বর্তমান
বিশ্বের সামাজিক যোগাযোগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় মাধ্যম Facebook
(ফেসবুক)। এ ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কে এখন যুক্ত রয়েছে বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি
মানুষ। Facebook এখন বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত ওয়েবসাইট। যে Google ব্যতীত
ইন্টারনেট কল্পনা করা যেত না, বর্তমানে সেই Google-কে ছাড়িয়ে Facebook এখন
শীর্ষ স্থান অধিকার করেছে। যে হারে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে তাতে
করে আগামী ২০১৪ সালেই এ সংখ্যা হবে দ্বিগুণ, অর্থাৎ ২০০ কোটি। বর্তমানে
সবচেয়ে বেশী ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছে এশিয়া মহাদেশে। আর দেশ হিসাবে
ব্রাজিল হ’ল সবচেয়ে বেশী ফেসবুক ব্যবহারকারী দেশ।
Facebook (ফেসবুক)-এর জন্ম কথা :
মার্ক জুকারবার্গের হাতে জন্ম নেয় বহুল আলোচিত এই Facebook। তিনি ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর সমস্ত নির্দেশনা এবং কর্মকৌশল তিনিই প্রথম তৈরী করেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা পড়া করার সময় তিনি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় সহায়ক ‘কোর্সম্যাচ’ নামে একটি সফটওয়্যার তৈরী করেন। এরপর তৈরী করেন ‘ফেসম্যাশ’ নামে আরেকটি সফটওয়্যার। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের নাম, ঠিকানা, ছবি ও তাদের সাথে যোগাযোগের বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত একটি ওয়েবসাইট তৈরীর পরিকল্পনা করেন মার্ক জুকারবার্গ। এ পরিকল্পনা থেকেই তার হাতে জন্ম নেয় পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বৃহত্তম সামাজিক যোগাযোগের সাইট ‘ফেসবুক’। ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী হার্ভার্ডের ডরমেটরিতে The Facebook নামে এর যাত্রা শুরু হয়। ঐ সালের মাঝামাঝিতে ন্যাপস্টারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তা শেন পর্কারকে প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিযুক্ত করে এই সাইটের যাত্রা শুরু হয় এবং ঐ বছরের জুন মাসে ক্যালিফোর্নিয়ার পারো আলটোতে এর কার্যালয় স্থানান্তর করা হয়। পরের মাসেই পেপ্যালের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পিটার থিয়েল বিনিয়োগ করেন এই উদ্যোগে। ২০০৫ সালে The Facebook-এর ‘দ্য’ অংশটি বাদ দিয়ে সরাসরি Facebook নামে যাত্রা শুরু করে। ১৩ বছরের ঊর্ধ্বে সকলেই এটি ব্যবহার করতে পারবে। ফেসবুক যারা ব্যবহার করে তারা তাদের নিজস্ব প্রোফাইলে বিভিন্ন ধরনের ছবি, ভিডিও এবং যে কোন তথ্য দ্বারা নিজের ইচ্ছামত সাজাতে পারে এবং এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা তাদের বন্ধুদের সাথে চ্যাট, মেসেজ আদান-প্রদানও করতে পারে। এছাড়াও প্রত্যেকের প্রোফাইলে Wall আছে, যেখানে সবাই মন্তব্য প্রেরণ করতে পারে। মূলত এই Wall Posting হ’ল Public Conversation. এমনকি এক বন্ধু অপর বন্ধুকে আনফ্রেন্ড, ব্লক ইত্যাদি করতে পারেন।
যারা এই ফেসবুকে বেশী সময় অতিবাহিত করেন তাদের অধিকাংশই ব্যক্তিগত জীবনে অসুখী। সম্প্রতি ফেসবুক সম্পর্কে সুইডেনে পরিচালিত একটি সমীক্ষা থেকে এ তথ্য জানা গেছে। সমীক্ষা মতে, যারা ফেসবুকে বেশী সময় অতিবাহিত করে, তাদের প্রায় অধিকাংশই ব্যক্তিগত ও দাম্পত্য জীবনে অসুখী ও অতৃপ্ত। ব্যবহারকারীদের মধ্যে অধিকাংশ মেয়েদের স্বামী নেই। যাদের স্বামী আছে, তাদের স্বামী প্রবাসী অথবা স্বামীর প্রতি অতৃপ্ত কিংবা স্বামী স্বীয় স্ত্রীর জন্য কম সময় ব্যয় করে। আবার যে সকল নারী বিবাহবিচ্ছেদ যন্ত্রণায় জর্জরিত তারা একটি সুখের নীড় খুঁজে ফেরে। এই জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৮৫% ব্যক্তি জানায়, তারা প্রতিদিনের রুটিনে ফেসবুকের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় রাখে। সমীক্ষা থেকে আরো জানা যায়, তরুণ-তরুণীদের কাছে ফেসবুক প্রাত্যহিক অভ্যাস ও সময় অতিবাহিত করার একটি মাধ্যম মাত্র। অন্যদিকে প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য এটি পরস্পরিক তথ্য আদান-প্রদানের উত্তম মাধ্যম। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী অর্ধেক লোক জানায়, তারা ফেসবুক ছাড়া নিজেদেরকে কল্পনাও করতে পারে না। শতকরা ২৫ জনের মতামত, তারা নিয়মিত ফেসবুকে ‘লগ ইন’ করতে না পারলে অসুস্থবোধ করে। সমীক্ষায় আরো জানানো হয়, মহিলারা প্রতিদিন গড়ে ৮১ মিনিট এবং পুরুষরা ৬৪ মিনিট ফেসবুকে সময় ব্যয় করে। পুরুষদের এক-তৃতীয়াংশ জানায়, তারা ফেসবুকে অন্যকে বিরক্ত করে থাকে।
অপর একটি সমীক্ষা মতে, ৮০% ছেলে-মেয়েরা সুদর্শনদেরকে ফেসবুকের মাধ্যমে বিরক্ত করে থাকে, যদিও তাদের একাধিক ছেলে বা মেয়ে বন্ধু রয়েছে। এমনকি তারা যৌনাচার বিষয়ক কথোপকথনের মাধ্যমে অন্যকে মানসিকভাবে বিরক্ত ও উত্ত্যক্ত করে থাকে। আর ছেলেরা মেয়েদের ও মেয়েরা ছেলেদের বন্ধু করতে বেশী আগ্রহী এবং অবিবাহিতরা বিবাহিতদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে।
সমীক্ষার প্রতিবেদকদের মতে, সারা বিশ্বের মোট বিয়ে বিচ্ছেদের এক-তৃতীয়াংশ ঘটনার জন্য ফেসবুক দায়ী। সাম্প্রতিক ৫ হাযার বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন পর্যালোচনা করে বৃটিশ আইনি সংস্থা ও ডিভোর্স অনলাইন একথা জানিয়েছে। তাদের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, গত বছরে সংঘটিত সকল বিয়ে বিচ্ছেদের ৩০ শতাংশের বেশী কারণ হিসাবে ফেসবুককে দায়ী করেছেন। অথচ ২০০৯ সালে এ হার ছিল ২০ শতাংশ। আমেরিকান একাডেমী অব ম্যাট্রিমোনিয়াল লইয়ার্স-এর তথ্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের ৮০% অ্যাটর্নির মতে, সামাজিক নেটওয়ার্ক সংক্রান্ত বিয়ে বিচ্ছেদের হার অনেক বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে।
নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহারকারীদের সাথে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে মতবিনিময় করে জানা গেছে, তাদের অনেকেই ধর্মীয় ব্যাপারে আনুগত্য ও শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে ফেসবুকের উপকার ও অপকার সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায়, তাতে ফেসবুক ব্যবহারে উপকারের চেয়ে অপকারের হারটাই বেশী। নিম্নে ফেসবুকের উপকারিতা ও অপকারিতার কিছু দিক তুলে ধরা হ’ল।-
ফেসবুকের উপকারিতা :
উপকারিতা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর এবং IUCN-এর Country Director নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ফেসবুকের মাধ্যমে আমি আমার অবসর জীবনে সকল বন্ধুদের সাথে সক্রিয় যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি এবং আমার সকল সুখ-দুঃখ, এমনকি আমার স্বপ্নের কথাও তাদের সাথে প্রতিদিন শেয়ার করতে পারি। আর সে কারণে ফেসবুক আমার নিকটে উপকারী একটি মাধ্যম।
ফেসবুকের অপকারিতা :
পরিশেষে ফেসবুক যদিও একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। তথাপি নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রটির মত বলতে হয় ‘প্রত্যেকটি ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে’। অতএব একে পেশা বা নেশা হিসাবে গ্রহণ করা অনুচিত। শুধুমাত্র মতবিনিময়, যোগাযোগ রক্ষা, তথ্য আদান-প্রদান, ইসলাম প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রভূমি হিসাবে গ্রহণ করা উচিত। আল্লাহ্ আমাদের মনের সকল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত। তিনি আমাদেরকে সঠিক পথে চলার তাওফীক দিন- আমীন!
আবু নাফিয মুহাম্মাদ লিলবর আল-বারাদী
যশপুর, তানোর, রাজশাহী।