বিস্ময়করভাবে ইতিহাসের ঘটনাগুলো ফিরে আসে। আফগানিস্তানে যেন ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটল। আফগান ইতিহাস নির্মাণে গোত্রনেতাদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল। গোত্রপ্রাধান্য ভিত্তিক সমাজে এরাই আফগানিস্তানের ইতিহাসের বড় অংশের নির্মাতা। এদের সঙ্গে সমঝোতা করেই আশপাশের দেশগুলোকে আফগান নীতি প্রণয়ন করতে হয়। প্রাচীন যুগ থেকে এযাবত আফগান অঞ্চলের রাজনীতির গতিধারা শক্তিশালী গোত্রগুলোই নিয়ন্ত্রণ করেছে। এবারও সেই গোত্র ও ধর্মভিত্তিক সংগঠন তালেবানদের অস্তিত্ব স্বীকার করেই যুক্তরাষ্ট্রকে শান্তিচুক্তি করতে হ’ল।
যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের মধ্যকার শান্তিচুক্তিকে আফগানিস্তানের ইতিহাস দিয়েই মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। তাহ’লে ইতিহাসের পরম্পরায় বিস্ময়কর সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যাবে। আফগানিস্তান শব্দের অর্থ আফগানদের ভূমি। এই ভূমির ওপর দিয়ে অনেক শক্তিশালী বিজেতার আনাগোনা হয়েছে। আশপাশে অনেক শক্তিশালী সাম্রাজ্য ও শাসকের উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু এই ভূমি কখনই স্থানীয়দের হাতছাড়া হয়নি। কেউই নিরঙ্কুশভাবে আফগানদের করতলগত করতে পারেনি। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, সব সময় হামিদ কারজাইরা ছিল। হামিদ কারজাইরা সব সময়ই বিদেশী শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আফগানিস্তানকে শাসন করতে চেয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।
এই চুক্তি উভয় পক্ষই ঐতিহাসিক বলে অভিহিত করেছেন এবং নিজেদেরকে বিজয়ী দাবি করে শান্তির পথে একধাপ অগ্রগতি বলে মন্তব্য করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেণ্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তানে সব সন্ত্রাসীকে দমন করার তথ্য দিয়ে বলেছেন, তালেবানরা চুক্তি মেনে চলবে এবং সন্ত্রাসীদের আর জায়গা দেবে না। অন্যদিকে তালেবান মুখপাত্র মোহাম্মদ নাঈম বলেছেন, শান্তির পথে একধাপ অগ্রগতি হ’ল।
ঘুরী, খিলজী, মোগলেরা এই আফগানিস্তানের ওপর দিয়ে গিয়ে ভারত শাসন করেছে। কিন্তু আফগানদের পুরোপুরি বশীভূত করতে পারেনি। ভূপ্রকৃতির গঠন ও ভৌগোলিক অবস্থান এই অঞ্চলকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। ঐতিহাসিক গ্রেকো-পারসিয়ান যুদ্ধের পর দিগ্বিজয়ী গ্রীক বীর আলেকজান্ডার (খৃ. পূ. ৩৫৬-৩২৩) ঈসা (আঃ)-এর জন্মের ৩৩০ বছর আগে এই পথ ধরে ভারতের দিকে অগ্রসর হন। পরে আবার এই পথ দিয়ে ফিরেও যান বলে ঐতিহাসিকেরা বলে থাকেন। কিন্তু এখানে থিতু হওয়ার চেষ্টা করেননি। বর্তমান আফগানিস্তানকে একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসেন আহমাদ শাহ দুররানী ১৭৪৭ খৃষ্টাব্দে। এরপর অনেক বংশ ও শাসকের হাত ঘুরে আফগানিস্তান আজকের পর্যায়ে এসেছে। কিন্তু বাইরের কোনো শক্তি আফগানিস্তানকে বেশী দিন পদানত করে রাখতে পারেনি।
১৮৩৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রথমবারের মতো আফগানিস্তান দখলের চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিরোধের মুখে ১৮৪২ সালে কাবুল ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়। কাবুল ছেড়ে আসা ব্রিটিশদের জন্য ছিল এক বিপর্যয়কর ঘটনা। আফগান প্রতিরোধের অগ্রভাগে ছিল বিভিন্ন গোত্রের যোদ্ধারা। রাশিয়াপন্থী দোস্ত মোহাম্মদকে হটিয়ে ক্ষমতাচ্যুত শাহ সুজাকে পুনর্বহালের জন্য ব্রিটিশরা অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানের মুখে দোস্ত মোহাম্মদ পালিয়ে হিন্দুকুশ পর্বতমালায় গিয়ে আশ্রয় নেন। ১৮৪২ সালের দোস্ত মোহাম্মদের ছেলে ওয়াজির আকবর খান বিভিন্ন গোত্রকে সংগঠিত করে কাবুল হামলা করেন।
আকবর খানের হামলার মুখে ব্রিটিশরা এবার কাবুল ছেড়ে পালাতে শুরু করে। ১৮ হাযার ব্রিটিশ ও ভারতীয়র মধ্যে মাত্র একজন ফিরতে পেরেছিল বলে ঐতিহাসিক বিবরণগুলো থেকে জানা যায়। ব্রিটিশ কমান্ডার মেজর জেনারেল স্যার উইলিয়াম এলফিনস্টোনকেও হত্যা করে আফগানরা। ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশরা আবারও কাবুল হামলা করে। এই দফায় ব্রিটিশরা জয়ী হ’লেও পুরোপুরি বশে আনতে পারেনি। ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে ডুরান্ড লাইন সীমারেখা স্থাপন করতে বাধ্য হয় বিলেতের শাসকেরা, যা আর তারা লঙ্ঘন করেনি।
ব্রিটিশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মিল হচ্ছে উভয়ই রাশিয়ার প্রভাব খর্ব করতে নিজস্ব লোককে কাবুলের মসনদে বসাতে গিয়েছিল এবং উভয় দেশই রীতিমতো নাস্তানাবুদ হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। আবার রুশপন্থীদের উৎখাতের জন্য যুক্তরাষ্ট্র গত শতকের আশির দশকে তালেবানদের গড়ে তোলে। এই তালেবানদের সঙ্গেই আবার ২০০১ ও ২০০২ সালে যুদ্ধে জড়িয়েছে তারা একে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের তকমা দিয়ে। অবশেষে সামরিক ও নৈতিক, উভয় ক্ষেত্রেই মার্কিনরা শেষ পর্যন্ত তালেবানদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেনি। বিশ্বের সর্বাধুনিক সামরিক বাহিনীকে ১৯ শতকের ব্রিটিশ বাহিনীর মতোই পরাজয় বরণ করতে হ’ল।
তালেবানদের একসময় সন্ত্রাসী ঘোষণা করা হয়েছিল। তাদের নেতাদের অনেকেরই মাথার মূল্য ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে আফগানিস্তানের কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যুর পর সেই তালেবানদের পাশে বসেই এখন যুক্তরাষ্ট্রকে শান্তির ঘোষণা দিতে বাধ্য হচ্ছে।
শান্তি আলোচনার শুরু থেকেই তালেবানরা যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে রেখেছে। তালেবানরা ক্যাম্প ডেভিডে আলোচনায় বসতে চায়নি এবং কাবুলের সরকারকেও আলোচনায় নিতে চায়নি। আলোচনা চলাকালেই হামলা করে মার্কিন সেনাকে হত্যা করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প আলোচনাকে বাতিল ঘোষণা করেও আবার আলোচনা শুরু করেছেন। এখন আফগানিস্তানকে আবার তালেবানদের হাতেই সঁপে দিয়ে যাচ্ছে। কারণ, চুক্তি অনুসারে ১৪ মাসের মধ্যে ন্যাটোর সেনা প্রত্যাহার করা হ’লে কাবুলের বর্তমান সরকারকেও দেশ ছাড়তে হ’তে পারে। কারণ, এই চুক্তিতে স্পষ্ট করে বলা নেই, পরবর্তী সময়ে আফগানিস্তানের শাসন পদ্ধতি কেমন হবে। এই চুক্তিতে অনেক কিছুই খোলাসা করা হয়নি। বিশেষ করে নারী অধিকার, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, যে বিষয়গুলোর জন্য তালেবানরা বিশেষভাবে সমালোচিত ছিল। তবে শান্তিচুক্তি নিয়ে আফগানদের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। এই চুক্তির কারণে আফগানিস্তানে শান্তি ফিরে আসতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। তবে ন্যাটো বাহিনীর পুরোপুরি প্রত্যাহার চান না কেউ কেউ।
আল-জাযীরার বিশ্লেষক মারওয়ান বিসরা এই চুক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সফল পরাজয়’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
এত কিছুর পরও যুক্তরাষ্ট্র তালেবানকে এতটা ছাড় দিচ্ছে কেন? সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে। হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান, সৌদি আরব ও ইসরায়েলকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র আরও বড়সড় কোন পরিকল্পনা করছে। কিন্তু ভিয়েতনাম, ইরাকের পর আরও একটি যুদ্ধে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর আরও একটি পরাজয় ঘটল আদিবাসী, দরিদ্র ও পশ্চিমের ভাষায় অশিক্ষিত মৌলবাদীদের কাছে। মার্কিনীদের যতই ভিন্ন ও বড় পরিকল্পনা থাকুক না কেন, দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে শেষ মার্কিন হেলিকপ্টার উড়াল দেওয়ার মতো অপমানজনক দৃশ্য তারা আফগানিস্তানে কিভাবে এড়ায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।