আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস সুদৃঢ়করণে মুসলিম হিসাবে করণীয়
মুসলিম হিসাবে আমরা যদি নিম্নের কাজগুলো একক ও সম্মিলিতভাবে করতে পারি তবে ইনশাআল্লাহ আমাদের ঈমান ও আমল মযবূত হবে। দুনিয়া ও আখেরাতে আমরা উন্নতি ও সফলতা লাভে সক্ষম হব।
১. ঈমানের ফিকির ২. আল্লাহর কাছে ধরণা বা দো‘আ ৩. জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ ও তা অর্জনে সচেষ্ট হওয়া ৪. অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ ৫. ব্যক্তিগত দায়িত্ব ও কর্তব্য জানা ও মানা ৬. পারিবারিক তাকীদ ৭. কুরআন-হাদীছ-ফিক্বহ ও ইসলাম সংক্রান্ত বই-পুস্তক অধ্যয়ন ৮. তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের জ্ঞানার্জন ৯. যুগোপযোগী মানসম্মত শিক্ষাগ্রহণ ১০. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রগতি অর্জন ১১. বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণ মোকাবেলা ১২. ইসলামী সমাজ গঠন ১৩. জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের প্রচেষ্টা ১৪. যোগ্য নেতৃত্ব ১৫. শত্রু-মিত্র জানা এবং হুঁশিয়ার হয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা ১৬. চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন ও দোষ-ত্রুটি পরিহার ১৭. ন্যায় বিচার বা আদল প্রতিষ্ঠা ১৮. অমুসলিমদের মাঝে দরদমাখা মন নিয়ে দ্বীন প্রচার ১৯. পরোপকার সাধন ২০. বিবিধ।
ঈমানের ফিকির : নবী করীম (ছাঃ) তো সমাজের মানুষের মুমিন হওয়া নিয়ে এতো চিন্তা-ফিকির করতেন যে, তাঁর জীবননাশের কথা খোদ আল্লাহ ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَفْسَكَ عَلَى آثَارِهِمْ إِنْ لَمْ يُؤْمِنُوا بِهَذَا الْحَدِيثِ أَسَفًا ‘তারা যদি এই বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন না করে, তাহ’লে তাদের পিছনে ঘুরে মনে হয় তুমি দুঃখে তোমার জীবন শেষ করে ফেলবে’ (কাহফ ১৮/৬)। তাদের অবস্থার প্রতি আক্ষেপ করে যেন তোমার প্রাণ ধ্বংস হয়ে না যায়। ইসলাম প্রচারের এমন ফিকিরই তো নবীর উম্মত হিসাবে আমাদেরও থাকা বাঞ্ছনীয়।
আল্লাহর কাছে ধরণা বা দো‘আ : যে কোন লক্ষ্যে পৌঁছাতে আল্লাহ তা‘আলার কাছে ধরণা অত্যন্ত যরূরী। কাজের তত্ত্বাবধায়ক তো তিনি। আমাদের ঈমানী দুর্বলতা কাটাতে যেমন একক ও জোটবদ্ধভাবে চেষ্টা করতে হবে, তেমনি আল্লাহর নিকট অবস্থা পরিবর্তনের জন্য দো‘আ করতে হবে। ‘ইয়া মুকাল্লিবাল কুলূব, ছাবিবত ক্বলবী আলা দীনিক’। অর্থ: ‘হে আল্লাহ! অন্তর পরিবর্তনকারী, তুমি আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর অটল রাখো’।[1] দ্বীনের পথে সমাজের উন্নতি সাধনে নিরন্তর চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা করা এবং তা বাস্তবায়নের অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, আর সেই সাথে আল্লাহ তা‘আলার নিকট হামেশা দো‘আ করতে হবে।
জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ ও তা অর্জনে সচেষ্ট হওয়া : দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য ও কল্যাণ অর্জনকে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। শুধু দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তি অর্জনের ভাবনা কোন মুসলিমকে পেয়ে বসা ঈমান বরবাদির অন্যতম কারণ। আজকের অধিকাংশ মুসলিম কিন্তু এ রোগের শিকার। আখেরাতে অনন্ত জীবনে যাতে জাহান্নামে যেতে না হয়, সেজন্য আখেরাত কেন্দ্রিক চেতনার আলোকে দুনিয়ার জীবন গড়তে হবে।
অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ : একদিন মুসলিম জাতির শৌর্য-বীর্য ছিল। তাদেরকে এশিয়া-ইউরোপের বড় বড় জাতি-গোষ্ঠী সমীহ করে চলত। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি উল্টে গেছে। এখন অনেকগুলো মুসলিম দেশ রয়েছে। কিন্তু তাদের প্রত্যেকটি রাষ্ট্র আজ অমুসলিম পরাশক্তির দয়ার ভিখারী। শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সামরিক, অর্থনৈতিক, মানব উন্নয়ন ইত্যাদি নানা সূচকে তাদের বৈশ্বিক কোন ভূমিকা নেই।
আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, চীন, রাশিয়া, জাপান, ভারত ইত্যাদি অমুসলিম রাষ্ট্রের তল্পিবাহক হয়ে তাদের দিন গুযরান করতে হয়। কেন মুসলিমদের পতন ঘটল, আর কী করে অমুসলিমদের উত্থান ঘটল, কেন মুসলিমরা হেরে গেল, তার কারণ উদঘাটন করে হারানো শক্তি পুনরুদ্ধারে সম্মিলিতভাবে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
ব্যক্তিগত দায়িত্ব ও কর্তব্য জানা ও মানা : প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ইসলামের নিরিখে ব্যক্তিগত দায়িত্ব ও কর্তব্য জানা ও মানা ফরয। আল্লাহ বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের কাজের জন্য দায়বদ্ধ (আম্বিয়া ২১/২৩; হিজর ১৪/৯২-৯৩)। প্রত্যেক মুসলিমের উপর বিদ্যা অন্বেষণ ফরয। প্রত্যেকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে ব্যক্তিগত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করলে সম্মিলিতভাবে তার উন্নত প্রভাব চোখে পড়বে। অলসতা করলে কিংবা দায়িত্বহীন আচরণ করলে সৃষ্টিশীলতার স্থলে বন্ধ্যাত্ব নেমে আসবে।
পারিবারিক তাকীদ : পরিবারের সদস্যদের বিশেষত সন্তানদের ইসলাম শিক্ষা দেওয়া এবং তারা ইসলামের বিধি-বিধান মানছে কি-না তার সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পরিবার প্রধান তথা মাতা-পিতার। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।[2] এ হাদীছে পরিবারের পুরুষ ও নারীকে তাদের সন্তানদের বিষয়ে জিজ্ঞাসার কথা বলা হয়েছে।
আরেকটি হাদীছে বলা হয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা কোন বান্দাকে কম হোক বা বেশী হোক, কিছু জনগণের উপর শাসন ক্ষমতা দিলে তাদের মাঝে সে আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করেছিল, নাকি তা নস্যাৎ করে দিয়েছিল, সে বিষয়ে ক্বিয়ামতের দিন তাকে জিজ্ঞেস করবেন। এমনকি লোকটিকে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন।[3] সন্তানদের উপর মাতা-পিতার প্রভাব যে অপরিসীম তা একটি স্বীকৃত বিষয়। হাদীছও সে কথা বলে। জন্মলাভকারী এমন কেউ নেই, যে ফিতরাত তথা ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে না। তারপর তার মাতা-পিতা তাকে ইহূদী, খৃষ্টান, অগ্নিপূজারী, মূর্তিপূজারী করে গড়ে তোলে।[4] যদি পরিবার প্রধান হিসাবে মাতা-পিতা সন্তানদের ইহূদী, খৃষ্টান, অগ্নিপূজারী ইত্যাদি বানাতে পারে তাহ’লে তারা চাইলে তাদের খাঁটি মুসলিম কেন বানাতে পারবে না?
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তো বুঝাতে চেয়েছেন, ইসলাম পরিহার করে ইহূদী, খৃষ্টান ও অগ্নিপূজারী মাতা-পিতা তাদের সন্তানদের ইহূদী, খৃষ্টান ও অগ্নিপূজারী করে তোলে। তিনি চেয়েছেন, মাতা-পিতা যেন তাদের সন্তানদের ইহূদী, খৃষ্টান ও অগ্নিপূজারী না বানিয়ে ইসলামের উপর অবিচল রাখে। সুতরাং যে মাতা-পিতা মুসলিম তারা সচেতন মনে সন্তানদের সাথে মিশবে, তাদের ইসলাম মানার আবশ্যকতা বুঝাবে, ইসলামের শত্রু-মিত্র কারা তাদের বিষয়ে জানাবে, তাদের থেকে আত্মরক্ষার উপায় জানাবে, ইসলাম প্রচারে তারা কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে তার কৌশল শিখাবে তাহ’লে সেই মাতা-পিতার সন্তান ইসলামের অগ্রসেনানী হবে ইনশাআল্লাহ।
কুরআন-হাদীছ, ফিক্বহ ও ইসলাম সংক্রান্ত বই-পুস্তক অধ্যয়ন : পুঁজি ছাড়া যেমন ব্যবসা হয় না, তেমনি বিদ্যা ছাড়া আমল-আক্বীদা যথার্থ হয় না। ইসলামের আমল-আক্বীদা, বিধি-বিধান জানার পুঁজি কুরআন-হাদীছ-ফিক্বহ ও ইসলাম সংক্রান্ত বই-পুস্তক। কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতির জন্য ইহ-পরকালে মুক্তির বার্তা দিয়েছেন। সে বার্তা ব্যাখ্যা ও হাতে-কলমে বাস্তবায়নের মডেল হিসাবে কাজ করেছেন তাঁর রাসূল (ছাঃ)। তাঁর কাজ কথা ও চরিতাদর্শ সংরক্ষিত আছে হাদীছে। সহজভাবে মানুষ যাতে তা বুঝতে ও আমলে নিতে পারে সেজন্য ফিক্বহ। ছাহাবীগণ ছিলেন রাসূলের সংস্পর্শে থেকে হাতে-কলমে ইসলাম শিক্ষা অর্জনকারী। এজন্য তাদের রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনী, চরিত্র ও কার্যাবলী সম্পর্কে জানা যরূরী এবং তা জানা যায় ইসলাম সংক্রান্ত বই-পুস্তক পড়ে। যুগে যুগে মুসলিম মনীষীগণ ইসলামের পক্ষে-বিপক্ষে উত্থাপিত নানা প্রশ্ন ও সমস্যা সমাধানে বই লিখেছেন। ইসলামের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের উপরেও তারা বই লিখেছেন। বই লিখেছেন মুসলিম মনীষীদের জীবন ও কার্যাবলীর উপরে, বই লিখেছেন জ্ঞান-বিজ্ঞান, যুদ্ধ-শান্তি ইত্যাদি বিষয়ে। এসব বই-পুস্তক পড়লে ইসলাম মানার প্রয়োজনীয় পুঁজি যে কেউ অর্জন করতে পারে। ফলে ইসলামের উপর তার অবস্থান সুদৃঢ় হবে।
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের জ্ঞানার্জন : আল্লাহ তা‘আলার মনোনীত দ্বীন ইসলাম হ’লেও পৃথিবীতে ধর্মের সংখ্যা অনেক এবং প্রত্যেকেই স্ব স্ব ধর্মকে সঠিক মনে করে। এছাড়া নানা দর্শন ও মতবাদে মানব জাতি আজ দীক্ষিত। ইসলাম, খৃষ্টান, ইহূদী, হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্মসহ যেমন জানা-অজানা অনেক ধর্ম আছে, তেমনি আছে ভাববাদ, বস্ত্তবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ, পুঁজিবাদ, মার্ক্সবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, প্রাচ্যবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র, আধুনিক রাজনীতি, কূটনীতি, অর্থনীতি, সমরনীতি ইত্যাদি। মুসলিম দেশগুলোতে এখন ইসলাম ব্যক্তিগতভাবে পালনীয় ধর্মে রূপ নিয়েছে। প্রশাসন, আইন, বিচার, অর্থ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিভিন্ন দর্শন ও ইজম আধিপত্য বিস্তার করে আছে। এখানে সহাবস্থান সূত্রে হোক, আর আত্মরক্ষার্থেই হোক পরস্পরকে জানার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। প্রতিপক্ষ যখন নানা অভিযোগ ও ত্রুটি তুলে ধরে ইসলাম ও মুসলিমদের ঘায়েল করে তখন শুধু কুরআন-হাদীছ দিয়ে উত্তর দিলে হয় না। কারণ তারা তো কুরআন-হাদীছকে স্বীকারই করে না। তাদের উত্তর যথাসম্ভব তাদের ধর্মগ্রন্থ ও দর্শন বা মতবাদ থেকে দিলে তবেই তারা কাবু হয়।
মাওলানা রহমাতুল্লাহ কিরানভি, মুনশী মেহেরুল্লাহ, শায়েখ আহমাদ দীদাত, ডা. যাকির নায়েক, ইউসুফ এস্টেস প্রমুখ এভাবে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের জ্ঞান দ্বারা প্রতিপক্ষকে লা-জওয়াব করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর ফলে হক-নাহক প্রকাশ হয়ে যায়। কিন্তু প্রতিপক্ষ সম্পর্কে না জেনে মাঠে নামলে কপালে পরাজয়ের গ্লানি জোটা অসম্ভব নয়। আবার নীরব থাকলে নিজেদের ভাবা হবে নাহক ও দুর্বল।
যুগোপযোগী মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণ : আধুনিক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিত্যনতুন নানা শাখার দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে। পুঁথিগত, কারিগরি, প্রকৌশল, প্রযুক্তি নানা বিষয়ের এখন ছড়াছড়ি। ব্যক্তির পক্ষে তা আয়ত্ব করা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। কিন্তু জাতিগতভাবে তা আয়ত্ব করা একান্ত প্রয়োজন। দুর্বল জাতির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এবং বৈষয়িক উন্নতি নিশ্চিত করতে এসব শিক্ষার বিকল্প নেই।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রগতি অর্জন : আধুনিক যুগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ, এ যুগ তথ্য-উপাত্তের যুগ। বর্তমান যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিমুখ জাতি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে না। শিক্ষাব্যবস্থায় এ দিকটা যত নিশ্চিত হবে ততই কল্যাণ। যদিও বলা হয় বিজ্ঞান ও আবিষ্কার কারও একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ধনী দেশগুলোর বিপুল অর্থ-সম্পদ ও বিত্ত-বৈভবের পিছনে বিজ্ঞান ও আবিষ্কারের হাত রয়েছে। আবিষ্কারের হাত ধরে তারা টেকনোলজিতে এগিয়ে গেছে। আবিষ্কার ও টেকনোলজির পেটেন্ট রয়েছে। কাজেই টাকা ছাড়া দরিদ্র দেশগুলোর তা আয়ত্ব করা সম্ভব নয়। এখানে মূল ভরসা দেশীয় কায়দায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা এবং তার ব্যবহার ও উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দ্বীন বিরোধী নয়, বরং সহায়ক। এ কথা প্রমাণ করতে যেমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞানে পারদর্শী হ’তে হবে তেমনি কুরআন-সুন্নাহর মৌলিক জ্ঞানে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে হবে। তাতে উভয় ধারার মধ্যে সখ্য তৈরি হবে। আধুনিক ইরান, তুরস্ক ও আফগানিস্তান এ পথে হাঁটছে বলে অনুমিত হয়।
বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণ মোকাবেলা : ইতিপূর্বে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্টেড মিডিয়ার অক্লান্ত ও অব্যাহত ধারায় মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। যার ফলে অমুসলিমদের মধ্যে তো বটেই মুসলিমদের মধ্যেও ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্ষোভ বেড়ে চলছে। এ অবস্থা চলতে দেওয়া মানে আত্মঘাতী হওয়া। কাজেই তাদের মিডিয়া আগ্রাসন ও বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণের মোকাবেলায় মুসলিমদের পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যেতে হবে। এজন্য ইসলাম ও মুসলিমদের অনুকূলে এবং অমুসলিমদের উত্থাপিত আপত্তি ও অভিযোগের জবাবে বই-পুস্তক লেখা, তা প্রকাশ ও প্রচারের ব্যবস্থা করা, সংবাদপত্র প্রকাশ করা, রেডিও, টিভি স্টেশন স্থাপন ও সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা, ফেইসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরা, শায়েখ আহমাদ দীদাত, ডাঃ যাকির নায়েকের মতো প্রোপাগেশন সেন্টার তৈরি করে প্রচারের ব্যবস্থা করা, জনগণের মাঝে আলোচনা-বক্তৃতা রাখা একান্ত প্রয়োজন। শুধু আত্মরক্ষামূলক প্রোগ্রাম নয়, বরং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণও সমানে চালাতে হবে।
ইসলামী সমাজ গঠন : পরিবারের মতো সমাজেরও ইসলামীকরণ যরূরী। ইসলামী সমাজে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই শান্তিতে নিরাপদে বাস করতে পারে। তাদের জীবন-জীবিকার উন্নয়ন ঘটে। এটি মুখের কথা নয়। মদীনা থেকে আফ্রিকার মরক্কো ও মধ্য এশিয়ার তুর্কিস্তান পর্যন্ত বিরাট এলাকা ইসলামের পতাকাতলে আসার পর স্থানীয় বাসিন্দারা যে কোন বাধা ছাড়া ইসলামের ছায়াতলে এসেছিল তা মুসলিমদের সামাজিক নিরাপত্তা ও সদাচরণের কারণে সম্ভব হয়েছিল। তাদের পূর্বেকার ক্ষমতাসীনদের অত্যাচার-অনাচার, যুলুম-নির্যাতনের মোকাবেলায় তারা মুসলিম শাসনকে আশীর্বাদ হিসাবে পেয়েছিল। শান্তি ও নিরাপত্তা না পেলে তারা আর যাই হোক গণহারে ইসলাম গ্রহণ করত না। ইসলামী সমাজ মানে এই নয় যে, সেখানে কোন অপরাধ সংগঠিত হবে না এবং লোকেদের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি ঘটবে।
ইসলামী সমাজে মানুষ তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত কেন্দ্রিক জীবন যাপন করতে পারবে। তারা স্বেচ্ছায়-স্বাচ্ছন্দ্যে নিরাপদে রাসূলের তরীকায় আল্লাহর আদেশ মানতে পারবে। এখানে মদ-জুয়া, ব্যভিচার-ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, আত্মসাৎ, জমি-যিরাত দখল, সূদ-ঘুষ, সংঘর্ষ, মারামারি, বিদ্রোহ ইত্যাদি ন্যূনতম পর্যায়ে থাকবে। অপরাধ যাতে সংগঠিত না হয় সেজন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকবে। অতীতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির মামলা-মোকদ্দমা দায়ের করতে ফি দিতে হ’ত না। খোদ অপরাধীও অনুশোচনায় নিজে বিচারকের কাছে উপস্থিত হ’ত। বিচারকার্যও দ্রুতই সম্পন্ন হ’ত। ইসলামী সমাজে রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা থাকবে তারা জনগণের মাঝে ইনছাফ প্রতিষ্ঠা করবে। তারা নিজেরা আল্লাহর কাছে জবাবদিহির চিন্তায় জনগণের খেদমত ও দেশের উন্নয়নে কাজ করবে। ফলে ইসলামী সমাজে আজও শান্তি, নিরাপত্তা ও ইনছাফ লাভ সম্ভব।
জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের প্রচেষ্টা : জামা‘আতবদ্ধ জীবন আর ইসলামী সমাজ মূলতঃ একই কথা। সমাজের মধ্যে জামা‘আতবদ্ধতার যে রূপের কথা ইসলাম বলে সেটা কোন সমাজে উপস্থিত থাকলে তা হবে জামা‘আতবদ্ধ সমাজ। ইসলাম মুসলিমদের ঐক্যের উপর ভীষণ রকম জোর দেয়। কোনরূপ অনৈক্য যাতে না দেখা দেয়, সে বিষয়ে তৎপর থাকার কথা বলে। দ্বন্দ্ব দেখা দিলে আপসে মীমাংসার কথা বলে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুসলিমদের জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের আদেশ দিয়েছেন। জামা‘আত থেকে আলাদা হওয়াকে নিজ থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলা বলে ঠাওরিয়েছেন। নির্জন প্রান্তরে তিনজন লোক থাকলেও তাদের একজন আমীরের অধীনে জামা‘আতবদ্ধ থাকতে বলা হয়েছে।
নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগে আওস, খাযরাজ, আনছার, মুহাজির প্রভৃতি বিশেষ জামা‘আত ছিল এবং তাদের আলাদা আলাদা সাইয়েদ বা নেতাও ছিল। ইসলামী রাষ্ট্রভিত্তিক জামা‘আত হ’লে তো তার থেকে উত্তম কিছু নেই। কিন্তু সে জামা‘আত না থাকলেও ইসলামকে পূর্ণভাবে পালনের স্বার্থে বিশেষ জামা‘আতে শরীক থাকা যরূরী। কিন্তু সমাজে মসজিদ, মক্তব প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ, দন্ডবিধি বা ফৌজদারী মামলার আওতায় পড়ে না এমন ছোট-বড় সামাজিক দ্বন্দ্ব-কলহের মীমাংসার মতো ফরযে কিফায়া আমলে নিতে বিশেষ জামা‘আতের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এরূপ জামা‘আত থাকলে তাদের চেষ্টায় ইসলামী ধারায় জীবন যাপন অনেক সহজ হবে।
যোগ্য নেতৃত্ব : রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে যোগ্য নেতৃত্বের একান্ত প্রয়োজন। আল্লাহ চাইলে যোগ্য নেতৃত্ব সমাজের সার্বিক অবস্থা আমূল বদলে দিতে পারে। যুগে যুগে এর বহু নযীর রয়েছে।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেক সময় একটা দেশের আমূল পরিবর্তন এনে দেয়। ১৪৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মাদ আল-ফাতিহ-এর কনস্টান্টিনোপল বিজয়কে বহু ঐতিহাসিক ইউরোপে মধ্য যুগের অবসান ও আধুনিক যুগের শুরু বলে মন্তব্য করেছেন। হাল আমলে দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক শাসক পার্ক চুং হি দক্ষিণ কোরিয়াকে দরিদ্র রাষ্ট্র থেকে ধনী রাষ্ট্রের কাতারে নিয়ে আসেন। একইভাবে ড. মাহাথির মুহাম্মাদ মালয়েশিয়ার ও লি কুয়ান ইউ সিঙ্গাপুরের দারিদ্র্য মুছে দিয়ে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। এসব নেতার উক্ত নেতৃত্বের সাথে দ্বীন-ধর্মের কোন যোগ নেই। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগ্যতা এখানে কেউ অস্বীকার করবে না। বাদশাহ আব্দুল আযীয বিন সঊদ সঊদী আরবকে শিরক-বিদ‘আতমুক্ত একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনে ভূমিকা রেখেছিলেন। কামাল পাশার প্রবর্তিত কঠোর সেক্যুলারিজম ও ইসলাম উৎখাতের নীতি থেকে তুরস্ককে বের করে আনতে তুর্কি নেতা রজব তাইয়্যেব এরদোগানের কথা ভুলে গেলে চলবে কি?
সমাজে দ্বীনের নবজাগরণে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের কথাও সমানভাবে উচ্চারণযোগ্য। দূর অতীতে ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ, মুজাদ্দিদ আলফে ছানী, শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী, শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব নজদী এবং নিকট অতীতের শাহ ইসমাঈল শহীদ, মাওলানা এনায়েত আলী, বেলায়েত আলী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। বিশেষ জামা‘আতের যেসব নেতা ইসলামের জাগরণে ভূমিকা রাখছেন তাদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় ১৯১২ সালে মুহাম্মাদিয়া সোসাইটির প্রতিষ্ঠিতা আহমাদ দাহলান, মালয়েশিয়ার লেম্বাগা তাবুং হাজীর উদ্যোক্তা প্রফেসর উংকু আব্দুল আযীয, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর আমীর প্রফেসর ড. আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ইসলামের প্রচারক হিসাবে আফ্রিকায় কুয়েতের ডাঃ আব্দুর রহমান আল-সুমাইত ও ইন্ডিয়ার কালিম ছিদ্দীকীর কর্মতৎপরতা কারও অজানা থাকার কথা নয়।
তুলনামূলক ধর্মতত্তেবর আলোচক হিসাবে শায়েখ আহমাদ দীদাত, ডাঃ যাকির নায়েক প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বেশী কথা বলা থেকে একটি উদাহরণ অনেক বেশী কার্যকর। কাজেই যোগ্য নেতৃত্বের সাফল্য নিয়ে সংশয়ের কিছু নেই। কিন্তু অদক্ষ নেতৃত্বের সমস্যাই বরং বেশী। আমাদের পরিবারে সমাজে আজ যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের নেতৃত্বে ইসলামের গতানুগতিক ধারার বাইরে তেমন কোন অগ্রগতি চোখে পড়ে না। এটি দিবালোকের মতো সত্য। নেতৃত্বের ইতিবাচক পরিবর্তন হ’লে হয়তো তার ফল আমরা পাব ইনশাআল্লাহ।
[ক্রমশঃ]
[1]. তিরমিযী হা/২১৪০; মিশকাত হা/১০২।
[2]. বুখারী হা/৮৯৩।
[3]. ছহীহাহ হা/১৬৩৬।
[4]. বুখারী হা/১৩৫৮।