ভূমিকা :
মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম একটি বড় মাধ্যম হ’ল দান-ছাদাক্বাহ। এই আর্থিক ইবাদতের একটি আত্মিক রূপ আছে, যা অন্যের মনস্পটে আবেগ-অনুভূতি সঞ্চারের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। তাই ছাদাক্বাহ কেবল সম্পদ বিসর্জন বা অন্যকে খাদ্য খাওয়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মাধ্যমেও ছাদাক্বাহ করা যায়, যার মাধ্যমে অন্যের হৃদয়ে ভালবাসা ও সম্প্রীতি তৈরী হয়। আর একেই বলে অনুভূতির ছাদাক্বাহ। টাকা-পয়সা না থাকলেও এই ছাদাক্বাহ করা যায়। শুধু দরকার ঈমান ও তাক্বওয়া। এই ছাদাক্বাহ অন্তরের অন্যতম একটি তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের পাশাপাশি সমাজের বুক থেকে হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার ও পরশ্রীকাতরতার কালিমা বিদূরিত হয়। মানব সমাজে প্রবাহিত হয় প্রশান্তি ও প্রশস্তির নির্মল সমীরণ। সুতরাং আর্থিক দান-ছাদাক্বার চেয়ে আবেগ-অনুভূতির ছাদাক্বাহর গুরুত্ব ও তাৎপর্য কোন অংশে কম নয়। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা অনুভূতির ছাদাক্বাহ শীর্ষক কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
অনুভূতির ছাদাক্বাহ করার উপাদান :
অনুভূতির ছাদাক্বাহ করার মূল উপাদান হ’ল সুস্থ ও পরিশুদ্ধ অন্তর। এর সাথে অর্থ-সম্পদও সহযোগী ভূমিকা পালন করতে পারে। মানব শরীর যেমন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, আমাদের হৃদয়গুলোও তেমনি অসুস্থ হয়ে যায়। মূলত পাপাচার, নিফাক্বী, কুফরী এবং ভ্রান্ত আক্বীদার কারণে আমাদের হৃদয়গুলো রোগাক্রান্ত হয়ে যায়। আবার হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার প্রভৃতি কারণে হৃদয়ে ময়লা পড়ে যায়। তাই অন্তরের সুস্থতার জন্য সদা সতর্ক থাকতে হয় এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী এর যথাযথ চিকিৎসা করতে হয়। কেননা আমাদের শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পরিচালনা করে আমাদের অন্তর। কোন মানুষের অন্তর খারাপ ও অসুস্থ হ’লে তার মুখের ভাষা এবং আচার-ব্যবহারও খারাপ হয়। আর যদি তার অন্তরটা সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন হয়, তাহ’লে তার মুখের ভাষা ও আচরণও সুন্দর হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,أَلاَ وَإِنَّ فِي الجَسَدِ مُضْغَةً: إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الجَسَدُ كُلُّهُ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الجَسَدُ كُلُّهُ، أَلاَ وَهِيَ القَلْبُ ‘জেনে রাখো! দেহের মধ্যে একটি গোশতপিন্ড আছে, যখন সেটা ভাল থাকে, তখন সারা দেহ সুস্থ থাকে। আর যখন তা নষ্ট হয়ে যায়, তখন সারা দেহ নষ্ট হয়ে যায়। জেনে রাখ সেটা হ’ল অন্তর’।[1]
আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, الْقَلْبُ مَلِكٌ وَالْأَعْضَاءُ جُنُودُهُ فَإِذَا طَابَ الْمَلِكُ طَابَتْ جُنُودُهُ وَإِذَا خَبُثَ الْمَلِكُ خَبُثَتْ جُنُودُه، ‘অন্তর হ’ল বাদশাহ এবং শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হ’ল তার সেনাবাহিনী। সুতরাং বাদশাহ যদি ভাল হয়, তাহ’লে তার সেনাবাহিনীও ভাল হয়। আর বাদশাহ যদি খারাপ হয়, তাহ’লে তার সেনাবাহিনীও খারাপ হয়’।[2]
আর এই অন্তরেই আমাদের ঈমান রক্ষিত থাকে। যার অন্যতম নিদর্শন হ’ল কোন মুমিনের ব্যথায় সমব্যথী হওয়া। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ، وَتَرَاحُمِهِمْ، وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى، ‘পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শনে তুমি মুমিনদেরকে একটি দেহের মত দেখবে। যখন শরীরের একটি অঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়, তখন শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এর কারণে রাত্রি জাগরণ ও জ্বরের মাধ্যমে সেই ব্যথায় অংশীদার হয়’।[3] ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,فَإِذَا كَانَ الْإِيمَانُ فِي الْقَلْبِ فَقَدْ صَلَحَ الْقَلْبُ ... الْأَعْمَالُ ثَمَرَةُ الْإِيمَانِ، ‘যখন হৃদয়ে ঈমান থাকে, তখন হৃদয় ভাল থাকে। আর ঈমানের ফলাফল হ’ল আমলের বাস্তবায়ন’।[4] অর্থাৎ যে অন্তরে ঈমান আছে, সেটা সুস্থ অন্তর। আর যে অন্তরে ঈমান নেই, সেটা অসুস্থ ও কলুষিত অন্তর। তবে শুধু ঈমান থাকলেই হবে না; বরং আমলের মাধ্যমে সেই ঈমানের বাস্তবায়ন থাকা আবশ্যক। নইলে ঈমান পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন,لَا يَسْتَقِيمُ إِيمَانُ عَبْدٍ حَتَّى يَسْتَقِيمَ قَلْبُهُ، وَلَا يَسْتَقِيمُ قَلْبُهُ حَتَّى يَسْتَقِيمَ لِسَانُهُ، ‘কোন বান্দার ঈমান অটল থাকে না, যতক্ষণ না তার হৃদয় স্থির থাকে। আর তার হৃদয় স্থির থাকে না, যতক্ষণ না তার জিহবা সংযত থাকে’।[5] ইবনু রজব হাম্বলী (রহঃ) বলেন,وَمَعْنَى اسْتِقَامَةِ الْقَلْبِ أَنْ يَكُوْنَ مُمْتَلِئًا مِنْ مَحَبَّةِ اللهِ، وَمَحَبَّةِ طَاعَتِهِ، وَكَرَاهَةِ مَعْصِيَتِهِ ‘অন্তরের অবিচলতার অর্থ হ’ল আল্লাহর ভালোবাসায় হৃদয় ভরপুর থাকা, তাঁর আনুগত্যের প্রতি আগ্রহ থাকা এবং তাঁর অবাধ্যতা বা পাপের কাজে মনে ঘৃণাবোধ থাকা’।[6] আর পাপের কারণে এবং আমলের মাধ্যমে সঠিক পরিচর্যার অভাবে ঈমান দুর্বল ও জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে পড়ে। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আছ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ الْإِيمَانَ لَيَخْلَقُ فِيْ جَوْفِ أَحَدِكُمْ كَمَا يَخْلَقُ الثَّوْبُ الْخَلِقُ، فَاسْأَلُوا اللهَ أَنْ يُّجَدِّدَ الْإِيْمَانَ فِي قُلُوبِكُمْ، ‘নিশ্চয়ই তোমাদের দেহাভ্যন্তরে ঈমান জীণ-শীর্ণ হয়ে যায়, যেমন তোমাদের পুরাতন কাপড় জীর্ণ হয়ে যায়। সুতরাং আল্লাহর নিকট প্রার্থনা কর, যেন তিনি তোমাদের হৃদয় সমূহে ঈমানকে নবায়ণ করে দেন’।[7] আর তাক্বওয়াপূর্ণ একনিষ্ঠ আমল এবং মৃত্যুর স্মরণ ঈমান নবায়ণের অন্যতম হাতিয়ার। আবুদ্দারদা (রাঃ) বলেন,مَا أَكْثَرَ عَبْدٌ ذِكْرَ الْمَوْتِ إلاَّ قَلَّ فَرَحُهُ وَقَلَّ حَسَدُهُ، ‘বান্দা মৃত্যুকে যত বেশী স্মরণ করবে, তার উৎফুল্লতা ও প্রতিহিংসা তত বেশী হ্রাস পাবে’।[8] সুতরাং অনুভূতির ছাদাক্বাহর নিমিত্তে হৃদয়কে সুস্থ ও পরিশুদ্ধ রাখার জন্য ঈমান ও আমলে বলীয়ান হ’তে হবে এবং আল্লাহভীতি ও মৃত্যুকে স্মরণের মাধ্যমে ঈমানকে তাযা রাখতে হবে। পাশাপাশি মন থেকে হিংসা-বিদ্বেষের আবর্জনা পরিস্কার করতে হবে। তবেই আমাদের অন্তরগুলো অনুভূতির ছাদাক্বাহ করার উপযোগী হয়ে উঠবে।
অনূভূতির ছাদাক্বাহ করা কেন প্রয়োজন :
অন্তর হ’ল মানব দেহের রাজধানী। এখানেই মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও হর্ষ-বিষাদের বসবাস। উপরন্তু বান্দার ঈমান ও পরহেযগারিতার মুকুটও মনের গহীনে লুক্কায়িত থাকে। অন্তর ভাল হওয়ার কারণেই একজন মানুষকে ভাল মানুষ গণ্য করা হয় এবং অন্তর খারাপ হওয়ার কারণেই কোন ব্যক্তিকে খারাপ ব্যক্তি হিসাবে অভিহিত করা হয়। ক্বাসেম আল-জাও‘ঈ বলেন, أصل الدِّين الورع، وأفضل العبادة مكابدة اللَّيل، وأفضل طرق الجنَّة سَلَامة الصَّدر، ‘দ্বীনের মূল হ’ল পরহেযগারিতা, রাত্রিকালীন আমলে কষ্ট সহ্য করা শ্রেষ্ঠতম ইবাদত এবং জান্নাতের সর্বোৎকৃষ্ট রাস্তা হ’ল হৃদয়ের সুস্থতা’।[9] ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,القُلُوبُ الصَّادِقَةُ وَالأَدْعِيَةُ الصَّالِحَةُ هِيَ الْعَسْكَرُ الَّذِيْ لَا يُغْلَبُ، ‘সত্যবাদী হৃদয় এবং মানুষের উত্তম দো‘আ এমন সেনাবাহিনী, যা কখনোই পরাজিত হয় না’।[10] সুতরাং নিজেকে আদর্শ ও জান্নাতী মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য অন্তরের পরিশুদ্ধি আবশ্যক। আর এই পরিশুদ্ধির অন্যতম উপায় হ’ল অনুভূতির ছাদাক্বাহ। একবার আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে জানতে চাওয়া হ’ল- সর্বোত্তম মানুষ কে? জবাবে তিনি বললেন,كُلُّ مَخْمُومِ الْقَلْبِ، صَدُوْقِ اللِّسَانِ ‘প্রত্যেক বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী ও সত্যভাষী ব্যক্তিরাই সর্বোত্তম মানুষ’। ছাহাবীগণ বললেন, বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, هُوَ التَّقِيُّ النَّقِيُّ، لَا إِثْمَ فِيهِ، وَلَا بَغْيَ، وَلَا غِلَّ، وَلَا حَسَدَ ‘সে হ’ল পূত-পবিত্র নিষ্কলুষ চরিত্রের মানুষ, যার কোন গুনাহ নেই, নেই কোন শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষ’।[11]
যাকাত প্রদানের মাধ্যমে যেমন ব্যক্তির মাল-সম্পদ পরিশুদ্ধ হয়, ঠিক তেমনি অনুভূতির ছাদাক্বার মাধ্যমে মানব হৃদয় নিষ্কলুষ ও পরিচ্ছন্ন হয়। আর সাধারণত এই নিষ্কলুষ ও পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের অধিকারীরাই পৃথিবীর সুখী মানুষ। সুখের সন্ধানে মানুষ টাকার পিছনে ছোটে, কিন্তু টাকা-পয়সা মানুষকে কখনো সুখ এনে দিতে পারে না; বরং সম্পদকে সুখের একটি উপকরণ বলা যেতে পারে মাত্র। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لَيْسَ الْغِنَى عَنْ كَثْرَةِ الْعَرَضِ وَلَكِنَّ الْغِنَى غِنَى النَّفس، ‘শুধু পার্থিব সম্পদের আধিক্য থাকলেই ঐশ্বর্যশালী হওয়া যায় না। মনের ঐশ্বর্যই আসল ঐশ্বর্য’।[12] আর অনুভূতির ছাদাক্বাহ করার জন্য এরকম মনের ঐশ্বর্য প্রয়োজন হয়। সুতরাং কোন মানুষ যখন আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি অল্পে তুষ্ট থেকে হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার ও শত্রুতামুক্ত হৃদয়ের অধিকারী হয়ে উঠে, তখন তিনি প্রকৃত ভাল মানুষ হিসাবে চিহ্নিত হন। এই সকল মানুষই তাদের ব্যবহারের সৌকর্য ও কোমল ভাষা দিয়ে অন্যের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হন। আর এরাই আল্লাহর নিকটে সর্বাধিক প্রিয় মানুষ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,أَحَبُّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللهِ سُرُوْرٍ تُدْخِلُهُ عَلَى مُسْلِمٍ ‘আর আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় কাজ হচ্ছে কোন মুসলিমকে খুশি করা’।[13] একবার কল্পনা করে দেখুন, সমাজের সবাই যদি হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে অপরকে খুশি করতে আত্মনিয়োগ করে, কেউ কাউকে কষ্ট না দেয়, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে এবং সবাই পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে, তাহ’লে আমাদের এই সমাজটা কতই না সুন্দর হবে! সুতরাং আল্লাহর প্রিয় বান্দা হ’তে এবং সমাজিক সমৃদ্ধির জন্যই আনুভূতির ছাদাক্বাহ করা প্রয়োজন।
অনুভূতির ছাদাক্বাহ করা ফযীলত :
অনুভূতির ছাদাক্বাহর মূলমন্ত্র হ’ল পরোপকার, কোমল ব্যবহার ও নম্র ভাষায় কথা বলা। মু‘আমালাতের যত শাখা-প্রশাখা আছে, আল্লাহর নিকটে এটাই সর্বাধিক প্রিয় কাজ। ওমর ফারূক (রাঃ) বলেন,سئل رسول الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أي الأعمال أفضل؟ قال: إدخالك السرور على مؤمن؛ أشبعةَ جَوْعَةَهْ، أو كسوةَ عَوْرَةَه، أو قضيةَ له حاجة، ‘একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ আমল কোনগুলি? তিনি বললে, কোন মুমিনকে খুশি করা (আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ কাজ); এভাবে যে, তুমি হয়ত তার ক্ষুধা নিবারণ করেছ, তার দোষ-ত্রুটি ঢেকে রেখেছ অথবা তার কোন প্রয়োজন পূর্ণ করেছ’।[14] অন্যত্র তিনি বলেন,من أفضل العمل إدخال السرور على المؤمن ‘সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ আমলের মধ্যে অন্যতম হ’ল মুমিনের মাঝে সুখানুভূতি জাগিয়ে তোলা’।[15] অপরকে আনন্দিত করা এবং কষ্ট না দেওয়ার অনুভূতি থাকা ঈমানের লক্ষণ। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা-প্রশাখা আছে। তন্মধ্যে সর্বনিমণ শাখা হ’ল ‘রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্ত্ত সরিয়ে ফেলা’।[16] অর্থাৎ যার মাঝে অপরকে কষ্ট না দেওয়ার এই অনুভূতিটুকুও জাগ্রত থাকে না, তার মাঝে ঈমানের সর্বনিমণ শাখাটাও অবশিষ্ট থাকে না। আর এটা শুধু মানবের প্রতি নয়; বরং আল্লাহর যে কোন সৃষ্টিকূলের প্রতি দয়া প্রদর্শন করাও হ’তে পারে অনুভূতির ছাদাক্বার প্রকৃষ্ট নমুনা। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,الرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ ارْحَمُوْا أَهْلَ الْأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ، ‘দয়াময় আল্লাহ দয়াশীল বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। সুতরাং তোমরা যমীনবাসীর প্রতি দয়া-প্রদর্শন কর, যিনি আকাশে আছেন (আল্লাহ), তিনি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন’।[17] খেয়াল করবেন, আপনি যদি কোন বিড়াল ছানা, ছাগল ছানা, গো-বাছুর বা অন্য কোন প্রাণীকে আদর করেন, তার আচরণ ও চলাফেরা দেখে এর প্রভাব আপনি তার মাঝে লক্ষ্য করতে পারবেন। আর এই দয়াপ্রদর্শনও একটি ছাদাক্বাহ। প্রমাণস্বরূপ সেই পতিতা মহিলার কথা উল্লেখ করা যায়, একটি তৃষ্ণার্ত কুকুর ছানাকে পানি পান করানোর কারণে আল্লাহ যাকে ক্ষমা করেছিলেন।[18] তাই একজন মানুষ যেমন অপর মানুষের কাছ থেকে দয়া পাওয়ার অধিকার রাখে, তেমনি পশু-পাখি, গাছ-পালাসহ আল্লাহর সকল সৃষ্টি মানুষের কাছ থেকে দয়া পাওয়ার অধিকার রাখে। আর যারা আল্লাহর অধিকার আদায় করে দুনিয়াবী এই অধিকারগুলো পূরণ করতে সক্ষম হন, আল্লাহর নিকটে তারাই সর্বাধিক মর্যাদাবান মানুষ হিসাবে গণ্য হন। সুতরাং বলা যায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে অনুভূতির ছাদাক্বাই সর্বশ্রেষ্ট। উল্লেখ্য যে, অর্থ ছাদাক্বাহরও গৌণ উদ্দেশ্য হ’ল অন্যের মনে সুখের অনুভূতি জাগিয়ে তোলা।
অনুভূতির ছাদাক্বাহ না করার ক্ষতি :
অনুভূতির ছাদাক্বাহ মানে অপরের প্রতি কোমলতা প্রদর্শন করা এবং তাকে আনন্দিত করা। আর এর বিপরীত দিক হ’ল আল্লাহর সৃষ্টিকে কষ্ট দেওয়া এবং তার প্রতি কঠোর হওয়া। কঠোর হৃদয়ের অধিকারীরা তাদের ব্যবহার ও কথার মাধ্যমে অপরকে কষ্ট দেয়। গীবত, গালি-গালাজ, মন্দ আচরণ, চোগলখুরী, সম্মানহানি, যুলুম-নির্যাতন, আমানতের খেয়ানত প্রভৃতির মাধ্যমে মানুষ একে অপরকে কষ্ট দিয়ে থাকে। এটা অনুভূতির ছাদাক্বার পরিপন্থি। কারণ একজন মুসলিমের জান, মাল এবং ইয্যত অপর মুসলিমের কাছে আমানত স্বরূপ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,الـمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الـمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ، وَالـمُؤْمِنُ مَنْ أَمِنَهُ النَّاسُ عَلَى دِمَائِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ، ‘প্রকৃত মুসলিম তো সেই ব্যক্তি, যার যবান ও হাত থেকে অন্য মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে এবং পরিপূর্ণ মুমিন সেই ব্যক্তি, যার কাছ থেকে মানুষ নিজের জীবন ও সম্পদকে সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ মনে করে’।[19] অন্যত্র তিনি বলেন,كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ مَالُهُ، وَعِرْضُهُ، وَدَمُهُ حَسْبُ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ، ‘একজন মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমের সম্পদ, সম্মান ও জীবনে হস্তক্ষেপ করা হারাম। কোন ব্যক্তির নিকৃষ্ট প্রমাণিত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ মনে করে’।[20]
সুতারাং একজন মুসলিমকে সর্বদা সর্তক থাকতে হয়, যেন তার কথা-কাজে অপর কেউ কষ্ট না পায়। রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে একজন মহিলার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, যে অনেক বেশী ছালাত আদায় করত, ছিয়াম পালন করত এবং দান-ছাদাক্বায়ও প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল, কিন্তু যবান দ্বারা প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়ার কারণে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে জাহান্নামী আখ্যায়িত করেছিলেন। আবার তাঁকে আরেকজন মহিলার কথা বলা হয়েছিল, যে শুধু ফরয ছিয়াম এবং ফরয ছালাত আদায় করত, পনিরের টুকরার মত স্বল্প পরিমাণ দান-ছাদাক্বাহ করত। কিন্তু নিজের যবান দ্বারা কখনো কাউকে কষ্ট দিত না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই মহিলাকে জান্নাতী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন’।[21] কারণ আল্লাহ কটুভাষীকে অপসন্দ করেন[22] এবং কথা-কাজে কোমলতাকে পসন্দ করেন[23]। সেজন্য কাউকে আনন্দিত না করতে পারলেও, অন্তত তাকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। নইলে জীবন হবে অভিশপ্ত ও বরকতশূন্য। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ آذَى الْمُسْلِمِينَ فِي طُرُقِهِمْ وَجَبَتْ عَلَيْهِ لَعْنَتُهُمْ، ‘যে ব্যক্তি রাস্তা-ঘাটে মুসলিমদের কষ্ট দেয়, সেই ব্যক্তির উপর তাদের অভিশাপ অনিবার্য হয়ে যায়’।[24]
শুধু মানুষকে নয়, কোন পশু-পাখিকে কষ্ট দেওয়ার অপরাধও আল্লাহ বরদাশত করেন না। রাসূল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, عُذِّبَتِ امْرَأَةٌ فِيْ هِرَّةٍ حَبَسَتْهَا حَتَّى مَاتَتْ جُوْعًا، فَدَخَلَتْ فِيْهَا النَّارَ، ‘একটি বিড়ালের কারণে একজন মহিলাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। সে বিড়ালটি বেঁধে রেখেছিল। অবশেষে বিড়ালটি ক্ষুধায় মারা যায়। আর এই কারণেই মহিলাটি জাহান্নামে প্রবেশ করেছে’।[25]
অনুভূতির ছাদাক্বাহ করার জন্য করণীয় :
অর্থ-সম্পদ দান করার জন্য যেমন টাকা-পয়সা থাকতে হয়, অনুভূতির ছাদাক্বাহ করার জন্য তেমনি হিংসা-বিদ্বেষ ও প্রবঞ্চণামুক্ত পরিশুদ্ধ হৃদয় থাকতে হয়। কেননা অনুভূতির ছাদাক্বাহ হৃদয়ে-হৃদয়ে লেনদেন হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لَا تَحَاسَدُوا، وَلَا تَبَاغَضُوا، وَلَا تَجَسَّسُوا، وَلَا تَحَسَّسُوا، وَلَا تَنَاجَشُوا، وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا، ‘তোমরা পরস্পর হিংসা করো না, একে অপরের সাথে শত্রুতা পোষণ করো না, গুপ্তচরবৃত্তি করো না, অপরের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করো না এবং পরস্পরকে প্রবঞ্চিত করো না। বরং তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসাবে পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে যাও’।[26] ইবনুল আরাবী বলেন,لا يكون القلب سليمًا إذا كان حقودًا حسودًا معجبًا متكبرًا، وقد شرط النَّبي صلّ الله عليه وسلم في الإيمان، أن يحبَّ لأخيه ما يحبُّ لنفسه ‘বিদ্বেষী, হিংসুক, অহংকারী ও উদ্ধত অন্তর কখনো খাঁটি অন্তর হ’তে পারে না। কেননা নবী করীম (ছাঃ) ঈমানের শর্তারোপ করেছেন যে, (প্রকৃত ঈমানদার হওয়া যায় না) যতক্ষণ না মুমিন কোন মুমিন ভাইয়ের জন্য তাই পসন্দ করে, যা সে নিজের জন্য পসন্দ করে’।[27] নির্মম সম্পদশালী লোকদের মাধ্যমে সৃষ্টিকূল উপকৃত হ’তে পারে না। পক্ষান্তরে একজন দয়াবান গরীব মানুষের মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টিকূল অনেক উপকৃত হ’তে পারে। কেননা ভালোবাসা, সেণহ-শ্রদ্ধা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, সম্প্রীতি, নম্রতা ও কোমলতার চাদরে মোড়া হৃদয়বান ব্যক্তিরাই কেবল অনুভূতির ছাদাক্বাহ করতে সক্ষম হন। সেকারণ অনুভূতির ছাদাক্বাহ করার যোগ্যতা অর্জনের জন্য সর্বাগ্রে অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার ও পরশ্রীকাতরতা দূর করতে হয়। হৃদয়ের যমীনে পরোপকার, ভ্রাতৃতববোধ ও পারস্পরিক কল্যাণকামিতার বীজ বপন করতে হয়। যেই বীজ থেকে মানবিকতার অঙ্কুরোদ্গম হয়। একদিন এই ছোট্ট চারা পত্র-পল্লবে সুশোভিত হয়ে সমাজের সর্বস্তরে শান্তি-সুখের অক্সিজেন সরবরাহ করে। তাই পরোপকারী ও পরিশুদ্ধ হৃদয়সম্পন্ন লোকদের মাধ্যমেই আদর্শ সমাজ নির্মিত হয়। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজসংস্কারক রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الْمُؤْمِنُ يَأْلَفُ وَيُؤْلَفُ، وَلَا خَيْرَ فِيمَنْ لَا يَأْلَفُ، وَلَا يُؤْلَفُ، وَخَيْرُ النَّاسِ أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ ‘মুমিন ব্যক্তি অন্যকে ভালোবাসে এবং অন্যের ভালোবাসার বাঁধনে আবদ্ধ হয়। সেই ব্যক্তির মধ্যে কোন কল্যাণ নেই যে অন্যকে ভালোবাসে না এবং প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয় না। আর মানুষের উপকারে নিয়োজিত ব্যক্তিরাই সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ’।[28] সুতরাং আবেগ-অনুভূতির ছাদাক্বার জন্য পরিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী হওয়া আবশ্যক।
অনুভূতির ছাদাক্বাহ করার কতিপয় উপায় :
ইসলাম সাম্য ও মানবিকতার ধর্ম। মানবতা ও মানবকল্যাণ এ ধর্মের প্রাণ। ইসলাম একজন মুসলিমকে নিজের সুখের উপর অন্যের আনন্দ ও স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে অনুপ্রাণিত করে। কাঁটার খোঁচা সহ্য করে অন্যের জন্য গোলাপ আহরণ করতে শিখায়। অনুরাগে ও অনুভবে অন্যের উপকার করতে এবং অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে প্রেরণা যোগায়। নিমেণ সংক্ষেপে অনুভূতির ছাদাক্বাহ করার কতিপয় উপায় তুলে ধরা হ’ল।-
১. হাসি মুখে কথা বলা : মানুষকে আনন্দিত করার একটি বিশেষ উপায় হ’ল ছোট-বড় নির্বিশেষে সবার সাথে সর্বদা হাসি মুখে কথা বলা। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,كُلُّ مَعْرُوفٍ صَدَقَةٌ، وَإِنَّ مِنَ الـمَعْرُوفِ أَنْ تَلْقَى أَخَاكَ بِوَجْهٍ طَلْقٍ، وَأَنْ تُفْرِغَ مِنْ دَلْوِكَ فِي إِنَاءِ أَخِيكَ، ‘প্রতিটি ভাল কাজই ছাদাক্বাহ স্বরূপ। তোমার ভাইয়ের সাথে হাসি মুখে সাক্ষাৎ করা এবং তোমার বালতির পানি দিয়ে তোমার ভাইয়ের পাত্র ভর্তি করে দেওয়াও নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত’।[29] অন্যত্র তিনি বলেন, تَبَسُّمُكَ فِي وَجْهِ أَخِيْكَ لَكَ صَدَقَةٌ ‘হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে তোমার ভাইয়ের সামনে উপস্থিত হওয়া তোমার জন্য ছাদাক্বাহ স্বরূপ’।[30]
২. কোমল ভাষায় কথা বলা এবং কর্কষ ভাষা পরিহার করা : কোমল ভাষা মানুষকে সহজেই প্রভাবিত করতে পারে। নম্র ব্যবহারে মানুষের হৃদয় আকৃষ্ট হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ رَفِيقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ، وَيُعْطِي عَلَى الرِّفْقِ مَا لَا يُعْطِي عَلَى الْعُنْفِ، ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ নম্র ব্যবহারকারী, তিনি নম্রতাকে পসন্দ করেন। তিনি নম্রতার জন্য যা দান করেন, কঠোরতার জন্য তদ্রূপ দান করেন না’।[31] অন্যত্র তিনি বলেন,مَنْ أُعْطِيَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ فَقَدْ أُعْطِيَ حَظَّهُ مِنَ الخَيْرِ، وَمَنْ حُرِمَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ فَقَدْ حُرِمَ حَظَّهُ مِنَ الخَي، ‘যাকে কোমলতার গুণ দান করা হয়েছে, তাকে কল্যাণের অংশ দান করা হয়েছে। আর যাকে কোমলতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তাকে যেন কল্যাণের অংশ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে’।[32] জনৈক কবি বলেন,
ثَمَرَةُ الْقَنَاعَةِ الرَّاحَةُ + وَثَمَرَةُ التَّوَاضُعِ الْمَحَبَّةُ
‘অল্পে তুষ্টির ফল হ’ল প্রশান্তি এবং বিনয়-নম্রতার ফলাফল হ’ল ভালবাসা’।[33] তবে আল্লাহর অবাধ্যতা ও পাপাচারের বিপক্ষে কোমলতা প্রদর্শন নয়; বরং সেই ক্ষেত্রে কঠোর হওয়াই শরী‘আতের নির্দেশ।
৩. সালাম দেওয়া : ছোট-বড়, পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে সকল মুসলিমকে সালাম দেওয়া ইসলামী শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত, যার মাধ্যমে অন্যের হৃদয়কে জয় করা যায় এবং পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল যে, ইসলামে কোন কাজ সর্বোত্তম? তখন তিনি বললেন,تُطْعِمُ الطَّعَامَ، وَتَقْرَأُ السَّلاَمَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ، ‘অপরকে খাওয়ানো এবং পরিচিত অপরিচিত সবাইকে সালাম দেওয়া’।[34] অন্যত্র তিনি বলেন, وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَا تَدْخُلُوا الجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا، وَلَا تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا، أَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى أَمْرٍ إِذَا أَنْتُمْ فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ؟ أَفْشُوا السَّلَامَ بَيْنَكُمْ ‘সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যে পর্যন্ত না তোমরা ঈমানদার হবে। আর ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি কাজের কথা বলে দেব না, যা করলে তোমাদের মাঝে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? তোমরা একে অপরের মাঝে সালামের প্রসার ঘটাও’।[35] সুতরাং মুসলিমদের মাঝে যত বেশী সালামের প্রসার ঘটবে, তাদের ভালোবাসার বন্ধন তত সুদৃঢ় হবে এবং জান্নাতের পথ সুগম হবে।
৪. ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলানো : ইয়াতীমদের মাথায় হাত বুলিয়ে, আদর ও সেবা দিয়ে তাদের হৃদয়ে সুখানুভূতি সঞ্চার করা যায়। যে সকল মুমিন বান্দাগণ ইয়াতীমদেরকে আদর করে এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করে, তারা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে জান্নাতে বসবাস করার সৌভাগ্য হাছিল করতে পারবে।[36]
৫. বড়দের সম্মান করা এবং ছোটদের সেণহ করা : বড়দেরকে সম্মান করা ও ছোটদের সেণহ করার মাধ্যমে সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ নির্মিত হয়। ইসলাম এই ব্যাপারে জোর তাকীদ দিয়েছে। একবার এক বয়স্ক লোক রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে আসে। লোকেরা তার জন্য পথ ছাড়তে বিলম্ব করে। এটা দেখে রাসূল (ছাঃ) বললেন,لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا وَيُوَقِّرْ كَبِيرَنَا ‘সেই ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়, যে আমাদের ছোটদের সেণহ করে না এবং আমাদের বড়দের সম্মান করে না’।[37]
৬. অন্যকে ক্ষমা করা ও সহমর্মিতা প্রদর্শন : অন্যকে ক্ষমা করা এক মহৎ গুণ, যার মাধ্যমে সহজে মানুষের মন জয় করা যায়। মক্কা বিজয়ের দিনে রাসূল (ছাঃ)-এর ক্ষমা প্রদর্শন এবং ইউসুফ (আঃ) কর্তৃক তার ভাইদেরকে ক্ষমা করার ইতিহাস যুগ-যুগান্তরে মানবজাতির প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। তাইতো আববাসীয় খলীফা আবু জা‘ফর মুনতাছির বিল্লাহ (২২২-২৪৮ হি.) বলেন,لَذَّةُ العَفْوِ أَعْذَبُ مِنْ لَذَّةِ التَّشَفِّي، وَأَقْبَحُ فَعَالِ الْمُقْتَدِرِ الانْتِقَامُ، ‘ক্ষমা করার তৃপ্তি রোগমুক্তি লাভের চেয়েও মধুর। আর ক্ষমতাধরের নিকৃষ্টতম কর্ম হ’ল প্রতিশোধ গ্রহণ করা’।[38]
৭. বিবাদ মীমাংসা করে দেওয়া : ইসলাম মানব জাতিকে সম্প্রীতি বজায় রেখে জীবন যাপনের নির্দেশ দেয়। একদিন রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) ছাহাবীদেরকে বললেন, أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِأَفْضَلَ مِنْ دَرَجَةِ الصِّيَامِ وَالصَّلَاةِ وَالصَّدَقَةِ، ‘আমি কি তোমাদেরকে ছালাত, ছিয়াম ও ছাদাক্বাহর চেয়েও উৎকৃষ্ট আমলের ব্যাপারে বলব না?’ ছাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ! বলুন। তখন তিনি বললেন, صَلَاحُ ذَاتِ البَيْنِ، فَإِنَّ فَسَادَ ذَاتِ البَيْنِ هِيَ الحَالِقَةُ، ‘পরস্পর সুসম্পর্ক স্থাপন করা। কারণ পরস্পর সুসম্পর্ক নষ্ট হওয়ার অর্থ হ’ল দ্বীন বিনষ্ট হওয়া’।[39]
৮. মানুষকে সুসংবাদ দেওয়া : কাউকে কোন বিষয়ে বা নেকীর কাজের ব্যাপারে আশান্বিত করা এবং সুসংবাদ দেওয়া আমলে ছালেহের অন্তর্ভুক্ত। রাসূল (ছাঃ) যখন কোন ছাহাবীকে কোন কাজে প্রেরণ করতেন, তখন তাকে নির্দেশ দিতেন, بَشِّرُوا وَلَا تُنَفِّرُوا، وَيَسِّرُوا وَلَا تُعَسِّرُوا ‘তোমরা লোকদেরকে সুসংবাদ দিবে, দূরে ঠেলে দিবে না। আর সহজ করবে, কঠিন করবে না’।[40]
৯. রোগীর সেবা করা : অনুভূতির ছাদাক্বাহ করার অন্যতম উপায় হ’ল রোগীর সেবা করা এবং তাকে দেখতে যাওয়া। এই কাজের মাধ্যমে রোগী এবং রোগীর পরিবারের সাথে যেমন আত্মিক হৃদ্যতা তৈরী হয়, তেমনি ফেরেশতাদের দো‘আ লাভ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়।[41]
১০. আত্মীয়-স্বজন ও অভাবীদের খোঁজ-খবর নেওয়া এবং তাদের প্রয়োজন পূরণ করা : এটি রাসূল (ছাঃ)-এর অন্যতম আদর্শ ছিল। যা পরবর্তীতে ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের জীবনাচরণে প্রতিফলিত হয়েছিল। আবুবকর, ওমর (রাঃ) মুসলিম জাহানের খলীফা হওয়া সত্ত্বেও, আত্মীয়-স্বজন, বিধবা ও অসহায় মানুষের খোঁজ-খবর নিতেন, তাদের সেবা করতেন এবং তাদের প্রয়োজন পূরণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন। সেকারণ তাদের মাধ্যমে সোনালী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শই ছিল তাদের অনুপ্রেরণার উৎস। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
أَحَبُّ النَّاسِ إِلَى اللهِ أَنْفَعَهُمْ لِلنَّاسِ، وَأَحَبُّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللهِ سُرُورٍ تُدْخِلُهُ عَلَى مُسْلِمٍ، أَوْ تَكْشِفُ عَنْهُ كُرْبَةً، أَوْ تَقْضِي عَنْهُ دِينًا، أَوْ تُطْرَدُ عَنْهُ جُوعًا، وَلِأَنْ أَمْشِيَ مَعَ أَخٍ لِي فِي حَاجَةٍ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أَعْتَكِفَ فِي هَذَا الْمَسْجِدِ، يَعْنِي مَسْجِدَ الْمَدِينَةِ، شَهْرًا،
‘আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় লোক হচ্ছে, যারা বেশী বেশী মানুষের উপকার করে। আর আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় কাজ হচ্ছে কোন মুসলিমকে খুশি করা অথবা কোন মুসলিম ভাইয়ের বিপদ দূর করা অথবা কোন মুসলিম ভাইয়ের ঋণ পরিশোধ করা অথবা কোন ভাইয়ের ক্ষুধা নিবারণ করা। কোন মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন (অভাব) পূরণের জন্য তার সাথে হাঁটা (সময় দেওয়া) আমার নিকট এক মাস মদীনার মসজিদে (মসজিদে নববী) ই‘তিকাফ করার চাইতেও অধিকতর প্রিয় কাজ’।[42]
১১. হাদিয়া দেওয়া : অন্যের সাথে ভালোবাসা ও সুসম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম সেতু বন্ধন হ’ল পরস্পর হাদিয়া বা উপহার দেওয়া। অনেক সময় ছোটখাট জিনিস হাদিয়া দেওয়ার মাধ্যমেও মানুষের হৃদয় জয় করা যায়। রাসূল (ছাঃ) অন্যের হাদিয়া গ্রহণ করতেন এবং নিজেও হাদিয়া দিতেন।[43] তিনি ছাহাবীগণকে এই ব্যাপারে উৎসাহিত করে বলতেন,تَهَادَوْا تَحَابُّوا ‘তোমরা পরস্পর উপহার আদান-প্রদান কর, তাহ’লে তোমাদের মাঝে ভালোবাসা পয়দা হবে’।[44]
উপসংহার :
পার্থিব জীবনে শারিরীক পরিচ্ছন্নতা যেমন প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশী প্রয়োজন হ’ল অন্তরের পরিশুদ্ধতা ও পরিচ্ছন্নতার। আর হৃদয় জগত পরিচ্ছন্ন রাখার অন্যতম প্রধান উপায় হ’ল অনুভূতির ছাদাক্বাহ। কেননা যাকাত প্রদানের মাধ্যমে যেমন সম্পদ পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয়, ঠিক তেমনি অনুভূতির ছাদাক্বাহর মাধ্যমে আমাদের হৃদয় পরিশুদ্ধ হয়। আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে এবং জান্নাত লাভের প্রধান মাধ্যম ও উপকরণ হ’ল অন্তরের পরিশুদ্ধি, যেখানে আল্লাহভীতি ও ঈমানের চারাগাছ রোপিত হয়। তাই আসুন! বেশী বেশী অনুভূতি ছাদাক্বাহর মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ হাছিলে সচেষ্ট হই। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সেই তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
মাস্টার্স (অধ্যয়নরত), আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. বুখারী হা/৫২; মুসলিম হা/১৫৯৯; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৮৪; মিশকাত হা/২৭৬২।
[2]. মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ৭/১৮৭।
[3]. বুখারী হা/৬০১১; মুসলিম হা/২৫৮৬; মিশকাতা হা/৪৯৫৩।
[4]. মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ১৩/৪০।
[5]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৩০৪৮; ছহীহাহ হা/২৮৪১; ছহীহুত তারগীব হা/১৫৫৪, সনদ হাসান।
[6]. ইবনু রজব হাম্বলী, জামে‘উল উলূম ওয়াল হিকাম ১/২১১।
[7]. মুস্তাদরাক লিল হাকেম হা/৫; ছহীহাহ হা/১৫৮৫; ছহীহুল জামে‘ হা/১৫৯০; ছহীহ হাদীছ।
[8]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হা/৩৫৭২৫; গাযালী, ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ৩/১৮৯।
[9]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া ২/৩৮৯; ইবনু আসাকির, তারিখু দিমাশক ৪৯/১২৩।
[10]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৮/৬৪৪।
[11]. ইবনু মাজাহ হা/৪২১৬; ছহীহাহ হা/৯৪৮; মিশকাত হা/৫২২১
[12]. বুখারী হা/৬৪৪৬; মুসলিম হা/১০৫১; তিরমিযী হা/২৩৭৩; ইবনু মাজাহ হা/৪১৩৭; মিশকাত হা/৫১৭০।
[13]. তাবারাণী, মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৬০২৬; ছহীহুল জামে‘ হা/১৭৬; ছহীহাহ হা/ ৯০৬, সনদ হাসান।
[14]. ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৯৫৪, ২০৯০; ছহীহাহ হা/২২৯১; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৮৯৭, সনদ হাসান।
[15]. ছহীহুল জামে‘ হা/৫৮৯৭, সনদ ছহীহ্।
[16]. বুখারী হা/৯; মুসলিম হা/৩৫; নাসাঈ হা/৫০০৫; ইবনু মাজাহ হা/৫৭; মিশকাত হা/৫।
[17]. আবূ দাঊদ হা/৪৯৪১; তিরমিযী হা/১৯২৪; মিশকাত হা/৪৯৬৯, ছহীহ হাদীছ।
[18]. বুখারী হা/৩৩২১; মুসলিম হা/২২৪৫; মিশকাত হা/১৯০২।
[19]. তিরমিযী হা/২৬২৭; নাসাঈ হা/৪৯৯৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৭১০; মিশকাত হা/৩৩, সনদ ছহীহ।
[20]. মুসলিম হা/২৫৬৪; আবূদাঊদ হা/৪৮৮২; তিরমিযী হা/১৯২৭; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৩৩; মিশকাত হা/৪৯৫৯; শব্দগুলো আবূ দাঊদের।
[21]. আহমাদ হা/৬৯৭৫; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৯৫৪৬; ছহীহুত তারগীব হা/২৫৬০; মিশকাত হা/৪৯৯২, সনদ ছহীহ।
[22]. তিরমিযী হা/২০০২; ইবনু হিববান হা/৫৬৯৩; ছহীহাহ হা/২৫৬০; মিশকাত হা/৫০৮১, হাদীছ ছহীহ।
[23]. বুখারী হা/৬০২৪; মুসলিম হা/২১৬৫; তিরমিযী হা/২৭০১; ইবনু মাজাহ হা/৩৬৮৯; মিশকাত হা/৪৬৩৮।
[24]. তাবারাণী, মু‘জামুল কাবীর হা/৩০৫০; ছহীহুত তারগীব হা/১৪৪; ছহীহাহ হা/২২৯৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৯২৩, সনদ হাসান।
[25]. বুখারী হা/২৩৬৫; মুসলিম হা/২২৪২; মিশকাত হা/১৯০৩।
[26]. মুসলিম হা/২৫৬৩।
[27]. ইবনুল আরাবী, আহকামুল কুরআন ৩/৪৫৯।
[28]. তাবারাণী, মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৫৭৮৭; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৭২৫২; ছহীহাহ হা/৪২৬।
[29]. তিরমিযী হা/১৯৭০; মিশকাত হা/১৯১০, ছহীহ হাদীছ।
[30]. তিরমিযী হা/১৯৫৬; ছহীহাহ হা/৫৭২; ছহীহুত তারগীব হা/২৬৮৫; ছহীহুল জামে‘ হা/২৯০৮, সনদ ছহীহ।
[31]. মুসলিম হা/২৫৯৩; আবূদাঊদ হা/৪৮০৭; ইবনু মাজাহ হা/৩৬৮৮; ৫০৬৮।
[32]. আহমাদ হা/২৫২৫৯; তিরমিযী হা/২০১৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৬০৫৫।
[33]. আহমাদ আল-বিকরী, নিহায়াতুল আরাব ফী ফুনূনিল আদাব ৩/২৪৫।
[34]. বুখারী হা/১২; মুসলিম হা/৩৯; মিশকাত হা/৪৬২৯।
[35]. মুসলিম হা/৫৪; তিরমিযী হা/২৬৮৮; ইবনু মাজাহ হা/৬৮; মিশকাত হা/৪৬৩১।
[36]. বুখারী হা/৫৩০৪; মুসলিম হা/২৯৮৩; আবূদাঊদ হা/৫১৫০; তিরমিযী হা/১৯১৮; মিশকাত হা/৪৯৫২।
[37]. তিরমিযী হা/১৯১৯, সনদ ছহীহ।
[38]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৯/৪৫০।
[39]. আবূদাঊদ হা/৪৯১৯;তিরমিযী হা/২৫০৯; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৪১২, সনদ ছহীহ।
[40]. মুসলিম হা/১৭৩২; আবূদাঊদ হা/৪৮৩৫; মিশকাত হা/৩৭২২, সনদ ছহীহ।
[41]. আহমাদ হা/৯৭৬; আবূদাঊদ হা/৩০৯৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৭১৭; ছহীহাহ হা/১৩৬৭, সনদ ছহীহ।
[42]. তাবারাণী, মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৬০২৬; ছহীহুল জামে‘ হা/১৭৬; ছহীহাহ হা/ ৯০৬।
[43]. বুখারী হা/২৫৮৫; আবূদাঊদ হা/৩৫৩৬; তিরমিযী হা/১৯৫৩; মিশকাত হা/১৮২৬।
[44]. তাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৭২৪০; ছহীহুল জামে‘ হা/৩০০৪।