ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধানের নাম, যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্ব মানবতার জন্য পথ নির্দেশিকা হিসাবে প্রদান করা হয়েছে। এটি নীরেট কোন জীবন ব্যবস্থার নাম নয়, বরং জীবনের সকল দিক ও বিভাগে গাম্ভীর্যপূর্ণ ও আনন্দঘন পরিবেশ উপহার দিতেও ইসলামের জুড়ি নেই। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের বন্ধন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। তাই প্রয়োজন সামাজিক রীতি-নীতি সম্পর্কে জানা। একে অপরকে কিভাবে অভিভাদন জানাতে হবে, সেটাও অবগত হওয়া। মানব জাতিকে ইসলাম এটা শিখিয়ে দিয়েছে, যার ভাষা আকর্ষণীয় এবং পদ্ধতিও চমৎকার। ইসলামের এই চমৎকার অভিবাদন পদ্ধতি অপরিচিত মানুষের সাথে সম্পর্ক জুড়ে দেয়। পরস্পরের মাঝে মনোমালিন্য দূর করে সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরী করতঃ শত্রুতার পরিবর্তে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে মানুষ একে অপরের নিকট ভালবাসার সৌরভ খুঁজে পায়। অনুভব করে সুসম্পর্কের কোমল পরশ। যে বাতাসে শত্রুতার গন্ধ নেই, আছে বন্ধুত্বের আবেহায়াত। যাতে হিংসার লেশ মাত্র নেই, আছে পরোপকারের ভিত। ক্ষতির আশংকা নেই, আছে সমূহ কল্যাণ। অহংকারের ভাব নেই, আছে বিনয়ের সমারোহ। মনে কষ্ট দেওয়ার কথা নেই, আছে মন জুড়ানোর বাণী। নিঃসন্দেহে সেই অভিবাদনটা হচ্ছে السلام عليكم (আস-সালা-মু আলাইকুম)। অর্থাৎ আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। সমাজের সকল ক্ষেত্রে সালামের গুরুত্ব কতখানি তা নিম্নে আলোকপাত করা হ’ল।

সালামের সংজ্ঞা :

سَلاَمٌ (সালামুন) শব্দটি فَعَالٌ-এর ওযনে বাবে تفغيل-এর مصدر (ক্রিয়ামূল)। এর আভিধানিক অর্থ শান্তি ও নিরাপত্তা। তাই اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمْ (আস-সালা-মু আলাইকুম) অর্থ হ’ল আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।

পরিভাষায় একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের সময় যে বাক্য দ্বারা একে অপরের সাথে ভালবাসা-বন্ধুত্ব, শান্তি-নিরাপত্তা, কল্যাণ ও দো‘আ কামনা করে তারই নাম সালাম।

সালাম প্রচলনের ইতিকথা :

মানব সভ্যতার শুরু থেকেই একে অপরের সাথে দেখা- সাক্ষাতের সময় পরস্পর ভাব বিনিময়ের বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন জাতি নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতি, আদর্শ ও রুচি অনুযায়ী বিভিন্ন শব্দ ও বাক্য বেছে নিয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় পরস্পরের দেখা-সাক্ষাতে আদাব, নমস্কার, নমঃনমঃ ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে। ইউরোপ ও আমেরিকার খৃষ্টান সম্প্রদায় Good Morning, Good Afternoon, Good Evening, Good Night বলে একে অপরকে সম্ভাষণ জানিয়ে থাকে। তেমনি Good Bye, Ta Ta বলে বিদায় জানাতে দেখা যায়।

প্রাক ইসলামী যুগে আরব সমাজে اَنْعَمَ اللهُ بِكَ عَيْنًا (আন‘আমাল্লাহু বিকা আইনান) অর্থাৎ আপনার দ্বারা আল্লাহ আপনার প্রিয়জনদের চক্ষু শীতল করুন এবং اَنْعِمْ صَبَاحًا (আনয়ামা ছবাহান) অর্থাৎ আপনার প্রত্যুষ সুন্দর-সমৃদ্ধ হোক বা শুপ্রভাত ইত্যাদি শব্দের প্রচলন ছিল।

ইসলামের আবির্ভাবের পর বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) প্রাক ইসলামী যুগে ব্যবহৃত শব্দগুলো পরিহার করে পরস্পরকে اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمْ (আস-সালা-মু আলাইকুম) বলে অভিবাদন জানাতে নির্দেশ দেন।[1]

সালাম আল্লাহ কর্তৃক প্রবর্তিত একটি বিধান :

সালামের এই বিধান মহান আল্লাহ স্বয়ং প্রবর্তন করেছেন। এ মর্মে নিম্নোক্ত হাদীছটি প্রনিধন যোগ্য।

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىُ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَلَقَ اللهُ آدَمَ عَلَى صُوْرَتِهِ طُوْلُهُ سِتُّوْنَ ذِرَاعًا فَلَمَّا خَلَقَهُ قَالَ اِذْهَبْ فََسَلِّْمْ عَلَى أُوْلَئِكَ النَّفِرَ وَهُمْ نَفَرٌ مِنَ الْمَلاَئِكَةِ جُلُوْسٌ، فَاُسْتَمِعْ مَا يُحَيُّوُْنَكَ فَإِنَّهَا تَحِيَّتُكَ وَتَحِيَّةُ ذُرِّيَتِكَ، فَذَهَبَ فَقَالَ اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمْ، فَقَالُوْا السَّلاَمُ عَلَيْكَ وَرَحْمَةُ اللهِ، قَالَ فَزَادُوْهُ وَرَحْمَةُ اللهِ،

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে তার আকৃতিতেই সৃষ্টি করেছেন। তার উচ্চতা ছিল ষাট হাত। আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করে বললেন, যাও অবস্থানরত ফেরেশতাদের ঐ দলকে সালাম কর। আর মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর, তোমার দেওয়া সালামের জবাবে তারা কী বলে। কেননা এটিই হবে তোমার ও তোমার সন্তানদের অভিবাদনের পদ্ধতি। অতঃপর আদম (আঃ) সেখানে গিয়ে اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمْ বললেন। জবাবে ফেরেশতাগণ বললেন, اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ وَرَحْمَةُ اللهِ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তারা وَرَحْمَةُ اللهِ অংশটি বৃদ্ধি করে বলেছেন’।[2]

সালামের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

সালাম নামক এই শান্তির বাণীটি সামাজিক জীবনে এক বিশাল স্থান দখল করে আছে। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে এমন এক আকর্ষণীয় চুম্বক শক্তি যা মনের সকল প্রকার দূরত্ব, মনের কালিমা ও অনৈক্য দূর করে সবাইকে কাছে এনে ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে দেয়।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশ :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, اَفْشُوْا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ ‘তোমরা সালামের ব্যাপক প্রচলন ঘটাও’।[3]

নবী করীম (ছাঃ) শুধু নির্দেশই দেননি বরং নিজেও বাস্তব জীবনে এর উপর আমল করে উম্মতের সামনে এক অনুস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি সবাইকে আগেই সালাম দিতেন। তিনি এমন একজন বিশ্বনেতা ছিলেন, যার কথা ও কর্মে ছিল অপূর্ব মিল। তাই আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার মানুষকে লক্ষ্য করে বলেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ ‘রাসূলুল্লাহ-এর জীবনাচরণেই রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ’ (আহযাব ২১)

সালাম অপর মুসলিম ভাইয়ের অধিকার :

এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের কতিপয় অধিকার রয়েছে। যেমন হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رسولُ اللهِ (صلى) حَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ سِتٌّ، قِيْلَ وَمَا هُنَّ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قاَلَ إِذَا لَقِيْتَهُ فَسَلِّمْ عَلَيْهِ وَإِذَا دَعَاكَ فَاَجِبْهُ، وَإِذَاِ اسْتَنْصَحَكَ فَاَنْصِحْ لَهُ، وإاِذَا عَطَسَ فَحَمِدَ اللهَ فَشَمِّتْه،ُ وَإِذَا مَرِضَ فعُدْْهُ وإِذَا مَاتَ فَاتْبَعْهُ-

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘এক মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের ছয়টি অধিকার তথা কর্তব্য রয়েছে। জিজ্ঞেস করা হ’ল, হে রাসূল (ছাঃ)! সেগুলো কী কী? তিনি বললেন, (১) যখন তুমি তার সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন তাকে সালাম দিবে। (২) সে যখন তোমাকে দাওয়াত দিবে তখন তুমি তার দাওয়াত কবুল করবে। (৩) সে যখন তোমার কাছে পরামর্শ বা উপদেশ চাইবে, তুমি তাকে সৎপরামর্শ দিবে। (৪) সে হাঁচি দিয়ে যখন ‘আল-হামদুল্লিাহ’ বলবে তুমি তার হাঁচির জবাব দিবে। (৫) সে যখন অসুস্থ হবে তখন তাকে দেখতে যাবে। (৬) সে যখন মারা যাবে তখন তুমি তার সঙ্গী হবে’ (জানাযা পড়বে ও দাফন করবে)।[4] সুতরাং বুঝা গেল সালাম অপর মুসলমান ভাইয়ের একটি অধিকার।

এছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা কারো সালামের জবাব উত্তমভাবে জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, 

وَإِذَا حُيِّيْتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوْا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوْهَا إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ حَسِيْبًا.

‘তোমরা যখন বিশেষ শব্দে সালাম প্রাপ্ত হবে তখন তোমাদের প্রতি প্রদত্ত সালামের চাইতে উন্নত ভাষায় সালাম দিবে। অথবা ঐ ভাষাতেই উত্তর দিবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা প্রতিটি বিষয়ের হিসাব সংরক্ষণকারী’ (নিসা ৮৬)

নিরাপদে জান্নাত লাভের উপায় :

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ سَلاَمٍ (رض) عَنِ النَّبِىِّ (صلى) أَنَّهُ قَالَ أَيُّهَا النَّاسُ اَفْشُوْا اَلسَّلاَمَ وَاْطعِمُوْا الطَّعُامَ وَصِلوُا الْأَرْحَامَ وَ صَلُّوْا بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ يَنَامُ تَدْخُلُوْا الْجَنَّةَ سَلاَمٌ-

আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম হ’তে বর্ণিত নবী করীম (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘হে মানবমন্ডলী! তোমরা সালামের ব্যাপক প্রচলন ঘটাও। ক্ষুধার্ত মানুষকে খাদ্য খাওয়াও। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা কর। তুমি রাতে ছালাত আদায় কর, মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তাহ’লে তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।

জান্নাতবাসীর প্রতি অভিবাদন :

হাশরের ময়দানে বিচার-ফায়ছালা হয়ে যাওয়ার পর ভাল কাজের জন্য একদল যাবে জান্নাতে আর মনদ কাজের জন্য একদল যাবে জাহান্নামে (সূরা হাক্কাহ)। যারা অফুরন্ত নে‘মত ভরা জান্নাতের অধিকারী হবে তাদেরকে ফেরেশতাগণ অভিবাদন জানিয়ে জান্নাতের দিকে নিতে নিতে বলবেন, سَلَمًا، سَلَمًا ‘তোমাদের প্রতি শান্তি-শান্তি’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَالمَلاَئِكَةُ يَدْخُلُوْنَ عَلَيْهِم مِّنْ كُلِّ بَابٍ، سَلاَمٌ عَلَيْكُم بِمَا صَبَرْتُمْ فَنِعْمَ عُقْبَى الدَّارِ- ‘অনন্তর ফিরিশতাগণ তাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রত্যেক দরজা দিয়ে আসবেন, আর বলবেন, سَلاَمٌ عَلَيْكُمْ (সালা-মুন আলাইকুম) আপনারা যে ধৈর্যধারণ করেছেন তার বিনিময়ে শান্তি পরকালের ঘর কতই না উত্তম’ (রা‘দ ২৩-২৪)

স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতবাসীদেরকে স্বাগত জানাবেন سَلاَمٌ قَوْلاً مِنْ رَّبٍّ رَّحِيْمٍ ‘মহান দয়ালু রবের পক্ষ থেকে সালাম বলা হবে’ (ইয়াসীন ৫৮)

অন্যত্র বলা হয়েছে, سَلاَمٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوْهَا خَاِلدِيْنَ. ‘তোমাদের প্রতি সালাম বা শান্তি। তোমরা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে থাক। অতঃপর তোমরা চিরস্থায়ী আবাস গ্রহণ করতঃ জান্নাতে প্রবেশ কর’ (যুমার ৭৩)

সালাম অহংকার দূর করে বিনয় সৃষ্টি করে :

অহংকার পতনের মূল। গর্ব-অহংকার যেমনি মানব জীবনকে মারাত্মক ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে তেমনি বিনয়, ভদ্রতা-নম্রতা মানুষকে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণে সাহায্য করে। অহংকারী দাম্ভিক ব্যক্তিকে যেমন কেউ পসন্দ করে না, তেমনি তাকে আল্লাহর ভালবাসেন না। আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرٍ. ‘যমীনে গর্বভরে চল না, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন অহংকারী দাম্ভিককে ভালবাসেন না’ (লোক্বমান ১৮)

অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَيَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِىْ قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِِّنْ كِبْرٍ. ‘যার অন্তরে বিন্দুমাত্র অহংকার থাকে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না’।[5] সুতরাং এ অহংকার নামক মারাত্মক ব্যাধি থেকে বাঁচতে চাইলে, আল্লাহর ভালবাসা পেতে হ’লে এবং জান্নাত লাভের বাসনা করলে সালামের ব্যাপক প্রচলন ঘটাতে হবে।

প্রথমে সালাম প্রদানকারী গর্ব-অহংকার থেকে যেমন মুক্ত থাকে তেমন বিনয়ীও হ’তে পারে। বিনয় আল্লাহর গযবে হ’তে রক্ষা করে তাঁর রহমতের অধিকারী বানায়। অহংকার ব্যক্তিকে কলুষিত করে আর বিনয় মানুষের জীবনকে পবিত্র করে। অহংকার শত্রুতা সৃষ্টি করে আর বিনয় শত্রুকেও পরম বন্ধুতে পরিণত করে। তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত অহংকার নামক মারাত্মক ব্যাধি থেকে বাঁচার জন্য সালামের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া।

সালাম কৃপণতা দূর করে :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لاَيَجْتَمِعُ الشُّحَّ وَالْاِيْمَانُ فِىْ قَلْبٍ عَبْدٍ أَبَدًا. ‘কৃপণতা ও ঈমান কোন বান্দার অন্তরে কখনো একত্রিত হ’তে পারে না’।[6]

মানব সভ্যতার প্রথম থেকেই দানশীল ব্যক্তিকে মানুষ ভালবাসে, সম্মান করে। অন্যদিকে বখীল লোককে সমাজের লোকেরা ঘৃণা করে, অশ্রদ্ধা করে।

জাবের (রাঃ) বলেন, একদা এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ) -এর খেদমতে হাযির হয়ে বললেন, আমার বাগানে অমুক ব্যক্তির একটি খেজুর গাছ আছে। ঐ গাছটি আমাকে কষ্ট দেয়। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেই লোকটিকে ডেকে এনে বললেন, তোমার খেজুর গাছটি আমার নিকট বিক্রি কর। সে বলল, না। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যদি তুমি তা বিক্রি না কর তাহ’লে আমাকে দান কর। সে বলল, না। এবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, বেহেশতের একটি খেজুর গাছের বিনিময়ে তা বিক্রি কর। সে বলল, না। অতঃপর নবী করীম (ছাঃ) বললেন, مَا رَأَيْتُ الَّذِىْ هُوَ أَبْخَلُ مِنْكَ إِلاَّ الَّذِىْ يَبْخَلُ بِالسَّلاَمِ. ‘আমি তোমার চেয়ে অধিক কৃপণ আর কাউকে দেখিনি। তবে হ্যাঁ, তোমার চেয়েও সেই ব্যক্তি বড় কৃপণ, যে সালাম দিতে কৃপণতা করে’।[7]

আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম ব্যক্তি :

আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম ব্যক্তি হ’তে হ‘লে সালাম দেওয়ার ব্যাপক প্রতিযোগিতা করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ أََوْلَى النَّاسِ بِاللهِ مَنْ بَدَأَ بِالسَّلاَمِ. ‘সেই ব্যক্তি আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম যে প্রথমে সালাম প্রদান করে’।[8]

সালাম ব্যক্তিকে সমাজে পরিচিত করে তোলে :

মানুষের সাথে পরিচয়ের সর্বোত্তম মাধ্যম হ’ল ‘সালাম’। বিনা কষ্টে, বিনা মূল্যে অত্যন্ত ফলদায়ক অভিবাদনটির নাম اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمْ (আস-সালা-মু আলাইকুম)। এটি কেবল একটি বাক্য নয়, বরং এক মহা চুম্বক শক্তির নাম। এর মাধ্যমে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করা যায়। সুতরাং আপনি যাদের কাছে দাওয়াত দিচ্ছেন, তাদেরকে ব্যাপক সালাম দিয়ে তাদের কাছে পরিচিত হেŠন। তাহ’লেই আপনার দাওয়াত তাদের কাছে গ্রহণীয় হবে, গোটা সমাজে সাড়া জাগাবে। আপনার সম্পর্ক বাড়বে ও দল ভারী হবে। কাফেলা এগিয়ে যাবে বিজয়ের লক্ষ্য পানে।

নবী করীম (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করা হ’ল উত্তম ইসলাম কোনটি? জবাবে তিনি বললেন, تُطْعِمُ الطَّعَامَ وْتَقْرَئُ السَّلاَمَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَّمْ تَعْرِفْ. ‘অন্যকে খাদ্য খাওয়ানো এবং পরিচিত অপরিচিত সকলকে সালাম দেওয়া’।[9]

সালাম সামাজিক সুসম্পর্ক গড়ার নিয়ামক :

সামাজিক শান্তি ও কল্যাণের জন্য প্রয়োজন ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলা। আর সালামের মাধ্যমেই ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসা সৃষ্টি হয়, শত্রুতা ও পরশ্রীকাতরতা দূর হয়। মহানবী (ছাঃ) বলেন,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قاَلَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ (صلى) لاَتَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوْا وَلاَتُؤْمِنُوْا حَتَّى تَحَابُّوْا أَوَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى شَيْئٍ إِذَا فَعَلْتُمُوْهُ تَحَابَبْتُمْ اَفْشُوْا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ-

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা ঈমান আনয়ন করবে। আর তোমরা ঈমানদার হিসাবে গণ্য হবে না যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদের এমন কথা বলে দিব না যা করলে তোমাদের পারস্পরিক ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে? (আর তাহ’ল) তোমরা পরস্পরের মাঝে সালামের প্রসার করবে’।[10]

সালাম সামাজিক জীবনে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা :

মা-বাবা, ভাই-বোনসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে গড়ে উঠে পরিবার। আর বহু পরিবার, হাট-বাজার, মসজিদ-মাদরাসা, স্কুল-কলেজ, রাস্তা-ঘাট ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠে সমাজ। মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ একে অপরের সহযোগিতা ছাড়া চলতে পারে না। ধনীর যেমন প্রয়োজন হয় গরীবের, গরীবেরও তেমন প্রয়োজন হয় ধনীর। প্রয়োজনের তাকীদে একে অপরের বাড়ি-ঘরে যেতে হয়। এ প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে অন্যের বাড়িতে প্রবেশ করার বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। তা হ’ল সালাম প্রদানের মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করা। অন্যথা বিনা বাক্য ব্যয়ে ফিরে আসবে। এতে করে সকলের সম্মান রক্ষা পাবে, মান-ইযযতের হিফাযত হবে এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لاَ تَدْخُلُوْا بُيُوْتًا غَيْرَ بُيُوْتِكُمْ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوْا وَتُسَلِّمُوْا عَلَى أَهْلِهَا ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ. ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের নিজেদের গৃহে ছাড়া অন্যের গৃহে প্রবেশ কর না, যতক্ষণ না গৃহবাসীর সম্মতি লাভ করবে এবং তাদেরকে সালাম দিবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম পদ্ধতি। যাতে তোমরা উপদেশ লাভ করতে পার’ (নূর ২৭)

বিনা অনুমতিতে ও বিনা সালামে অপরের বাড়িতে প্রবেশ করার কারণে মানুষের সম্ভ্রমের হানি ঘটে। সন্দেহ সৃষ্টি হয়। বাড়ীওয়ালা কি অবস্থায় আছে তা বুঝা যায় না। এতে তার ইযযত বিনষ্ট হওয়ার কারণে রুষ্ট হ’তে পারে। আর এভাবে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হয়।

পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষায় সালাম :

সম্পর্ক একবার তৈরি হয়ে গেলে যে আর নষ্ট হবে না, একথা বলা মুশকিল। শয়তান সবসময় পিছনে লেগে আছে পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট করার জন্য। কিন্তু প্রকৃত মুমিন কখনো শয়তানের চক্রান্ত সফল হ’তে দেয় না। যদি কখনো কোন কারণে সম্পর্কের মাঝে ফাটল ধরেও যায়, তাহ’লে মুমিন তা পূনর্গঠনে তৎপর হয়ে উঠবে, এটাই ঈমানের স্বাভাবিক দাবী। কারণ দু’জন মুসলমানের পক্ষে তিন দিনের বেশী সম্পর্ক বিচ্ছেদ করে রাখা ইসলামে জায়েয নয়। সম্পর্ক রক্ষা ও পুনর্গঠনে তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি প্রথমে সালাম দিবে তাকে উত্তম বলা হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ যদি সম্পর্ক পুনর্গঠনে পিছিয়ে যায় তার জন্য দুঃসংবাদ রয়েছে।

عَنْ أَبِىْ أيُّوْبَ الْأَنْصَارِىْ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ (صلى) لاَيَحِلُّ لِلرَّجُلِ أَنْ يَّهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلاَثِ لَيَالٍ يَلْتَقَيِانِ فَيَعْرِضُ هَذَا وَيَعْرِضُ هَذَا خَيْرُهُمَا الَّذِىْ يَبْدَأُ بِالسَّلاَمِ-

আবু আইয়ুব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘কোন ব্যক্তির জন্য হালাল নয় যে, তিন দিনের অধিক সে অপর কোন মুসলমান ভাইকে ত্যাগ করে। কোথাও পরস্পরে দেখা-সাক্ষাৎ হ’লে একজন একদিকে আরেকজন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর তাদের দু’জনের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে প্রথমে সালাম দিবে’।[11]

সালাম আদান-প্রদানের নিয়ম-পদ্ধতি :

ইসলামে সালাম আদান-প্রদানের কিছু নির্দিষ্ট বিধি-বিধান শরী‘আত নির্ধারণ করে দিয়েছে। নিম্নে দলীল ভিত্তিক তা পেশ করা হ’ল।-

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ (صلى) يُسَلِّمُ الصَّغِيْرُ عَلَى الْكَبِيْرِ وَالْمَارُّ عَلَى الْقَاعِدِ وُالْقَلِيْلُ عَلَى الْكَثِيْرِ-

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘কম বয়সী বয়োজ্যেষ্ঠকে, পথ অতিক্রমকারী উপবিষ্টকে এবং কম সংখ্যক অধিক সংখ্যককে সালাম দিবে’।[12]

وَعَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ (صلى) يُسَلَّمُ الرَّاكِبُ عَلَى الْمَاشِىْ وَالًمَاشِىْ عَلَى الْقَاعِدِ وَالْقَلِيْلُ عَلَى الْكَثِيْرِ.

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আরোহী ব্যক্তি পদব্রজে চলাচলকারীকে এবং পদব্রজে চলা ব্যক্তি উপবিষ্ট ব্যক্তিকে, আর কমসংখ্যক অধিক সংখ্যক লোককে সালাম দিবে’।[13]

ছোটরা সালাম করবে বড়দেরকে, এটাই আদব। কিন্তু শিক্ষা দেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছোটদের সালাম দিয়েছেন। যেমন হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَنَسٍ قَالَ أَنَّ رَسُوْلُ اللهِ (صلى) مَرَّ عَلَى غِلْمَانٍ فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ.

‘আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বালকদের নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় তাদেরকে সালাম দিলেন’।[14]

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ (صلى) لاَ تَبْدَؤُا الْيَهُوْدَ وَلاَ النَّصَارَى بِالسَّلاَمِ وَإِذَا لَقِيْتُمْ أَحَدَهُمْ فِىْ طَرِيْقٍ فَاضْطَرُّوْهُ إِلَى أَضْيَقِهِ.

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা ইহুদী-নাছারাদেরকে আগে সালাম দিবে না এবং রাস্তায় চলার পথে যখন তাদের কারো সাথে তোমাদের সাক্ষাৎ হয়, তখন তাদেরকে রাস্তার সংকীর্ণ পাশ দিয়ে হাঁটতে বাধ্য কর’।[15]

عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ (صلى) إِذَاسَلَّمَ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْكِتَابِ فَقُوْلُوْا وَعَلَيْكُمْ.

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন আহ‘লে কিতাব তোমাদেরকে সালাম দিবে, তখন তোমরা জবাবে শুধু وُعَلَيْكُمْ বলবে’।[16]

عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ مَرَّ بِمَجْلِسٍ فِيْهِ أَخْلاَطٌ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ وَالْمُشْرِكِيْنَ عَبْدَةِ الأَوْثَانِ وَالْيَهُوْدِ فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ.

উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক মজলিসের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন, যেখানে মুসলমান, মুশরিক তথা পৌত্তলিক ও ইহুদী সম্প্রদায়ের লোক ছিল। তিনি তাদেরকে সালাম দিলেন’।[17]

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ (صلى) قَالَ إِذَا لَقِىَ اَحْدُكُمْ اَخَاهُ فَلْيُسُلِّمْ عَلَيْهِ فَإِنْ حَالَتْ بَيْنَهُمَا شَجَرَةٌ أَوْ جِدَارٌ أَوْ حَجَرٌ ثم لَقِيَهُ فَلْيُسَلِّمْ عَلَيْهِ.

আবু হুরায়রা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কারো মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ হবে, তখন সে যেন তাকে সালাম দেয়। অতঃপর যদি তাদের উভয়ের মধ্যখানে কোন বৃক্ষ, প্রাচীর কিংবা পাথরের আড়াল পড়ে যায়, পরে পুনরায় যখন সাক্ষাৎ হয় তখনও যেন সালাম দেয়’।[18]

عَنْ قَتَادَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ (صلى) إِذَا دَخَلْتُمْ بَيْتًا فَسَلِّمُوْا عَلَى أَهْلِهِ وَإِذَا خَرَجْتُمْ فَأَوْدِعُوْا أَهْلَهُ بِسَلاَمٍ.

ক্বাতাদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন তোমরা কোন গৃহে প্রবেশ করবে তখন গৃহবাসীকে সালাম দিবে। আর যখন বের হবে তখনো গৃহবাসীকে সালাম করে বিদায় গ্রহণ করবে’।[19]

عَنْ غَالِبٍ قَالَ اِنَّا لَجُلُوْسٌ بِبَابِ الْحَسَنِ الْبَصَرِىْ وَإِذْ جَاءَ رَجُلٌ فَقَالَ حَدَّثَنِىْ أَبِىْ عَنْ جَدِّىْ قَالَ بَعَثَنِىْ أَبِىْ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ (صلى) فَقَالَ اِئْتِهِ فَأْقْرِئْهُ السَّلاَمَ، قَالَ فَأَتَيْتُهُ فَقُلْتُ أَبِىْ يُقْرِئُكَ السَّلاَمَ فَقَالَ عَلَيْكَ وَعَلَى أَبِيْكَ السَّلاَمَ.

গালিব (রহঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আমরা হাসান বছরী (রহঃ)-এর দরজায় বসে ছিলাম। হঠাৎ একজন লোক এসে বলল, আমার পিতা, আমার দাদা হ’তে বর্ণনা করেছেন তিনি বলেন, একদিন আমার পিতা আমাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে পাঠালেন, তাকে আমার সালাম জানাবে। আমার দাদা বলেন, আমি তাঁর কাছে এসে বললাম, আমার পিতা আপনাকে সালাম জানিয়েছেন। তিনি বললেন, তোমার উপর ও তোমার পিতার উপর আমার সালাম’।[20]

সালামের অপব্যবহার ও বিকৃত উচ্চারণ :

আল্লাহ তা‘আলা যে সালাম আদম (আঃ)-কে শিখিয়েছিলেন এবং আদম (আঃ) থেকে যে সালাম এখন পর্যন্ত চলছে এবং ক্বিয়ামতের আগ পর্যন্ত চলবে; আর আমাদেরকে নবী (ছাঃ) যে সালাম প্রতিষ্ঠা করে একে দো‘আ, সম্ভাষণ, সংস্কৃতি হিসাবে চালু করে দিয়েছেন, সে সালামের অপব্যবহার ও বিকৃত উচ্চারণ আজকের মুসলিম সমাজে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর কতিপয় নমুনা নিম্নে পেশ করা হ’ল।-

১। অফিসের বড় ছাহেব তার পিয়নকে বললেন, শহীদ ছাহেবকে আমার সালাম দাও। অর্থাৎ এ সালামের মানে হ’ল শহীদ ছাহেব যেন তার সাথে দেখা করে। এখানে সালামকে তারা অফিসিয়াল কোড ওয়ার্ড হিসাবে ব্যবহার করেন।

২। মুদি দোকানদার তার এক কর্মচারীকে দিয়ে মহ’ললার এক বাসার গৃহকর্তার কাছে সালাম পাঠায়। মুদি দোকানদার এ সালাম পাঠায় বাসার কর্তার কাছে পাওনা তাগাদার জন্য। এ সালাম পাওনা তাগাদার সালাম।

৩। এক ভদ্রলোক তার পড়শীকে নিজের ছেলে পাঠিয়ে সালাম জানালেন। তার মানে পড়শীর কাছে পূর্বে টাকা ধার চেয়েছিলেন। ছেলেকে দিয়ে সালাম পাঠিয়ে তা স্মরণ করিয়ে দিলেন। সালাম পেয়েই যেন ছেলের হাতে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেন।

৪। দু’জনের মধ্যে কোন এক ব্যাপারে প্রচন্ড বিতর্ক চলছে। বিতর্কের শেষ পর্যায়ে একজন অপরজনকে বললেন, খুব হয়েছে ভাই, এবার সালাম! সালাম দিয়ে বিতর্ক থেকে কেটে পড়া মানে তিনি আর তর্ক করতে রাযী নন।

৫। ঈদের দিন শিশুরা স্বজনদের বাসায় বাসায় গিয়ে, মুরুববীদের সালাম দেয় সালামীর জন্য। প্রকৃত পক্ষে তারা এ দিনে সালাম দিয়ে সালামী বা টাকা কুড়াতে আসে। মূল উদ্দেশ্য সালাম দিতে আসা নয়। একে বিনোদনী আদুরে ভিক্ষা বলা যায়।

৬। অফিসে এসে বড় ছাহেবকে সালাম দেওয়ার অভ্যাস আছে অনেকের। কোন না কোন অসীলায় তারা দেখা করবেনই এবং একটা সালাম দেবেনই। এখানে বড় ছাহেবকে সালাম দেওয়া মানে বড় ছাহেবের নযরে আসা, আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা।

আসলে সালামকে এসব উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য ইসলামী সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বরং এ সালামকে শুধুমাত্র আমাদের পারস্পরিক দো‘আ ও আশির্বাদ হিসাবে দান করা হয়েছে। সুতরাং সালামকে আসল উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করে অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা ইসলামী সংস্কৃতিকে ব্যঙ্গ করার শামিল।

শুধু সালামের অপব্যবহারই নয়, আজকে আমাদের মুসলিম সমাজে সালামের বিকৃত উচ্চারণ লক্ষ্য করা যায়। কলকাতার ‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধান সালামকে বিকৃত করে ফেলেছে। তারা সালামের শুদ্ধ বানান লিখেছে ‘সেলাম’। সালাম-এর ব্যাখ্যায় লিখেছে ‘সালাম’ হচ্ছে ‘সেলাম-এর রূপভেদ’। তাদের মতে ‘আস-সালা-মু আলাইকুম’-এর শুদ্ধ বানান হচ্ছে ‘সেলাম আলায়কুম’ যার অর্থ (লেখা হয়েছে) ‘নমস্কার’।

আজকের যুবকরা বিভিন্ন স্টাইলে সালাম প্রদান করে থাকে। যেমন- (১) সেলামালিকুম (২) শ্লামালিকুম (৩) আস্সালামালিকুম (৪) আস্লামালিকুম (৫) সালামালিকুম। সালামের এই বিকৃত রূপ এখন প্রকৃত হ’তে যাচ্ছে। আগামীতে এই ‘সালাম’ আরও কত বিকৃত হবে তা আল্লাহ মা‘লূম। এজন্য আমরাই দায়ী। বিকৃত আর অপব্যবহার যে আমরাই করছি তাতে কোন সন্দেহ নেই। আসুন! আমরা সালামের অপব্যবহার ও বিকৃত উচ্চারণ থেকে বিরত হই।

পরিশেষে সকলের নিকট এই নিবেদন করতে চাই, আসুন! নিজেকে অহংকার মুক্ত করতে, আল্লাহ তা‘আলার নিকটবর্তী হ’তে, জনপ্রিয়, জননন্দিত ও অধিক পরিচিত হ’তে, ইসলামের উত্তম কাজটি করতে, নিজেকে একজন আদর্শবান, সুন্দর ও অনুপম মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে, সালাম দেওয়াকে নিজের অভ্যাসে পরিণত করি। ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, বিজ্ঞ-মূর্খ, কুলি-মজুর, সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে সালাম দেওয়ার মত একটি মন তৈরী করি এবং নিজেকে সকলের প্রিয় মানুষে পরিণত করি। আমাদের সমাজকে একটি আদর্শ, সুন্দর নিরাপদ আবাসভূমিতে পরিণত করার জন্য, ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার সৌরভ দিয়ে সৌন্দর্যমন্ডিত একটি জনপদ তৈরি করতে আসুন! সালামের ব্যাপক প্রচলন করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন-আমীন!


মুহাম্মাদ মাইনুল ইসলাম

ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

[1]. আবুদাঊদ, মিশকাত ৪৪৪৯/২৭

[2]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৬২৮

[3]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪৪৩১

[4]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৫২৫

[5]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫১০৮

[6]. তিরমিযী, নাসাঈ, মিশকাত হা/৩৮২৮

[7]. আহমাদ, বাইহাক্বী, ছহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২৭১৬, হাদীছ হাসান

[8]. আহমাদ, তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪৬৪৬, হাদীছ ছহীহ

[9]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৬২৯

[10]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪৬৩১

[11]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫০২৭

[12]. বুখারী, মিশকাত হা/৪৬৩৩

[13]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৬৩২

[14]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৬৩৪

[15]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪৬৩৫

[16]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৬৩৭

[17]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৬৩৯

[18]. আবু দাঊদ, মিশকাত হা/৪৬৫০

[19]. বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৪৬৫১

[20]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪৬৫৫






বিষয়সমূহ: শিষ্টাচার
রাস্তার আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
নববী চিকিৎসা পদ্ধতি (৫ম কিস্তি) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
বিশ্ব ভালবাসা দিবস - আত-তাহরীক ডেস্ক
হজ্জের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মানবাধিকার ও ইসলাম - শামসুল আলম
পিতা-মাতার উপর সন্তানের অধিকার (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ শফীকুল আলম
বাজারের আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আহলেহাদীছগণের অগ্রণী ভূমিকা (গত সংখ্যার পর) - ড. নূরুল ইসলাম
আল্লাহর প্রতি ঈমানের স্বরূপ (পঞ্চম কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
ফৎওয়া : গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও বিকাশ (৪র্থ কিস্তি) - ড. শিহাবুদ্দীন আহমাদ, শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, রাজশাহী
সফল মাতা-পিতার জন্য যা করণীয় - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
ইবাদতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আরও
আরও
.