উপক্রমণিকা :
ইসলাম একটি শাশ্বত ও সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থা। জীবনের প্রতিটি স্তরে রয়েছে এর কল্যাণমুখী দিকনির্দেশনা। বিশ্বজাহানের মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাববুল আলামীনের বিধানাবলী জানা এবং তদনুযায়ী আমল করার অন্যতম মাধ্যম হ’ল শিক্ষা। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি উন্নত ও সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনের চাবিকাঠি হ’ল শিক্ষা। তাই আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে সর্বপ্রথম যে বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন সেটা হ’ল- اِقْرَأْ ‘পড়’ তথা শিক্ষার্জন কর। একই সাথে কোন ধরনের শিক্ষার্জন করতে হবে সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেন,اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَق-خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ، اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ، الَّذِيْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِ، عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ ‘পড়, তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাটবাধা রক্ত দিয়ে। পড়, আর তোমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত। যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলমের মাধ্যমে। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন এমন বিষয়ে যা সে জানত না’ (আলাক্ব ১-৫)। শিক্ষার মাধ্যমেই অর্জিত হয় জ্ঞান। এর মাধ্যমে মানুষের ইয্যত-সম্মান বৃদ্ধি পায়, সমাজে তার মর্যাদার স্তর নির্ণীত হয়। আল্লাহ তা‘আলা শিক্ষার্জনের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও জ্ঞানীর মর্যাদা সম্পর্কে বলেন, قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِيْنَ يَعْلَمُوْنَ وَالَّذِيْنَ لاَ يَعْلَمُوْنَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُوْلُو الْأَلْبَابِ ‘বল, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান? কেবলমাত্র জ্ঞানীরাই উপদেশ গ্রহণ করে থাকে’ (যুমার ৩৯/৯)। অন্যদিকে অজ্ঞতাকে অন্ধকারের সাথে তুলনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الْأَعْمَى وَالْبَصِيْرُ أَمْ هَلْ تَسْتَوِي الظُّلُمَاتُ وَالنُّوْرُ ‘বল, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান অথবা অন্ধকার ও আলো কি সমান?’ (রা‘দ ১৩/১৬)। হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্যকারী আলোকবর্তিকা সদৃশ ইলম অর্জন করা পুরুষ-নারী সকলের জন্য ফরয। রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয’।[1] উপরোক্ত আয়াত ও হাদীছ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শিক্ষার্জনকে ইসলাম সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করেছে। কেননা শিক্ষার মাধ্যমে ইসলামের যাবতীয় বিধানাবলী তথা হালাল-হারাম, জায়েয-নাজায়েয, আদেশ-নিষেধ, ন্যায়-অন্যায়, সুবিচার-অবিচার, কল্যাণ-অকল্যাণ, ভাল-মন্দ, সুনীতি-দুর্নীতি ইত্যাদি সম্পর্কে জানা এবং মানা যায়।
মানুষ আশরাফুল মাখলূকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীব। আর এই শ্রেষ্ঠত্বের মূলে রয়েছে জ্ঞান তথা শিক্ষা। পক্ষান্তরে সৃষ্টির সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও অভিশপ্ত জীব হ’ল ইবলীস শয়তান। তার মূলেও ছিল জ্ঞান। আদি মানব আদম (আঃ)-কে সৃষ্টির পর আদম (আঃ) ও ফেরেশতাদের মাঝে আল্লাহ তা‘আলা জ্ঞানের পরীক্ষা নিয়েছিলেন। এ পরীক্ষায় আদম (আঃ) কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এবং আদম (আঃ)-এর চেয়ে হাযার হাযার বছর পূর্বে সৃষ্টি হওয়া ফেরেশতাগণ অকৃতকার্য হয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাগণকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদম (আঃ)-কে সিজদা করার জন্য। ফেরেশতাগণ তাদের অকৃতকার্যতা মেনে নিয়ে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী আদম (আঃ)-কে সিজদা করেছিলেন শুধু ইবলীস ব্যতীত (বাক্বারাহ ২/৩১-৩৪)। বরং ইবলীস উল্টো যুক্তি প্রদর্শন করেছিল এই বলে যে,أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ خَلَقْتَنِيْ مِن نَّارٍ وَّخَلَقْتَهُ مِنْ طِيْنٍ ‘আমি তার চেয়ে উত্তম। আমাকে তুমি সৃষ্টি করেছ আগুন থেকে আর তাকে সৃষ্টি করেছ মাটি থেকে’ (আ‘রাফ ১২)। আগুনের বৈশিষ্ট্য হ’ল ঊর্ধ্বগামী হওয়া আর মাটির বৈশিষ্ট্য হ’ল নিম্নগামী হওয়া। সুতরাং আমি আদমকে সিজদা করব কেন? বরং আদমেরই উচিত আমাকে সিজদা করা। বাহ্যিক দৃষ্টিতে ইবলীসের যুক্তি সঠিকই মনে হয়। কিন্তু ইবলীসের জ্ঞানের পরিচয় যেখানে দেয়া প্রয়োজন ছিল, সেখানে দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করার ফলে সে চির অভিশপ্ত এবং সৃষ্টির সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়েছে। উপরোক্ত আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, শিক্ষা দু’ধরনের যথা- ১. সুশিক্ষা, যে শিক্ষা ছিল আদমের। ২. কুশিক্ষা, যে শিক্ষা ছিল ইবলীসের। পৃথিবীতে আজও দু’ধরনের শিক্ষাই রয়েছে। এর মধ্যে দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর, নৈতিকতা সম্পন্ন সুশিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে দেশের পরবর্তী নাগরিকদের গড়ে তুলতে হবে। আর সে আলোকেই আমাদের শিক্ষানীতি প্রণীত হওয়া যরূরী।
জাতীয় শিক্ষানীতি :
জাতীয় শিক্ষানীতি একটি দেশের ধর্মীয় মূল্যবোধে উজ্জীবিত নৈতিকতা সম্পন্ন সুনাগরিক তৈরির দিক-নির্দেশনা। বিধায় এটা জাতির জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি শিক্ষানীতির সঙ্গে জাতির উন্নতি-অবনতি, কল্যাণ-অকল্যাণ, উত্থান-পতন তথা জাতির ভাগ্য ও ভবিষ্যত জড়িত। তাই দেশের মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আক্বীদা-বিশ্বাস, কৃষ্টি-সভ্যতা ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পন্ন যুগোপযোগী আধুনিক ও বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা উচিত। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সাত বার জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে। কিন্তু কোন শিক্ষানীতিতে দেশের মানুষের চাহিদার প্রতিফলন ঘটেনি। শিক্ষানীতিগুলোতে সুশিক্ষার চেয়ে কুশিক্ষার প্রভাব বেশী ছিল। বিধায় যতই শিক্ষিতের হার বাড়ছে ততই দেশ ও জাতি দুর্নীতি, অবক্ষয় ও অবনতির দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ সহ বিশ্বব্যাপী অপরাধকর্মের তালিকা প্রণয়নে দেখা যাবে যে, সাধারণ থেকে ভয়াবহ অপরাধ কর্মের সাথে শিক্ষিত লোকেরাই বেশী জড়িত। সূদ-ঘুষ, যৌন কেলেংকারী, মাদক ব্যবসা, নারী ও শিশু পাচার, পণ্যে ভেজাল মিশ্রণ ও পরিমাপে কারসাজি, বৈদেশিক ও কষ্টার্জিত অর্থে বিদেশ থেকে আনা সার, তেল ইত্যাদি প্রতিবেশী দেশে পাচার, নিম্নমানের পণ্য আমদানী, ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ পানীয় উৎপাদন ও বিপণন, মওজুদদারী, চোরাচালানী, ফটকাবাজী, কালোবাজারী, মুনাফাখোরী চাঁদাবাজী, স্বজনপ্রীতি, জালিয়াতী, টেন্ডারবাজী, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, এম.এল.এম ব্যবসার নামে প্রতারণা ও ধোঁকাবাজী, শেয়ার বাজার কেলেংকারী, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, অবৈধ গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ, বিনা টিকেটে রেলভ্রমণ, দলীয় কারণে বা টাকার বিনিময়ে অযোগ্য লোককে নিয়োগদান, ফাইল আটকিয়ে চাঁদাবাজী, পর্ণোগ্রাফী, ব্লাকমেইল, অপহরণ, তথ্য ও মিডিয়া সন্ত্রাস, ট্যাক্স ও শুল্ক ফাঁকি, টাকার বিনিময়ে বা দলীয় কারণে রায় বিকৃতি, ভিসাকার্ড স্ক্যান্ডাল, পরীক্ষায় অসদুপায়, সিনেমা, সিডি, অডিও, ভিডিও-তে অশ্লীলতা-বেহায়াপনা ইত্যাদিতে যে দুর্নীতি ও অনৈতিকতা এর সিংহভাগই শিক্ষিত লোকদের দ্বারাই সংঘঠিত হয়ে আসছে। আর এসবই হচ্ছে ইসলামী নৈতিকতা বহির্ভূত শিক্ষার কারণে। নিরক্ষরতা যেমন মন্দ ও নিন্দনীয়, তেমনি নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থাও অনুরূপভাবে মন্দ ও নিন্দনীয়। কারণ কুশিক্ষা নিরক্ষরতার মতই মূর্খতার জন্ম দেয়। ফলশ্রুতিতে প্রায় ৬০% শিক্ষিত লোকের এ দেশে উন্নতি-সমৃদ্ধির পরিবর্তে দিন দিন অবক্ষয় ও অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। ২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত পরপর পাঁচবার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বাংলাদেশ শীর্ষস্থান দখল করেছে। অতি সম্প্রতি পদ্মা সেতু দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক কৃত ঋণচুক্তি বাতিল করেছে। এসবের একমাত্র কারণ ধর্মীয় মূল্যবোধ বিবর্জিত নৈতিকতাহীন শিক্ষা ব্যবস্থা। পরকালীন জবাবদিহিতার ভয় ও ঈমানী চেতনাই কেবল মানুষকে দুর্নীতি মুক্ত রাখতে পারে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার বাণী,هَذَا كِتَابُنَا يَنْطِقُ عَلَيْكُمْ بِالْحَقِّ إِنَّا كُنَّا نَسْتَنْسِخُ مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ ‘এটা আমার কিতাব (রেকর্ড) যা তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে সত্যতা সহকারে। তোমরা যা করতে তা আমি লিপিবদ্ধ করতাম’ (জাছিয়া ২৯)।
বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন :
স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত দেশে সাতটি শিক্ষা কমিশন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। কিন্তু কোন শিক্ষানীতি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। যতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক দিকগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে, আর ইতিবাচক দিকগুলো অবগুণ্ঠিত থেকে গেছে। স্বাধীনতার পরে গঠিত শিক্ষা কমিশন সাতটি হচ্ছে-
১। ড. কুদরত-এ খুদা শিক্ষা কমিটি : ১৯৭২-৭৪
২। কাজী জাফর আহমেদ শিক্ষা প্রণয়ন কমিটি : ১৯৭৮
৩। ড. মজিদ খান শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি : ১৯৮৩
৪। ড. মফিজ উদ্দিন শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি : ১৯৮৭
৫। ড. শামসুল হক শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি : ১৯৯৬
৬। অধ্যাপক মনিরুযযামান মিঞা শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি : ২০০৩
৭। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি : ২০১০
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ :
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে গঠিত হয়ে ১৯৭৪ সালে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে ড. কুদরত-এ খুদা শিক্ষা কমিশন। যেটি ধর্মীয় ভাবধারার সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত, ধিকৃত ও নিন্দনীয় হয়। ১৯৯৬ সালে একুশ বছর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে পুনরায় শিক্ষানীতি প্রণয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ১৯৯৭ সালে রিপোর্ট প্রস্ত্তত হয়। উক্ত প্রতিবেদনের আলোকে শিক্ষানীতি-২০০০ প্রণীত হয়। কিন্তু ক্ষমতার পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এ শিক্ষানীতিও আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও ড. কাজী খলীকুজজামান আহমদকে কো-চেয়ারম্যান করে ১৮ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। এ কমিটি ড. কুদরত-এ খুদা ও ড. শামসুল হক শিক্ষা কমিশনের আলোকে শিক্ষানীতির চূড়ান্ত খসড়া-২০০৯ ওয়েব সাইটে প্রদান করে। যাতে ২৯টি অধ্যায়, ৭টি সংযোজনী এবং ২টি সারণী ছিল। এ শিক্ষানীতির বিষয়ে জনগণের মতামত চাওয়া হয়। বিভিন্ন মহল সে বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা, সমালোচনা করে তাদের সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেন। কিন্তু জনগণের সেসব মতামত গ্রহণ বা বর্জনের কোন সংখ্যাভিত্তিক তথ্য বা ব্যাখ্যা না দিয়ে এর কিছু শব্দ ও টার্ম পরিবর্তন করে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ চূড়ান্ত করা হয় এবং ৩ অক্টোবর ২০১০ জাতীয় সংসদে পাশ হয়।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত প্রাক- কথন এবং মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী প্রদত্ত মুখবন্ধ সহ এতে মোট ২৮টি অধ্যায় এবং ২টি সংযোজনী রয়েছে। অর্থাৎ খসড়া শিক্ষানীতি থেকে ১টি অধ্যায় এবং ৫টি সংযোজনী ও ২টি সারণী বাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর কোন কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি। এতে প্রতীয়মান হয় যে, সংযোজনী ২ ও ৩ বাদ দেয়া হয়েছে জাতিকে শিক্ষার বিষয়বস্ত্ত ও ধরন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখার কৌশল হিসাবে। কারণ এ দু’টি সংযোজনীর একটিতে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠ্য বিষয় তালিকা ও নম্বর বণ্টন দেখানো হয়েছিল। কিন্তু ২০১০ এর শিক্ষানীতিতে বুদ্ধিবৃত্তিক এমন কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়েছে, যাতে পাঠ্যক্রমে কী কী বিষয় আছে তা জানার কোন উপায় থাকছে না। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ মুখবন্ধে বলেছেন, ‘শিক্ষানীতি কোন অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়, এর পরিবর্তন ও উন্নয়নের পথ সব সময়ে উন্মুক্ত থাকবে। কোন ভুল-ত্রুটি হলে তা সংশোধন করা যাবে’। মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রীর এ আশ্বাস বাণীতে আশ্বস্ত হয়ে শিক্ষানীতি ২০১০-এর প্রাককথন থেকে শুরু করে মুখবন্ধসহ কতিপয় অধ্যায়ের কতিপয় বিষয়ের গঠনমূলক সমালোচনা, পর্যালোচনা ও প্রস্তাবনা পেশ করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ। যাতে পরবর্তীতে এ শিক্ষানীতিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন ও সংকোচনের মাধ্যমে একটি ধর্মীয় মূল্যবোধ ভিত্তিক বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষানীতির মাধ্যমে জাতিকে সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করা যায়।
প্রাক-কথন
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রদত্ত প্রাক-কথনের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলেছেন, ‘আওয়ামীলীগ আগামী প্রজন্মকে নৈতিক মূল্যবোধ, জাতীয় ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়নের প্রস্ত্ততি পূর্বেই গ্রহণ করেছিল’।
আমরা জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান এবং তিনি নিজেও ধার্মিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ। জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে তাঁর মাথায় হিজাব এবং হাতে তাসবীহ এ কথারই সাক্ষ্য বহন করে। সুতরাং জাতি আশা করেছিল তিনি তাঁর বাণীতে আগামী প্রজন্মকে ধর্মীয় মূল্যবোধে উজ্জীবিত, নৈতিকতা সম্পন্ন, জাতীয় ঐতিহ্যে উদ্বুদ্ধ করে জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ মানব সম্পদ হিসাবে গড়ে তোলার আশাবাদ ব্যক্ত করবেন। কারণ ধর্মীয় মূল্যবোধ ব্যতীত নৈতিক মূল্যবোধ আশা করা বাতুলতা মাত্র। তেতুল গাছ লাগিয়ে সুমিষ্ট আঙ্গুর ফল প্রত্যাশা যেমন অর্থহীন ও অবাস্তব, তদ্রূপ ধর্মীয় মূল্যবোধ ব্যতীত নৈতিক মূল্যবোধ আশা করাও অবান্তর ও অনর্থক। কেবল আল্লাহভীতি, তাওহীদ-রিসালাতে বিশ্বাস ও পরকালীন জবাবদিহিতার ভয়ই কাউকে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানাই এজন্য যে, শেষ প্যারায় তিনি বলেছেন, ‘এই শিক্ষানীতির উল্লেখযোগ্য দিক হল এখানে ধর্ম, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে’। কিন্তু দুঃখজনক হ’লেও সত্য ও বাস্তব যে, জাতীয় শিক্ষানীতির অধ্যায়, অনুচ্ছেদ, পরিচ্ছেদ, কর্মকৌশল, পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচীর কোথাও তাঁর এ মূল্যবান বাণীর পুরো প্রতিফলন ঘটেনি। জাতীয় শিক্ষানীতিতে শেষোক্ত দু’টি বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করলেও সুকৌশলে ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার কর্মকৌশলে যথার্থভাবে ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থা নেই।
মুখবন্ধ
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মুখবন্ধে বলেছেন, ‘এটা কোন দলীয় শিক্ষানীতি নয়, জনগণ তথা জাতির আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটিয়ে তৈরী করা হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি’। এ বিষয়ে মাননীয় মন্ত্রীর সাথে একমত পোষণ করতে পারছি না বলে দুঃখিত। কেননা সূক্ষ্মদৃষ্টিতে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এটা একটি দলীয় শিক্ষানীতিরই প্রতিচ্ছবি। এ শিক্ষানীতি আদৌ জাতির আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন নয়। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত একটি স্বাধীন দেশের যে জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে ধর্মীয় শিক্ষা আবশ্যিক হিসাবে থাকবে না, সেটা জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয় কিভাবে? পঞ্চম প্যারার শেষাংশে লিখা রয়েছে, ‘সবরকম বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সকলের জন্য শিক্ষার অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্য শিক্ষানীতির মৌলিক ভিত্তি হিসেবে অনুসরণ করা হয়েছে’।
মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের এ বক্তব্য প্রশংসার দাবী রাখে। কিন্তু এ বক্তব্যের বাস্তব প্রতিফলন কতটুকু তা বিবেচ্য বিষয়। আসলেই কি এ শিক্ষানীতিতে মাদরাসা শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার মাঝের এবং সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিদ্যমান আকাশ-পাতাল বৈষম্যের অবসান ঘটানো হয়েছে। দেশে সরকারী ও রেজিস্ট্রার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৫৭,৭৩৩টি (বর্তমানে সব সরকারী) অথচ সরকারী ও রেজিস্ট্রার্ড ইবতেদায়ী মাদরাসা একটিও নেই। সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ১৪,৭৮১টি। অথচ সরকারী দাখিল মাদরাসা একটিও নেই। সরকারী কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ আছে ১০,৯১৬টি। অথচ সরকারী কামিল মাদরাসা আছে মাত্র ৩টি। সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৩৪টি। অথচ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আছে মাত্র ১টি। তাও আবার নামকাওয়াস্তে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। কেননা প্রতিষ্ঠালগ্নে প্রতিটি অনুষদের প্রতিটি গ্রুপে ২০০ নম্বর ইসলামী শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু বর্তমানে খোল-নলচে পাল্টে তা বিলুপ্ত করা হয়েছে। একই দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও, একই বাপের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও একজন সাধারণ শিক্ষার্থী সরকারী প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করার সুযোগ পাচ্ছে। অথচ অন্যজন মাদরাসায় লেখাপড়া করার কারণে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক মাসিক বেতন পাচ্ছে ৯০০০-১৬০০০/- টাকা। অথচ হাতে গোনা কয়েকটি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষক পাচ্ছে মাত্র ৫০০/-। তাও আবার অধিকাংশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষকরা সরকারী এক টাকাও পায় না। সরকারী স্কুল-কলেজের ৮ম শ্রেণী পাশ একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী যে বেতন-বোনাস পাচ্ছে স্নাতক-স্নাতকোত্তর পাশ করা একজন বেসরকারী স্কুল বা দাখিল স্তরে কোন কোন সহকারী শিক্ষক সে পরিমাণ বেতন-বোনাস পাচ্ছে না। সাধারণ শিক্ষার স্নাতক-স্নাতকোত্তর পাশ করে বি.সি.এস, এম.ফিল, পিএইচ.ডি করতে পারছে অথচ সমমান হওয়া সত্ত্বেও মাদরাসা থেকে ফাযিল কামিল পাশ করে বি.সি.এস, এম.ফিল, পিএইচ.ডি ইত্যাদি করতে সুযোগ পাচ্ছে না। এভাবে প্রতিটি স্তরে রয়েছে সীমাহীন বৈষম্য। এ শিক্ষানীতিতে এ বৈষম্যগুলো দূরীকরণে কোন প্রস্তাব বা দিক নির্দেশনা নেই। তাহ’লে এটা বৈষম্যহীন শিক্ষানীতি হ’ল কিভাবে তা আমাদের বোধগম্য নয়। মুখবন্ধের ৭ম প্যরায় বলা হয়েছে, ‘মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মানসম্মত শিক্ষা ও দক্ষ জনসম্পদ গড়ার প্রধান শক্তি মানসম্মত দক্ষ নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক’।
মানসম্মত দক্ষ নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক পেতে হ’লে তাঁদের বেতন-ভাতাদিও মানসম্মত ও যুগোপযোগী হওয়া উচিত নয় কি? শিক্ষকতার পেশা আজ সবচেয়ে অবহেলিত। একই ডিগ্রী অর্জন করে অন্য পেশায় যে বেতন-ভাতা পাওয়া যায়, বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণের ভাগ্যে তার অর্ধেকও জোটে না। যার কারণে মেধাবীগণ শিক্ষকতা পেশায় আসতে চায় না। আর কতিপয় মেধাবী যারা শিক্ষকতা পেশায় আসছে তারা অর্থ সংকটের কারণে ক্লাসের চেয়ে বাইরে প্রাইভেট পড়ানো ও কোচিং-এ পাঠদানকে বেশী প্রাধান্য দিতে বাধ্য হচ্ছে। শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক ন্যায্য বেতন-ভাতাদির ব্যবস্থা না করেই ইতিমধ্যে শিক্ষকের জন্য প্রাইভেট-টিউশনি ও কোচিং-এ পাঠদান নিষিদ্ধের যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, তাতে শিক্ষকতার পেশা আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
মুখবন্ধের নবম প্যারায় বলা হয়েছে, ‘মোটকথা সকলের জন্য মানসম্মত শিক্ষা, আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা, কম্পিউটার সহ আধুনিক প্রযুক্তি ও তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষালাভ এবং তা আয়ত্ত ও প্রয়োগ করা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা, গণিত, ইতিহাস, বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, পেশাগত দক্ষতা অর্জনের জন্য কারিগরি পেশাগত জ্ঞান ও শিক্ষা এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ অগ্রাধিকারের বিষয়’।
অবাক না হয়ে পারছি না এজন্য যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাণীতে ধর্ম, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বললেও অত্র প্যারায় অগ্রাধিকার প্রাপ্ত বিষয়ের তালিকায় ধর্মীয় কোন বিষয়ের নাম উল্লেখ নেই। তাহ’লে কি ধরে নেয়া যায় যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথার কোন মূল্যায়ন হয় না?
শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যাভভভখখভততদতকতকyুতৃকতদুৃকাতদ
জাতীয় শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা’। শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্যের উপরোক্ত শব্দমালা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এখানে যতগুলো শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে সবগুলো শুধু ইহকালীন কল্যাণের জন্য নিবেদিত। একটি শব্দও পরকালীন মুক্তির উদ্দেশ্য নিবেদিত নয়। একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশের শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্যের প্রথমে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে বাক্যাংশটুকু কাম্য ছিল।
৪নং পয়েন্টে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা বিকশিত করে প্রজন্ম পরম্পরায় সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা’। এখানে জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে ইসলামের ইতিহাসের কথাও উল্লেখ করা উচিত ছিল। ১৪নং পয়েন্টে বলা হয়েছে, ‘সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে সম মৌলিক চিন্তা-চেতনা গড়ে তোলা এবং জাতির জন্য সম নাগরিক ভিত্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে সব ধারায় শিক্ষার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যবই বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণ। একই উদ্দেশ্যে মাধ্যমিক স্তরেও একইভাবে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে পাঠদান’। সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে সম মৌলিক চিন্তা-চেতনা গড়ে তোলার নীতি যৌক্তিক ও বাস্তবানুগ নয়। কারণ মানুষের চিন্তা ও চেতনা তার ধর্মীয় বিশ্বাস, কর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এক্ষেত্রে বরং শিক্ষার্থীদের স্ব স্ব ধারার শিক্ষার ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে মৌলিক বিষয়ের সমমানের জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা করাই যুক্তিযুক্ত। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যবই বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণ করা যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত নয়। কেননা দেশের বিদ্যমান শিক্ষাধারা হচ্ছে সাধারণ শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ও বিশেষ শিক্ষা (ইংলিশ মিডিয়াম এবং কওমী মাদরাসা)। এসব শিক্ষার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এক ও অভিনণ নয়। এতে মাদরাসা শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার সাথে একীভূত করে মাদরাসা শিক্ষাকে বিলুপ্ত ও ধ্বংস করার অপকৌশল গ্রহণ করা হয়েছে।
২৩ নং পয়েন্টে বলা হয়েছে, ‘দেশের আদিবাসী সহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ ঘটানো’। এ দেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলো সাংবিধানিকভাবে উপজাতি হিসাবে স্বীকৃত। সুতরাং তাদেরকে আদিবাসী বলা অসাংবিধানিক। আর তারা যদি আদিবাসী হয় তাহ’লে বাকি ৯৫% নাগরিক কি অভিবাসী, পরগাছা?
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কৌশল ৪-এ বলা হয়েছে, ‘মসজিদ, মন্দির, গীর্জা ও প্যাগোডায় ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত সকল ধর্মের শিশুদেরকে ধর্মীয় জ্ঞান, অক্ষর জ্ঞান সহ আধুনিক শিক্ষা ও নৈতিকতা শিক্ষা প্রদানের কর্মসূচি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার অংশ হিসেবে গণ্য করা হবে’। এ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মূলত ধর্ম শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মাদরাসা ও স্কুলে ধর্ম না পড়িয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা প্রভৃতি উপাসনালয়ের মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রদানের কথা বলা হয়েছে। বস্ত্ততঃ এর মাধ্যমে ধর্ম শিক্ষাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। আমরা মনে করি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থা আবশ্যিক করার পাশাপাশি মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা প্রভৃতি উপাসনালয়ের মাধ্যমে অতিরিক্ত শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা রাখা উচিত। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সম্মানিত সদস্যদের প্রতি আমার সবিনয় জিজ্ঞাসা, আপনাদের সন্তানদেরকে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য মসজিদ, মন্দির, গীর্জা বা প্যাগোডায় পাঠাবেন কি?
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধর্মীয় শিক্ষার কোন ব্যবস্থা না থাকায় একজন শিশু তৃতীয় শ্রেণীতে উঠার পূর্ব পর্যন্ত তিন বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একবারের জন্যও আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর, গড প্রভৃতি শব্দগুলো শুনতে পাবে না। কারণ শিশু শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোন প্রকার ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা এতে রাখা হয়নি। পক্ষান্তরে এতে রাখা হয়েছে সহজ আকর্ষণীয় বিষয়ের নামে ছবি, রং, গল্প ও ছড়ার নামে শিশু মনে অশ্রাব্য মিথ্যা-বানোয়াট কল্প-কাহিনীর জন্ম দিয়ে তাদেরকে রূপকথার রূপকার হিসাবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যা ললিতকলারই নামান্তর। এ ধরনের উদ্ভট বানোয়াট কল্প-কাহিনী শিখিয়ে শিশুদেরকে ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে সরিয়ে রাখার পায়তারা করা হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা
প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বৃদ্ধি করে আট বছর তথা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে’। কিন্তু এতে কি ফায়দা হবে সে সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি এবং অপকারিতা ও সমস্যা সম্পর্কেও মনে হয় কোন চিন্তা-ভাবনা করা হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বৃদ্ধি করলে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত আরও তিনটি করে শ্রেণীকক্ষ বৃদ্ধি করতে হবে। অতিরিক্ত শিক্ষক ও আসবাবপত্র প্রয়োজন হবে। সে অতিরিক্ত শিক্ষক বিদ্যমান নিম্ন মাধ্যমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পূর্বে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক হবে, নাকি নতুনভাবে নিয়োগ দেয়া হবে? যদি নতুনভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়, তাহ’লে নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও দাখিল স্তরের তিন লক্ষাধিক শিক্ষকের চাকুরির কি অবস্থা হবে? একই সাথে প্রশ্ন থেকে যায়, বিদ্যমান নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও দাখিল স্তরের ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম শ্রেণী কি বিদ্যমান থাকবে, নাকি উক্ত দুই শ্রেণী বিলুপ্ত করা হবে? আর যদি নিমণ মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও দাখিল স্তরে চাকুরিরত শিক্ষকদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয় তাহ’লে তারা সরকারী শিক্ষক নাকি বেসরকারী শিক্ষক হিসাবে গণ্য হবে? (প্রকাশ থাকে যে, প্রাথমিক বিদ্যালয় ৯০ ভাগই সরকারী (বর্তমানে শতভাগ সরকারী)। অন্যদিকে নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮৭ ভাগই বেসরকারী)। এ ধরনের হাযারো প্রশ্নের কোন সমাধান না করেই অভূতপূর্ব ডিজিটাল পান্ডিত্য যাহির করা হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতিতে। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহে নিয়োগপ্রাপ্ত এসএসসি পাশ ৬০% মহিলা শিক্ষকদের (সমমান সণাতক পাশ পুরুষ শিক্ষক) পক্ষে কি সম্ভব অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করা?
প্রাথমিক শিক্ষার কৌশল পর্বের দ্বিতীয় প্যারায় বলা হয়েছে, ‘প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে’। অনুরূপভাবে ইবতেদায়ী মাদরাসাগুলোকে জাতীয়করণ করা হবে কি না ‘বৈষম্যহীন শিক্ষানীতি’ দাবীদার জাতীয় শিক্ষানীতিতে এ সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা নেই জেনে আমরা হতবাক। প্রাথমিক স্তরে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হ’লেও তা কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে সে সম্পর্কে কর্মকৌশলে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। বরং প্রাথমিক স্তরে বাধ্যতামূলক হিসাবে যে কয়টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে (বাংলা, ইংরেজি, নৈতিক শিক্ষা, বাংলাদেশ স্টাডিজ, গণিত, সামাজিক পরিবেশ, প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিচিতি, তথ্য প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান) তন্মধ্যে ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বলতে কোন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। মূলতঃ এখানে সূক্ষ্ম চাতুরতার আশ্রয় নিয়ে ধর্মভিত্তিক নৈতিক শিক্ষার বিষয়ে প্রহসন করা হয়েছে।
বিভিন্ন ধারার সমন্বয় অনুচ্ছেদের শেষ দু’লাইনে বলা হয়েছে, ‘সাধারণ, কিন্ডার গার্টেন, ইংরেজি মাধ্যম ও সব ধরনের মাদরাসাসহ সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নিয়মনীতি মেনে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন হতে হবে’। আমাদের পরামর্শ হ’ল এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের শুধু নিবন্ধনই নয় বরং সাথে সাথে নিয়ন্ত্রণও করতে হবে। কারণ কিন্ডার গার্টেন, ক্যাডেট মাদরাসা ও স্কুল এগুলো এক ধরনের গলাকাটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা শিশু শ্রেণীতেই একটা ছেলেমেয়েকে ‘মহাপন্ডিত’ বানিয়ে ফেলার স্বপ্ন দেখায়। ইংরেজী, বাংলা, আরবীর এক বোঝা বই সিলেবাসভুক্ত করে ছোট শিশুর মুখ দিয়ে কিছু ইংরেজী, আরবী মুখস্থ করিয়ে এবং পরীক্ষায় প্রাপ্যতার চেয়ে বেশী বেশী নম্বর দিয়ে বাবা-মাকে তাক লাগিয়ে দেয় ও তাদের পকেট থেকে মাসে মাসে হাযার হাযার টাকা খসিয়ে নেয়। অথচ ঐসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদরাসাগুলির ব্যর্থতা ও অপ্রতুলতার কারণে সুযোগসন্ধানী লোকেরা এভাবে সর্বত্র শিক্ষাবাণিজ্য শুরু করেছে। সুতরাং এসব প্রতিষ্ঠানের সরকারী নিয়ন্ত্রণ আশু প্রয়োজন।
[চলবে]
কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
হেড মুহাদ্দিছ, বেলটিয়া কামিল মাদরাসা, জামালপুর।
[1]. ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২১৮, সনদ হাসান।