াস। একথা পূর্বে আলোচনা হয়েছে যে, রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর পৃথিবীতে বিচরণ করা তার কাজ নয়। আর একই সময়ে কয়েকটি মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হওয়াও তার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং রাসূল (ছাঃ) যদি মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত না হন তাহ’লে তাঁর সম্মানে দাঁড়ানোর প্রশ্নই আসে না।

সপ্তম শতাব্দী হিজরীতে মীলাদ প্রথা চালু হওয়ার প্রায় এক শতাব্দীকাল পরে আল্লামা তাকিবউদ্দীন সুবকী (৬৮৩-৭৫৬ হিঃ) কর্তৃক ক্বিয়াম প্রথার প্রচলন ঘটে বলে কথিত আছে।[15] কারো কারো মতে, কুকুবুরী কর্তৃক রবীউল আউয়াল মাসে ঈদে মীলাদুন্নবী উদ্যাপন উদ্ভাবনের দুই শতাব্দী পরে ক্বিয়ামের প্রচলন হয়। ঈদে মীলাদুন্নবী উৎসবের অংশ হিসাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার ঘটনা বর্ণনার সময় কেউ কেউ তাঁর পৃথিবীতে আগমনের স্মৃতিকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য দাঁড়িয়ে পড়তে শুরু করেন। হিজরী ১০ শতকেও এই ক্বিয়াম বা দাঁড়ানো জনপ্রিয়তা লাভ করেনি, যদিও তখন মীলাদ জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।[16]

ক্বিয়াম যখন থেকেই আরম্ভ হোক না কেন একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, রাসূল (ছাঃ)-এর জীবিত অবস্থায় ছাহাবীগণকে তাঁর সম্মানে দাঁড়াতে নিষেধ করতেন।[17] তাঁর মৃত্যুর পরে ছাহাবীগণ একাজ কখনই করেননি। পরবর্তী সালাফে ছালেহীনও এ রকম বিদ‘আতী আমল পালন করেননি।


[1]. ফাযলু ছালাত আলান নবী (ছাঃ), হা/৫২।

[2]. মুসলিম হা/২৮৪৯; ‘হজ্জ’ অধ্যায়; ‘ইহরাম থেকে হালাল হওয়া রহিতকরণ এবং তা পূর্ণ করার নির্দেশ প্রসঙ্গে’ অনুচ্ছেদ।

[3]. বুখারী হা/৩৩৭০; মুসলিম হা/৪০৬; মিশকাত হা/৯১৯।

[4]. বুখারী হা/৪৭৯৭; মুসলিম, রিয়াযুছ ছালেহীন হা/১৪০৫।

[5]. বুখারী হা/৬৩৫৮।

[6]. বুখারী হা/৬৩৬০; মুসলিম হা/৪০৭; মিশকাত হা/৯২০।

[7]. বুখারী হা/১০৯, ৩৪৬১; মিশকাত হা/১৯৮।

[8]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০।

[9]. মুসলিম ২/৮১৯, হা/১১৬২।

[10]. তিরমিযী হা/৩৬১৯; ইমাম তিরমিযী হাদীছটিকে হাসান গরীব বলেছেন।

[11]. ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর এহইয়াউস সুনান (আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স), পৃ: ৫২১।

[12]. এহইয়াউস সুনান, পৃ: ৫২৩।

[13]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, মীলাদ প্রসঙ্গ (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন : ৫ম সংস্করণ : ২০০৮), পৃ: ৫।

[14]. নাসাঈ হা/১২৮২; মুসনাদে আহমাদ হা/৩৬৬৬, ৪২১০; ইবনে হিববান হা/৯১৪; ছহীহ তারগীব হা/১৬৬৪।

[15]. মীলাদ প্রসঙ্গ, পৃ: ৫।

[16]. এহইয়াউস সুনান, পৃ: ৫২৩।

[17]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৪৬৯৮। ইমাম তিরমিযী হাদীছটিকে হাছান ছহীহ বলেছেন।





জান্নাত লাভের কতিপয় উপায় (প্রথম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মুহাররম ও আশূরা : করণীয় ও বর্জনীয় - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
আশূরায়ে মুহাররম - আত-তাহরীক ডেস্ক
প্রসঙ্গ : মাসিক আত-তাহরীক - মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম প্রধান
পরহেযগারিতা - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
বিদ‘আত ও তার ভয়াবহতা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
মানব জাতির প্রতি ফেরেশতাদের দো‘আ ও অভিশাপ - মুহাম্মাদ আবু তাহের, পরিচালক, কিউসেট ইনস্টিটিউট, সিলেট।
যাকাত ও ছাদাক্বা - আত-তাহরীক ডেস্ক
দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকার (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
শায়খ আলবানীর তাৎপর্যপূর্ণ কিছু মন্তব্য (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণ সমূহ (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত (৮ম কিস্তি) - মুযাফফর বিন মুহসিন
আরও
আরও
.