ব্রোকলি একটা পুষ্টিকর সবজি যা দেখতে ফুলকপির মত কিন্তু বর্ণে সবুজ। যদিও আমাদের দেশে বাণিজ্যিক ভাবে ব্রোকলি এখনো তেমন পরিচিত হয়ে উঠেনি। তবে কিছু সৌখিন মানুষ এর চাষ স্বল্প পরিসরে শুরু করেছে। ব্রোকলিতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন সি, ক্যারোটিন ও ক্যালসিয়াম বিদ্যমান। স্বাস্থের জন্য উপকারী এই সবজির পুষ্টিগুণ অনেক বেশি থাকায় আমাদের এর চাষ শুরু করা দরকার। ব্রোকলি মাঠ থেকে তোলার পর তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায় বলে টবে ব্রোকলি চাষ করতে পারলে অল্প অল্প করে খাওয়ার জন্য সংগ্রহ করা যায় সহজেই। আপনি চাইলে বাড়ির আঙ্গিনায়, বারান্দায় বা ছাদের অল্প জায়গায় টবে ব্রোকলি চাষ করতে পারেন। নিম্নে টবে ব্রোকলির উৎপাদন কলাকৌশল ও প্রয়োজনীয় উপকরণ বর্ণনা করা হল।
জাত : ভাল ফসল পেতে ভাল জাত নির্বাচন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ব্রোকলির উল্লেখযোগ্য জাতগুলো হচ্ছে- টপার-৪৩, ডান্ডি, সপ্রডিটিং টেক্সাস ১০৭, গ্রিন ডিউক, ক্রুসেডার, ওয়ালথাম ২৯, গ্রিন মাউন্টেইল, ইতালিয়ান গ্রিন, গ্রীন বাড ইত্যাদি। তবে আমাদের দেশের আবহাওয়ায় প্রিমিয়াম ক্রপ, এল সেন্ট্রো, গ্রিন কমেট ও ডি সিক্কো জাত গুলো বিশেষ উপযোগী। বিভিন্ন বীজ কোম্পানি ব্রোকলির সাধারণ ও শঙ্কর জাতের বীজ বাজারজাত করছে। আপনি তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারেন।
সময় : সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস ব্রোকলি চাষের উপযুক্ত সময়। তাই আগস্ট মাসে বর্ষার পর পরই জমি প্রস্ত্তত করতে হয় এবং পরে বীজতলায় ব্রোকলির বীজ বুনতে হয়।
সার ও মাটি : মাটি নরম ও ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। পরিমান মত গোবর, টিএসপি ও খৈল দিয়ে সার ও মাটি ভালভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। অথবা পাতা পচা সার বা গোবর সার ১ ভাগ, বালু ১ ভাগ ও মাটি ২ ভাগ মিশিয়ে ব্রোকলির বীজতলা তৈরি করে নিতে পারেন। মনে রাখবেন মাটি সব সময় নরম তুলতুলে থাকলে সব ধরনের সবজি ভালো ফলন দেয় ও তাড়াতাড়ি বাড়ে। আর অবশ্যই সারাদিন রোদ পায় এমন জায়গা ব্রোকলি চাষের জন্য নির্বাচন করবেন।
চারা তৈরি ও রোপন : ভাল ফলন পেতে হ’লে বীজতলায় চারা তৈরি করে পরে মূল টবে লাগাতে হবে। বীজ রোপনের পর চারা গজাতে ৩/৪ দিন সময় লাগে। ৮/৯ দিন বয়সে চারা মূল টবে লাগানোর উপযুক্ত হয়। তবে ৩/৪ সপ্তাহের সুস্থ চারা সার ও মাটি ভরা টবে লাগালে ভাল হয়। টবে লাগানোর উপযুক্ত চারা চেনার জন্য যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখবেন তা হলো চারার উচ্চতা ৮-১০ সেমি, ৫-৬টি সবল পাতা ও গাঢ় সবুজ বর্ণ। টব নির্বাচনের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখবেন যেন ছোট না হয়ে যায়। কারন এটি দ্রুত বাড়ে ও আকারে মোটামুটি মাঝারি আকারের হয়, তাই ৫ লিটার পাত্রের সমান টবে লাগাবেন।
পরবর্তী পরিচর্যা : চারা রোপণের পর প্রথম ৪-৫ দিন পর্যন্ত এক দিন অন্তর অন্তর পানি দিতে হবে। পরবর্তীতে ৮-১০ দিন অন্তর বা প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিলেই চলবে। টব সব সময় আগাছা মুক্ত রাখুন আর মাটি ঝুরঝুরে করে দিন। আর পরিমান মত যৈব সার ব্যবহার করুন এবং সার প্রয়োগের পরে পানি দিতে ভুলবেন না। সাধারনত শুঁয়া পোকা ও জাব পোকা ব্রোকলির ক্ষতি করে। জাব পোকা ও শুঁয়া বেশি হলে রিডেন, মার্শাল বা নাইট্রো ওষুধ স্প্রে করা যেতে পারে তবে তা কোন কৃষি কর্মকতার পরামর্শ অনুযায়ী করলে ভাল হয়।
ফসল সংগ্রহ : ব্রোকলি অনেক দ্রুত বাড়ে। সাধারণত চারা রোপণের ৩ থেকে সাড়ে ৩ মাসের মধ্যে সবজিটি খাবার উপযোগী হয়। এটি সংগ্রহের সময় প্রথমে ফুলের উপরের অংশটা সাবধানে কেটে নিবেন তাহলে পাতার গোড়া থেকে আবার ফুল বের হবে, যা পরবর্তীতে সংগ্রহ করতে পারবেন।
ব্রোকলির পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা :
ব্রোকলি যে শুধুই স্বাদে, বর্ণে ও গন্ধে অনন্য তা নয়, এছাড়াও ব্রোকলির রয়েছে বহুবিধ পুষ্টি উপাদান যা আমাদের শরীর-স্বাস্থ্যকে ভাল রাখতে নানাভাবে সহায়তা করে। শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতায় এই ব্রোকলির জুড়ি মেলা ভার। সাধারণত অন্যান্য সবজিতে ব্রোকলির মত এতো পুষ্টিগুণ পরিলক্ষিত হয় না। আর এজন্যই এর কদরও দিন দিন বেড়ে চলেছে। তাহলে এবার চলুন জেনে নেয়া যাক কেন আমাদের খাদ্য তালিকায় এর গুরুত্ব অপরিসীম, আর এর থেকে আমরা কি কি পুষ্টিগুণ বা স্বাস্থ্য উপকারিতা পেতে পারি।
দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখে : অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি ব্রোকলিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ আছে, যা রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে এবং দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখে।
ওযন নিয়ন্ত্রণে রাখে : এতে ক্যালরির পরিমাণ অনেক কম থাকে বলে অতিরিক্ত ওযন নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
লিভার ঠিক রাখে : ব্রোকলি মানব দেহের গ্লুকোসিনোলেট নামক অর্গানিক উপাদানের মাত্রা বাড়িয়ে লিভারের দূষিত পদার্থ নিষ্কাশন করে ফলে লিভার থাকে রোগ মুক্ত।
হাড় সুস্থ রাখে : প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন কে তে ভরপুর ব্রোকলি হাড়ের গঠন শক্তিশালী করে ও বিভিন্ন ধরনের হাড়ের রোগে আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে।
পরিপাকতন্ত্র ঠিক রাখে: ব্রোকলি প্রাকৃতিক আশ বা ফাইবার সমৃদ্ধ বলে দেহের পরিপাক তন্ত্র ঠিক রাখে, খাদ্য সঠিক ভাবে হজম করতে সাহায্য করে ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এমনকি এটি নিম্ন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখতে সহায়তা করে।
হৃদরোগ প্রতিরোধ করে : হৃদরোগ প্রতিরোধে ব্রোকলি বা সবুজ ফুলকপি অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এর উপকারী পুষ্টি উপাদান ম্যাগনেশিয়াম আর ক্যালশিয়াম রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং মানব দেহের ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। উপরন্তু ব্রোকলিতে বিদ্যমান ভিটামিন বি ৬ হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনে।
ক্ষত সারিয়ে তুলে : এই সবুজ ফুলকপি ব্রোকলিতে বিদ্যমান আর,ডি,এ নামক এন্টি অক্সিডেন্ট দেহের যেকোন ধরনের ক্ষত দ্রুত সারিয়ে তুলে এবং ফ্রি র্যাডিকেলের বিপরীতে কাজ করে।
রোগ প্রতিরোধ করে : রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্রোকলি অভাবনীয় প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের মস্তিষ্ক ও এর কার্যক্রম সুচারু রুপে সম্পাদন করতে এর ভূমিকা অপরিসীম।
তারুণ্য ধরে রাখে : ব্রোকলির এন্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন সি মানব শরীরের তারুণ্য ধরে রাখতে ও দ্রুত বৃদ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা করে।
ক্যান্সার প্রতিরোধ করে : বর্তমান সময়ে ক্যান্সার একটি খুব ভয়ংকর মরণব্যাধি। ব্রোকলি এই রোগ প্রতিরোধে আমাদের শরীরকে সহায়তা করে এবং ক্যান্সারের কোষ বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে। এর বিটা ক্যারোটিন ও সেলিনিয়াম বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার যেমন, ফুসফুস, যকৃত, প্রোস্টেট, কোলন ও প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সারের আক্রমন থেকে রক্ষা করে ও এর বিপরীতে লড়াই করে।
অ্যালার্জি প্রতিরোধ করে : এই সবজির আরেকটি উপকারী উপাদান ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড যা প্রদাহ বিরোধী হিসাবে কাজ করে এবং ক্যাম্ফেরল প্রায় সকল ধরনের অ্যালার্জেটিক উপাদান হ্রাস করে।
\ সংকলিত \