সজনা বা সজিনা গ্রামবাংলার একটি অতি পরিচিত বৃক্ষ। অতুলনীয় ভেষজ গুণসমৃদ্ধ বৃক্ষটি একদা গ্রামবাংলার প্রতি বাড়ীতে ২/৪টি করে দেখা যেত। কালের প্রবাহে কাঠের দাম বৃদ্ধিজনিত কারণে বসতবাড়ী, রাস্তা-ঘাটে, পুকুর পাড়ে সর্বত্র বিদেশী পরিবেশহানিকর কাঠজাত বৃক্ষ রোপণের হিড়িক পড়ায় অযত্ন, অবহেলায় তা এখন কম চোখে পড়ে। সজনা বৃক্ষ হ’লেও এর থেকে কাঠ পাওয়া যায় না। এর কান্ড নরম ও ভঙ্গুর প্রকৃতির। সজনার ঔষধি গুণ অতুলনীয়। এর পাতা, ডাঁটা, ছাল, মূল প্রতিটি অংশই ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ। বিশেষ করে রক্তের কোলেস্টরেল হ্রাস, বায়ুপিন্ডের প্রকোপ হ্রাস, হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে এর ঔষধি গুণ ব্যাপক। এর পাতা এবং ডাঁটা বা ছড়া সবজি হিসাবে খুবই উপাদেয় ও মুখরোচক। নিরামিষ মুগ, মসুর কলাই, ফেলন যে কোন ডালের সাথে এর ডাঁটা টুকরা করে কেটে রান্না করলে খুবই সুস্বাদু হয়।

সজনা গাছের ডাল কেটে নিয়ে বর্ষাকালে উঁচু বন্যামুক্ত রোদ পড়ে এমন জায়গায় পুঁতে দিলে তা থেকে শিকড় গজিয়ে গাছে রূপান্তরিত হয়। আবার এর বীজ থেকেও চারা করা যায়। ডাল পুঁতে দিলে যে গাছ হবে তা থেকে ডাঁটা তাড়াতাড়ি ধরবে হেতু ডাল রোপণই উত্তম। দেশের যে কোন স্থানে এমনকি পাহাড়েও তা রোপণ করা যায়। এর পরিচর্যায় তেমন কোন খরচ নেই বললেই চলে। প্রাকৃতিক নিয়মে বেড়ে উঠা গাছের শীতকালে সব পাতা ঝরে যাওয়ার পর গাছে ফুল আসে। সজনা ফুল মৌমাছিদের খুবই প্রিয়। এর থেকে আহরিত মধুর গুণও ভাল।

চৈত্র-বৈশাখ মাসে এর ডাঁটা বা ছড়া খাওয়ার উপযোগী হয়। এ সময়ে গাছে লম্বা ডাঁটা ব্যতীত কোন পাতা থাকে না। ডাঁটা পরিপক্ব হ’তে থাকলে গাছে নতুন পাতা গজায়। এজন্য ডাঁটা সংগ্রহের জন্য ডাল কাটতেও দেখা যায়। ডাল কাটার পরে নতুন পাতা তথা শাখা-প্রশাখা গজিয়ে গাছ পুনঃ সুশোভিত হয়ে যায়। বসত বাড়ীর আঙ্গিনায়, উঠানের পাশে, পুকুর পাড়ে, জমির আইলের পতিত ধরনের যে কোন স্থানে এমনকি শহরের বাসা বাড়ীতে তা রোপণ করলে ডালপালা কম হয় হেতু এর দ্বারা তেমন কোন সমস্যা হয় না। বর্তমানে এক কেজি সজনা ডাঁটার মূল্য ৬০-৮০ টাকা। ভেষজ ঔষধি গুণের কারণে শহরের রসনাবিলাসী লোকেরা তা বেশী দামে কিনে থাকে। এমতাবস্থায় সজনা গাছ রোপণ যথেষ্ট লাভজনক। একটি মাঝারি সাইজের সজনা গাছের ডাঁটা বিক্রিতে বছরে ২/৩ হাযার টাকা অনায়াসে আয় করা যায়। অথচ এর উৎপাদন খরচ নেই বললেই চলে। এর ডাঁটা এমন সময়ে বিক্রি উপযোগী হয় তখন গ্রামবাংলার চৈত্র-বৈশাখ মাসের আকাল থাকে। ঐ সময়ে বেকার গ্রামীণ গরীব পরিবারের আয়ের ক্ষেত্রে তা বিশেষ সহায়ক হয়। এছাড়া পাতা বিক্রিতে প্রায় সারা বছর কিছু কিছু আয় করা যায়। বিশেষ করে বাংলা বছরের চৈত্র সংক্রান্তিতে হিন্দু সম্প্রদায় পাঁচন তৈরির জন্য এর ডাঁটা বেশী বেশী ক্রয় করে থাকে। ঐ সময়ে বিভিন্ন এলাকায় ফড়িয়ারা বাড়ী বাড়ী গিয়ে ঠিকা দামে গাছশুদ্ধ ডাঁটা কিনে থাকে এবং নিজেরাই তা সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। এতে অনেকে হাযার হাযার টাকা আয় করে থাকে। যার কারণে এ সবজি বাজারে বিক্রি হবে কিনা এ নিয়ে উৎপাদন বা আবাদকারীকে ভাবতে হয় না। এমনকি তা বিদেশে রফতানীর উজ্জ্বল সম্ভাবনাও রয়েছে।

কাঠের গাছ থেকে ১৫-২০ বছর পর এককালীন টাকা পাওয়া যায়। অথচ সজনা গাছ থেকে প্রতিবছর আয় সম্ভব যা গরীব গৃহস্থের অভাব অনটনের সময় বন্ধুর মতো সহায়তা করে থাকে। এজন্য স্বল্প ভূমির মালিক অথবা ভূমিহীন দরিদ্র বেকারদের জন্য সজনা বৃক্ষ রোপণও আয়ের একটা অবলম্বন হ’তে পারে। যে কোন পরিবারে ১০/১২টি সজনা গাছ থাকা মানে সারা বছর সবজি ও আয়ের নিশ্চয়তা থাকা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে অলস বসে থেকে কেবল হা-হুতাশ না করে স্বাবলম্বী হ’তে সজনা গাছ লাগানোর মাধ্যমে পারিবারিক সবজির চাহিদা পূরণে প্রণোদনা সৃষ্টি করা দরকার।

দ্বৈত-যৌগ ফলমূল ও সবজি চাষে স্বাবলম্বী

কলার সাথে টমেটো, সীমের সাথে পটল, পেঁপের সাথে হলুদ ও মিষ্টি কুমড়া, গাজরের সাথে লাউ, অাঁখের সাথে পিঁয়াজ ও পটল। একই জমিতে দ্বৈত ও যৌগ ফলমূল এবং শাকসবজির চাষ করে লক্ষ্যমাত্রার অধিক ফসল ফলানোর রেকর্ড সৃষ্টি করেছে গাইবান্ধার সাঘাটা উপযেলার পুঁটিমারী গ্রামের চাষী আমীর হোসাইন ব্যাপারী। ১৯৮৪ সালে তিনি মাত্র ৫ কাঠা জমিতে পরীক্ষামূলক চাষবাস শুরু করেন। ফলমূল, শাকসবজি উৎপাদন ও বিক্রয়ের আয় হ’তে তিনি প্রায় তিন একর জমির মালিক হয়েছেন। তার বাড়ির চতুর্দিক আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ বিভিন্ন জাতের ফলমূল, শাকসবজি ও গাছ গাছালী ঘেরা একটি সবুজ উদ্যানে পরিণত হয়েছে। বাড়ির উঠান থেকে শুরু হয়েছে ফলমূল ও শাকসবজির বাগান। ফসলভেদে বাগানগুলি ভিন্ন ভিন্ন পরিসরে স্থাপিত হয়েছে। কলা ২ একর ৭৪ শতক, পিঁয়াজ ২০ শতক, সীম ১৭ শতক, টমেটো ৩৬ শতক, আলু ৭০ শতক, ফুলকপি ও পাতাকপি ২০ শতক, গাজর ২০ শতক, পেঁপে ২৫ শতক, অাঁখ ১০ শতক, পটল ৩০ শতক, মোট সাড়ে ৮ বিঘা জমিতে ফসল ফলাতে তিনি সর্বসাকুল্যে ৭৫ হাযার টাকা ব্যয় করেছেন। কলা বিক্রি করেই ২ লাখ টাকা আয় হবে, অন্যান্য ফসল হ’তে আয় আসবে ১ লাখ ৫০ হাযার টাকা। কার্তিকের শুরু থেকে সীম তোলা শুরু হয়। প্রতি সপ্তাহে ১০০ কেজি সীম বিক্রি হয়েছে। ১৪ শতক জমিতে সীমের জাংলাসহ খরচ হয়েছে মাত্র ৬ হাযার টাকা। ইতিমধ্যে সীম বিক্রি হয়েছে ৩৫ হাযার টাকা।

আমির হোসাইন সব সময় হাইব্রীড জাতের শাকসবজি ও ফলমূলের আবাদ করেন। তিনি হিরোপ্লাস জাতের টমেটো, স্নোহোয়াট জাতের কপি, ইউনাইটেড (ইংল্যান্ড)-এর পিঁয়াজ, ভারতের রাচির পেঁপে ও অাঁখ, হিটারী জাতের বাঁধাকপি, এসি আই-এর আলু আবাদ করেন। তার বাগানে ১৫-২০ হাত লম্বা অাঁখ, ৪-৫ কেজি ওযনের কপি, প্রায় দেড় কেজি ওযনের টমেটো হয়েছে। ১৯৮৪ সালে মাত্র ৫ কাঠা জমিতে তিনি ভারতের রাঁচি প্রজাতির পেঁপে রোপণ করে প্রায় দেড়শ মণ পেঁপে ফলাতে সক্ষম হন। এ থেকে প্রায় ১০ হাযার টাকা লাভ হয়। উৎসাহিত হয়ে বিভিন্ন সময়ে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ আয়োজিত প্রশিক্ষণে অংশ নেন। শুরু করেন হাইব্রীড শস্যের আবাদ। ১৯৮৪ থেকে ২০১১ পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি গড়ে তুলেছেন প্রায় ৮.৫ বিঘা জমিতে উন্নত জাতের শাকসবজি ও ফলমূলের বাগান। তার ছোট্ট ঝুঁপড়ী এখন একটি আধুনিক পাকা বাড়ি। মৎস্য চাষের জন্য পুকুর, গাভী ও ছাগল পালনের জন্য গোয়াল। বর্তমানে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ টাকা। সরকারিভাবে বিভিন্ন কৃষি মেলা ও প্রদর্শনীতে আমির হোসাইন শ্রেষ্ঠ কৃষক হিসাবে পুরস্কৃত হয়েছেন।

\ সংকলিত \






আরও
আরও
.