হোদায়বিয়া
থেকে ফেরার পথেই যু-ক্বারাদের ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তনের
পরপরই সংঘটিত হয় খায়বার যুদ্ধ। এই খায়বার যুদ্ধেও রাসূল (ছাঃ)-এর মু‘জেযা
বা অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পেয়েছিল। এই উভয় স্থানে ছাহাবীগণ অসীম বীরত্ব ও
সাহসিকতা প্রদর্শন করেছিলেন। বিশেষত সালামাহ বিন আকওয়া ও আলী (রাঃ)-এর অসীম
সাহসিকতা ও বীরত্বের কারণে কাফেররা পিছু হঠতে বাধ্য হয় এবং মুসলিম
মুজাহিদরা বিজয় লাভ করেন। সেই সাথে তারা লাভ করেন বহু গনীমত। এ সম্পর্কেই
নিম্নোক্ত হাদীছ।-
ইয়াস ইবনু সালামাহ (রাঃ) তাঁর পিতা হ’তে বর্ণিত, তিনি (সালামা) বলেন, (মুসলমানদের গনীমতের মাল লুণ্ঠনকারী লুটেরাদের ধাওয়া করে ছাহাবী সালামা বিন আকওয়া)। সে পবিত্র সত্তার কসম! যিনি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে মর্যাদামন্ডিত করেছেন, আমি তখন এতই দ্রুতগতিতে তাদের পিছু ধাওয়া করে যাচ্ছিলাম যে, আমার পিছনে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর কোন ছাহাবীকেই দেখতে পেলাম না। এমনকি তাদের ঘোড়ার খুরের ধূলিও আমার দৃষ্টিগোচর হ’ল না। অবশেষে সূর্যাস্তের প্রাক্কালে তারা (শত্রুরা) এমন একটি গিরি পথে উপনীত হ’ল যেখানে ‘যু-ক্বারাদ’ নামক একটি প্রস্রবণ রয়েছে। অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত অবস্থায় তারা পানি পান করতে অবতরণ করল। তখন তারা পিছনে তাকিয়ে আমাকে তাদের পিছু ধাওয়া করে দৌড়ে আসতে দেখতে পেল। আমি সেখান থেকে তাদেরকে তাড়িয়ে দিলাম। তারা এক ফোঁটা পানিও পান করতে পারল না। তখন তারা সেখান থেকে বেরিয়ে একটি টিলায় আশ্রয় নিল। আর আমিও তাদের পিছু ধাওয়া করতে লাগলাম। আমি তাদের যে কোন একজনের নিকটবর্তী হ’তাম আর তার কাঁধের অস্থিতে তীর নিক্ষেপ করে বলতাম, ‘এটা নেও, আমি আকওয়ার পুত্র, আজ দুধ পান স্মরণের দিন’। সে তখন বলল, তার মা তার জন্য কাঁদুক, তুমি কি সে আকওয়া, যে আমাদের সেই ভোর থেকে অতিষ্ঠ করে রেখেছ? আমি বললাম, হ্যাঁ, হে নিজের জানের দুশমন! আমি সেই তোমার ভোরবেলার আকওয়া।
তিনি (রাবী) বলেন, অতঃপর তারা দু’টি ক্লান্ত ঘোড়া টিলায় ছেড়ে চলে গেল। তখন আমি ঐ দু’টাকে হাকিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট নিয়ে এলাম। সেখানে কিছু দুধভর্তি একটি সাতীহা (চামড়ার পাত্র) এবং একটি পানি ভর্তি সাতীহা নিয়ে এসে আমির আমার সাথে মিলিত হ’ল। আমি তখন ওযূ করলাম ও (দুধ) পান করলাম। তারপর আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে আসলাম, তখন তিনি ঐ পানির (কুয়ার) কাছে ছিলেন যেখান থেকে আমি ওদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
এদিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঐ সমস্ত উট ও মুশরিকদের নিকট থেকে আমার ছিনিয়ে আনা বর্শা ও চাদর প্রভৃতি হস্তগত করেছেন। তখন বিলাল (রাঃ) ঐ লোকদের কাছ থেকে আমার উদ্ধারকৃত একটি উট যবেহ করে তার কলিজা এবং কুঁজ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য ভুনা করছিলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাকে সুযোগ দিন, আমি আমাদের মধ্য থেকে একশ’ জনকে বাছাই করে নিয়ে ঐ দুশমনদের পিছু ধাওয়া করে তাদের সকলকে এমনভাবে হত্যা করব যে, তাদের খবর বয়ে নিয়ে যাওয়ার মত একটি লোকও অবশিষ্ট থাকবে না। একথা শুনে রাসূলুললাহ (ছাঃ) এমনভাবে হাসলেন যে, আগুনের আভায় তাঁর চোয়ালের দাঁতগুলো প্রকাশ পেল।
এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তুমি কি মনে কর যে, তুমি তা করতে পারবে হে সালামাহ! আমি বললাম, হ্যাঁ, ঐ পবিত্র সত্তার শপথ! যিনি আপনাকে সম্মানিত করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন বললেন, এতক্ষণে তো তারা গাতফান পল্লীতে আতিথ্য গ্রহণ করছে। রাবী বলেন, এমন সময় গাত্ফান গোত্রের একটি লোক আসল। সে বলল, অমুক ব্যক্তি তাদের জন্য একটি উট যবেহ করেছে। অতঃপর তারা যখন এর চামড়া খসাচ্ছিল তখন তারা ধুলো বালি উড়তে দেখতে পেল। তারা বলে উঠল ওরা (আকওয়া ও তার বাহিনী) তোমাদের নিকটে এসে পড়েছে। তখন তারা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এরপর যখন আমরা সকালে উপনীত হ’লাম, রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আজকে আমাদের সেরা অশ্বারোহী হচ্ছে আবূ কাতাদা আর আমাদের সেরা পদাতিক সেনা সালামাহ। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) আমাকে অশ্বারোহী ও পদাতিক হিসাবে গণীমতের দুই অংশ দিলেন। দু’ভাগ একত্রে দিলেন। এরপর মদীনায় ফিরে আসার সময় আমাকে তাঁর সাথে স্বীয় উটনী ‘আযবা’র পিছনে বসিয়ে নিলেন।
রাবী বলেন, পথ চলার সময় আনছারের এক ব্যক্তি, যাকে পদব্রজে চলার ব্যাপারে কেউ পরাজিত করতে পারতো না, সে বলতে লাগল, কেউ কি আছে যে, মদীনায় পৌছার ব্যাপারে প্রতিযোগিতা করবে? কোন প্রতিযোগী আছে কি? এ কথাটি সে বারবার বলছিল। যখন আমি তার এ কথাটি শুনলাম তখন বললাম, তুমি কি কোন সম্মানিত লোককে সম্মান দিতে জান না বা কোন ভদ্রলোককেই পরোয়া করবে না? সে বলল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত অন্য কাউকে নয়।
রাবী বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার পিতা-মাতা আপনার উপর কুরবান, আপনি আমায় অনুমতি দিন যেন আমি ঐ ব্যক্তির সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারি। তিনি বললেন, তোমার ইচ্ছা হ’লে। তখন আমি বললাম, আমি তোমার দিকে আসছি। তারপর আমি লাফ দিয়ে নীচে নেমে দৌড়ালাম। তারপর এক বা দু’টিলা অতিক্রম করার দূরত্বে রইলাম তখন পর্যন্ত আমার দম বন্ধ রেখে তার পিছু পিছু দৌড় দিলাম। আরও দু’এক ঢিলা পর্যন্ত ধীরগতিতে চলার পর সজোরে দৌড় দিয়ে তার নিকট পৌঁছে গেলাম এবং তার দু’কাঁধের মধ্যবর্তী স্থানে একটি ঘুষি মেরে বললাম, ওহে আল্লাহর কসম! তুমি হেরে গেছ। সে বলল, আমিও তাই মনে করছি। অতএব আমি তার পূর্বেই মদীনায় পৌছে গেলাম। আল্লাহর কসম! এরপর আমরা তিন রাতের অধিক মদীনায় থাকতে পারিনি। অমনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে আমরা খায়বারের দিকে বেরিয়ে পড়লাম। তখন আমার চাচা আমির (রাঃ) উৎসাহমূলক কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন,
تَاللهِ لَوْلاَ اللهُ مَا اهْتَدَيْنَا * وَلاَ تَصَدَّقْنَا وَلاَ صَلَّيْنَا
وَنَحْنُ عَنْ فَضْلِكَ مَا اسْتَغْنَيْنَا * فَثَبِّتِ الأَقْدَامَ إِنْ لاَقَيْنَا
وَأَنْزِلَنْ سَكِينَةً عَلَيْنَا-
‘আল্লাহর কসম! আল্লাহর অনুগ্রহ না হ’লে আমরা হেদায়াত পেতাম না, ছাদাক্বাও দিতাম না আর ছালাতও আদায় করতাম না। আমরা আপনার অনুগ্রহ থেকে কখনো অমুখাপেক্ষী হ’তে পারি না। তাই আপনি আমাদের কদম দৃঢ় রাখুন, যখন আমরা শত্রুদের সম্মুখীন হই এবং আপনি আমাদের প্রতি প্রশান্তি বর্ষণ করুন।
তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এ ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, আমি আমির। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘তোমার রব তোমাকে ক্ষমা করুন’। রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন যার জন্য বিশেষভাবে ক্ষমার দো‘আ করতেন সে শহীদ হ’ত। তখন স্বীয় উটের উপর আসীন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) চিৎকার করে বললেন, হে আল্লাহর নবী! আমিরকে দিয়ে আমাদের আরো উপকৃত করলেন না কেন? তিনি (রাবী) বলেন, তারপর যখন আমরা খায়বারে উপস্থিত হ’লাম, তখন খায়বার অধিপতি মারহাব তরবারি দোলাতে দোলাতে বেরিয়ে এসে বলল,
قَدْ عَلِمَتْ خَيْبَرُ أَنِّى مَرْحَبُ * شَاكِى السِّلاَحِ بَطَلٌ مُجَرَّبُ
إِذَا الْحُرُوبُ أَقْبَلَتْ تَلَهَّبُ،
‘খায়বার জানে যে, আমি মারহাব, পূর্ণ অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত, অভিজ্ঞতাপূর্ণ এক বীর পুরুষ। যখন যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘনীভূত হয় তখন সে তরবারিসমূহ চমকাতে থাকে’।
রাবী বলেন, তার মোকাবিলায় আমার চাচা আমির (রাঃ) কবিতা আবৃত্তি করতে করতে বললেন,
قَدْ عَلِمَتْ خَيْبَرُ أَنِّى عَامِرٌ * شَاكِى السِّلاَحِ بَطَلٌ مُغَامِرٌ
‘খায়বার জানে যে, আমি আমির অস্ত্রে-শস্ত্রে সুসজ্জিত যুদ্ধে অবতীর্ণ এক অজেয় বীর বাহাদুর’।
রাবী বলেন, তারপর তাদের মধ্যে আঘাত বিনিময় হ’ল। মারহাবের তরবারির আঘাত আমিরের ঢালের উপরে পড়ল। তখন আমির (রাঃ) নীচে থেকে তাকে (মারহাবকে) আঘাত করতে চাইলে তা ফিরে এসে তার নিজের উপরই পতিত হ’ল, আর তাতে তার নিজ দেহের শাহরগটি কেটে গিয়ে তার মৃত্যু হ’ল।
সালামাহ (রাঃ) বলেন, তখন আমি বের হ’লাম। নবী করীম (ছাঃ)-এর কয়েকজন ছাহাবীকে বলাবলি করতে শুনলাম যে, আমিরের আমল বরবাদ হয়ে গেছে, সে আত্মহত্যা করেছে। তখন আমি কাঁদতে কাঁদতে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমিরের আমলগুলো কি বরবাদ হয়ে গেল? তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, (এ কথা) কে বলেছে? আমি বললাম, আপনারই কয়েকজন ছাহাবী। তিনি বললেন, যারা এরূপ বলেছে তারা মিথ্যা বলেছে এবং তার প্রতিদান সে দু’বার পাবে।
অতঃপর তিনি আমাকে আলী (রাঃ)-এর নিকট পাঠালেন। তিনি চক্ষুরোগে আক্রান্ত ছিলেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমি এমন এক ব্যক্তির কাছে (আজ) পতাকা সমর্পণ করব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে অথবা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও তাকে ভালবাসেন। তারপর আমি আলী (রাঃ)-এর কাছে গেলাম এবং তাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে আসলাম। তখন তার চোখ ছিল রোগগ্রস্ত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার চোখে থুথু দিলেন। (তাতে) তিনি সুস্থ হ’লেন। তখন তিনি তার হাতে পতাকা দিলেন। এবারো মারহাব বেরিয়ে এসে কবিতা আওড়াতে লাগল,
قَدْ عَلِمَتْ خَيْبَرُ أَنِّى مَرْحَبُ * شَاكِى السِّلاَحِ بَطَلٌ مُجَرَّبُ
إِذَا الْحُرُوبُ أَقْبَلَتْ تَلَهَّبُ،
‘খায়বার জানে যে, আমি মারহাব, পূর্ণ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, অভিজ্ঞতাপূর্ণ এক বীর পুরুষ। যখন যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘনীভূত হয় তখন সে তরবারিসমূহ চমকাতে থাকে’।
তখন আলী (রাঃ) বললেন,
أَنَا الَّذِى سَمَّتْنِى أُمِّى حَيْدَرَهْ * كَلَيْثِ غَابَاتٍ كَرِيهِ الْمَنْظَرَهْ أُوفِيهِمُ بِالصَّاعِ كَيْلَ السَّنْدَرَهْ،
‘আমি সে ব্যক্তি যাকে আমার মা হায়দার নামে ডাকে। যেমন বিশাল বন্যসিংহ ভয়ংকর, (আমার কাছে আগত) দুশমনের আমি প্রতিদান দেই ‘সান্দারার’ দাড়িপাল্লায় পূর্ণ করে’। অর্থাৎ তাদের নির্দ্বিধায় হত্যা করি।
রাবী বলেন, তিনি (আলী রাঃ) মারহাবের মাথায় তলোয়ার দ্বারা আঘাত করে তাকে হত্যা করলেন। তারপর তার হাতেই (খায়বার) বিজয় হ’ল। (মুসলিম হা/১৮০৭; ইসলামিক ফাউন্ডেশন হা/৪৫২৭; ইসলামিক সেন্টার হা/৪৫২৯)।
শিক্ষা :
১. জিহাদে অংশগ্রহণ করে ভুলবশত কিংবা অসতর্কতায় নিজের অস্ত্রে নিজে নিহত হ’লেও শাহাদতের মর্যাদা পাওয়া যাবে।
২. জিহাদের ময়দানে শত্রুকে ভয় দেখানোর জন্য নিজের শৌর্য-বীর্য প্রকাশ করা যায়। যেভাবে আমির ও আলী (রাঃ) করেছিলেন।
৩. ইহকাল ও পরকালীন বিজয় ও সফলতার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি মহববত থাকা যরূরী।
৪. অসীম বীরত্বের জন্য কোন মুজাহিদকে নেতা দ্বিগুণ গনীমত প্রদান করতে পারেন।
-মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
পিঞ্জুরী, কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ।