নবী করীম (ছাঃ)-এর সাহচর্য ও শিক্ষা লাভের মাধ্যমে ছাহাবীগণ হয়ে উঠেছিলেন নির্ভীক বীর সেনানীরূপে। লক্ষ্য ছিল তাদের জান্নাত, ব্রত ছিল ইসলামের বিজয় লাভ। ফলে অদম্য ঈমানী চেতনা নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে শত্রুদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। ছিনিয়ে আনতেন ইসলামের বিজয়। নিম্নোক্ত হাদীছে ছাহাবীদের বীরত্বের নমুনা ফুটে উঠেছে।-

ইয়াস ইবনু সালামা (রাঃ) সূত্রে তাঁর পিতা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে হুদায়বিয়ায় পৌঁছলাম। তখন সংখ্যায় আমরা চৌদ্দশ’। তদুপরি সেখানে ছিল পঞ্চাশটি বকরী, যাদের পানি পানের জন্য পর্যাপ্ত পানি ছিল না। রাবী বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কুয়ার কিনারায় বসলেন এবং দো‘আ করলেন অথবা তাতে থুথু দিলেন। রাবী বলেন, আর অমনি পানি উথ্‌লে উঠল। তখন আমরাও পানি পান করলাম এবং (পশুদেরকেও) পানি পান করালাম।

রাবী বলেন, তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের বায়‘আতের জন্য গাছতলায় ডাকলেন। রাবী বলেন, লোকদের মধ্যে আমি সর্বাগ্রে বায়‘আত করলাম। তারপর একে একে অন্যান্য লোকেরাও বায়‘আত করল। তিনি যখন বায়‘আত গ্রহণ করতে করতে লোকজনের মধ্যবর্তী স্থানে (অর্থাৎ অর্ধ পরিমাণে) পৌঁছলেন, তখন বললেন, হে সালামা! তুমি বায়‘আত হও। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! লোকদের মধ্যে প্রথমেই আমি বায়‘আত হয়েছি তিনি বললেন, আবারও হও! রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে অস্ত্রহীন অবস্থায় দেখতে পেলেন। তাই তিনি আমাকে একটি ‘হাজাফাহ’ বা ‘দারাক্বাহ’ (ঢাল) দান করলেন।

অতঃপর যখন তিনি বায়‘আত করতে করতে লোকদের শেষ প্রান্তে পৌঁছলেন তখন আবার বললেন, তুমি কি আমার কাছে বায়‘আত হবে না হে সালামা? রাবী বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তো লোকদের মধ্যে প্রথমভাগে এবং মধ্যভাগে (দু’ দু’বার) আপনার কাছে বায়‘আত করেছি। তিনি বললেন, আবারও হও! তখন আমি তৃতীয়বার বায়‘আত হ’লাম। এরপর তিনি আমাকে বললেন, হে সালামা! তোমার সেই ঢালটি কোথায়, যা আমি তোমাকে দিয়েছিলাম? রাবী (সালামা) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার চাচা আমিরের সাথে অস্ত্রবিহীন অবস্থায় আমার দেখা হ’লে আমি তাকে তা দিয়ে দিয়েছি। রাবী বলেন, এতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হেসে দিলেন এবং বললেন, তুমি দেখছি পূর্ববর্তীযুগের সেই লোকদের মত, যে বলেছিল, হে আল্লাহ‌! আমি এমন একজন বন্ধু চাই, যে আমার প্রাণের চাইতেও আমার নিকট অধিক প্রিয় হবে।

এরপরে মুশরিকরা আমাদের কাছে প্রস্তাব পাঠাল। আমাদের এক পক্ষের লোকজন অন্যপক্ষের শিবিরে যাতায়াত করতে লাগল এবং শেষ পর্যন্ত আমরা উভয় পক্ষ পরস্পরে সন্ধিবদ্ধ হ’লাম। রাবী [সালামা (রাঃ)] বলেন, আমি তালহা ইবনু ওবায়দুল্লাহর খেদমতে নিয়োজিত ছিলাম। আমি তাঁর ঘোড়াকে পানি পান করাতাম এবং তাঁর পিঠ মালিশ করতাম (আঁছড়ে দিতাম) এবং তাঁর অন্যান্য খিদমত করতাম। আমি তার ওখানে খাওয়া-দাওয়া করতাম। নিজের পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ পরিত্যাগ করে আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের রাহে মুহাজির হয়েছিলাম। রাবী বলেন, তারপর যখন আমরা ও মক্কাবাসীরা সন্ধিতে আবদ্ধ হ’লাম এবং আমাদের এক পক্ষ অপর পক্ষের সাথে মেলামেশা করতে লাগলাম তখন আমি একটি গাছতলায় গিয়ে তাঁর নিচের কাঁটা প্রভৃতি পরিষ্কার করে তার গোঁড়ায় একটু শুয়ে পড়লাম। এমন সময় মক্কাবাসী চারজন মুশরিক এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সম্পর্কে অপ্রীতিকর কথা বলতে লাগল।

আমার কাছে ওদের কথাবার্তা অত্যন্ত খারাপ লাগল এবং আমি স্থান পরিবর্তন করে আর একটি গাছের তলায় চলে গেলাম। তারা তাদের অস্ত্র গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখে শুয়ে পড়ল। এমন সময় প্রান্তরের নিম্নাঞ্চল থেকে কে যেন চিৎকার করে বলল, হে মুহাজিরগণ! সাহায্য! ... ইবনু যুনায়ম নিহত হয়েছে। আমি তৎক্ষণাৎ আমার তরবারী উঠিয়ে ধরলাম এবং ঐ চারজনের উপর আক্রমণ চালালাম। তখন তারা ঘুমিয়ে ছিল। আমি তাদের অস্ত্রগুলি হস্তগত করলাম এবং তা আটি বেঁধে আমার হাতে নিলাম। তিনি বলেন, এরপর আমি বললাম, যে মহান সত্তা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সম্মানিত করেছেন তাঁর কসম! তোমাদের মধ্যে কেউ যদি মাথা তুলে, তবে তাঁর সেই অঙ্গে আঘাত (করে বিচ্ছিন্ন) করব যেখানে তাঁর চোখ দু’টি রয়েছে (অর্থাৎ ঘাড়ে)।

রাবী বলেন, তারপর তাদেরকে আমি হাঁকিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। তিনি বলেন, এমন সময় আমার চাচা আমির ‘আবালাত’ গোত্রের একজনকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট নিয়ে এসেছেন। তাকে বলা হ’ত মিকরায। সে ছিল আঘাত নিরোধক বস্ত্রাকৃত একটি ঘোড়ায় আসীন। আর তাঁর সাথে সত্তরজন মুশরিক। রাসূলুল্লাহ  (ছাঃ) তাদের দিকে তাকালেন এবং বললেন, ‘ওদেরকে ছেড়ে দাও, যাতে অপকর্মের সূচনা ওদের পক্ষ থেকেই হয় এবং পুনরাবৃত্তিও তারাই করে’ একথা বলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ক্ষমা করে দিলেন। তখন আল্লাহ্‌ তা‘আলা নাযিল করলেন, ‘সেই পবিত্র সত্তা যিনি মক্কা প্রান্তরে তাদের হাতকে তোমাদের উপর থেকে এবং তোমাদের হাতকে তাদের উপর থেকে বিরত রেখেছেন তাদের উপর তোমাদের বিজয়ী করার পর’।

রাবী বলেন, তারপর মদীনায় প্রত্যাবর্তনের জন্য বেরিয়ে পড়লাম। পথে এমন একটি স্থানে আমরা অবতরণ করলাম যেখানে আমাদের ও লাহয়ান গোত্রের মধ্যে কেবল একটি পাহাড়ের ব্যবধান ছিল। আর তারা ছিল মুশরিক। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেই ব্যক্তির জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করলেন, যে ব্যক্তি রাতে নবী করীম (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের পক্ষ থেকে খবরদারীর জন্য পাহাড়ের উপরে আরোহণ করবে। সালামা বলেন, সে রাতে আমি দুই কি তিনবার ঐ পাহাড়ে আরোহণ করেছিলাম। তারপর আমরা মদীনায় এলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর গোলাম রাবাহকে দিয়ে তাঁর উটগুলি পাঠালেন। আর আমিও তালহা (রাঃ) এর ঘোড়ায় চড়ে তাঁর সাথে সাথে উটগুলি চারণভূমির দিকে নিয়ে গেলাম সেগুলোকে ঘাস-পানি খাওয়ানোর জন্য। যখন আমাদের ভোর হ’ল, আবদুর রহমান ফাযারী চড়াও হয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর (বিচরণকৃত) সমস্ত উট ছিনিয়ে নিয়ে গেল এবং তাঁর রাখালকে হত্যা করল। আমি তখন রাবাহকে বললাম, হে রাবাহ! লও এই ঘোড়া নিয়ে তুমি তালহা ইবনু ওবায়দুল্লাহকে পৌঁছে দিও আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সংবাদ দাও যে, মুশরিকেরা তাঁর চারণভূমির উটগুলো লুটে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, তখন আমি একটি টিলার উপর দাঁড়ালাম। তারপর মদীনার দিকে মুখ করে তিনবার হাক দিলাম, ইয়া ছাবাহা! (ভোরের আক্রমণ)

তারপর আমি লুটেরাদের পিছু ধাওয়া করলাম এবং তাদের উপর তীর নিক্ষেপ করতে লাগলাম। আর আমি মুখে এই বাক্য উচ্চারণ করছিলাম, ‘আমি আকওয়ার পুত্র, আজ সেই দিন, আজ ইতরকে (শায়েস্তা করার) দিন। আজকে কেমন মায়ের দুধ (খেয়েছ তা স্মরণের দিন)’। তখন আমি তাদের যে কাউকে পেয়েছি, তাঁর উপর এরকমভাবে তীর নিক্ষেপ করেছি যে, তীরের অগ্রভাগ তাঁর কাঁধের কোমল হাড় ছেদ করে বেরিয়েছে। তিনি বলেন, আমি বলতে লাগলাম, এ আঘাত নাও, আমি আকওয়ার পুত্র, আজ ইতরের দিন (দুধপান স্মরণের দিন)। তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! আমি তীর নিক্ষেপ করতে থাকলাম এবং ঘায়েল করতে লাগলাম এবং যখনই কোন ঘোড় সওয়ার আমার দিকে ফিরত তখনই আমি গাছের আড়ালে এসে তাঁর গোঁড়ায় বসে তাঁর প্রতি তীর নিক্ষেপ করতাম আর তাকে জখম করে ফেলতাম।

অবশেষে যখন তারা পাহাড়ের সংকীর্ণ পথে পৌঁছল এবং তারা সে সংকীর্ণ পথে ঢোকে পড়ল, আমি তখন পাহাড়ের উপরে উঠে সেখান থেকে (অবিরাম) তাদের উপর পাথর গড়িয়ে দিতে লাগলাম। তিনি বলেন, এভাবে আমি তাদের পশ্চাদ্ধাবন করতে থাকলাম যে পর্যন্ত না আল্লাহর সৃষ্ট উটগুলোর প্রতিটি উট যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ভারবাহী রূপে ছিল তা আমার পিছনে রেখে না যাই। অবশেষে তারা এগুলি আমার আওতায় ফেলে চলে গেল। তারপরও আমি তাদের অনুসরণ করে তাদের দিকে তীর নিক্ষেপ করতে থাকলাম। এমনকি তারা ত্রিশটির বেশি চাঁদর এবং ত্রিশটি বল্লম নিজেদের বোঝা হালকা করার উদ্দেশ্য ফেলে গেল। তারা যেসব বস্তু ফেলে যাচ্ছিল আমি তাঁর প্রত্যেকটিকে পাথর দিয়ে চিহ্নিত করে যাচ্ছিলাম, যাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ তা চিনতে পারেন।

অবশেষে তারা পাহাড়ের একটি সংকীর্ণ স্থানে গিয়ে পৌঁছল। এমন সময় বদর ফাযারীর অমুক পুত্র এসে তাদের সাথে মিলিত হ’ল। এবার তারা সকলে মিলে সকালের খাবার খেতে বসল। আমি পাহাড়ের একটি শৃঙ্গে বসে পড়লাম। তখন সে ফাযারী বলল, ঐ যে লোকটাকে দেখছি সে কে? তারা বলল, লোকটির হাতে আমরা অনেক দুর্ভোগ পোহায়েছি। আল্লাহর কসম! সেই রাতের আধার থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত লোকটা আমাদের পিছন থেকে সরছে না, সে আমাদের প্রতি (অবিরাম) তীর নিক্ষেপ করেছে, এমনকি আমাদের যথাসর্বস্ব সে কেড়ে নিয়েছে। তখন সে বলল, তোমাদের মধ্যকার চারজন উঠে গিয়ে তাঁর উপর চড়াও হও। তখন তাদের চার ব্যক্তি পাহাড়ে উঠে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তারপর তারা যখন আমার কথা শোনার মত নিকটবর্তী স্থানে এসে পৌঁছল, তখন আমি বললাম, তোমরা কি আমাকে চেন? তারা বলল, না। তিনি বলেন, আমি বললাম, আমি সালামা ইবনু আকওয়া। কসম সেই পবিত্র সত্তার! যিনি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সম্মানিত করেছেন। আমি তোমাদের যাকেই পেতে চাইব (লক্ষ্য বানাব) তাকে ধরে ফেলব। কিন্তু তোমাদের কেউ চাইলেই আমাকে ধরতে পারবে না।

তখন তাদের একজন বলল, আমিও তাই মনে করি। তিনি বলেন, তারপর তারা ফিরে গেল। আর আমি সেই স্থানেই বসে রইলাম। অবশেষে আমি গাছ-গাছালির মাঝ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অশ্বারোহীদের অগ্রসর হ’তে দেখলাম। তিনি বলেন, তাদের মধ্যে সবার আগে ছিলেন আখারাম আসাদী। তাঁর পিছনে আবূ কাতাদা আনছারী। তাঁর পিছনে মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ কিন্দী। তিনি বলেন, আমি তখন আখরামের ঘোড়ার লাগাম ধরলাম। তিনি বলেন, তখন তারা (শত্রুরা) পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালিয়ে গেল। আমি বললাম, হে আখরাম! ওদের থেকে সতর্ক থাকবে। তারা যেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ এসে মিলিত হওয়ার পূর্বেই তোমাদের বিচ্ছিন্ন করে না ফেলে। আখারাম বললেন, যে সালামা! তুমি যদি আল্লাহ্‌ ও ক্বিয়ামত দিনের প্রতি বিশ্বাসী হও এবং জান্নাত ও জাহান্নামকে সত্য মনে কর তবে আমার এবং শাহাদতের মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টি করো না। সালামা বলেন, তখন আমি তাঁর পথ ছেড়ে দিলাম।

তখন তিনি আব্দুর রহমানের সাথে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হ’লেন। আখরাম আব্দুর রহমানের ঘোড়াকে আহত করলেন, আর আব্দুর রহমান বর্শার আঘাতে তাকে কতল করে দিল এবং আখরামের ঘোড়ার উপর চড়ে বসল। ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ঘোড় সাওয়ার আবূ কাতাদা (রাঃ) এসে পৌঁছলেন। তিনি আব্দুর রহমানকে বর্শার আঘাতে হত্যা করলেন। সেই পবিত্র সত্তার কসম! যিনি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে মর্যাদা মন্ডিত করেছেন, আমি তখন এতই দ্রুতগতিতে তাদের পিছু ধাওয়া করে যাচ্ছিলাম যে, আর পিছনে (অনেক দূর পর্যন্ত) মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর কোন ছাহাবীকেই দেখতে পেলাম না, এমনকি তাদের ঘোড়ার খুরের ধুলিও আমার দৃষ্টিগোচর হ’ল না। এভাবে চলতে চলতে সূর্যাস্তের প্রাক্কালে তারা এমন একটি গিরি পথে উপনীত হ’ল যেখানে যু-কারাদ নামক একটি প্রস্রবণ রয়েছে। অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত অবস্থায় তারা পানি পান করতে অবতরণ করল। তখন তারা আমাকে তাদের পিছু ধাওয়া করে দৌড়ে আসতে দেখতে পেল। এক জায়গায় পানি পান করার পূর্বেই আমি সেখান থেকে তাদেরকে তাড়িয়ে দিলাম। তখন তারা পাহাড়ের একটি ঢালু উপত্যকার দিকে দৌড়াতে লাগল আর আমিও তাদের পিছু ধাওয়া করতে লাগলাম।

আমি তাদের যে কোন একজনের নিকটবর্তী হলে তাঁর কাঁধের অস্তিতে তীর নিক্ষেপ করে বললাম, আমি আকওয়ার পুত্র, ইতরদের (বোঝাবার) দিন আজ (দুধপান স্মরণের দিন)। সে তখন বলল, তাঁর মা (পুত্রহারা হয়ে) তাঁর জন্য কাঁদুক। তুমি কি সে আকওয়া যে আমাদের সেই ভোর থেকে অতিষ্ঠ করে রেখেছ? আমি বললাম হ্যাঁ, তোমার জানের দুশমন, (আমি) সেই তোমার ভোরবেলার আকওয়াই। তিনি বলেন, অতঃপর তারা দু’টি ক্লান্ত ঘোড়া উপত্যকায় ছেড়ে চলে গেল। তিনি বলেন, তখন আমি ঐ দু’টোকে হাকিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট নিয়ে এলাম। তিনি বলেন, সেখানে একটি অল্প দুধ ভর্তি ‘সাতীহা’ (চামড়ার তৈরি পাত্র) এবং একটি পানি ভর্তি সাতীহা নিয়ে এসে আমির আমার সাথে মিলিত হ’লেন। আমি তখন ওযূ করলাম এবং (দুধ) পান করলাম। তারপর এমন অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে এলাম যখন তিনি ঐ পানির কাছে ছিলেন, যা থেকে আমি ওদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম।

এদিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঐ সমস্ত উট ও মুশরিকদের নিকট থেকে আমার ছিনিয়ে আনা সবকিছু বর্শা ও চাঁদর প্রভৃতি হস্তগত করেছেন। তখন বিলাল, লোকদের কাছে থেকে আমার উদ্ধারকৃত একটি উট যবেহ করেছেন এবং তাঁর কলিজা ও কুজ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য ভুনা করছিলেন। তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে সুযোগ দিন, আমি আমাদের লোকদের থেকে একশ’ জনকে বাছাই করে নিয়ে সেই দুশমনদের পিছু ধাওয়া করি যাতে তাদের সকলকে এমনভাবে হত্যা করব যে, তাদের খবর বয়ে নিয়ে যাওয়ার মত একটি লোকও অবশিষ্ট থাকবে না। তিনি বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এমনভাবে হাসলেন যে, চুলার আগুনের আভায় তাঁর চোয়ালের দাঁতগুলি প্রকাশ পেল। এরপর রাসূলুল্লাহ  (ছাঃ) বললেন, হে সালামা! তুমি কি মনে কর যে, তুমি তা-ই করবে? আমি বললাম, হ্যঁা সেই পবিত্র সত্তার শপথ! যিনি আপনাকে সম্মানিত করেছেন। নবী  করীম (ছাঃ) তখন বললেন, এতক্ষণে তো তারা গাতফান পল্লীতে আতিথ্য ভোগ করছে।

তিনি বলেন, পরে গাতফান গোত্রের একটি লোক এসে বলল, অমুক তাদের জন্য একটি উট যবেহ করেছে। তারা যখন তাঁর চামড়া ছড়াচ্ছিল তখন তারা ধুলোরাশি উড়তে দেখতে পায়। তখন তারা বলে উঠল ওরা (আকওয়া ও তাঁর বাহিনী) তোমাদের নিকট এসে পড়েছে। তখন তারা পালিয়ে যায়। এরপর আমাদের ভোর হ’ল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমাদের আজকের সেরা অশ্বারোহী হচ্ছে আবূ কাতাদা আর আমাদের সেরা পদাতিক হচ্ছে সালামা। তিনি বলেন, তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে অশ্বারোহী ও পদাতিক হিসাবে গণীমতের দুই অংশ দিলেন। আমাকে তিনি একত্রে দুই অংশ দিলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের মদীনায় প্রত্যাবর্তনকালে আমাকে তাঁর সাথে তাঁর উটনী ‘আযবার’ পিছনে বসিয়ে নিলেন। তিনি বলেন, তারপর যখন আমরা পথ অতিক্রম করছিলাম, এমন সময় আনছারের এমন এক ব্যক্তি, যাকে দৌড়ে কেউ পরাজিত করতে পারত না, সে বলতে লাগল, কেউ কি আছে যে, মদীনায় সর্বপ্রথম পেঁŠছার ব্যাপারে প্রতিযোগিতা করবে? এ কথাটি সে বারবার বলছিল। তিনি বলেন, যখন আমি তাঁর এ (চ্যালেঞ্জমূলক) কথাটি শুনলাম, তখন বললাম, তুমি কি কোন সম্মানিত লোককে সম্মান দিতে জান না বা কোন ভদ্রলোককেই পরোয়া করবে না? সে বলল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত অন্য কাউকে নয়। তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতা-মাতা আপনার উপর কোরবান, আপনি আমাকে তার সাথে প্রতিযোগিতা করার অনুমতি দিন। তিনি বললেন, তোমার ইচ্ছা হ’লে।

রাবী বলেন, তখন আমি বললাম, চল! তারপর আমি লাফ দিয়ে নীচে নেমে দৌড় দিলাম। তারপর এক বা দুই টিলা অতিক্রম করার দূরত্বে রইলাম তখন পর্যন্ত আমার দম নিয়ন্ত্রণে রেখে তাঁর পিছু পিছু দৌড় দিলাম। আরও দুই এক টিলা পর্যন্ত ধীর গতিতে চলার পর সাজোরে দৌড় দিয়ে তাঁর নিকটে পৌঁছে গেলাম এবং তাঁর কাঁধের মধ্যবর্তী স্থানে একটি ঘুষি মেরে বললাম, ওহে! আল্লাহর কসম! তুমি হেরে গেছ। তখন সে বলল, আমিও তাই মনে করছি। তিনি বলেন, অতএব আমি তাঁর পূর্বেই মদীনায় পৌঁছে গেলাম।

তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! এরপর আমরা তিন রাতের অধিক মদীনায় থাকতে পারিনি। এমনি সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে আমরা খায়বারের দিকে বেরিয়ে পড়লাম। তিনি বলেন, তখন আমার চাচা আমির (রাঃ) প্রেরণামূলক কবিতা আবৃতি করতে লাগলেন। আল্লাহর কসম! আল্লাহর অনুগ্রহ না হ’লে আমরা হিদায়াত পেতাম না, ছাদাকাও দিতাম না আর ছালাতও আদায় করতাম না। আমরা আপনার অনুগ্রহ থেকে কখনও বেপরওয়া হ’তে পারি না, তাই আপনি আমাদের কদম দৃঢ় রাখুন, যখন আমরা শত্রুদের সম্মুখীন হই এবং আপনি আমাদের প্রতি প্রশান্তি বর্ষণ করুন।

তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এ ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, আমি আমির। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমার রব তোমাকে ক্ষমা করুন। রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কারো জন্য বিশেষভাবে দো‘আ করতেন সে শহীদ হ’ত। তিনি বলেন, তখন নিজ উটে বসা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) দূর থেকে আওয়াজ করে বললেন, ইয়া নবী আল্লাহ্‌! আমিরকে দিয়ে যদি না আমাদের আরো উপকার করতেন? তিনি বলেন, তারপর যখন আমরা খায়বারে উপস্থিত হ’লাম, তখন খায়বার অধিপতি মুরাহহাব (মারহাব) তরবারি দোলাতে দোলাতে বেরিয়ে এল এবং বলল, খায়বার জানে যে, আমি মুরাহহাব, পূর্ণ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, অভিজ্ঞতাপূর্ণ এক বীরপুরুষ। রাবী বলেন, আমার চাচা আমির (রাঃ) কবিতা আবৃতি করতে করতে বললেন, ‘খায়বার জানে যে, আমি আমির অস্ত্রে শস্ত্রে সুসজ্জিত যুদ্ধে অবতীর্ণ বীর বাহাদুর নির্ভীক ব্যক্তি।

রাবী বলেন, তারপর তাদের মধ্যে আঘাত বিনিময় হ’ল। আমির (রাঃ) নীচে থেকে যখন তাকে আঘাত করতে চাইলেন, তখন তা ফিরে এসে তাঁর নিজের উপরই লাগল। আর তাতে তাঁর পায়ের গোছার সংযোগ শিরা কেটে গিয়ে মৃত্যু হ’ল। (রাবী) সালামা (রাঃ) বলেন, তখন আমি বের হ’লাম। নবী করীম (ছাঃ)-এর কয়েকজন ছাহাবীকে বলাবলি করতে শুনলাম যে, আমিরের আমল বরবাদ হয়ে গেছে, সে আত্মহত্যা করেছে। তখন আমি কাঁদতে কাঁদতে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমিরের আমলগুলি কি বরবাদ হয়ে গেছে? তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, (একথা) কে বলেছে? রাবী বলেন, আমি বললাম, আপনারই কয়েকজন ছাহাবী। তিনি বললেন, যারা এরূপ বলেছে তারা মিথ্যা বলেছে এবং তাঁর প্রতিদান সে দু’বার পাবে।

তারপর তিনি আমাকে আলী (রাঃ)-এর নিকটে পাঠালেন। তখন তিনি  চক্ষুরোগে  আক্রান্ত  ছিলেন।  তখন  রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমি এমন এক ব্যক্তিকে (আজ) পতাকা সমর্পণ করব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং (অথবা বলেলন) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও তাকে ভালবাসেন। তিনি বলেন, তারপর আমি আলী (রাঃ)-এর কাছে গেলাম এবং তাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে আসলাম। তখন তাঁর চোখ ব্যথাগ্রস্ত হ’ল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর চোখে থুথু দিলেন আর তাতেই তিনি সুস্থ হ’লেন। তখন তিনি তাঁর হাতে পতাকা দিলেন।

এবারো মুরাহহাব বেরিয়ে এল এবং কবিতা আওড়াতে লাগল খায়বার জানে যে, আমি মুরাহহাব, যুদ্ধের অস্ত্রে সজ্জিত এক অভিজ্ঞতাপূর্ণ বীর বাহাদুর ব্যক্তি। যখন যুদ্ধ তাঁর লেলিহান শিখা নিয়ে অগ্রসর হয়, তখন আলী (রাঃ) বললেন, ‘আমি সে ব্যক্তি যাকে আমার মা ‘হায়দার’ (সিংহ) নাম রেখেছেন, যার দর্শন বন্য সিংহের মত ভয়ঙ্কর। আমি তাদের (দুশমনদের) প্রতিদান দেই বড় বড় পাত্র দিয়ে (অর্থাৎ তাদের অবলীলায়) হত্যা করি’। এরপর তিনি মুরাহহাবের মাথায় তলোয়ার মারলেন এবং তাকে হত্যা করলেন। তারপর তারই হাতে (খায়বার) বিজয় হ’ল (মুসলিম হা/১৮০৭; ছহীহাহ হা/৩৫৫৩)

পরিশেষে বলব, আজও ইসলামের বিজয় লাভের জন্য ছাহাবীদের ন্যায় ঈমানী বলে বলীয়ান হয়ে অগ্রসর হ’তে হবে। ভীরুতা পরিহার করে বিরোধী শক্তির দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে ঈমানী শক্তি বাড়িয়ে দিন এবং বাতিলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার হিম্মত দিন-আমীন!






সালমান ফারেসী (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
দাজ্জালের আগমন - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
জান্নাত-জাহান্নামের সৃষ্টি ও জাহান্নামের কতিপয় শাস্তি - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
লি‘আনের বিধান প্রবর্তনের ঘটনা - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
আসমা বিনতু আবী বকর (রাঃ)-এর সীমাহীন দৃঢ়তা - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
সৌন্দর্যই মর্যাদার মাপকাঠি নয় - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
অতিথি আপ্যায়নে ইলাহী মদদ - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
হিংসা-বিদ্বেষ না করার ফল জান্নাত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
সন্তানের প্রতি নূহ (আঃ)-এর অন্তিম উপদেশ - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আয়েশা (রাঃ)-এর প্রতি অপবাদের ঘটনা - আত-তাহরীক ডেস্ক
রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক স্বপ্নে দেখা একদল মানুষের বিবরণ - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
হাদীছের গল্প - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
আরও
আরও
.