ভূমিকা :
শিখন ফলাফল বা ‘লার্নিং আউটকামস’ হচ্ছে কিছু নির্দিষ্ট জ্ঞান, দক্ষতা বা দক্ষতার বিবরণ, যা শিক্ষার্থীরা একটি শিক্ষা কার্যক্রম যেমন প্রশিক্ষণ সেশন, সেমিনার, কোর্স, প্রোগ্রাম বা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জন করবে। উপরন্তু, পূর্বে উল্লেখিত প্রতিটি কার্যক্রমের জন্য পৃথক পৃথক শিখন ফলাফল থাকতে পারে। আলোচ্য নিবন্ধে একটি ধর্মীয় বা সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিখন ফলাফল কি হ’তে পারে তার উপর আলোকপাত করা হবে। তথা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কি কি শিখন ফলাফল নিয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, যার প্রয়োগের দ্বারা তারা তাদের নিজেদের জীবনে উন্নয়ন করতে পারবে এবং কার্যকরভাবে সমাজে অবদান রাখতে পারবে, সেসব বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
‘শিখন ফলাফল’-এর একটি উদাহরণ হচ্ছে ক্রিটিকাল থিঙ্কিং বা সমালোচনামূলকভাবে চিন্তা করা। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা সমালোচনামূলকভাবে এবং সৃজনশীলতার সাথে সমস্যা সমূহ মূল্যায়ন এবং কৌশলগতভাবে চিন্তা করার দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারবে। অতঃপর ক্রিটিকাল থিঙ্কিং সুনির্দিষ্টভাবে মূল্যায়ন করার মানদন্ড নির্ধারণ করতে হবে। যেমন কতটুকু সন্তোষজনকভাবে ছাত্ররা একটি সমস্যাকে সনাক্ত, সংজ্ঞায়িত এবং সংক্ষিপ্তসার করতে পারছে। প্রাসঙ্গিক এবং অর্থবহ তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে। বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় আনতে পারছে। গুরুত্বপূর্ণ অনুমানসমূহ বিবেচনায় নিতে পারছে। প্রমাণ সমূহের মানকে মূল্যায়ন করতে পারছে এবং সিদ্ধান্তগুলি চিহ্নিত করে সেগুলির প্রভাব ও পরিণতি তুলে ধরতে পারছে। শিক্ষকরা বিভিন্ন কোর্সে বিভিন্ন সৃজনশীল চর্চার মাধ্যমে এই সমালোচনামূলক চিন্তা করার সক্ষমতা বিকাশের চেষ্টা করে যাবেন। পর্যায়ক্রমে ক্রিটিকাল থিঙ্কিং মূল্যায়ন করার মানদন্ড ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি সম্বন্ধে অবগত হয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। যাতে করে শিক্ষার্থীরা গ্রাজুয়েশন করার সময় একটি সন্তোষজনক স্তরের ক্রিটিকাল থিঙ্কিং দক্ষতা নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে।
সংক্ষেপে প্রাতিষ্ঠানিক ‘লার্নিং আউটকামস’ হচ্ছে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সর্বজনীন দক্ষতা, যেগুলো নির্দিষ্ট কোর্স, সাবজেক্ট বা বিভাগ ভিত্তিক নয়। এই ‘লার্নিং আউটকামস’গুলোর ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষার্থীদের পারদর্শী করার চেষ্টা অব্যাহত রাখা আবশ্যক। এক্ষণে এ ধারণাটি আরও স্পষ্ট করার জন্য এতদসংক্রান্ত অন্যান্য কিছু বিষয় আলোচনা করা হবে।
‘শিখন ফলাফল’ সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয় :
প্রথমতঃ ‘লার্নিং আউটকামস’গুলি সরাসরি প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক লক্ষ্যের সাথে যুক্ত এবং এগুলি প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার্থীদের অর্জন সম্পর্কে নির্দিষ্ট এবং পরিমাপযোগ্য ফলাফল সরবরাহ করে, যার দ্বারা প্রতিষ্ঠানটি তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য কিভাবে অগ্রসর হচ্ছে তা জানা যায় এবং প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পারে। তাই আবশ্যিকভাবে ‘লার্নিং আউটকামস’ প্রতিষ্ঠানের স্ট্রাটেজিক প্ল্যানের অন্তর্ভুক্ত।
দ্বিতীয়তঃ ‘শিখন ফলাফল’ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতার প্রতিনিধিত্ব করে। যেসব দক্ষতা ব্যক্তিজীবন, সামাজিক জীবন ও কর্মজীবনে কার্যকর ভূমিকা পালনে এবং সার্বিক সফলতা অর্জনে আবশ্যক। এগুলোর গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার সময়ের সাথে পরিবর্তন হ’তে পারে এবং নতুন নতুন দক্ষতার চাহিদা সৃষ্টি হ’তে পারে। যেমন উদ্যোক্তা দক্ষতা বা এন্ত্রেপ্রেনিউরিয়াল স্কিল অপেক্ষাকৃত একটি নতুন ‘লার্নিং আউটকাম’। চাকরীর বাজারের অনিশ্চয়তা মোকাবেলা করার জন্য বিশ্বব্যাপী উদ্যোক্তা দক্ষতার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোক্তা দক্ষতাকে তাদের ‘লার্নিং আউটকামসে’র মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের যেমন বিভিন্ন পেশাজীবী, ফিল্ডের এক্সপার্টস ও নিয়োগকারীদের মতামতের ভিত্তিতে ‘লার্নিং আউটকামস’গুলো শনাক্ত করা হয়।
তৃতীয়তঃ ‘লার্নিং আউটকামস’ বিদ্যমান পাঠ্যসূচী বা পাঠ্যক্রম বা কোর্স পাঠের সাথে পরস্পর বিরোধী হবে না। বরং সেসব চলমান শিক্ষার অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধশালী করবে। কেননা ‘লার্নিং আউটকামসে’র বোধগম্যতা, অনুশীলন, মূল্যায়ন ও সংশোধনমূলক কাজসমূহ স্বতন্ত্রভাবে করা হয়। যেমন যদি লিখিত যোগাযোগ দক্ষতাকে একটি ‘লার্নিং আউটকাম’ নির্বাচন করা হয়, সেক্ষেত্রে কতগুলো প্রাসঙ্গিক কোর্স বা সাবজেক্ট মনোনয়ন করে সেগুলোর বিদ্যমান পাঠ্যসূচীকে কেন্দ্র করেই রিটেন কমিউনিকেশন স্কিল যোরদার করার জন্য বিশেষ চর্চা এবং অনুশীলন করাতে হবে। শিক্ষক-ছাত্র উভয়ই এই দক্ষতা শেখা ও শিখানোর ব্যাপারে বিশেষভাবে মনোযোগী হবেন। অতঃপর স্বতন্ত্রভাবে বিশেষ মানদন্ড ব্যবহার করে ছাত্রদের অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হবে এবং সংশোধন মূলক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এছাড়াও শ্রেণীকক্ষের বাইরে বিভিন্ন ছাত্র কার্যক্রমের মাধ্যমে যেমন দেওয়াল পত্রিকা, স্টুডেন্ট নিউজ লেটার, স্টুডেন্ট ম্যাগাজিন, সাহিত্য ক্লাব, রচনা প্রতিযোগিতা, কবিতা লেখা প্রতিযোগিতা ইত্যাদির সাহায্যে ছাত্ররা তাদের রিটেন কমিউনিকেশন স্কিল উনণয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে।
চতুর্থতঃ বহির্বিশ্বে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিস্তৃতভাবে এক্রিডিটেশন (সত্যায়ন) প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হ’তে হয় এবং এর জন্য আছে স্বতন্ত্র এবং শক্তিশালী এক্রিডিটেশন বডিস বা সত্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান। এই এক্রিডিটেশন প্রতিষ্ঠানগুলো যে পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এক্রিডিটেশন পরিচালনা করেন তাকে বলে শিক্ষার নিশ্চয়তা।
আর এই ‘শিক্ষার নিশ্চয়তাকে’ কেন্দ্র করে ডিগ্রি প্রোগ্রামের ‘লার্নিং আউটকামস’গুলো নির্ধারণ এবং পুনর্বিবেচনা করা হয়। ‘লার্নিং আউটকামস’ অর্জনের জন্য ডিগ্রি প্রোগ্রামের পাঠ্যক্রম ডিজাইন, বিতরণ ও উন্নতি সাধন করা হয় এবং ডিগ্রি প্রোগ্রামগুলোর মাধ্যমে ‘লার্নিং আউটকামস’ পূরণ বা অর্জনের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়। সহজ কথায়, ‘লার্নিং আউটকামস’ নির্ধারণ, বাস্তবায়ন ও অর্জনের এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পড়াশোনাকে সমাজের পরিবর্তনশীল প্রয়োজনের ও আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে প্রাসঙ্গিক রাখার ও সামঞ্জস্য বিধান করার চেষ্টা করে। এছাড়া শিক্ষার্থীরা প্রাসঙ্গিক এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের জীবন উন্নয়নে ও সমাজের কল্যাণে কার্যকরভাবে ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজ এক্রিডিটেশনের জন্য না হ’লেও তাদের শিক্ষাকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য ‘লার্নিং আউটকামস’ প্রক্রিয়া ব্যবহার করতে পারে। শিক্ষকরা ‘লার্নিং আউটকামস’কে ব্যবহার করে তাদের পাঠদান ও শেখানোর প্রণালী সমূহ আরও কার্যকরী করতে পারবে এবং শিক্ষার্থীরা অধিকতর যোগ্য ও প্রতিযোগিতা সম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠতে পারবে।
পঞ্চমতঃ ‘লার্নিং আউটকামস’ বা ‘শিখন ফলাফল’ এবং ‘লার্নিং অবজেক্টিভস’ বা ‘শেখার উদ্দেশ্য’ এই দু’টিকে আলাদাভাবে দেখতে হবে। যেমন একটি ইংলিশ গ্রামার কোর্সের শেখার উদ্দেশ্য হ’তে পারে- এই ক্লাসে শিক্ষক কি পড়াবেন সেটা। অন্যদিকে এটাকে ‘শিখন ফলাফল’ হিসাবে ব্যক্ত করলে বলতে হবে অনেকটা এরকম ‘এই কোর্স সম্পন্ন করে অন্তত ৮০% শিক্ষার্থী ব্যাকরণগত ত্রুটিমুক্ত একটি অনুচ্ছেদ বা একটি ছোট প্রবন্ধ লিখতে পারবে’। সুতরাং দেখা যাচ্ছে একটি ‘লার্নিং আউটকামে’ কার্যকর ক্রিয়া থাকবে; শিক্ষার্থী কী করতে সক্ষম হবে তার একটি বিবরণ থাকবে; কোন পরিস্থিতিতে তারা এটি করতে সক্ষম হবে তা বলা থাকবে এবং কোন পারফরমেন্স স্তরে তাদের পৌঁছতে সক্ষম হওয়া উচিত তার ধারণা থাকবে। তার মানে শিক্ষার্থীরা শিখনের ক্রিয়াকলাপ শেষ করার পরে তাদের শিক্ষাকে বাস্তবে কিভাবে প্রয়োগ করতে পারবে সেটা ‘লার্নিং আউটকামসে’ প্রতিফলিত হবে। সেজন্য ‘লার্নিং আউটকামস’ পরিমাপযোগ্য হ’তে হবে। অল্প কথায় ‘লার্নিং আউটকামসে’ অন্তর্ভুক্ত করা হবে শিক্ষার্থীদের শেখার আচরণ, উপযুক্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং সাফল্য নিরূপণের নির্দিষ্ট মানদন্ড।
কিছু প্রস্তাবিত ‘লার্নিং আউটকামস’ এবং সেগুলির প্রয়োগের কৌশল :
প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার নিজের ‘লার্নিং আউটকামস’ নিজেই ঠিক করবে। প্রতিষ্ঠানের মূল স্টেকহোল্ডারদের যেমন শিক্ষক, ছাত্র, ম্যানেজমেন্ট, অভিভাবক, সম্ভাব্য নিয়োগকর্তা, বিভিন্ন পেশাজীবী এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে কতগুলো ‘লার্নিং আউটকামস’ নির্ধারণ করা হবে। এখানে কিছু বহুল প্রচলিত ‘লার্নিং আউটকামস’ সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।-
(১) লিখিত ও মৌখিক যোগাযোগ দক্ষতা :
লিখিত ও মৌখিক যোগাযোগ দক্ষতা অত্যন্ত মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। সকল প্রকার সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রে যোগাযোগ দক্ষতা অপরিহার্য। যোগাযোগ দক্ষতায় দুর্বলতা থাকলে সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রে ভুগতে হয় বা পিছিয়ে পড়তে হয়। মোটকথা প্রায় সকল ক্ষেত্রেই সফলতার একটা অন্যতম চাবিকাঠি হচ্ছে কার্যকরী ও বলিষ্ঠ যোগাযোগ দক্ষতা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন কোর্সের মাধ্যমে ছাত্রদের মাঝে যোগাযোগ দক্ষতার বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি কার্যকরী যোগাযোগ দক্ষতা অর্জনের নিশ্চয়তা বিধানের পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া না থাকায়, যেমনটা ‘লার্নিং আউটকামসে’র মাধ্যমে করা হয়, শিক্ষাগ্রহণকারীদের একটি বড় অংশের যোগাযোগ দক্ষতা দুর্বল থেকে যাচ্ছে। যোগাযোগ দক্ষতাকে একটি ‘লার্নিং আউটকাম’ হিসাবে লিখতে হ’লে এভাবে লেখা যায়: ‘শিক্ষার্থীরা সামাজিক এবং কর্মক্ষেত্রে কার্যকর ও পারস্পরিক উপকারী সম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ দক্ষতা প্রদর্শন করবে’। এখানে লক্ষণীয় যে ছাত্ররা যোগাযোগ দক্ষতা দিয়ে কি করতে পারবে তার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
বাস্তবায়ন কৌশল :(১) এই ‘লার্নিং আউটকাম’ এবং তৎসংশ্লিষ্ট সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বা নির্ণায়কসমূহ সম্পর্কে শিক্ষক ও ছাত্রদের অবগতি, আগ্রহ ও গুরুত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। শিক্ষকরা বিভিন্ন নির্বাচিত কোর্সে বা সাবজেক্টে সৃজনশীলতা চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে লিখিত ও মৌখিক যোগাযোগ দক্ষতার বৈশিষ্ট্যগুলো ছাত্রদের মাঝে বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। ছাত্রদের অগ্রগতি নিরূপণের জন্য বিভিন্ন ধাপে মূল্যায়নের ব্যবস্থা করবেন এবং ফলাফলের ভিত্তিতে চর্চা ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনয়ন করবেন। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা সমাপন করে বের হওয়ার সময় অধিকাংশ শিক্ষার্থী যেন লিখিত ও মৌখিক যোগাযোগ দক্ষতার বৈশিষ্ট্যগুলো একটি সন্তোষজনক স্তরে অর্জন ও প্রয়োগ করতে পারে, তার নিশ্চয়তা বিধান করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
(২) উপরোক্ত ‘লার্নিং আউটকাম’ অর্জনের লক্ষ্যে লিখিত ও মৌখিক যোগাযোগ দক্ষতা সম্পর্কিত কতগুলো সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বা নির্ণায়ক ঠিক করতে হবে, যেগুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধাপে প্রয়োজনীয় চর্চা, অনুশীলন, মূল্যায়ন ও সংশোধনীর প্রক্রিয়া চালাতে হবে। শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান পরিচালকগণ এগুলো ঠিক করবেন। উদাহরণ স্বরূপ, লিখিত যোগাযোগ দক্ষতা নির্ণায়ক সমূহ, যেসব দ্বারা ছাত্রদের করা বিশেষ এসাইনমেন্ট মূল্যায়ন করা হবে তা প্রদত্ত হ’ল।-
(ক) যুক্তি ও বিন্যাস : লেখাতে ধারণাগুলো কত ভালভাবে তুলে ধরা হয়েছে; অনুচ্ছেদের বিন্যাস এবং ট্রানজিশন কতটা যৌক্তিকভাবে ও কার্যকরভাবে করা হয়েছে, ভূমিকা কতটা পরিষ্কার ও নির্দিষ্ট হয়েছে এবং উপসংহারে রচনার উদ্দেশ্য ও সারসংক্ষেপ কতটা স্পষ্ট এবং কৌতূহলোদ্দীপক করা হয়েছে।
(খ) ভাষা : সংক্ষিপ্ত স্ট্যান্ডার্ড বাক্যের ব্যবহার কতদূর হয়েছে, কার্যকরভাবে এবং ভারসাম্য বজায় রেখে বিভিন্ন প্রকার বাক্য কাঠামোর প্রয়োগ কি পরিমাণ হয়েছে এবং জটিল বাক্য, উন্নত শব্দভান্ডার এবং ত্রুটিমুক্ত ব্যবহার কতদূর করা হয়েছে।
(গ) বানান ও ব্যাকরণ : লেখাটি বানান এবং ব্যাকরণের ক্ষেত্রে কতটা ত্রুটিমুক্ত হয়েছে।
(ঘ) সাহিত্য পর্যালোচনা : পর্যালোচনার মান কতটা উচ্চ হয়েছে এবং টীকা সমূহ কতটা সঠিকভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
(ঙ) উদ্দেশ্য : ফোকাস, সংগঠন, স্টাইল এবং বিষয়বস্ত্ত রচনার উদ্দেশ্যকে কতটা স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করতে পেরেছে এবং রচনার উদ্দেশ্যটি লেখার কেন্দ্রস্থলে কতটুকু ধারণ করা হয়েছে।
মৌখিক যোগাযোগ দক্ষতার বৈশিষ্ট্য হ’তে পারে, যার মাধ্যমে কোন বিশেষ মৌখিক উপস্থাপনা মূল্যায়ন করা হবে- (ক) অর্গানাইজেশন বা বিন্যাস : উদ্বোধনী বক্তব্য কতটা স্পষ্ট হয়েছে, দর্শকদের আগ্রহকে কতটা আকর্ষণ করতে পারছে এবং পুরো আলোচনায় বিষয়বস্ত্তর প্রতি কতটা কেন্দ্রীভূত থাকতে পারছে?
(খ) উপস্থাপনা প্রবাহ : উপস্থাপনার বিভাগ ও স্তরের রূপান্তর কতটা সাবলীল ও মসৃণ হচ্ছে এবং দর্শকদের অনুসরণ করা কতটা সহজ হচ্ছে।
(গ) কণ্ঠস্বরের গুণগতমান এবং গতি, ডেলিভারী কতটা ভাল হচ্ছে; কন্ঠের আওয়াজ, মাত্রা এবং টোন কতটা আকর্ষণীয় হচ্ছে এবং উৎসাহ, আগ্রহ এবং আত্মবিশ্বাস কতটা বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
(ঘ) দেহ ভাষা : দর্শকদের আগ্রহ বজায় রাখতে দেহ ভাষা কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হচেছ কি-না।
(ঙ) মিডিয়া ব্যবহার : বিভিন্ন মিডিয়ার ব্যবহার কতটা কার্যকরী ও আকর্ষণীয়ভাবে করা হচ্ছে; প্রেজেন্টেশন মেটেরিয়াল পড়তে এবং বুঝতে কতটা সহজ হচ্ছে এবং প্রেজেন্টেশন মেটেরিয়াল বক্তব্যের গুণমান কতটুকু উন্নত করছে।
(৩) শ্রেণীকক্ষের বাইরে ছাত্রদেরকে বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রমে জড়িত করা যেতে পারে, যার দ্বারা তারা লিখিত ও মৌখিক যোগাযোগ দক্ষতার বৈশিষ্ট্যগুলো চর্চা করতে পারবে। যেমন স্টুডেন্ট পত্রিকা, স্টুডেন্ট ম্যাগাজিন, রচনা প্রতিযোগিতা, ডিবেট ক্লাব, বুক রিডিং ক্লাব, ক্রিয়েটিভ রাইটিং সোসাইটি ইত্যাদি। সুস্পষ্ট লক্ষ্য অর্জনের প্রয়োজনকে মাথায় রেখে শিক্ষক-ছাত্ররা মিলে নতুন নতুন শিক্ষা কার্যক্রম উদ্ভাবন করবে এবং এসব দ্বারা উপকৃত হ’তে থাকবে।
(২) সমালোচনামূলক চিন্তা দক্ষতা (Critical thinking skill) :
ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল হচ্ছে কোন একটি সমস্যা বা বিষয়কে সমালোচনা মূলকভাবে ও সৃজনশীলতার সাথে চিন্তা ও বিশ্লেষণ করে যুক্তিসংগত ও কৌশলগত সমাধানে উপনীত হ’তে পারার দক্ষতা। আজকের দিনে চাকরী, ব্যবসা বা অন্য কোন সামাজিক কাজের ক্ষেত্রে যে দক্ষতাটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল। বহির্বিশ্বের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিতভাবে তাদের গ্রাজুয়েটসদের বিভিন্ন খাতে সম্ভাব্য নিয়োগ কর্তাদের কাছ থেকে পদ্ধতিগতভাবে যেমন সার্ভে বা ফোকাস গ্রুপ বা ইনডেপ্ত সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জানতে চায় তারা গ্রাজুয়েটসদের মাঝে কি ধরনের দক্ষতা দেখতে চান। সর্বসম্মতি ক্রমে বিভিন্ন খাতের সম্ভাব্য নিয়োগ কর্তারা যে দক্ষতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন সেটা হচ্ছে ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল। কেননা সামগ্রিকভাবে আজকের দিনের সমস্যাগুলো বা বিষয়গুলো জটিল, সর্বদা পরিবর্তনশীল, গতিশীল, প্রতিযোগিতা মূলক এবং অপ্রত্যাশিত। যাদের মোকাবেলায় ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল অপরিহার্য। তাই বিদেশের স্বীকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা সর্বজনীন ‘লার্নিং আউটকাম’ হচ্ছে ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল।
যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করার সময় শিক্ষার্থীদের ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিলের কিছু কিছু দক্ষতা অর্জন করতে পারার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, যেসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিলকে একটি লার্নিং আউটকাম নির্ধারণ করে পদ্ধতিগতভাবে এবং ভেবে-চিন্তে ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল চর্চা ও অনুশীলন করে, তাদের ছাত্রদের মাঝে সাধারণভাবে ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিলের অধিকতর বিকাশ ঘটে থাকে। আমাদের দেশের সামাজিক সমস্যা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বাস্তবতার নিরিখে ছাত্রদের মাঝে উক্ত স্কিলের অধিকতর বিকাশ ঘটানোর প্রচেষ্টা থাকা বাঞ্ছনীয়। এই স্কিলকে একটি ‘লার্নিং আউটকাম’ হিসাবে লিখতে হ’লে সেখানে শিক্ষার্থীরা ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল অর্জন করে কি করতে পারবে তা ব্যক্ত করতে হবে। যেমন ‘শিক্ষার্থীরা কোন বিষয় বা সমস্যাকে সমালোচনা মূলকভাবে ও সৃজনশীলতার সাথে চিন্তা ও বিশ্লেষণ করে যুক্তিসংগত ও কৌশলগত সমাধানে উপনীত হ’তে পারার ক্ষমতা প্রদর্শন করবে’।
বাস্তবায়ন কৌশল : (১) যেকোন ‘লার্নিং আউটকাম’ বাস্তবায়ন করতে হ’লে একে শিক্ষক, ছাত্র ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মাঝে প্রচার করতে হবে। এব্যপারে তাদের অবগতি, আগ্রহ ও গুরুত্ব অনুধাবন বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। কেননা তারা উৎসাহিত না হ’লে কোন ‘লার্নিং আউটকাম’ কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব না। শিক্ষকরা বিভিন্ন নির্বাচিত কোর্সে সমাজে বহুল প্রচলিত ও প্রাসঙ্গিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে প্রজেক্ট, টার্ম পেপার, প্রবন্ধ, রিসার্চ পেপার, প্রেজেন্টেশন ইত্যাদি করানোর চেষ্টা করবেন, যেখানে ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল প্রয়োগের চর্চা হবে। শিক্ষকরা সেগুলো ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল মূল্যায়নের বৈশিষ্ট্যগুলোর নিরিখে মূল্যায়ন করবেন এবং ফিডব্যাক দেবেন। শিক্ষার্থীরা গ্রাজুয়েট না হওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তি হ’তে থাকবে।
(২) ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিক্ষক এবং ম্যানেজমেন্টকে স্কিলটির মূল্যায়নের কতগুলো সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করতে হবে, যেসবের দ্বারা ছাত্রদের করা বিশেষ প্রজেক্ট মূল্যায়ন করা হবে যেমন (ক) মূল সমস্যা বা ইস্যুগুলিসহ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিকগুলো কতটা সনাক্ত, সংজ্ঞায়িত এবং সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করতে পারছে (খ) সমস্যা এবং সমস্যাগুলির পরিধি নির্ধারণ করতে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাসঙ্গিক এবং অর্থবহ অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক পরিপূরক তথ্য কতটা সংগ্রহ করতে পারছে (গ) বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ এবং অংশীদারদের অবস্থান কতটা বিবেচনা করা হয়েছে (ঘ) মূল স্টেকহোল্ডারদের অবস্থান, প্রভাব এবং সক্ষমতা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট বুঝ, উপলব্ধি এবং বিবেচনা প্রদর্শন কতটা করতে পারছে (ঙ) মূল অনুমানগুলি কতটুকু বিবেচনায় নিতে পারছে (চ) নৈতিক বিষয়ে কতটা সংবেদনশীলতা দেখাতে পারছে (ছ) প্রমাণসমূহের গুণগত মানের কতটা মূল্যায়ন করতে পারছে (জ) কারণ এবং প্রভাব কতটা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে এবং বিদ্যমান বা সম্ভাব্য পরিণতিগুলিকে কতটা সম্বোধন করা হয়েছে (ঝ) স্পষ্টভাবে সত্য, মতামত এবং মূল্যবোধ সংক্রান্ত রায়ের মধ্যে কতটা পার্থক্য করতে পারছে (ঞ) সম্ভাব্য বিকল্প সমাধান কতটা সনাক্ত করতে পারছে ও তাদের প্রতিটির সুবিধা-অসুবিধাগুলো কতটা বিশ্লেষণ করতে পারছে (ট) উপসংহার তাদের প্রভাব এবং তাদের পরিণতিগুলি কতটা সনাক্ত করতে পারছে এবং (ঠ) যুক্তিসঙ্গতভাবে নিজের বক্তব্য কতটা প্রতিফলিত করতে পারছে।
(৩) শ্রেণীকক্ষের চর্চা ও অনুশীলনের সাথে শ্রেণীকক্ষের বাইরে দেশের চলমান সমস্যাগুলো নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম করা যেতে পারে। যেমন আলোচনা সভা, মতবিনিময়, গেস্ট লেকচার, বিতর্ক, প্রতিযোগিতা, ফিল্ড ট্রিপ ইত্যাদি। আমরা যুগ যুগ ধরে এমন অনেক সমস্যা বহন করে চলেছি যেসব পৃথিবীর বহু দেশ অনেক আগেই বহুলাংশে কমিয়ে ফেলেছে।
যেমন ঘুষের ব্যাপক প্রচলন, পথশিশু, ভিক্ষুক, সড়কে বিশৃঙ্খলা, ব্যাপক অনৈতিকতা, সামাজিক অসমতা, শিক্ষিত বেকার, মুসলমানদের ইসলামের প্রতি অনীহা, দাওয়াতী কাজের সফলতা-ব্যর্থতা, দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা ও দুর্বলতা, সমাজের প্রয়োজনের সাথে শিক্ষার সম্পর্কের দুর্বলতা ইত্যাদি। ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল প্রয়োগ করেই এসব ইস্যুর মোকাবেলা করতে হবে। তাই এসবের আলোচনা ও চর্চা ছাত্রদের মধ্যে ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল বিকাশে সহায়ক হবে।
(৩) উদ্যোক্তা দক্ষতা :
যে দক্ষতার দ্বারা একজন ব্যক্তি কোন নতুন আইডিয়াকে সনাক্ত করে সেটাকে কর্মে রূপান্তরিত করতে পারে তাকে এন্ত্রেপ্রেনিউরিয়াল স্কিল বা উদ্যোক্তা দক্ষতা বলে। এই দক্ষতার মধ্যে রয়েছে সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং ঝুঁকি গ্রহণ করার প্রবণতা। এছাড়াও রয়েছে ব্যবসার উদ্দেশ্যগুলি অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও পরিচালনা করার ক্ষমতা। বহুকাল ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গ্রাজুয়েটসদের চাকরীর জন্য তৈরি করে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বহির্বিশ্বের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ছাত্রদের চাকরীর বদলে উদ্যোক্তা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ হ’ল অর্থনীতির চরিত্র বদলে যাওয়া যথা রোবোটাইজেশন বা যন্ত্রমানব, ব্যাপক অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয়তা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। এগুলোর ব্যাপক প্রসার হওয়ার কারণে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদন বাড়ার সাথে চাকরী বাড়ছে না। ফলে উন্নত এবং উন্নয়শীল সব ক্যাটাগরির দেশেই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্রদের উদ্যোক্তা বানানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন উদ্যোক্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন কোর্স অফার করা, এন্ত্রেপ্রেনিউয়ারশিপ ডিগ্রী প্রোগ্রাম অফার করা, এন্ত্রেপ্রেনিউয়ারশিপ সেন্টার খুলে তার মাধ্যমে উদ্যোক্তা ট্রেনিং দেওয়া ও উদ্যোক্তাদের নানাভাবে সহায়তা করা ইত্যাদি। উদ্যোক্তাদের পুঁজি সরবরাহ করার জন্য বিভিন্ন দেশের সরকার ও অন্যান্য ফান্ডিং এজেন্সিগুলো বিভিন্ন ধরনের ফান্ডিং প্রোগ্রাম চালু করল। যেমন উদ্যোক্তা ফান্ড, এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ) ঋণ ইত্যাদি। কিন্তু ফ্রি ফান্ড বা অতি অল্প মূল্যের উদ্যোক্তা ফান্ড নিয়ে হ’ল ব্যাপক দুর্নীতি এবং অপব্যবহার বা অপচয়। ফলে আকাঙ্ক্ষিত ফল অর্জিত হ’ল না।
এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য বিশেষজ্ঞরা রিসোর্স বেইজড এন্ত্রেপ্রেনিউয়ারশিপ থিওরীর বা তত্ত্বের পরিবর্তে রিসোর্স আইডেন্টিফিকেশন বেইজড এন্ত্রেপ্রেনিউয়ারশিপ থিওরী উপস্থাপন করলেন। প্রথম তত্ত্ব অনুযায়ী উদ্যোক্তাদের পুঁজি দিতে হবে। কেননা পুঁজি ছাড়া তারা ব্যবসা শুরু করতে পারবে না। আর দ্বিতীয় তত্ত্বমতে উদ্যোক্তাদের বাইরে থেকে পুঁজি দিতে হবে। কেননা প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনগন্ডির মধ্যে কিছু রিসোর্স থাকে যেটাকে ব্যবসা শুরু করার পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করা সম্ভব এবং এই রিসোর্সকে ব্যবসার রিসোর্স হিসাবে সনাক্ত করতে হবে যাকে বলে সল্যাক বা সুপ্ত রিসোর্স। যেমন এক ব্যক্তির কেমিস্ট্রিতে ডিগ্রী আছে এবং সে তিন রুমের এক বাড়ীতে থাকে। তার কেমিস্ট্রি ডিগ্রী এবং একটি ঘর হ’তে পারে তার বিজনেস রিসোর্স। এই দু’টিকে কাজে লাগিয়ে সে পানি বোতলজাত করা শুরু করতে পারে। আর একটি উদাহরণ, এক ব্যক্তি ভালো কেক বানাতে পারে এবং সেটাই হ’তে পারে তার বিজনেস রিসোর্স। প্রথমে সে কেক বানিয়ে নিজের আশপাশের বাসাগুলোতে উপহার হিসাবে কেক বিতরণ করতে পারে এবং তারপর বিক্রি শুরু করতে পারে। মানুষের মুখে মুখে কেকের কথা ছড়াবে এবং মার্কেট বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এই দু’টি উদাহরণই বাস্তবে ঘটেছে।
বাংলাদেশে সাধারণভাবে বেকারত্বের সমস্যা অত্যন্ত ব্যাপক। বিশেষভাবে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই সমস্যা সমাধানের একটি কার্যকর উপায় হচ্ছে বেকারদের উদ্যোক্তায় পরিণত করা। সেই লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোক্তা দক্ষতাকে একটি ‘লার্নিং আউটকাম’ হিসাবে নির্ধারণ করে তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিতে পারে। উদ্যোক্তা দক্ষতাকে একটি ‘লার্নিং আউটকাম’ হিসাবে উপস্থাপন করার একটি উদাহরণ হচ্ছে ‘শিক্ষার্থীরা কোন নতুন ব্যবসার আইডিয়াকে সনাক্ত করে সেটাকে কর্মে রূপান্তরিত করতে পারার ক্ষমতা প্রদর্শন করবে’।
বাস্তবায়ন কৌশল : (১) এন্ত্রেপ্রেনিউরিয়াল স্কিল বা উদ্যোক্তা দক্ষতা কি এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে ছাত্র ও শিক্ষকদের অবগত এবং অনুপ্রাণিত করতে হবে। কোন চলমান কোর্সে উদ্যোক্তা সংক্রান্ত অধ্যায় সংযোজন করে এব্যাপারে আলোচনা, চর্চা ও অনুশীলন চালানো যেতে পারে। অন্যথায় উদ্যোক্তা নামে একটি বা একাধিক নতুন কোর্স চালু করতে হবে। বিভিন্ন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উদ্যোক্তার উপর নানা ধরনের কোর্স অফার করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন চলমান কোর্সে উদ্যোক্তা বিষয়কে হাইলাইট করা হয় নানা সৃজনশীল পদ্ধতিতে।
(২) এই উদ্যোক্তা দক্ষতা বিষয়ক ‘লার্নিং আউটকাম’ বাস্তবায়নের জন্য কতগুলো সুনির্দিষ্ট মূল্যায়নকারী বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে নিতে হবে। যেগুলোর মাধ্যমে ছাত্রদের উদ্যোক্তা বিষয়ক প্রজেক্ট বা এসাইনমেন্ট মূল্যায়ন করে জানা যাবে তারা উদ্যোক্তা দক্ষতা কোন স্তর পর্যন্ত অর্জন করতে পেরেছে। যেমন (১) বৈজ্ঞানিকভাবে বা অব্জেক্টিভলি মার্কেট বিশ্লেষণ করে নতুন ব্যবসার আইডিয়া কতটা সনাক্ত করতে পারছে (২) মার্কেট বিশ্লেষণ এবং নতুন ব্যবসার আইডিয়া সনাক্তকরণে কতটা সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারছে (৩) নতুন ব্যবসার ঝুকি কতটা বিশ্লেষণ ও গণনা করতে পারছে (৪) ব্যবসার উদ্দেশ্যগুলি কতটা অব্জেক্টিভলি এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে নির্ধারণ করতে পারছে (৫) ব্যবসার পরিকল্পনা কতটা পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে করতে পারছে এবং (৬) ব্যবসার বাস্তবায়ন ও পরিচালনা সংক্রান্ত তথ্য কতটা সম্পূর্ণভাবে ও অব্জেক্টিভলি দিতে পারছে।
(৩) বিভিন্ন ফিল্ডের সফল উদ্যোক্তাদের গেস্ট স্পীকার হিসাবে ক্লাসে বা কমন লেকচার হলে নিয়ে আসতে হবে। তারা তাদের অভিজ্ঞতার কথা ছাত্রদের কাছে বলবে এবং আলোচনা করবে। এতে করে ছাত্ররা উদ্যোক্তা সম্বন্ধে শিখবে এবং অনুপ্রাণিত হবে। এই রকম ইভেন্ট সারা বছর ধরে চালাতে হবে।
(৪) ছাত্রদেরকে নিয়ে ফিল্ড ট্রিপ করা যেতে পারে। তারা বিভিন্ন ধরনের উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানে যাবে এবং স্বচক্ষে তাদের অপারেশনস, ম্যানেজমেন্ট, মার্কেটিং ইত্যাদি দেখে শিখবে ও অনুপ্রাণিত হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বিভিন্ন সেক্টারের উদ্যোক্তাদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করবে এবং তাদের সাথে পার্টনারশিপ গড়ে তোলার চেষ্টা করবে।
(৫) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে এন্ত্রেপ্রেনিউরিয়ারশিপ বা উদ্যোক্তা সেন্টার খুলতে পারে। এই সেন্টার উদ্যোক্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন আলোচনা সভা, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, ট্রেনিং ইত্যাদি আয়োজন করবে। তাছাড়াও নতুন উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করার জন্য বিভিন্ন প্রোগ্রাম চালু করবে যেমন ইনকিওবেটর, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, শর্ট কোর্স, ট্রেনিং, রিসার্চ, গেস্ট স্পীকার ইত্যাদি। এজাতীয় সেন্টারগুলো সাধারণত বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী অনুদান বা রিসার্চ ফান্ড পেয়ে থাকে। কেননা এগুলোকে সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো উৎসাহিত করে থাকে। উপরন্তু সেন্টারগুলো উদ্যোক্তা কেন্দ্রিক বিভিন্ন রিসার্চ পাবলিকেশন্স বা ম্যাগাজিন বা নিউজপেপার বের করতে পারে। (ক্রমশঃ)
* প্রফেসর (অবঃ), লুইজিয়ানা টেক ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা; কিং ফাহাদ ইউনিভার্সিটি অফ পেট্রোলিয়াম এ্যান্ড মিনারেলস্, সঊদীআরব; সুলতান ক্বাবূস ইউনিভার্সিটি, ওমান।