সম্প্রতি
বাংলাদেশ জুড়ে ভয়াবহ কয়েকটি ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা সারা দেশ নাড়িয়ে
দিয়ে গেছে। মানুষ পাশবিকতার চরমতম পর্যায়ে না পৌঁছালে তার পক্ষে এমন
বর্বরতার জন্ম দেয়া অসম্ভব। অথচ এই অচিন্তনীয় ঘটনাই এখন বাংলাদেশের
পত্র-পত্রিকার নিত্য-নৈমিত্তিক খবর। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে মাত্র গত নয়
মাসে করোনা মহামারীর ভয়াবহ বিপর্যয় ও লকডাউনের মত কার্যত কাফ্যুর্
পরিস্থিতির মধ্যেই ৯৭৫টি ধর্ষণের ঘটনা পুলিশ রেকর্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে,
যার মধ্যে গণধর্ষণের মত ভয়ংকর অপরাধ ছিল ২০৮টি। এদের মধ্যে ৪৩ জনকে ধর্ষণের
পর হত্যা করা হয়েছে। আর লজ্জায়-অপমানে আত্মহত্যা করেছে আরো ১২ জন নারী।
এগুলো শুধু রেকর্ডভুক্ত ঘটনা। প্রকৃত সংখ্যা যে কয়েকগুণ বেশী তা বলার
অপেক্ষা রাখে না। কেননা এ ধরণের ঘটনার মাত্র ২০ শতাংশই প্রকাশ পায়।
মান-সম্মানের ভয়ে লোকলজ্জায় বাকি ঘটনাগুলো অপ্রকাশিত থাকে। এর বাইরে
করোনাকালীন পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে নিহত হয়েছে আরো ২৭৯ জন নারী। আর
নির্যাতনে আত্মহত্যা করেছে ৭৪ জন নারী।
উপরোক্ত তথ্যগুলো থেকে কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়, আমাদের সমাজ নারীদের নিরাপত্তা দিতে কতটা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এবং কিভাবে এ সমাজে নারীরা মর্মান্তিক নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। অথচ দেশবিধায়কগণ দাবী করেন, দেশের আইন-কানূন ও সমাজব্যবস্থা নাকি নারীবান্ধব করে গড়ে তোলা হয়েছে! বস্ত্ততঃ প্রচলিত এই নারীবান্ধব সমাজ গড়ার শ্লোগান যে নারীকে কতটা অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ফেলে দিয়েছে, তা আমাদের দায়িত্বশীলগণ যতদিন পর্যন্ত উপলব্ধি না করবেন, ততদিন নারীর জন্য নিরাপদ সমাজ গড়ার দাবী অবান্তরই প্রতীয়মান হবে।
সচেতন পাঠক! নারী নির্যাতন কেন হয়? বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে কেন এক শ্রেণীর বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ ধর্ষণের মত বর্বরতায় লিপ্ত হচ্ছে? কেন ধর্ষণের পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ মুসলিম দেশগুলির মধ্যে প্রথম? এই ধর্ষণ মনোবৃত্তির মূল উৎস কোথায়? এই প্রশ্নগুলির উত্তর আমাদের খোঁজা দরকার। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হ’ল- ধর্ষণ যখন মহামারীর আকার ধারণ করে তখন তা কেবল ব্যক্তিগত অপরাধ থাকে না, বরং সেই অপরাধের দায় সমগ্র সমাজের উপর পড়ে। যেই সমাজে মানবিক মূল্যবোধের চর্চা নেই, নৈতিক শিক্ষার বাস্তবায়ন নেই, আইনের শাসন নেই, সেই সমাজে এই ধরণের অপরাধ যে ধারাবাহিক চলতেই থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাহ’লে কি আমাদের সামাজিক পরিমন্ডলই এই ধর্ষক উৎপাদনের উর্বর রসদ যোগান দিচ্ছে? আসুন! বিষয়টি যাচাইয়ের চেষ্টা করি।
প্রথমতঃ চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রই স্বীকার করবেন যে, বর্তমানে ধর্ষণ মনোবৃত্তি তৈরীতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে মিডিয়া। পত্র-পত্রিকা ও সিনেমা-টিভিতে নারীকে যেভাবে অশালীনভাবে উপস্থাপন করা হয়, তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, যুবসমাজের মধ্যে বিকৃত মানসিকতা ঢুকিয়ে দেয়ার প্রাথমিক কাজটি মূলতঃ মিডিয়াই নিয়মিতভাবে আঞ্জাম দিচ্ছে। আর এর সাথে আরো ভয়ংকরভাবে যুক্ত হয়েছে অবাধ আকাশ সংস্কৃতির নীল দংশন, যার বিষাক্ত ছোবলে একশ্রেণীর যুবসমাজের মন-মস্তিষ্ক পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে ফেলেছে। সুতরাং আইন যতই কঠোর করা হোক না কেন, যদি মিডিয়ার এই জঘন্য উৎসমুখ বন্ধ না করা যায়, তবে কখনই সুস্থ ও নিরাপদ সমাজব্যবস্থা কামনা করা সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়তঃ নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপন সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য যেন একটিই- নারী-পুরুষের অনৈতিক সম্পর্ককে উৎসাহিত করা। নারী-পুরুষ বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ককে সেখানে এত স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন তা কোন অপরাধের সংজ্ঞাতেই পড়ে না। ফলে যেনা-ব্যভিচারের বিস্তার দিন দিন বাড়ছে। নারী-পুরুষ সহজেই তাদের ইয্যত-আব্রু বিকিয়ে দিচ্ছে। এর বিপরীতে বিবাহ তথা বৈধ সম্পর্ককে দিন দিন করা হচ্ছে কঠিন থেকে কঠিনতর। পরিবার থেকে যেমন দ্রুত বিবাহকে উৎসাহ দেয়া হয় না, তেমনি সমাজও দ্রুত বিবাহকে অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখে। ফলে একদিকে নারী-পুরুষের বৈধ সম্পর্কের পথ কঠিন হয়ে যাচ্ছে, অপরদিকে সহজসাধ্য হচ্ছে অনৈতিক সর্ম্পক, যেনা-ব্যভিচার।
তৃতীয়তঃ নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও সহশিক্ষা অনৈতিকতা বিস্তৃতির অন্যতম কারণ। নারী শিক্ষা, নারী উন্নয়ন তথা নারীর কর্মসংস্থানের নামে বর্তমানে যে প্রোপাগান্ডা চলছে, তার একটিই উদ্দেশ্য নারীদেরকে চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে ঘর থেকে বের করে জীবন-জীবিকার কঠিন ময়দানে নামিয়ে দেয়া। তাতে সমস্যা ছিল না, যদি তাদের জন্য স্বতন্ত্র ও নিরাপদ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া হ’ত। কিন্তু তাদেরকে পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতায় লাগিয়ে দিয়ে রীতিমত যুদ্ধে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। অপরদিকে সহশিক্ষার নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পবিত্র অঙ্গনে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীদেরকে অবাধ মেলামেশার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। নৈতিকতার মহা পরীক্ষায় সেখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই উত্তীর্ণ হ’তে পারে না। ফলে মানবীয় প্রবৃত্তির দুর্বলতম অংশের কাছে পরাজিত হয়ে অতি সহজে তারা অনৈতিকতার পথে পা বাড়াচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে পাপ-পঙ্কিলতার মহাসাগরে। এদেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন যেন ইভটিজিং, যেনা-ব্যভিচার ও অবাধ যৌনাচারের অনুশীলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। জোড়ায় জোড়ায় অন্তরঙ্গভাবে বসে থাকা নর-নারীর প্রকাশ্য অপকর্মে শয়তানও বোধহয় লজ্জিত হয়। অথচ ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে নীরবে আমরা তা হযম করে চলেছি অহর্নিশ।
চতুর্থতঃ পথেঘাটে নারীর পর্দাহীন এবং অশালীন চলাফেরা নিঃসন্দেহে ধর্ষকদের কুপ্রবৃত্তি তৈরীতে বড় ভূমিকা রাখছে। নৈতিক মূল্যবোধ, লজ্জাশীলতা ও ইসলামের দেয়া নীতিমালাকে অবজ্ঞা করে একজন নারী যখন অশালীন পোষাকে ঘর থেকে বের হয়, তখন সে যেন সমাজের কীটগুলোকে অনৈতিকতার দিকে প্রচ্ছন্ন আহবান জানায়। সুতরাং আধুনিক নারীবাদীরা ধর্ষণের পিছনে পর্দাহীনতার পরোক্ষ দায় যতই আড়ালের চেষ্টা করুক না কেন, যতদিন নারী স্বেচ্ছাচারী ও পর্দাহীন থাকবে, ততদিন নারীর প্রতি সহিংসতা বিদূরিত হওয়া দুরাশাই থাকবে।
পঞ্চমতঃ যদিও সরকার ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করেছে, কিন্তু সেই আইনের বাস্তবায়ন না হওয়া এবং প্রচলিত বৃটিশ বিচারব্যবস্থার সীমাহীন দুর্বলতাও নারী নির্যাতন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ২০০১ থেকে ২০২০ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত নারী নির্যাতন মামলা সমূহ পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ পর্যন্ত আদালতে মাত্র ৩.৫৬% মামলার রায় হয়েছে। আর উচ্চ আদালতের জটিলতা কাটিয়ে মাত্র ০.৩৭% মামলায় দন্ডাদেশ কার্যকর হয়েছে। শুধু তাই নয়, পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৬টি যেলায় ধর্ষণের অভিযোগে ৪৩৭২টি মামলা হয়েছে। কিন্তু দোষী সাব্যস্ত করা গেছে মাত্র ৫জনকে। অর্থাৎ মুখে মুখে আইনের বুলি কপচানো হ’লেও বাস্তবে এসব মামলা ও আইনী ব্যবস্থা কেবল প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। শুধু তাই নয়, অর্থ ও ক্ষমতার দাপটে প্রকৃত দোষীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আড়ালে থেকে যায়। সুতরাং নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে গেলে প্রচলিত এই বিচারব্যবস্থার আশু পরিবর্তন কিংবা সংস্কারের কোন বিকল্প নেই। ইসলামের কঠোর বিচারব্যবস্থা যদি চালু করা যেত, তবে নিঃসন্দেহে নারীর প্রতি সহিংসতার হার বহুলাংশেই নিবারণ করা সম্ভব হ’ত।
সর্বোপরি নারীদের প্রতি আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই বিরাট ত্রুটি রয়ে গেছে। আমাদের পরিবারে ও সমাজে ইসলামের নৈতিক শিক্ষার চর্চা না থাকায় নারীদেরকে একদল মানুষ ভোগ্যপণ্য মনে করে যথেচ্ছ ব্যবহার করছে, অপরদল নিছক সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র মনে করে। অথচ পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুষ্ঠু সমাজ গঠনে তাদের ভূমিকাও অপরিসীম। তারা কেউ আমাদের মা, কেউ বোন, কেউ স্ত্রী, কেউ কন্যা। একশ্রেণীর বিপথগামী নারীদের কারণে নারীদের প্রতি আমাদের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হ’তে পারে না। সুতরাং পরিবার ও সমাজে নারীর যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে দৃষ্টির হেফাযতসহ তাদের প্রতি ইসলামের নির্দেশিত হক্বগুলো আদায় করতে হবে। পরিবার ও সমাজে এই আদর্শিক মূল্যবোধের চর্চা নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা শুধু আইন দিয়ে নারী নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব নয়।
পরিশেষে যুবসমাজের প্রতি আহবান থাকবে, একজন পুরুষ যদি নারীকে নিজের মা-বোনের আসনে রাখে, তবে তাদের প্রতি অসংগত বা অভব্য আচরণের কোন প্রশ্নই আসতে পারে না। সুতরাং নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধকে শক্তিশালী করুন। আল্লাহকে ভয় করুন। নিজের ব্যক্তিত্বের সুরক্ষা ও চারিত্রিক সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রাখতে চাইলে অবশ্যই নারীদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে। যদি তা না থাকে, তবে যেকোন সময় চারিত্রিক অধঃপতন নেমে আসবে। অতএব আসুন! নিজেরা সর্বোতভাবে পবিত্র থাকি এবং নিজেদের ব্যক্তিত্বে সুষহ চিন্তা ও ইসলামী মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাই। সেই সাথে সমাজকেও পবিত্র রাখার জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করি। প্রচলিত কিশোর গ্যাং কালচার, বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড কালচার, বখাটেপনা, ইভটিজিং, যেনা-ব্যভিচার ও পর্দাহীনতা প্রভৃতি সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চারকন্ঠ হই। এভাবে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যদি আমরা একটি সচেতন, জাগ্রত ও আল্লাহভীরু প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারি, তাহ’লে এসব অপরাধ সামাজিকভাবেই দমন হবে ইনশাআল্লাহ। সরকারের প্রতিও আমাদের আহবান থাকবে- কেবল ধর্ষণের বিরুদ্ধে কেতাবী আইন নয়; বরং বাস্তবতার ময়দানে এই জঘন্য পাপাচারের উৎসমুখগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং তা সমাধানের জন্য সর্বাত্মক ও বাস্তবমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন এবং আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে যাবতীয় অন্যায় ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে ইসলামের রূপরেখা মেনে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!