মসুর আমাদের দেশের একটি বহুল পরিচিত শস্য। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ শস্য আবাদ হয়ে থাকে। এ শস্যের চাষাবাদ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হ’ল।-

পুষ্টি মূল্য ও ব্যবহার : মসুর ডালে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য শক্তি ও প্রোটিন আছে। ডাল হিসাবে প্রধানত খাওয়া হয়। এছাড়াও পিয়াজু বা বিভিন্ন মুখরোচক খাবারে ব্যবহৃত হয়।

উপযুক্ত জমি ও মাটি : সুনিষ্কাশিত বেলে দো-আঁশ মাটি মসুর চাষের জন্য উপযোগী।

বপনের সময় : অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ (কার্তিক মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত) বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।

জাত পরিচিতি :

বারি মসুর-১ : গাছের আকৃতি মধ্যম এবং উপরিভাগের ডগা বেশ সতেজ। গাছের পাতা গাঢ় সবুজ। কান্ড হালকা সবুজ। ফুলের রং সাদা। বারি মসুর-১ জাতটির বীজের আকার স্থানীয় জাতসমূহের চেয়ে একটু বড়। হাযার বীজের ওযন ১৫-১৬ গ্রাম। ডাল রান্না হওয়ার সময়কাল ১০-১২ মিনিট। আমিষের পরিমাণ ২৬-২৮%। এ জাতের জীবনকাল ১০৫-১১০ দিন। হেক্টরপ্রতি ফলন ১.৭-১.৮ টন।

বারি মসুর-২ : গাছের আকার মধ্যম। গাছের উপরিভাগ সামান্য লতানো হয়। পাতায় সরু আকর্ষী থাকে। গাছের পাতা গাঢ় সবুজ। কান্ড হালকা সবুজ ও ফুল সাদা। হাযার বীজের ওযন ১২-১৩ গ্রাম। ডাল রান্না হওয়ার সময়কাল ১৪-১৬ মিনিট। আমিষের পরিমাণ ২৭-২৯%। জাতটির জীবনকাল ১০৫-১১০ দিন। হেক্টরপ্রতি ফলন ১.৫-১.৭ টন।

বারি মসুর-৩ : মসুর-৩ জাতটি একটি শংকর জাত। পাতার রং সবুজ। বীজের রং ধূসর এবং বীজে ছোট ছোট কালচে দাগ আছে। বীজের আকার স্থানীয় জাত অপেক্ষা বড়। হাযার বীজের গড় ওযন ২২-২৫ গ্রাম। ডাল রান্না হওয়ার সময়কাল ১০-১২ মিনিট। আমিষের পরিমাণ ২৪-২৬%। জাতটির জীবনকাল ১০০-১০৫ দিন। ফলন হেক্টরপ্রতি ১.৫-১.৭ টন।

বারি মসুর-৪ : গাছের রং হালকা সবুজ। পত্রফলক আকারে বড় এবং পাতার শীর্ষে আকর্ষী আছে। ফুলের রং বেগুনি। বীজের আকার স্থানীয় জাত হ’তে বড় ও চেপ্টা ধরনের। বীজের রং লালচে বাদামী। হাযার বীজের ওযন ১৮-২০ গ্রাম। এ জাতটি মরিচা ও স্টেমফাইলিয়াম ব্লাইট রোগ প্রতিরোধী। ডাল রান্না হওয়ার সময়কাল ১১-১৩ মিনিট। আমিষের পরিমাণ ২৪-২৬%। জাতটির জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন। ফলন হেক্টরপ্রতি ১.৬-১.৭ টন।

বীজ বপন : ছিটিয়ে অথবা সারি করে বীজ বপন করা যায়। সারিতে বপনের ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সে.মি. রাখতে হবে। বীজের পরিমাণ প্রতি হেক্টরে ৩০-৩৫ কেজি। ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে বীজের পরিমাণ সামান্য বেশী দিতে হবে। তবে বারি মসুর-৩ এর বেলায় হেক্টরপ্রতি ৩৫-৪০ কেজি বীজ ব্যবহার করতে হবে।

সার ব্যবস্থাপনা : জমিতে শেষ চাষের সময় হেক্টরপ্রতি নিম্নরূপ সার ব্যবহার করতে হবে। হেক্টর প্রতি ইউরিয়া ৪০-৫০ কেজি, টিএসপি ৮০-৯০ কেজি, এমওপি ৩০-৪০ কেজি।

অণুজীব সার সুপারিশ মত। সমুদয় সার শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে। যে জমিতে আগে মসুর চাষ করা হয়নি সেখানে প্রতি কেজি বীজের জন্য ৯০ গ্রাম হারে অনুমোদিত অণুজীব সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। ইনোকুলাম ব্যবহার করলে সাধারণতঃ ইউরিয়া সার ব্যবহার করতে হয় না।

সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা : বপনের ৩০-৩৫ দিনের মধ্যে নিড়ানি দিয়ে একবার আগাছা দমন করা প্রয়োজন। অতিবৃষ্টির ফলে জমিতে যাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয় সেজন্য পানি বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

রোগ ব্যবস্থাপনা :

গোড়া পচা রোগ : এ রোগে গাছ আক্রান্ত হ’লে পাতা ক্রমান্বয়ে হলদে রং ধারণ করে। আক্রান্ত গাছ ঢলে পড়ে ও শুকিয়ে যায়। মাটি ভিজা থাকলে গাছের গোড়ায় ছত্রাকের সাদা মাইসেলিয়াম ও সরিষার দানার ন্যায় স্কেলেরোসিয়াম গুটি দেখা যায়। এ জীবাণু গাছের অবশিষ্টাংশে, বিকল্প পোষক ও মাটিতে বেঁচে থাকে এবং পরবর্তী বছরে ফসল আক্রমণ করে। ভিজা স্যঁাতস্যাঁতে মাটি রোগ বিস্তারে সহায়ক।

ব্যবস্থাপনা : ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। অধিক পরিমাণে পচা জৈব সার ব্যবহার করতে হবে। ভিটাভেক্স-২০০ প্রতি কেজি বীজে ২.৫-৩.০ গ্রাম (০.২৫%) মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।

মরিচা রোগ : আক্রান্ত গাছের পাতায় বিভিন্ন আকৃতির ছোট ছোট মরিচা রংয়ের গুটি দেখা যায়। পরবর্তীতে তা গাঢ় বাদামী ও কালো রং ধারণ করে। কান্ডেও এ রকম লক্ষণ দেখা যায়। আর্দ্র আবহাওয়ায় এ রোগের প্রকোপ বেশী হয়।

ব্যবস্থাপনা : ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগ প্রতিরোধী জাত যেমন বারি মসুর-৩ ও বারি মসুর-৪ চাষ করতে হবে। টিল্ট-২৫০ ইসি (০.০৪%) ১২-১৫ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

স্টেমফাইলাম ব্লাইট রোগ : আক্রান্ত গাছের পাতায় সাদা ছত্রাকের জালিকা দেখা যায়। দূর থেকে আক্রান্ত ফসল আগুনে ঝলসানো মনে হয়। আক্রমণের শেষ পর্যায়ে গাছ কালচে বাদামী রং ধারণ করে। ভোর বেলায় পাতা এবং কান্ডে এক ধরনের সাদা ছত্রাক জালিকার উপস্থিতি দ্বারা সহজেই স্টেমফাইলাম ব্লাইট রোগ শনাক্ত করা যায়। বীজ, বিকল্প-শোষক, বায়ু প্রভৃতির মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে।

ব্যবস্থাপনা : ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আক্রমণ দেখা দেওয়া মাত্র রোভরাল-৫০ ডব্লিউপি নামক ছত্রাকনাশক (০.২%) ১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

ফসল তোলা : মধ্য-ফাল্গুন থেকে মধ্য-চৈত্র (মার্চ) মাসে ফসল সংগ্রহ করা যায়।

গুদামজাত ডালের পোকা ব্যবস্থাপনা : পূর্ণবয়স্ক পোকা ও কীড়া উভয়ই গুদামজাত ডালের ক্ষতি করে থাকে। এ পোকা ডালের খোসা ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে শাঁস খেতে থাকে। ফলে দানা হাল্কা হয়ে যায়। এর ফলে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় এবং খাওয়ার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে।

ব্যবস্থাপনা : গুদামজাত করার আগে দানা ভালভাবে পরিষ্কার করতে হয়। ডালের দানা শুকিয়ে পানির পরিমাণ ১২%-এর নিচে আনতে হবে। বীজের জন্য টন প্রতি ৩০০ গ্রাম ম্যালাথিয়ন বা সেভিন ১০% গুড়া মিশিয়ে পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। ফসটক্সিন ট্যাবলেট ২টি বড়ি প্রতি ১০০ কেজি গুদামজাত ডালে ব্যবহার করতে হয়। এ বড়ি আবদ্ধ পরিবেশে ব্যবহার করতে হয়।

বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি : বীজ ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে আর্দ্রতার পরিমাণ আনুমানিক ১০%-এর নীচে রাখতে হবে। তারপর টিনের পাত্র ও পলিথিনসহ চটের ব্যাগ অথবা আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া মাটির পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে।

\ সংকলিত \






আরও
আরও
.