আন্তর্জাতিক
রাজনীতির নানা ডামাডোলে দু’টি বিষয় খুব বেশী মনযোগ পাচ্ছে না। একটি হচ্ছে
সিরিয়ার গোলান হাইটসকে ইসরাঈলের অংশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণা আর চীনের
শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর সম্প্রদায়ের ওপর বেইজিংয়ের নির্মম নির্যাতন ও দমিয়ে
রাখার অভিযোগ। উভয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠীই একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
গোলান মালভূমির অধিবাসীদের নরকযাত্রা ১৯৬৭ সালে শুরু। আর উইঘুরদের দোজখবাস
কিছুদিন ধরেই প্রকাশিত হয়েছে।
গোলান মালভূমি দিয়েই শুরু করা যাক। জাতিসংঘের সদ্য অনুষ্ঠিত সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান একটি প্রশ্ন রেখেছেন, ইসরাঈলের সীমানা কোনটি? ইসরাঈল কি ১৯৪৭ সালের সীমানায় থাকবে নাকি ১৯৬৭ সালের সীমানা দখল করে রাখবে? অথবা এর সীমানা নিয়ত বাড়তেই থাকবে। ইসরাঈলই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র দেশ, যাদের আয়তন দিন দিন বাড়ছেই। অন্যের দেশ দখলের হুমকি ধমকি হামেশাই দিচ্ছে ইসরাঈল। বিস্ময়করভাবে ইসরাঈল দাবী করছে, এটা নাকি তাদের অধিকার। ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি পালন করছে কেবল। কিন্তু এই অধিকার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ইসরাঈল মানবাধিকার, জাতিসংঘের সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করছে। ইসরাঈল ক্রমেই একটি বর্ণবাদী দেশে পরিণত হচ্ছে আরব শাসকদের গোপন ও সক্রিয় সহযোগিতায়।
গোলান মালভূমি দখলের ইতিহাস ফিরে দেখা যাক। ইসরাঈল ১৯৬৭ সালে পাঁচ দিনের যুদ্ধে গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। বরং বলা ভালো, গোলান মালভূমিকে আরব নেতারা ইসরাঈলের দখলদারি মনোভাবের কাছে সমর্পণ করে অর্থ ও ক্ষমতার স্বার্থে বিক্রি করে দেয়।
অভিযোগ রয়েছে, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পিতা হাফীয আল-আসাদ প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকাকালে গোলান মালভূমিকে ইসরাঈলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজের ভবিষ্যৎ ক্ষমতাকে পোক্ত করার জন্য।
ঐ যুদ্ধে অংশ নেওয়া অনেক সৈনিক পরবর্তী সময়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন, গোলান মালভূমির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল কুনায়েত্রা হাফীয আল-আসাদ বিনা প্রতিরোধেই ইসরাঈলের হাতে ছেড়ে দেন। ইসরাঈলের সৈন্য প্রবেশের ১৭ ঘণ্টা আগেই সিরীয় সৈন্যরা হাফীয আল-আসাদের নির্দেশে কুনায়েত্রা ছেড়ে চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা‘দাতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ড. মাহমূদ জামে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, গোলান ছেড়ে দেওয়ায় হাফীয আল-আসাদকে ইসরাঈল ১০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার দিয়েছিল। ১০০ মিলিয়ন ডলারের ঐ চেক মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাছেরের সিন্দুকে গচ্ছিত ছিল।
বাশার আল-আসাদও কি পিতার পথই অনুসরণ করছেন? আরবের গণমাধ্যমগুলো সম্প্রতি অভিযোগ করেছে, ইসরাঈলের সঙ্গে বাশার এবারও গোপন অাঁতাত করেছেন পিতার মতই। গোলান মালভূমি ছেড়ে দিয়ে নিজের ক্ষমতায় টিকে থাকা নিশ্চিত করেছেন বাশার। এ সমঝোতা হওয়ার পরই ডোনাল্ড ট্রাম্প গোলানকে ইসরাঈলের অংশ হিসাবে ঘোষণা করেন এবং কাছাকাছি সময়ে সিরিয়ায় আইএস পরাজিত হয়েছে বলে ঘোষণা করেন।
এবার চীনের উইঘুরদের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। পশ্চিম চীনের উইঘুর সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর নির্মম নির্যাতনের ভয়ংকর সব তথ্য পাওয়া যাবে। সেখানে উইঘুরদের সামাজিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে। রি-এডুকেশনের নামে তাদের ধর্ম পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না। ছালাত আদায়ে বাধা দেওয়া হয়। মসজিদকে পানশালায় পরিণত করার অভিযোগও রয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কাউন্সিল জানিয়েছে, নিরীহ নিরপরাধ আটক উইঘুরদের দেহ থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করে বিক্রি করে দিচ্ছে চীনা কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ অস্বীকার করলেও চীন এটা স্বীকার করেছে, মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত লোকজনের সাজা কার্যকরের পর তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চিকৎসা খাতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ইউঘুররা নীরবে নির্যাতন সয়ে যাচ্ছে। জিনজিয়াং-এ মানবতার পতন ঘটছে। সভ্যতার এই পর্যায়ে এসে কোন দেশ সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অঙ্গ বিক্রি করে দিচ্ছে, তা মেনে নেওয়া অসম্ভব। সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে প্রাচীন ও মধ্যযুগের চিত্র ভেসে ওঠে, যখন শত্রুকে বধ করে বীরত্ব ও শৌর্য প্রকাশের জন্য কলিজা চিবিয়ে খাওয়া হ’ত। চৈনিকরা কলিজা খাচ্ছে না বটে, তবে বিক্রি করে দিচ্ছে। রীতিমতো হাট বসিয়ে।
চীনে দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে। সামরিক শক্তিতেও বলীয়ান হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকে চীনই একমাত্র প্রতিহত করতে পারবে বলে অনেকেই চীনের গুণমুগ্ধ। কিন্তু যুদ্ধবাজ মার্কিন আধিপত্যবাদের বিপরীতে অর্থনৈতিক দানব চীনের আর্বিভাব ঘটছে। চীনের আগ্রাসী শিল্পনীতির বিরুদ্ধে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় বিক্ষোভ হয়। অনেক দেশই চীনের ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ছে। দেশের অভ্যন্তরেও চীন সমান আগ্রাসী। বিরোধী মতকে দুমড়েমুচড়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। শুধু বিরোধী রাজনৈতিক মতবাদই না, এবার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনায় সক্রিয় হয়েছে চীন।
কার্যত গোলানের অধিবাসী ও জিনজিয়াং-এর সংখ্যালঘু নাগরিকদের কোন অধিকার নেই। ভিন্ন দেশ হ’লেও উভয় এলাকার পরিস্থিতি একই। নিজ গৃহেই অধিবাসীরা পরবাসী। নিজেদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোন অধিকার নেই। আর বিস্ময়করভাবে সবাই নীরব। মিসরের সিনাই উপদ্বীপ ও লেবানন অধিকৃত এলাকা ফিরে পেলেও সিরিয়া গোলান হাইটস ফিরে পায়নি। কখনোই এ নিয়ে আরব দেশগুলো ইসরাঈলকে চাপ দেয়নি। সিরিয়া নিজেও না। আরব লীগ ও ওআইসি এখন এক ঠাট্টা-তামাশার সংগঠনে পরিণত হয়েছে। লোক দেখানো বিবৃতি ও বৈঠক করা ছাড়া এই দুই সংগঠনের কোন কাজ আছে বলে মনে হয় না। সদস্য দেশগুলোকে রক্ষায় কোন পদক্ষেপই এরা নিতে পারেনি।
উইঘুরদের নিয়ে বেশী সোচ্চার ছিল তুরস্ক। আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল প্যাঁচে পড়ে তুরস্কও এখন নীরব। মুসলিম বিশ্বে পাকিস্তান কাশ্মীর প্রশ্নে সক্রিয়। জাতিসংঘে উইঘুর বিষয়ক এক প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো ভোট দিলেও সঊদী আরবের নেতৃত্বে মুসলিম দেশগুলো চীনের পক্ষাবলম্বন করে। পরিহাস এই, মুসলিম দেশগুলো যখন উইঘুর মুসলিমদের বিষয়ে উদাসীন, তখন মুসলমানদের শত্রু বলে চিহ্নিত যুক্তরাষ্ট্র সে ব্যাপারে সরব।সম্প্রতি জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জ্বালাময়ী বক্তব্য দিলেও সন্তর্পণে গোলান ও উইঘুরের কথা এড়িয়ে গিয়েছেন। শুধু ইমরান খান নন, সবাই এড়িয়ে যাচ্ছেন। আরবের নেতারা নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে নীরব থাকছেন। উইঘুরদের ক্ষেত্রে চীনের অর্থনৈতিক শক্তির কাছে সব মুসলিম দেশ আজ পদানত। বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য কেউ হারাতে চায় না। চীন বিভিন্ন দেশে বন্দর, রাস্তাঘাট নির্মাণ করে দিচ্ছে। ওয়ান বেল্ট ইনিশিয়েটিভ, সিল্ক রুটসহ নানা পরিকল্পনায় সবাইকে বিমোহিত করছে। চীন যেন কালো জাদুকরের ভূমিকায় অবতীর্ণ। জাদুর নেশায় সবাই বোবার অভিনয় করছে। কিন্তু ওদিকে গোলান, জিনজিয়াং-এর বাতাস আরও ভারী হচ্ছে অত্যাচারিতের চাপাকান্নায়। সভ্যতার আকাশ ঢেকে যাচ্ছে ইসরাঈল ও চীনের থাবায়।
\সংকলিত\
[1]. https://www.aliqtisadalislami.net/موقف-الشريعة-الإسلامية-من-الاحتكار-وا/
[2]. হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাতহুল বারী (রিয়াদ: দারুস সালাম, ১৪২১হি:/২০০০ খ্রি:) ৪/৪৩৯; শরীফ আলী বিন মুহাম্মাদ আল-জুরজানী, কিতাবুত তা‘রীফাত (দেওবন্দ: মাকতাবা ফাকীহুল উম্মাহ, তাবি), পৃ: ১৩।
[3]. লিসানুল আরাব ৪/২০৮; তাজুল আরূস ১১/৭২ প্রভৃতি।
[4]. আল-আইন ৩/৬২।
[5]. আছ-ছিহাহ ২/৬৩৫।
[6]. মু‘জামু মাকাঈসিল লুগাহ ২/৯২।
[7]. লিসানুল আরাব ৪/২০৮।
[8]. আল-ক্বামূসুল মুহীত ১/৩৭৮।
[9]. তাহযীবুল লুগাহ ৪/৬০।
[10]. তাজুল আরূস ১১/৭১।
[11]. ফাতহুল বারী ৪/৪৪০।
[12]. আবূদাঊদ হা/৩৪৪৭; ইমাম শাওকানী, নায়লুল আওতার (বৈরূত: দারুল কিতাব আল-আরাবী, ১৪২০ হি:/২০০০ খ্রি:), ৩/৬০৫।
[13]. http://www.alkhaleej.ae/supplements/page/83366ca9-8f8b-4c54-a483-1463f1ab137d
[14]. আতিইয়া মুহাম্মাদ সালিম, শারহু বুলূগিল মারাম, মাকতাবা শামেলাহ দ্র.।
[15]. http://www.alkhaleej.ae/supplements/page/645ea360-5b5f-42ac-ae5c-261cc1dd2d63
[16]. শায়খ আতিইয়া মুহাম্মাদ সালিম, শারহু বুলূগিল মারাম, মাকতাবা শামেলা দ্র.।
[17]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৫/৪২৩, হজ্জ ২৫ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র.।
[18]. ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ১/২৪৩।
[19]. আল-মাওছিলী। আল-ইখতিয়ার লি-তা‘লীলিল মুখতার ৪/১৬০।
[20]. মুহাম্মাদ সাইয়িদ তানতাবী, আত-তাফসীর আল-ওয়াসীত ১/২৯৬১।
[21]. আবুদাঊদ, হা/২০২০, হাদীছ যঈফ; তাফসীরে কুরতুবী, হজ্জ ২৫ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র.।
[22]. ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ২/৭৩।
[23]. https://www.aliqtisadalislami.net / موقف-الشريعة-الإسلامية-من- الاحتكار-وا।
[24]. http://www.alkhaleej.ae/supplements/page/645ea360-5b5f-42ac-ae5c-261cc1dd2d63
[25]. মুসলিম হা/১৬০৫।
[26]. ইমাম নববী, আল-মিনহাজ শারহু ছহীহ মুসলিম (বৈরূত: দারুর রাইয়ান লিত-তুরাছ, ১৪০৭ হি:/১৯৮৭খ্রি:), ১১/৪৩।
[27]. নায়লুল আওতার ৩/৬০৪।
[28]. আতিইয়া মুহাম্মাদ সালিম, শারহু বুলূগিল মারাম, মাকতাবা শামেলাহ দ্র.।
[29]. সিলসিলা ছহীহা হা/৩৩৬২।
[30]. ড. ইউসুফ আল-কারযাভী, আল-হালালু ওয়াল হারামু ফিল-ইসলাম, পৃঃ ২২৪।
[31]. আহমাদ, হা/১৯৪২৬, শু‘আইব আরনাঊত বলেছেন, إسناده جيد ‘এর সনদ উত্তম’; আল-হালালু ওয়াল হারামু ফিল ইসলাম, পৃ: ২২৫।
[32]. ইবনু মাজাহ হা/২১৫৩, হাদীছ যঈফ; মিশকাত হা/২৮৯৩।
[33]. আল-হালালু ওয়াল হারামু ফিল ইসলাম, পৃ: ২২৪-২২৫।
[34]. নায়লুল আওতার ৩/৬০৪।
[35]. মুওয়াত্ত্বা ইমাম মালেক হা/২৩৯৮।
[36]. ঐ, হা/২৪০০ عَنْ مَالِك أَنَّهُ بَلَغَهُ أَنَّ عُثْمَانَ بْنَ عَفَّانَ كَانَ يَنْهَى عَنْ الْحُكْرَةِ
[37]. ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ২/৭২।
[38]. ড. কাহতান আব্দুর রহমান আদ-দূরী, আল-ইহতিকার ওয়া আছারুহু ফিল ফিক্বহিল ইসলামী (বৈরুত:১৪৩২/২০১১), পৃঃ ১০২।
[39]. বাদায়েউছ ছানায়ে ৫/১২৯।
[40]. আল-ইহতিকার ওয়া আছারুহু ফিল ফিক্বহিল ইসলামী, পৃঃ ১০৩-১০৬; https://www.aliqtisadalislami.net/موقف-الشريعة- الإسلامية-من-الاحتكار- وا।
[41]. আল-মিনহাজ ১১/৪৩।
[42]. সাইয়িদ সাবিক, ফিক্বহুস সুন্নাহ (বৈরুত: মুআস্সাসাতুর রিসালাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪২৪/২০০৩), ৩/১৬৪।
[43]. ড. আমীন মোস্তফা আব্দুল্লাহ, উসূলুল ইকতিছাদ আল-ইসলামী (মিসর: মাতবা‘আ ঈসা আল-বাবী আল-হালাবী, ১৪০৪হি:/১৯৮৪খ্রি:), পৃ: ২৮৭।
[44]. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ২/২০২।